-শ্রী সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়
হিন্দু ধর্মে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের নানা রীতি আছে, যার মধ্যে তিলকাঞ্চন শ্রাদ্ধের কথাই আজকাল সবচেয়ে বেশি শোনা যায়। তবে আরেক ধরনের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের কথাও প্রায়ই শোনা যায়, বৃষোৎসর্গ শ্রাদ্ধ। শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে বৃষ বা ষণ্ডকে উৎসর্গ করা হত প্রকৃতির বুকে। এই ষাঁড়ই ধর্মের ষাঁড় নামে পরিচিত। এই রীতির সঙ্গে জড়িত ছিল আরেক রীতি, যেখানে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হত তার ঈশানকোণে একটি কাঠ কেটে স্থাপন করা হত। এই কাঠের নিচের অংশে মৃত ব্যক্তির অবয়ব খোদাই করা হত। তবে এখন এটি বিলুপ্ত হওয়ার পথে। এই কাঠটিই বৃষকাষ্ঠ।
এদেশে এমন শিল্পের নিদর্শনের কদর নেই। তাই গ্রামগঞ্জে এই শিল্পের নিদর্শন আর প্রায় দেখা যায় না। অবশ্য আমাদের গ্রাম হাওড়া জেলার উদয়নারায়ণপুরের শিবপুরের পাশের গ্রাম শিবানীপুরে এমন নিদর্শন বছর পনেরো আগেও দেখেছি, সিদ্ধেশ্বরীতলায়।
এদেশে কদর না থাকলেও বৃষকাষ্ঠের কদর রয়েছে আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে বড় দ্বীপরাষ্ট্র মাদাগাস্কারে। এদেশে বৃষকাষ্ঠের নাম আলোয়ালা। স্থানীয় মাহাফিলি জনজাতির মানুষজন যে ভাষায় কথায় বলেন সেই মালাগাসি ভাষায় আলো শব্দের অর্থ দূত। যাঁরা পরলোকে পূর্বজদের কাছে যাচ্ছেন তাঁদের কাছে এই স্মৃতিস্তম্ভ যেন দূতের মতো। সমাজে যাঁরা গণ্যমান্য, তাঁদের স্মৃতিস্তম্ভের উপরে জেবুর মাথা বসিয়ে দেওয়ার চল রয়েছে। জেবু হল স্থানীয় গবাদি পশু, আমাদের দেশের গরুর সঙ্গে সেটি প্রায় হুবহু মিলে যায়।
মাদাগাস্কারের বেটিওকি-আম্পানিহি এলাকায় সাকুল্যে লাখ দেড়েক মাহাফিলি জনজাতির বাস। মনে করা হয়, দক্ষিণপূর্ব আফ্রিকা থেকে তাঁরা এই দ্বীপে এসে বসবাস শুরু করেন দ্বাদশ শতাব্দী নাগাদ। তাঁদের রাজা বা সমাজের যিনি প্রধান তাঁকে বিশাল সমাধিক্ষেত্রে চিরশায়িত করা হত। প্রধানের সমাধিকে বলা হত ভোলামেনা, স্থানীয় ভাষায় যার অর্থ, সোনা। সেই জন্য এই দ্বীপে তাঁরা পরিচিত মাহাফিলি নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। স্থানীয় ভাষায় মাহাফিলি কথার দুটি অর্থ রয়েছে, যাঁরা পবিত্র কোনও কিছু তৈরি করেন এবং যাঁরা অন্যদের আনন্দ দেন। ভাষাবিদরা অবশ্য পবিত্রতার বিষয়টিকেই বেশি মান্যতা দেন। এঁদের ভাষা মালয়ো-পলিনেশিয়ান ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত, মানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া-ওশিয়ানিয়ার সঙ্গে এঁদের কোনও যোগসূত্র রয়েছে। এঁদের সমাজ পিতৃতান্ত্রিক।
ঐতিহাসিকভাবে মারোসেরানা নামে এক ব্যক্তি ছিলেন এই জনগোষ্ঠীর প্রথম শাসক। তাঁর নামেই মারোসেরানা বংশ। এঁদের কবরস্থানকে ভোলামেনা বলা হত। এঁদের আরও একটা প্রথা ছিল, মৃত্যুর পরে নামকরণ বা আনারাতাহিনা। মৃত রাজার নাম কেউ মুখে আনতেন না, তাই রাজার মৃত্যুর পরে তাঁর আলাদা নাম দেওয়া হত। মৃত ব্যক্তির আত্মীয়দের চুল কেটে ফেলতে হত, কেউ তাতে রাজি না হলে তাঁকে সমাজচ্যুত করা হত। এখনও কয়েকটি হিন্দু সমাজে দেখা যায়, মুণ্ডনের পরে অশৌচ শুরু হচ্ছে, এঁদেরও সামাজিক নিয়ম অনেকটা তেমনই।
