– সৌভিক বিশ্বাস
চারিদিকের গুলির শব্দ হঠাৎ থেমে গেল। গাছের গুঁড়িতে লুকিয়ে থাকা যুবকটি বুঝলেন দুরন্ত মার্কসীয় বিপ্লবের মোটরসাইকেলের গতি ধীর হয়ে আসছে। গ্রাম্য স্কুলের মধ্যে যিনি অর্ধ আহত বিধ্বস্ত তিনি কিউবার প্রাক্তন ভারী ও শিল্প মন্ত্রী,তিনি আর্নেস্তো গেভারা। বন্দী হবার পরের দিন সকালে ঘরে আসলেন সি আই এর তরুণ তুর্কি ফেলিক্স রদ্রিগেজ। চে অবাক করে দিয়ে বলেছিলেন – মৃত চে অপেক্ষা জীবিত চে অনেক বেশী কাজের। – কি ইঙ্গিত ছিল সেটা সহজ বোধ্য। এদেরই ভারতের লাল সন্তানেরা দেশের বিপ্লবীদের মুচলেকা দিয়েছেন বলে তীব্র ব্যঙ্গ করেন।
যাই হোক cut to বলিভিয়া। বিশ্বের পপ culture প্রসারিত হবার পর থেকে চে হল একটা পণ্য স্বরূপ। আকর্ষনীয় মুখ যাকে দেখে সবাই একনজরে আকৃষ্ট করে। একজন সাইকোপ্যাথ কিলার হয়ে উঠলেন বর্তমান বিশ্বের Famous Popular Marketing Material ব্যক্তি। সেই সুন্দর আকর্ষণীয় মুখের আড়ালে রয়েছে রক্ত মাখা হাত। যা অবশ্য বলিভিয়ান আর্মি কেটে নিয়েছিলেন। সে কথা প্রসঙ্গক্রমে আসবে।
গর্ভবতী মেয়েটি টিভির সুইচ দিতেই স্ক্রিনে দেখতে পেলেন তার পিতাকে। দেখেই অসুস্থ বোধ করতে লাগলেন। মেয়েটির হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসতে লাগলো। পর্দার ওপারে তখন লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে একটা খুনের, যা স্টেট স্পন্সর্ড মার্ডার বললেই সঠিক হয়। ২৪ বছর বয়সী মেয়েটির বাবা কর্নেল রোজাস ছিলেন সান্তা ক্লারার জাতীয় পুলিশের উচ্চপদে। চে সেই অঞ্চল দখল করার পর, ওনার বাবা গেরিলা বাহিনীর হাতে আটক হন। বেশ কয়েকদিন নিরুদ্দেশ থাকার পর ওনার পরিবারকে নোট পাঠানো হয় যে ওনার বাবা বেঁচে আছেন।
কিন্তু তারপর যা হলো বিশ্বের ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল। কোনরূপ ট্রায়াল ব্যতীত সোজা গুলি এবং সেটি সরাসরি সম্প্রচারের নির্দেশ দেন আর্নেস্তো। রজাস-এর বাড়ি ঘিরে ফেলে কমিউনিস্ট গুণ্ডারা। এমনকি সেই দিন টিভিতে বাবার হত্যা দেখা গর্ভবতী মেয়ে অসুস্থ বোধ করলেও তাকে সেই সময়ে হাসপাতালে যেতে দেওয়া হয়নি। চলছিল পাশবিক আনন্দ। ‘বুর্জোয়া মরেছে, বুর্জোয়া মরেছে’।
তারপর কিউবার শিল্প মন্ত্রী হিসাবে ‘৬৪ সালে United Nations এ ভাষণ। অকপটে স্বীকার – “Yes We have executed people, we are executing people and shall continue as long as it is necessary “
