স্বভূমি ও সমকাল

আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকের উদ্দেশ্যে একটি খোলা চিঠি –

মাননীয় সম্পাদক
আনন্দ বাজার পত্রিকা
কলকাতা,

সুধী,

আপনার সম্পাদিত সংবাদপত্রে ৫ই মার্চ, ২০২১, শুক্রবারের শহর সংস্করণের চার নম্বর পৃষ্ঠায় প্রকাশিত, “অথচ বামপন্থীদের কাছে প্রত্যাশা ছিল আদর্শ আর নৈতিকতার – শেষে নতুন খাল কাটলেন ?” শীর্ষক লেখনীর প্রেক্ষিতে আপনাকে এই খোলা চিঠি।

তামাম দুনিয়াতেই ইদানীং কালে আলোচনা হোক কি সমালোচনা কিংবা বিতর্কের কেন্দ্রে থাকা বিভিন্ন বিষয়গুলোর মধ্যে “পোস্ট ট্রুথ”, “ফেক নিউস”, “হোয়াটস্যাপ ইউনিভার্সিটির” মতন কিছু শব্দ বা শব্দবন্ধ তালিকার একদম উপরের দিকেই নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে। এ নিয়ে বোধকরি এতটুকু সন্দেহের অবকাশ আর কারো নেই। আর এ কথা অস্বীকার করাও কার্যত অসম্ভব যে এমন ধারা একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ, বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যম অর্থাৎ পরিভাষায় যাদের আমরা সোশ্যাল মিডিয়া বলি, শেষ কয়েক বছরে তাদের বিপুল বাড়বাড়ন্ত। এ কথা মোটেই অত্যুক্তি নয় যে মানব সভ্যতার ইতিহাসে এতাবৎকাল পর্যন্ত্য আবিষ্কৃত, একসাথে অনেক মানুষের কাছে কোনো বিষয়বস্তু বা বার্তা পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমগুলোর মধ্যে বর্তমানে সব থেকে জনবহুল আর জনপ্রিয় হলো ইন্টারনেট নির্ভর সোশ্যাল মিডিয়া। যে মাধ্যমের সাহায্যে যে কেউ তার খুশি মতন বিষয়বস্তু তুলনামূলকভাবে সব থেকে কম আয়াসে বিশ্বজনীন পাঠক, দর্শক বা শ্রোতার কাছে পৌঁছে দিতে পারে। আর তাই একসাথে অনেক মানুষের কাছে কোনো বিষয়বস্তু বা বার্তা পৌঁছে দেওয়ার সব রকম মাধ্যমগুলোর মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়াতে বিষয়বস্তু গ্রহণকারীর সংখ্যার অনুপাতের তুলনায় তা পরিবেশনকারীর সংখ্যার আনুপাতিক হার সব থেকে বেশি। যেহেতু সেখানে পরিবেশন করা নানা ধরণের বিষয়বস্তুর গুণগত মান যাচাই করার মতন কোন পাকাপোক্ত ব্যবস্থা সে অর্থে এখনো পর্যন্ত্য প্রায় কিছুই নেই। অন্তত আমাদের দেশে তো নেই-ই। (যদিও এ বিষয়ে বর্তমান ভারত সরকার যথেষ্ট তৎপর হয়েছেন আর দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সাম্প্রতিক রায়ও তাদের সেই অভিমুখেই দিশা নির্দেশ করেছে) সেহেতু সোশ্যাল মিডিয়ার উপর ভরসা করার ক্ষেত্রে যে কোনো পরিণত মস্তিষ্কের সামনে প্রধান অন্তরায় হলো সেখান থেকে পাওয়া খবর তথা তথ্যের পাশাপাশি সেগুলোর উৎসমুখ আর পরিবেশনকারীদের বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব। যদিও এ জন্য সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর নিজেদের কার্যপ্রণালী সর্বাংশে দায়ী হলেও সে নিয়ে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আর তা না থাকারই কথা। কারণ পরিবেশিত বিষয়বস্তুর গুণগত মান তাদের ব্যবসায়িক তথা অন্যান্য লক্ষ্যপূরণের ক্ষেত্রে এখনো পর্যন্ত্য মোটেই কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। আর ঠিক এই কারণেই ছাপার অক্ষরে যারা খবর তথা তথ্য পরিবেশন করেন, তা সে প্রতিদিন নিউজ প্রিন্টে হোক কি সাময়িকীর পৃষ্ঠায়। তাদের উপরেই চিন্তাশীল মানুষ একটু বেশি করে আস্থা রেখেই আজ আপাত নিশ্চিন্তে দিন কাটাচ্ছেন। এমনকি তাদের বৈদ্যুতিন মাধ্যম বা ইন্টারনেট সংস্করণও মানুষের সেই আস্থার অন্যতম ভাগীদার। কিন্তু যে কোনো সমাজের চিন্তাশীল মানুষের জন্য অশনি-সঙ্কেত হলো যখন তাদের সেই আস্থা নিয়ে শুরু হয় খুব নিকৃষ্ট মানের ছেলেখেলা। আর সেটা করেন, প্রাপ্ত খবর তথা তথ্যের গুণগতমানের বিষয়ে চিন্তাশীল মানুষের আস্থা আজকের সমাজ জীবনেও যাদের উপর সর্বাধিক তারা নিজেরাই। ঠিক এমনটাই আবার একবার দেখা গেলো “ভারতে সর্বাধিক প্রচারিত প্রথম শ্রেণির বাংলা দৈনিক”, আনন্দ বাজার পত্রিকার ৫ই মার্চ, শুক্রবারের শহর সংস্করণের চার নম্বর পৃষ্ঠায়। অনেকটা সোশ্যাল মিডিয়াতে পরিবেশন করা “পোস্ট ট্রুথের” কায়দায় ছাপা হলো, “অথচ বামপন্থীদের কাছে প্রত্যাশা ছিল আদর্শ আর নৈতিকতার – শেষে নতুন খাল কাটলেন ?” শীর্ষক একটা লেখনী। যে লেখনীর প্রায় প্রতিটা ছত্রে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়েছে সত্যের কদর্য অপলাপ আর তথ্যের জঘন্য বিকৃতি। সাথে লেখিকার নিজের ব্যক্তিগত কিছু মন্তব্য, আর তাঁর উপস্থাপিত প্রায় সমস্ত বিষয়ে পর্যাপ্ত আর যথোপযুক্ত তথ্যের তোয়াক্কা না করেই তাঁর নিজের টেনে দেওয়া উপসংহার। আর সেই সব কিছুকে হাতিয়ার বানিয়ে পাঠক বা পাঠিকাদের বিভ্রান্ত করে দিয়ে জনমতকে নিজের মতন করে প্রভাবিত করার এক ভয়ঙ্কর অপচেষ্টা।

