আমার ইতিহাসসংস্কৃতি

দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অতিশ

– শ্রী হরপ্রসাদ শাস্ত্রী

 

[দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান ‘অতিশ’  বাঙ্গালার একজন বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন। বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রে তিনি অসাধারণ পন্ডিত ছিলেন, তত্ত্বজ্ঞ ছিলেন, এবং সেই সঙ্গে তিনি একজন কৃতকর্মা ধর্মনেতাও ছিলেন। ১৩০৮ খ্রীষ্টাব্দে বৃদ্ধ বয়সে ভোট-দেশ বা তিব্বতে আহূত হইয়া সেই দেশে গিয়া বৌদ্ধধর্ম-সংঘকে সুনিয়ন্ত্রিত করিয়া দেন। তিব্বতীরা এখনও উঁহার স্মৃতির পূজা করে, উঁহাকে দেবতার সম্মান দেয়। উঁহার জীবন-কথার সহিত বাঙ্গালী-মাত্রেরই পরিচয় থাকা উচিত|]

বাঙ্গালা দেশের আর এক গৌরব – দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। তাঁহার নিবাস পূর্ব-বঙ্গে বিক্রমণীপুর । তিনি ভিক্ষু হইয়া বিক্রমশীল   বিহারে  আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখানে অল্প দিনের মধ্যেই তিনি প্রধান পন্ডিত বলিয়া গণ্য হন। সে সময়ে মঠের অধ্যক্ষ তাঁহাকে সুবর্ণ-দ্বীপে প্রেরণ করেন। তিনি সুবর্ণ-দ্বীপে বৌদ্ধ ধর্ম সংস্কার করিয়া প্রসিদ্ধ হন। তথা হইতে ফিরিয়া আসিলে, তিনি বিক্রমশীল বিহারের অধ্যক্ষ হন। তখন নালন্দার চেয়েও বিক্রমশীলের খ্যাতি-প্রতিপত্তি অত্যন্ত অধিক হইয়াছে। অনেক বড় বড় লোক, অনেক বড় বড় পন্ডিত, বিক্রমশীল হইতে লেখাপড়া শিখিয়া, শুধু ভারতবর্ষে নয়, তাহার বাহিরে-ও-গিয়া, বিদ্যা ও ধর্ম প্রচার করিয়াছিলেন। বিক্রমশীল বিহারের রত্নাকর শান্তি একজন খুব তীক্ষ্ণবুদ্ধি নৈয়ায়িক ছিলেন, প্রজ্ঞাকরমতি, জ্ঞানশ্রী ভিক্ষু প্রভৃতি বহু গ্রন্থকার ও  পন্ডিতের নাম বিক্রমশীলের মুখ উজ্জ্বল করিয়া রাখিয়াছিল। এইরূপ বিহারের অধ্যক্ষ হওয়া অনেক সৌভাগ্যের কথা। দীপঙ্কর অনেক সময়ে ব্রাহ্মণ পন্ডিত ও অন্য যানাবলম্বীদিগের সহিত ঘোরতর বিচারে প্রবৃত্ত হইতেন, ও তাহাতে জয়লাভ করিতেন।     

