বসুধা

মুদ্রায় সাত হাজার বছর আগের খনি ও অস্ত্র তৈরির কথা

– শ্রী সুমিত্র বন্দ্যেপাধ্যায়

জানেন কি, নব্যপ্রস্তর যুগে কোন পাথরে অস্ত্র তৈরি হত? কোথায় সেই পাথর পাওয়া যেত? মুদ্রায় প্রাচীন সভ্যতা পর্বে আজ আমরা নব্যপ্রস্তর যুগে, পোল্যান্ডের এক পাথুরে খনিতে। ২০১৯ সালে এটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় যুক্ত হয়েছে। তবে তার অনেক আগে, ২০১২ সালে ২ জ্লোটি কয়েনে এই খনি ও সেই যুগের অস্ত্রের ছবি ব্যবহার করেছিল পোল্যান্ড।

পোল্যান্ডের খনি অঞ্চল ক্রজেমিওনকি বা স্খমিসকি (Krzemionki) বিখ্যাত হয়েছে প্রাগৈতিহাসিক যুগের খনির জন্য়। এই জায়গাটিকে প্রাগৈতিহাসিক স্ট্রাইপড ফ্লিন্ট খনি অঞ্চল বলে ঘোষণা করে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে চিহ্নিত করেছে ইউনেস্কো। পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত এই খনি নব্যপ্রস্তর যুগের, মানে খ্রিস্টপূর্ব ৩৯০০ থেকে ১৬০০ বছর আগের। বিশ্বের প্রতিটি ভূ-রাজনৈতিক অঞ্চলে আধুনিক ও মধ্যযুগের সূচনা যেমন বিভিন্ন সময়ে হয়েছে, ঠিক একইভাবে অন্যান্য যুগের সময়কালও আলাদা। এই খনিটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, আবিষ্কারের পরে হাজার হাজার বছর পার হয়ে গেলেও এই খনিটি প্রায় আগের মতোই রয়েছে। চাপা পড়ে থাকা এই খনি নতুন করে আবিষ্কারের পরে, আধুনিক যুগের মানুষের কাছে পূর্বপুরুষের পরিচয় ঘটাতে এই জায়গাটিকে জাদুঘরে পরিণত করেছে সেদেশের প্রশাসন।

জাদুঘর, মানে মাটির নিচে সুড়ঙ্গ পথে প্রাগৈতিহাসিক খনির সাক্ষী। খনির মধ্যে কেমন ভাবে এই পাথর থাকত, কেমনভাবে মানুষ তা খুঁড়ে বের করত, কীভাবে অস্ত্র তৈরি করত, সেই সব জানতে, চাক্ষুস করতে বহু পর্যটক এখানে আসেন। বিজ্ঞানীরা তো আসেনই।

অন্তত সাড়ে পনেরো কোটি বছর আগে সিলিকা ও অন্যান্য উপাদান কঠিন হয়ে এই পাথর তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু কীভাবে এইসব পাথর কেলাসিত হয়েছিল, তখন ওই জায়গার তাপমাত্রা কত ছিল এসব নিয়ে এখনও তাঁরা এখনও স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। তাছাড়া প্রাকৃতিক উপাদান ঠিক কোন অবস্থায় থাকলে এই পাথর তৈরি হয় তা নিয়েও গবেষণা চলেছে।

এখন যেখানে ক্রজেমিওনকি এক সময় সেখানে অগভীর সমুদ্র ছিল, সেখানে চুনাপাথরের স্তরও ছিল। সময়ের সঙ্গে সেগুলি সিলিকার সঙ্গে মিশে জমাট বাঁধতে থাকে। তা থেকেই কোটি কোটি বছর ধরে এটি তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন এটি দীর্ঘদিন জেলির মতো থকথকে অবস্থায় ছিল, তা থেকে জল সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে যাওয়ায় এখন কঠিন পাথরে পরিণত হয়েছে।

এই খনি থেকে পাওয়া বজ্রকঠিন-পাথর দিয়ে কুঠার ও লাঙ্গলের ফলা তৈরি করতেন আদিম মানুষ। নব্যপ্রস্তর যুগে এখানে যে মানুষ বসবাস করতেন, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই খনি। সেই যুগে এই অঞ্চলের আদিম মানুষের সংস্কৃতি কেমন ছিল এটি তার সাক্ষ্য বহন করছে, তাই গবেষকদের কাছেও এই স্থান গুরুত্বপূর্ণ। হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতি চাক্ষুষ করতে পর্যটকরা তো আসেনই। মানব সভ্যতার ইতিহাসে হাতিয়ারের উদ্ভব, মানুষ কীভাবে খনি থেকে জিনিস উৎপাদন করতে শিখল এবং চকমকি পাথর, যা মানুষকে আগুন জ্বালানো শিখিয়েছে, সেসব নিয়ে যাঁদের আগ্রহ রয়েছে এই খনি তাঁদের কাছে স্বপ্নের জায়গা। একটা নয়, পোল্যান্ড জুড়ে ১৭টি জায়গায় এমন খনি রয়েছে। একত্রে সবগুলি নিয়েই হেরিটেজ সাইট।

এই খনির পাথর, মানে স্ট্রাইপড এখন সুয়েতোক্রৎইস্কি হীরক নামে পরিচিত। হীরক বলার মধ্যে কোনও অত্যুক্তি নেই, কারণ এইসব পাথর অত্যন্ত কঠিন তো বটেই, সোনার গয়নাতেও বসানোর চল ছিল।

এক বছরের বেশি সময় ধরে মুদ্রায় হারানো সভ্যতার কথা লিখেছি। এইসব লেখায় এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, ওসিয়ানিয়া ও আমেরিকার প্রসঙ্গ এসেছে, তবে মূলত লাতিন আমেরিকা। মহাদেশ হিসেবে উত্তর আমেরিকা যেমন এখনও বাদ রয়েছে তেমনি যেসব দেশের ইতিহাসের কথা প্রায়শই শোনা যায় সেইসব দেশের মধ্যে এখনও বাদ রয়েছে মিশর, গ্রিস, ইরাক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি। তবে সেইসব পর্বে যাওয়ার আগে একঘেয়েমি কাটাতে স্বাদ বদলের চেষ্টা করব।

আগামী কয়েক পর্বে অগস্ট উপলক্ষে ভারত।

 

(লেখক পরিচিতি – প্রাক্তন সাংবাদিক, বর্তমানে ভাষাতত্ত্ববিদ; ইতিহাস চর্চা ও মুদ্রা সংগ্রহ তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান অঙ্গ)

Comment here