যদিও এই অপচেষ্টা নতুন নয়। ব্রিটিশ ভারতের অবসান হওয়ার পরেও যা প্রায় নির্বিরোধে ধারাবাহিক ভাবে চলে এসেছে এতকাল। যার আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৪৭-এ এই দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা সম্পূর্ণ ভাবে এ দেশেরই মানুষের হাতে আসার অব্যবহিত পরেই। বিশ্ববরেণ্য, প্রবাদপ্রতিম ঐতিহাসিক আচার্য্য রমেশ চন্দ্র মজুমদার তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি, ৩ খন্ডের “History of the Freedom Movement in India” -এর ১ম খন্ডের মুখবন্ধে লিখেছেন “রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসকে দেখার ও মূল্যায়ন করার সরকারী প্রবণতা বর্তমান সময়ের অমঙ্গলের চিহ্নস্বরূপ। সরকারী উদ্যোগে রচিত এ দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের মূলীভূত তত্ত্ব হলো অষ্টাদশ শতকে ভারত তার স্বাধীনতা হারিয়ে মাত্র ২শো বছর বিদেশী শাসকের অধীনস্ত হয়েছে। যদিও প্রকৃত তথ্যনিষ্ঠ ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দিয়েছে আরো ৫শো বছর পূর্বেই ভারত তার স্বাধীনতা হারিয়েছে। আর ২শো বছর আগে অষ্টাদশ শতাব্দীতে যা হয়েছে তা শুধুই তার প্রভুর বদল ব্যতিরেকে আর কিছুই নয়। এমনই বিভিন্ন তথ্যনিষ্ঠ ইতিহাসের উপস্থাপনা করার “অপরাধে” ১৯৫৫ সালে ভেঙে দেওয়া হয় সেই কমিটি যা সরকারী উদ্যোগে দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির ইতিহাস গ্রন্থিত করার উদ্দেশ্যে ১৯৫২ সালে তৎকালীন ভারত সরকারের শিক্ষা মন্ত্রকের অধীনে গঠন করা হয়েছিল। যে উদ্যোগের প্রস্তাবক ছিলেন কিংবদন্তী ঐতিহাসিক ডঃ মজুমদার নিজে। সাথে তিনিই ছিলেন ইতিহাস গ্রন্থনা করার উদ্দেশ্যে তৈরী হওয়া সরকারী কমিটির প্রধান। কারণ ধারে, ভারে আর প্রশ্নাতীত যোগ্যতায় তাঁর সমকক্ষ আর কাউকে পাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। যদিও সেই সরকারী উদ্যোগ কিন্তু বাতিল হয় না। পরের বছরেই ডঃ মজুমদারকে সরিয়ে ঐতিহাসিক তাঁরা চাঁদকে কমিটির প্রধান ঘোষণা করে ঐ একই উদ্যোগ আবার নতুন করে শুরু করা হয়। ১৯৬৭ সালে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের পছন্দের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে সরকারী ইতিহাস আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশিতও হয়। কিন্তু হতোদ্যম হয়ে থেমে না গিয়ে সরকারী ইতিহাস প্ৰকাশিত হওয়ার ৫ বছর আগেই ১৯৬২তে জনসমক্ষে আসে ৭ বছর যাবৎ ডঃ মজুমদারের একার অক্লান্ত পরিশ্রম আর মেধার ফসল, এ দেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ের তথ্যনিষ্ঠ ইতিহাসের আকর গ্রন্থ, ৩ খন্ডের “History of the Freedom Movement in India”।