এই সময়ে তিব্বত দেশে বৌদ্ধ ধর্ম লোপ পাইয়া আসে ও বোন-পার দল খুব প্রবল হইয়া উঠে। তাহাতে ভয় পাইয়া তিব্বত দেশের রাজা, বিক্রমশীলা বিহার হইতে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানকে তিব্বতে লইয়া যাইবার জন্য দূত প্রেরণ করেন। দীপঙ্কর দুই একবার যাইতে অসম্মত হইলেও বিষয়ের গুরুত্ব বুঝিয়া পরিণামে তথায় যাইতে স্বীকার করেন। তিনি যাইতে স্বীকার করিলে, তিব্বতরাজ অনেক লোকজন দিয়া তাঁহাকে সমসম্মানে আপন দেশে লইয়াযান যান। যাইবার সময় তিনি অনেক দিন নেপালে স্বয়ম্ভূক্ষেত্রে বাস করেন। তথা হইতে বরফের পাহাড় পার হইয়া তিনি তিব্বতের সীমানায় উপস্থিত হন। যিনি তাঁহাকে আহ্বান করিয়া নিজ দেশে লইয়া গিয়াছিলেন, তাঁহার রাজধানী পশ্চিম তিব্বতে ছিল। যে সকল বিহারে তিনি বাস করিয়াছিলেন, সে সকল বিহার এখনও লোকে অতি পবিত্র বলিয়া মনে করে। ফ্রান্কে সাহেব যে আর্কিওলজিকাল রিপোর্ট বাহির করিয়াছেন, তাহাতে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অতিশের কর্মক্ষেত্র সকল বেশ ভাল করিয়া দেখাইয়া দিয়াছেন। অতিশ যখন তিব্বতে যান তখন তাঁহার বয়স হইয়াছিল ৭০ বৎসর। এইরূপ বৃদ্ধ বয়সেও তিনি তিব্বতে গিয়া অসাধারণ পরিশ্রম করিয়াছিলেন, এবং তখনকার অনেক লোককে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত করিয়াছিলেন। তাহার পরে তিব্বতে নানা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উদয় হইয়াছে।  তিব্বতে যে কখনও বৌদ্ধ ধর্ম লোপ পাইবে এরূপ আশঙ্কা আর নাই। তিনি তিব্বতে মহাজন মতেরই প্রচার করেন। তিনি বেশ বুঝিয়াছিলেন যে, তিব্বতীরা বিশুদ্ধ মহাযান ধর্মের অধিকারী নয়; কেন না, এখনও তাহারা দৈত্য-দানবের পূজা করিত; তাই তিনি বজ্র-যান ও কালচক্র-যানের গ্রন্থ তর্জমা করিয়াছিলেন, ও অনেক পূজা-পদ্ধতি ও স্তোত্রাদি লিখিয়াছিলেন; তাঞ্জুর কাটালগে প্রতি পাতেই দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান বা অতিশের নাম দেখিতে পাওয়া যায়। আজিও সহস্র সহস্র লোক তাঁহাকে দেবতা বলিয়া পূজা করে। অনেকে মনে করেন তিব্বতীয়দিগের যা কিছু বিদ্যা, সভ্যতা – এ সমুদায়ের মূল কারণ তিনিই। এরূপ লোককে যদি বাঙ্গালার গৌরব মনে না করি, তবে মনে করিব কাহাকে?

১) বিক্রমণীপুর – অধুনা ঢাকা জেলায় অবস্থিত ‘বিক্রমপুর’ – এর নামান্তর। পূর্ব বঙ্গের বিখ্যাত স্থান। রামপাল গ্রামে বিক্রমপুর নগরের ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান।

২) বিক্রমশীল বিহার – নামান্তর ‘বিক্রমশিলা’ বিহার। বিহার প্রদেশের অন্যতম বৌদ্ধ জ্ঞান-কেন্দ্র হিসাবে ইহার নাম। বিক্রমশিলা কোথায় অবস্থিত ছিল তাহা এখন ঠিকমত জানা যায় না – তবে রাজগির ও নালন্দার মধ্যে ‘শিলাও’ গ্রাম বিক্রমশিলার স্থান হইতে পারে।

৩) সুবর্ণ-দ্বীপ – সুমাত্রা দ্বীপ। খ্রীষ্টাব্দ প্রথম সহস্রকে ভারতের সহিত ‘দ্বীপময় ভারত’ অর্থাৎ সুবর্ণ দ্বীপ বা সুমাত্রা, যবদ্বীপ, বলিদ্বীপ প্রভৃতির বিশেষ সংযোগ ছিল। ঐ সব স্থান, এবং মালয় উপদ্বীপ,  শ্যাম, কম্বোজ ও চম্পা, তখন ধর্মে, সভ্যতায় ও জীবন-পদ্ধতিতে ভারতবর্ষের অংশ হইয়া গিয়াছিল। দ্বীপঙ্কর সুবর্ণদ্বীপে একজন বিখ্যাত মহাযান পন্ডিতের নিকট অধ্যয়ন করিতে গিয়াছিলেন।