মাদাগাস্কারে এসে মাহাফিলিরা বসবাস শুরু করার পরে গ্রাম থেকে বেশে কিছুটা দূরে বনের মধ্যে সমাধি দেওয়া শুরু হয়। সমাধির উপরে স্থাপন করা হত আলোয়ালা। তবে বাইরের জগতের কাছে একথা অজানাই ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসিরা এই দ্বীপ দখল করে উপনিবেশ স্থাপন করে। তারপরে তাদের মাধ্যমেই বাইরে দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে আলোয়ালার কথা। এমনকি বিদেশে তা বিক্রিও শুরু হয়ে যায়। স্থানীয় শিল্পীদের অনেকে এখনও নানা মাপের আলোয়ালা তৈরি করেন শুধুমাত্র শৌখিন জিনিস হিসেবে। ঘর সাজানোর জন্য অনেকে অনলাইনে সেসব কেনাকাটাও করেন।
পরিবারের প্রথম যাঁকে সমাহিত করা হয়েছিল সুদূর অতীতে তাঁর সমাধির পাশে সমাহিত করা হয় স্ত্রীকে। পরের প্রজন্মের সমাধি তার চেয়ে উত্তরে। সেই প্রজন্মের স্ত্রীর সমাধি পুরুষের পাশে। এভাবেই চলে আসছে প্রথা। ক্রমে উত্তরের দিকে জায়গা শেষ হয়ে এলে, একেবারে দক্ষিণ থেকে আবার শুরু হয়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে বিয়ের পরে মেয়েকে দূরে যেতে হয়, তাই তাঁর সমাধি হয় স্বামীর পাশে, পূর্ব দিকে। আলোয়ালার নকশায় প্রায়শই দেখা যায় মাকড়শার জালের মতো নকশা। এর মাধ্যমে পারিবারিক দৃঢ় বন্ধনকে বোঝানো হয়। মাদাগাস্কারের দারুশিল্পে তাই মাকড়শার জালের আদল প্রায়শই দেখা যায়। এছাড়াও অন্য নানা নকশা সময়ের সঙ্গে যোগ হয়েছে। বংশ পরম্পরায় শেখা দারুশিল্পের উন্নতি এবং একই সঙ্গে সময় যত এগিয়েছে তার শৈলীতে পরিবর্তনও হয়েছে। প্রথমদিকে নকশায় নির্দিষ্ট ছন্দ না থাকলেও সময়ের সঙ্গে জ্যামিতিক আকারের প্রাধান্য বেড়েছে, প্রতিটি আলোয়ালো আরও সুচারু হয়েছে। যে ব্যক্তির জন্য এই তৈরি করা হচ্ছে, সেই ব্যক্তির জীবনকথা সংক্ষেপে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয় আলোয়ালোতে। এখানেও বিশেষ কিছু চিহ্ন থাকে যাকে ইংরেজিতে বলা হয় আইকন। স্থানীয় মাহাফিলি জনজাতির ব্যবহার করা চিহ্নের ব্যাখ্যা যাঁরা জানেন তাঁদের কাছে প্রতিটি আলোয়ালো অন্য মাত্রা পেয়ে যায়। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। পশুপাখি ও নগ্ন মানবমূর্তি থাকার অর্থ সেই আলোয়ালা মাহাফিলি জনজাতির। যদি তাতে মানুষের মিলনমূর্তি দেখা যায় তাহলে বুঝতে হবে এটি সাকালাভা জনগোষ্ঠীর। তান্দ্রয় জনজাতির সমাধিস্থলের সঙ্গে মাহাফিলিদের আলোয়ালোর যথেষ্ট মিল রয়েছে।
মাদাগাস্কারের ২০০৪ সালের ২০০ আরিয়ারি (সেদেশের মুদ্রার নাম) ব্যাঙ্কনোটের রিভার্স দিকে যে ছবি ছাপা হয়েছে সেটি পশ্চিম মাদাগাস্কারের এমনই এক গোরস্থানের ছবি। এখানে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে দেওয়া কবরের উপরে বসানো হয়েছে আলোয়ালো। প্রতিটিই দারুশিল্পের উৎকৃষ্ট নিদর্শন। কোনওটির একেবারে শীর্ষে জেবুর অবয়ব খোদাই করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আর গোরস্থানের বিভিন্ন জায়গায় পড়ে শিং সহ জেবুর করোটি। জেবু এই জনজাতির কাছে অতি পবিত্র, তাই এঁদের বহু মুদ্রায় জেবুর শিং দেখা যায়।
(লেখক পরিচিতি – প্রাক্তন সাংবাদিক, বর্তমানে ভাষাতত্ত্ববিদ; ইতিহাস চর্চা ও মুদ্রা সংগ্রহ তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান অঙ্গ)
Comment here