আনন্দ বাজার পত্রিকার ৫ই মার্চ, ২০২১, শুক্রবারের শহর সংস্করণের চার নম্বর পৃষ্ঠায় উপরে উল্লিখিত লেখনীর প্রথম সাতটা ছত্রে লেখিকা শুধুই বামফ্রন্ট অর্থ্যাৎ ভারতের মার্ক্সবাদী কম্যুনিস্ট পার্টী আর তাদের দীর্ঘদিনের সহযোগী দলগুলোর কেন্দ্রীয় তথা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নেতৃত্বের ওপর নিজের হতাশা আর ক্ষোভ ব্যক্ত করেছেন। মাথায় ফেজ টুপি লাগানো “ভাইজান” আব্বাস সিদ্দিকী যে ব্রিগেডের ময়দান থেকে সেদিন প্রচন্ড গরমে শরীর সুস্থ রাখতে সমবেত জনতাকে মুসলমান অধ্যুষিত তৎকালীন পূর্ব বঙ্গ তথা অধুনা বাংলাদেশে প্রচলিত শব্দ “পানি” খেতে নিষেধ করবেন। তারস্বরে এই বঙ্গভূমি “স্বাধীন” করার ডাক দেবেন। মোটের ওপর এতদিন ধরে খুব সন্তর্পনে ধামাচাপা দিয়ে রাখা তৎকালীন কম্যুনিস্ট পার্টী আর মুসলিম লীগের যৌথ প্রযোজনায় তৈরী হওয়া ১৯৪৬-এর ১৬ই অগাস্টের হাড় হিম করে দেওয়া স্মৃতি, এ শহরে হিন্দু গণহত্যার ভয়ঙ্কর ইতিহাস এই শহর কলকাতার বুকের ওপর দাঁড়িয়েই হিন্দু “ভোটারদের” মনে আবারও একবার টাটকা করে তুলবেন। আর সে কারণেই এ রাজ্যে এখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা সচেতন হয়ে যাবেন। সে সমস্ত কথা বাম নেতৃত্ব যে আগে থেকে বুঝেও বুঝতে চাননি সেটাই লেখিকার হতাশার আসল কারণ কিনা সে উত্তর একমাত্র তিনিই দিতে পারবেন। কারণ আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের প্রেক্ষিতে বামপন্থীদের নৈতিক অধঃপতনের নিন্দা করতে গেলে তো পশ্চিমবঙ্গের অনেক জায়গার মতন এই শহর কলকাতার বেলেঘাটা, বরাহনগরের মতন বেশ কিছু অঞ্চলের আনাচে কানাচে এখনো নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়া স্মৃতিসৌধগুলো যে রাজনৈতিক দলের গুন্ডা আর পুলিশের হাতে খুন হওয়া মার্ক্সবাদী কম্যুনিস্ট পার্টীর অজস্র কর্মীদের স্মৃতি রক্ষা করতে এক সময় বানানো হয়েছিল সেই রাজনৈতিক দল অর্থাৎ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাথেই নির্বাচনী জোটের বিরুদ্ধে লেখিকার তো আগে সরব হওয়া উচিত ছিল। যখন মাত্র কয়েক বছর আগেও এই বাম নেতারাই উঠতে বসতে বলতেন “৭২ থেকে ৭৭এর কালো দিনগুলোর” জন্য দায়ী এক এবং একমাত্র “কংগ্রেস”।