৪)  বোন্-পা – ভোট বা তিব্বতীরা খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতকে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করিবার পূর্বে যে ধর্ম পালন করিত তাহার নাম ছিল ‘Bon’ ‘ বোন্’। নানাপ্রকার দৈত্য-দানব ভূত-প্রেত পূজা এবং মন্ত্রজপ প্রভৃতি উহার মুখ্য স্বরূপ ছিল। এই ধর্মের অনেক আচার অনুষ্ঠান তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মের সহিত মিশিয়ে গিয়াছে। ‘ বোন্’ ধর্ম যাহারা মানে তিব্বতী ভাষায় তাহাদের বলে ‘ বোন্-পা ‘। 

৫) ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ (Archaeological Department) নামক সরকারী কার্যবিভাগ হইতে জরমান মিশনারী পন্ডিত Franke (ফ্রাঙ্কে) পশ্চিম-তিব্বত ভ্রমণ করিয়া দীপঙ্করের যাত্রাপথ ধরিয়া একটী ‘রিপোর্ট’ বা বিবরণী প্রকাশ করিয়াছিলেন। সম্প্রতি Giuseppe Tucci (জুসেপ্পে তুচ্চি) নামে বিখ্যাত ইটালীয় পন্ডিত-ও অনুরূপ অনুসন্ধান প্রকাশিত করিয়াছেন।

৬) বজ্র-যান ও কালচক্র-যান – বাঙ্গালা দেশে ও নেপালে প্রচলিত মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের পরিণতি বা শেষ বিকাশ হয়, পূজা, মন্ত্র-জপ ও নানাপ্রকার অনুষ্ঠানমূলক এই দুই সম্প্রদায়ে। উত্তর-ভারত তুর্কীদের দ্বারা বিজিত হইবার কিছু পূর্বে বজ্র-যান ও কালচক্র-যান পূর্ব-ভারতের বৌদ্ধদের মধ্যে বিশেষ প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং বাঙ্গালা দেশ হইতে নেপাল হইয়া তিব্বতেও প্রসূত হয়।

৭) তিব্বতীরা সংস্কৃত, প্রাকৃত ইত্যাদি ভারতীয় ভাষা হইতে নিজেদের ভাষায় নিজেরা ও ভারতীয় পন্ডিতদের সাহায্যে যে সকল বৌদ্ধ শাস্ত্রের অনুবাদ করে, সেগুলিকে তাহাদের ভাষায় বলিত Bstan-hgyur (আধুনিক উচ্চারণে Tan-jur) এবং এই সব শাস্ত্রের যে টীকা তাহারা নিজ ভাষায় লাইক তাহার নাম দেয় Bkah ghyur (বা Kan-jur)। এই ‘তাঞ্জুর’ ও ‘কাঞ্জুর’ লইয়াই বিরাট তিব্বতী বৌদ্ধ সাহিত্য। ফরাসী পন্ডিত Cordier (কর্দিয়ে)  ‘তাঞ্জুর’-গ্রন্থাবলীর এক নির্ঘন্ট বা তালিকা (‘কাটালগ’) ফরাসী ভাষায় প্রকাশিত করেন।  শাস্ত্রী মহাশয় এই তালিকার কথা বলিতেছেন।

 

(লেখক পরিচিতি – সুবিখ্যাত বাঙ্গালী ভারততত্ত্ববিদ, সংস্কৃত বিশারদ, সংরক্ষণবিদ ও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচয়িতা)

Comment here