– সৌম্যদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
UNESCO স্বীকৃতি পেয়েছে দুর্গাপূজা। শুনে আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মত খুশি হয়েছিলাম আমিও। কিন্তু বিস্তারিত পড়তে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ… এরা বলছে বাংলার (বাংলা বলতে এরা শুধু কলকাতার কথাই বলেছে কারণ এদের মতে কলকাতার বাইরে আর কিছু নেই) দুর্গাপূজা র বয়স নাকি মাত্র ৫০০ বছর!!!
যেখানে পালযুগে শুরু হওয়া তিনটি হাজার বছরের বেশি সময় ধরে চলা দুর্গাপূজা আজও চলছে সগর্বে এই বাংলার বুকে, যেখানে বাংলার মাতৃকা উপাসনার ইতিহাস দুই হাজার বছরের ও বেশি, সেখানে এই অনাচার মেনে নেওয়া অসম্ভব।
🔶 বিশ্বের প্রথম দুর্গাপূজা ও রাজা সুরথ 🔶
বঙ্গাধিপতি রাজা সুরথকে চৈত্রবংশীয় রাজা (চন্দ্রের পুত্র চৈত্র র বংশধর) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে দূর্গা সপ্তশতী দেবী মাহাত্ম্য এবং মার্কণ্ডেয় পুরাণে। তিনি তার রাজ্য এবং তার সমস্ত সম্পত্তি হারান। সবকিছু হারিয়ে তিনি তার ভাগ্য ফেরাতে তার রাজধানী বলিপুর (বর্তমানে বোলপুর) ত্যাগ করেন। পরে সমাধি বৈশ্যের সাথে তার দেখা হয়। যিনি একজন বণিক ছিলেন। কাকতালীয়ভাবে তিনিও দেউলিয়া ছিলেন। কারণ তার পরিবার তার সাথে প্রতারণা করেছিল। তারপর সৌভাগ্যক্রমে তাদের সাথে মেধস মুনির সাথে দেখা হয়। তিনি তাদের ভাগ্য ফিরে পাওয়ার জন্য তাদের অবশ্যই দেবী দূর্গার পূজা করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন।
রাজা সুরথ এবং সমাধি বৈশ্য পশ্চিমবঙ্গের গড় জঙ্গলে মেধস মুনির আশ্রমে বসন্তকালে দূর্গা পূজা বা দুর্গোৎসব করেছিলেন। এটি ছিল পৃথিবীর প্রথম দূর্গাপূজা। এই উৎসবকে বলা হয় বাসন্তী পূজা বা “বসন্তকালীন দুর্গোৎসব”|
দেবী মাহাত্ম্যের ১২তম এবং ১৫তম লাইন “তত: স্বপুরমায়াতো নিজেদেশাধিপোহভবৎ” অনুসারে তিনি পশ্চিমবঙ্গের বোলপুরের বর্তমান “সুপুর” (স্বপুর) এর রাজা ছিলেন।
মার্কণ্ডেয় পুরাণে এই স্থানটির উল্লেখ আছে:
” তত: স্বপুরমায়াতো নিজেদেশাধিপোহভবৎ।
আক্রান্ত: স মহাভাগস্তৈস্তদা প্রবলারিভি:॥৭
অমাতৈ:বলিভি:দুষ্টে:দুর্বলস্য দুরাত্মভি:।
কোষ বলঞ্চাপহৃতং তাত্রাপি স্বপুরে তত:॥৮ “