এবার আসা যাক সোশ্যাল মিডিয়া মার্কা পোস্ট ট্রুথের বিষয়ে। লেখনীর নবম ছত্রে লেখিকার “মনে পড়েছে” শ্যামাপ্রসাদ মুসলিম লীগের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন আর প্রথমবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছিলেন মুসলিম লীগের হাত ধরে। লেখিকা আরো জানিয়েছেন ১৯৪১-এ অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক জিন্নাহর কলকাঠিতে বাধ্য হয়ে কৃষক প্রজা পার্টি ভেঙে যোগ দিয়েছিলেন মুসলিম লীগে। আর শ্যামাপ্রসাদ যোগ দিয়েছিলেন সেই মন্ত্রীসভায়। আর সেই সময়েই বাংলায় মুসলিম লীগের সমর্থন বাড়ে অনেকখানি। যেহেতু তিনি নিজে উল্লেখ করেননি তাই জানতে ইচ্ছা রইলো এমন ঐতিহাসিক তথ্য তিনি কোন সূত্র থেকে পেয়েছেন? লেখিকা হয় জানেন না আর না হয় জেনে বুঝে সত্যিটা চেপে গিয়েছেন। আসলে ১৯৩৭এর নির্বাচনের পরে কংগ্রেসের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে মুসলিম লীগের সমর্থনে অবিভক্ত বাংলায় সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী হওয়ারও পরে নিজের দল কৃষক প্রজা পার্টীর অন্তর্দ্বন্দ্ব আর কংগ্রেসের চাপের মুখে নিজের সরকারের পতন রক্ষার্থে ঐ বছরেরই ১৫ই অক্টোবর আবারও একবার মুসলিম লীগেই যোগ দিয়েছিলেন ফজলুল হক। আর জিন্নাহের সাথে ফজলুল হকের দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ১৯৪০-এর জুন মাসে। “আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর” বইতে আবুল মনসুর আহমেদ লিখেছেন ১৯৪০-এর ১৫ই জুন অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের কার্যকরী কমিটি প্রস্তাব পাশ করে ভাইসরয়ের যুদ্ধ পরিষদে (War Council) যোগ দেওয়ার ব্যাপারে মুসলমানদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। আর ১৮ই জুন তারিখে সেই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন অবিভক্ত পঞ্জাবের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, ইউনিয়নিস্ট পার্টীর প্রধান খান বাহাদুর সিকান্দার হায়াৎ খান। জানিয়েছিলেন মুসলিম লীগের এ হেন নির্দেশ পাঞ্জাব আর বাংলাতে প্রযোজ্য নয়। ১৯শে জুন সিকান্দার হায়াৎ খানের এমন পদক্ষেপকে শিশুসুলভ বলে চিহ্নিত করেছিলেন, জিন্নাহ। পাঞ্জাব, আসাম আর বাংলার তিনজন মুসলমান প্রধানমন্ত্রীর ভাইসরয়ের যুদ্ধ পরিষদে যোগ দেওয়া মেনে নিতে না পেরে জুলাই মাসে তাদের তিনজনের বিরুদ্ধেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সর্বোচ্চ নেতা মহম্মদ আলী জিন্নাহ। ৮ই সেপ্টেম্বর তারিখে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা নবাবজাদা লিয়াকত আলী খানকে একটা চিঠি লিখেছিলেন ফজলুল হক। আর ১১ই সেপ্টেম্বর সেই চিঠি ছেপে দিয়েছিলো কলকাতা থেকে প্ৰকাশিত “স্টেটসম্যান” পত্রিকা। সেই চিঠিতেই ফজলুল হক লিখেছিলেন সরকারের প্রধানমন্ত্রীর মতন সাংবিধানিক পদে থেকে ভাইসরয়ের নির্দেশ অমান্য করা তাদের পক্ষে অসম্ভব ছিল। তিনি মনে করেছিলেন লব্ধ প্রতিষ্ঠিত আইনজীবি, কায়েদ-এ-আজম তার এই অকাট্য যুক্তি উপেক্ষা করতে পারবেন না। তা সত্ত্বেও ৩০শে জুলাই হায়দ্রাবাদ থেকে বিবৃতি দিয়ে জিন্নাহ জানালেন ডিফেন্স কাউন্সিলে যোগ দিয়ে মুসলিম লীগের নির্দেশ উপেক্ষা করার জন্য ফজলুল হক সহ মুসলিম লীগের বাকি সদস্যদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে তিনি বদ্ধপরিকর। জিন্নাহের উদ্যোগে ২৫শে অগাস্ট বোম্বাই শহরে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের কার্যকরী কমিটির সামনে হাজির হয়ে নিজেদের বক্তব্য পেশ করার নির্দেশ জারি হলো মুসলিম লীগের কার্যকরী কমিটির সিদ্ধান্ত তথা নির্দেশ উপেক্ষা করার অভিযোগে অভিযুক্ত তিন প্রধানমন্ত্রীর জন্যেই। আসামের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্যার মহম্মদ সাদুল্লাহ সেই নির্দেশ পালন করলেও নির্দিষ্ট দিনে বোম্বাই গেলেন না ফজলুল হক। জিন্নাহের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ কার্যকরী কমিটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিলো ১০ দিনের মধ্যে পদত্যাগ করতে হবে ফজলুল হককে। সেই মতন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন তিনি। আর ৮ই সেপ্টেম্বর তারিখে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক তথা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা লিয়াকত আলী খানকে লেখা সেই ঐতিহাসিক চিঠিতেই মুসলিম লীগের কার্যকরী কমিটির সাথেই কাউন্সিলের সদস্যপদও ত্যাগ করলেন ফজলুল হক। ত্যাগ করলেন মুসলিম লীগের সাথে সমস্ত সংশ্রব। আর তার পরেই ফজলুল হকের সাথে জোট করে তাঁর মন্ত্রীসভায় যোগ দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় সংখ্যালঘু হিন্দুদের অধিকার রক্ষা করতে তৎপর হয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ।