অবাক হওয়ার কিছু বিশেষ; নেই ওরা এমনই অকপট। তাও প্রোপাগান্ডার চালে ওরাই শ্রেষ্ঠ, ওরাই মুক্তির সুরকার। আসলে মানুষ হত্যা না করলে শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা হয়না যে। প্র্যাক্টিক্যাল ফিল্ডের মূল গিনিপিগ তো সাধারণ মানুষ। মার্কসবাদকে সন্তুষ্ট করতে পারে একমাত্র রক্ত – এবং শুধু ক্ষমতা দখলেই সেটা থেমে থাকে না। অন্ধকারের পরে যেমন আলোর উত্থান হয়, তেমনই চে-এর দিন আস্তে আস্তে শেষ হয়ে আসছিল। বলিভিয়ান ভূমিপুত্রর আর্মির হাতে লেখা হচ্ছিল মৃত্যুর ডিক্রি। আফিকার দেশ কঙ্গোতে বিপ্লব সফল না হবার ফলে ফিরে গোপনে ফিরে আসেন কিউবাতে। যদিও এসে থেমে থাকেনি তার প্র্যাক্টিক্যাল ফিল্ড খোঁজার কাজ। বিপ্লবের প্লট হিসাবে খুঁজে পেলেন পাশের দেশ বলিভিয়া। পরিকল্পনা করলেন গেরিলা উত্থান। ঠিক সেই মতন গেরিলা বাহিনী তৈরী করে লড়াই শুরু করলেন বলিভিয়ান আর্মি ও সরকারের বিরুদ্ধে। কিন্তু বৃত্ত ছোটো হয়ে আসছিল ক্রমশ। গ্রামের মানুষকে কাজে লাগিয়ে আমেরিকার ট্রেনিং প্রাপ্ত বলিভিয়ান আর্মি কমিউনিস্ট গেরিলা বাহিনীর গতি বিধি জানতে পারছিল। চে বুঝতে পারলেন অভিমন্যুর মতন আমি ঘরে এসেছি কিন্তু তিনি ওনার মতন লড়াই না করে হাভানা চুরুট ধরিয়ে বলেছিলেন সেই কথা যা আগেই একবার বলেছি – আমি চে, আমি মৃত অপেক্ষা জীবিত বেশি কাজের।
তারপর সেইদিন লা হিগুয়েরার একটা ঘরে ওনাকে সারা রাত হাত পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়। আমেরিকা চাইছিল জীবিত চে কিন্তু বলিভিয়ান আর্মির কঠোর নির্দেশ – বাঁচিয়ে রাখলে ক্ষতি, ঘটে যাওয়া পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে না। তাই পরের দিন সকালে অফিসার টেরান ঘরে উপস্থিত হতেই চে বললেন, ‘আমি জানি তুমি আমায় মারতে এসেছো’! তারপরের কথা বলার আগেই গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিলেন চে-কে। ওই অঞ্চলের হাসপাতালের লন্ড্রি রুমে চের নিথর দেহ ফেলে রাখা হয়েছিল আন্তর্জাতিক মিডিয়া এবং গ্রামবাসীদের জন্য। বলিভিয়ান আর্মি ওনার হাতের পাঞ্জা আগেই বলেছি কেটে নিয়েছিল যাতে কাস্ত্রো কে দেখাতে পারে যে চে মৃত। যে হাত দিয়ে সাধারণ কে হত্যা করা হয়েছিল তা না রাখাই শ্রেয়।
একসময়ের মার্কসবাদী ত্রাস সৃষ্টিকারী বিপ্লবীর কি নির্মম মৃত্যু! যেমন কর্ম তেমন ফল। এইটি হিন্দু ছাড়া কেউ বিশ্বাস না করলেও অদ্ভুত ভাবে তাদের ক্ষেত্রে সর্ব কালের সত্য ছিল – আছে – থাকবে। চেকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা জামায়,কফি মগে থাকলেও ইতিহাস উন্মুক্ত হবার দরুন একজন খুনী, সাইকোকিলার, গণহত্যার নায়ককে নিয়ে কতদূর Romanticism চলে সেটাই দেখার অপেক্ষায় রইলাম।
চে-দের মনে রাখা উচিৎ যতদিন ওদের মতন দখলদার থাকবে ততদিন বলিভিয়ান আর্মির মতন জাতীয়তাবাদী ভূমিপুত্রদের সেনাদের ন্যায় প্রতিরোধ গড়ে উঠবে। দেশে দেশে কালের নিয়মে তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে জাতির স্বার্থে, জাতীয়তার স্বার্থে। লং লিভ বলিভিয়ান আর্মি।
Comment here