– -শ্রী সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়
বিশ্বজুড়ে বললে ঠিক বলা হবে কিনা জানি না, তবে দেশজুড়ে তো বটেই। দেশজুড়ে চলছে মহাকুম্ভে স্নানের উন্মাদনা। প্রয়াগরাজে তিন নদীর সঙ্গমে তো বটেই, গঙ্গা ও যমুনার তীরেও পঞ্চাশ কোটির বেশি মানুষ পুণ্যস্নান করেছেন। শিবরাত্রিতে এবারের মতো কুম্ভস্নান শেষ। আজ মুদ্রায় ইতিহাসপর্বে মহাকুম্ভ।
পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী, শক্তি কমে যাওয়ার ফলে সমুদ্রের নিচে সঞ্চিত অমৃতের সন্ধানে সমুদ্র মন্থন করার কথা চিন্তা করেন দেবতারা, কিন্তু এই কাজ তাঁদের একার পক্ষে সম্ভব হবে না বুঝে তাঁরা অসুরদের স্মরণাপন্ন হন। স্থির হয়, যেসব রত্ন পাওয়া যাবে তা সমানভাগে ভাগ করা হবে, যদিও বিষ্ণুকে ভার দেওয়া হয়, যাতে অশুভশক্তির অধিকারী অসুররা কোনওভাবে অমৃতের ভাগ না পান। স্থির হয়, মন্দার পর্বতকে দণ্ড হিসেবে ব্যবহার করা হবে এবং রজ্জু হতে রাজি হন নাগরাজ বাসুকী। প্রথমে স্থির হয় দেবতারা ধরবেন মাথার দিক এবং অসুররা লেজের দিক। কিন্তু লেজের দিক মাথায় তুলনায় কম গুরুত্বের বা অপবিত্র বলে অসুররা তাতে রাজি হননি। শেষে দেবতারাই লেজের দিক ধরেন, অসুররা ধরেন মাথার দিক। এমনই ছবি রয়েছে ফ্রেঞ্চ ইন্দোচায়নার ১৯৪৫ সালের ১০০ পিয়াসট্রেস কারেন্সি নোটে। সমুদ্রমন্থনের যে ছবি ছাপা হয়েছে সেটি আঙ্কোর থমের একটি স্থাপত্য।
সমুদ্রমন্থনের প্রায় শেষে অমৃতকুম্ভ ওঠে, কোনও কোনও মত অনুযায়ী সেই অমৃতকুম্ভ নিয়ে উত্থিত হন ধন্বন্তরী স্বয়ং। হিন্দু ধর্মে কুম্ভ বা কলস যেমন পবিত্র, বৌদ্ধধর্মেও তাই। এই কারণেই সাবেক হিন্দুরাষ্ট্র নেপাল এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় হিন্দু ও বৌদ্ধ প্রভাবিত বিভিন্ন দেশের মুদ্রায় কলসের ছবি দেখতে পাওয়া যায়। কোথাও আবার এই কলসের গায়ে পাখা বা ডানা রয়েছে। এখানে উদাহরণ হিসাবে নেপালের একটি ২০ পয়সার ছবি দেওয়া হল।
অমৃতকুম্ভ পাওয়ার পরে অসুরদের হাত থেকে সেই সেটি রক্ষা করতে তা নিয়ে উড়ে যান গরুড়। তখন তা থেকে কয়েকফোঁটা চলকে পড়ে। অন্য একটি মতও রয়েছে। সেই মত অনুযায়ী, মায়ের দাসত্ব মোচনের জন্য গরুড় যখন স্বর্গ থেকে অমৃতকুম্ভ আনছিলেন তখনই তা চলকে পড়ে। পণ্ডিতরা বলেন, চলকে কোথায় পড়েছিল সেই উল্লেখ পৌরাণিক কাহিনিতে পাওয়া যায় না, তবে কথিত আছে যে প্রয়াগরাজের যুক্তত্রিবেণী, হুগলির মুক্তত্রিবেণী, হরিদ্বার, ত্র্যম্বক ও উজ্জ্বয়িনীতে অমৃতের ফোঁটা পড়েছিল, তাই এখানেই নির্দিষ্ট সময় অন্তর কুম্ভমেলা বসে। হুগলির প্রয়াগে এবারে নতুন করে কুম্ভস্নান শুরু হয়েছে।
অমৃতকুম্ভকে রক্ষা করেছিলেন গরুড়, নেপাল রাষ্ট্রব্যাঙ্কের লোগোতে গরুড়ের ছবি রয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন রূপে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন মুদ্রায় গরুড়ের ছবি দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের অশোকস্তম্ভের মতো থাইল্যান্ডের অন্যতম জাতীয় চিহ্ন হিসেবে গরুড়ের ছবি ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন স্থানে, মুদ্রাতেও।
পূর্ণকুম্ভ হয় ১২ বছর অন্তর, এবার নাকি মহাকুম্ভ, এমন যোগ নাকি আবার ১৪৪ বছর পরে আসবে। তাই এবছর উন্মাদনা চরমে। এখনও পর্যন্ত পঞ্চাশ কোটির বেশি মানুষ স্নান করেছেন প্রয়াগরাজে। বিশ্বের ছোট ৭০টি দেশের জনসংখ্যাই বোধহয় এত নয়! উত্তরভারতের বিভিন্ন সংবাদপত্র জুড়ে প্রয়াগের খবর এখন যথেষ্ট প্রাধান্য পাচ্ছে, আর আজ থেকে ৭৫ বছরেরও বেশি আগে ভারত থেকে সুদূরে, ফরাসি উপনিবেশের মুদ্রায় ছাপা হয়েছে এমন ছবি যার সঙ্গে যোগ করেছে অমৃতকুম্ভের।
(লেখক পরিচিতি – প্রাক্তন সাংবাদিক, বর্তমানে ভাষাতত্ত্ববিদ; ইতিহাস চর্চা ও মুদ্রা সংগ্রহ তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান অঙ্গ)