কারণ, এই ঘটনার ৪ বছর আগে ১৯৩৭এর প্রভিন্সিয়াল অ্যাসেম্বলীর নির্বাচনে অবিভক্ত বাংলায় কোনও দলই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। স্বাভাবিক ভাবেই একার পক্ষে সরকার গঠন করা কোনো দলের পক্ষেই সম্ভব ছিল না। এমন একটা অচলবস্থার পরিস্থিতিতে জোট সরকার গঠনের প্রস্তাব নিয়ে কৃষক প্রজা পার্টীর সর্বোচ্চ নেতা ফজলুল হক দ্বারস্থ হয়েছিলেন অবিভক্ত বাংলায় সব থেকে বেশি আসন জিতে আসা কংগ্রেসের। কিন্তু সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন কংগ্রেসের হাই কম্যান্ড। বাংলার প্রদেশ কংগ্রেসও হাই কম্যান্ডের নির্দেশের অন্যথা করতে পারেননি। সেই সময়ের মাত্র কিছু দিন আগে, অবিভক্ত বাংলায় তো বটেই অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের ওজনদার আর ক্ষমতাবান নেতা, খোয়াজা নাজিমুদ্দিনকে রীতিমতো মুখোমুখি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হারিয়ে বরিশালের পটুয়াখালী থেকে নির্বাচন জিতেছিলেন ফজলুল হক। অথচ কংগ্রেসের সমর্থন পেতে ব্যর্থ হয়ে দ্বারস্থ হতে বাধ্য হয়েছিলেন সেই মুসলিম লীগেরই। অবিভক্ত বাংলায় তৈরী হয়েছিল মুসলিম লীগ, কৃষক প্রজা পার্টী, ইউরোপীয় প্রতিনিধি আর তফসিলি নির্দল প্র্রার্থীদের জোট সরকার। মুসলিম লীগের সমর্থনের জোরে সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন কৃষক প্রজা পার্টীর ফজলুল হক। আর তার পরের চার বছরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মুসলিম লীগের বদান্যতায় চলা কৃষক প্রজা পার্টীর সাথে তাদের জোট সরকার অবিভক্ত বাংলায় ১৮৮১ থেকেই সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের অধিকার সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ধারাবাহিক ভাবে হনন তো করেই চলেছিল সেই সাথেই চলেছিল অবিভক্ত বাংলার হিন্দুদের উপর অমানবিক অত্যাচার। 

বিভিন্ন কারাগারে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির বিষয়ে আন্দোলন, কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের জন প্রতিনিধিত্ব বিষয়ক আইনের পরিবর্তন, বেঙ্গল সেকেন্ডারি এডুকেশন সংশোধনী আইন সহ বিভিন্ন বিষয়ের সুদূরপ্রসারী কু-প্রভাব বাংলার সেই সময়ে সংখ্যালঘু হিন্দু সমাজকে যে দ্রুত ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তা সম্যক উপলব্ধি করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। আর ১৯৩৭-১৯৪০, এই ৪ বছর ধরে উপরে উল্লিখিত বিভিন্ন বিষয়ের প্রতিবাদে গড়ে তুলেছিলেন ধারাবাহিক প্রতিবাদ আন্দোলন। তাঁর সব আন্দোলনে বাংলার আপামর হিন্দু সমাজ যে অকুন্ঠ সমর্থন দিয়েছিলেন শুধু তাই নয়। এমন ধারার বিভেদমূলক হিন্দু বিরোধী ব্যবস্থার প্রতিবাদে তাঁর সমর্থনে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে সক্রিয় আর সোচ্চার হয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিজ্ঞান সাধক আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, প্রখ্যাত সাংবাদিক, সম্পাদক ও প্রকাশক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, বিখ্যাত চিকিৎসক ডাঃ নীলরতন সরকার, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুবিখ্যাত দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ স্যার ব্রজেন্দ্র নাথ শীল প্রমুখের মতন বাংলার প্রবাদপ্রতিম মানুষেরাও। জানিনা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে ৪ বছর ধরে ধারাবাহিক ভাবে অত্যাচারিত, বঞ্চিত, সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার্থে শাসন ক্ষমতায় আসীন হওয়াকে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা বলে দেগে দেওয়া লেখিকা এঁদেরও হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার দোষে দুষ্ট বলার চেষ্টা এর পরে করবেন কি না।

কুশল কামনা সহ ধন্যবাদান্তে,

সৌগত বসু
কলকাতা
৬/৩/২০২১

 

চিত্রঋণ: http://www.shyamaprasad.org/ 

Comment here