বর্তমান দিনে গড় জঙ্গল পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম বর্ধমান জেলার দূর্গাপুরে । বোলপুরে তার প্রতিষ্ঠিত সুরথেশ্বর শিব মন্দির ও রয়েছে। । শ্রী শ্রী চণ্ডীর মতে, তারা এই দূর্গা প্রতিমা গড় জঙ্গলে মাটি দিয়ে তৈরি করেছিলেন । পুজোর পর সুরথ তার সমস্ত হারানো সম্পত্তি ফেরত পান এবং তিনি তার রাজধানী বলিপুরে (বর্তমানে বোলপুর) ফিরে আসেন। সুরথ বসন্তে তার রাজধানী বোলপুরে দূর্গাপুজো করেছিলেন। এই পুজোর সময় তিনি পশু বলি দেন। এই বাংলা শব্দ “বলি” (পশু বলি) থেকে, এই স্থানকে “বলিপুর” (বর্তমানে বোলপুর) বলা হয়।
[ মহামুনি মেধসের আশ্রম ]
🔶 যুগ ভিত্তিক বাংলার মা দুর্গা উপাসনা 🔶
🛑 পান্ডু রাজার ঢিবিতে প্রাপ্ত মাতৃকা মূর্তি:-
বাংলায় মাতৃকা উপাসনার প্রাচীনতম নিদর্শন হলো তাম্রযুগীয় সময়ের অর্থাৎ আজ থেকে ৪০০০ বছর আগেকার সময়ের প্রাপ্ত মাতৃকা দেবী( Mother Goddess) বা পক্ষী মাতৃকা র মূর্তি। এই মূর্তি বর্তমান পশ্চিম বর্ধমান জেলার আউসগ্রাম-২ ব্লকের পান্ডু রাজার ঢিবি অঞ্চল থেকে পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত এই দেবী ছিলেন শস্য দায়িনী এবং রক্ষাকারী দেবী। এই ধরনের মূর্তি পাওয়া গেছে ভারতের অন্যান্য বিভিন্ন অংশেও। পক্ষী মাতৃকা কে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন আজকের দিনের মা আদ্যাশক্তি র উপাসনার পূর্বসূরী বলে।
🛑 গঙ্গাঋদ্ধি যুগ(চন্দ্রকেতুগড়) :-
গঙ্গারিডাই বা গঙ্গাঋদ্ধি বা গঙ্গারাঢ়ী হল গাঙ্গেয় উপত্যকা তথা রাঢ়বঙ্গ সংলগ্ন অঞ্চলে গড়ে ওঠা সভ্যতা ও একটি সাম্রাজ্য। আলেকজান্ডার এর আক্রমণকালে তার সঙ্গে আসা ব্যক্তিত্ব রা যারা পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক লেখালেখির কাজ করেন তাঁরা এই অঞ্চলকে গঙ্গারিডাই বলে অভিহিত করেছেন।
চন্দ্রকেতুগড় এই গঙ্গাঋদ্ধি র একটি রাজধানী শহর ছিল বলে জানা যায়। চন্দ্রকেতুগড় বর্তমানে উত্তর ২৪ পরগণার বেড়চম্পা গ্রামের কাছে অবস্থিত। চন্দ্রকেতুগড় এ অবশ্য গঙ্গাঋদ্ধি যুগ ছাড়াও মৌর্য, কুষাণ, গুপ্ত এবং পাল সেন দেব যুগের ও বিভিন্ন জিনিস পাওয়া গেছে।
গঙ্গাঋদ্ধি যুগের বহু মাতৃকা মূর্তি পাওয়া গেছে চন্দ্রকেতুগড়ে পুরাতাত্ত্বিক খননকালে। মূলত মাতৃকা র ইষা ও উষা রূপের পূজা হতো তখন, মা এর সাথে মা এর দুই অনুচিকীর্ষা জয়া ও বিজয়া র ও অবস্থান দেখা যায়। এর থেকে সহজেই বলা যায় সেইসময় মাতৃকা উপাসনা চলতো এই বাংলার বুকে চলতো রমরমিয়ে, আজ থেকে আড়াই হাজার বছরের ও আগে।
🛑 মৌর্য্য যুগ:-
মৌর্য্য যুগে বাংলা ও তার আশেপাশের অঞ্চল থেকে দেবী মাতৃকা ( Mother Goddess) এর টেরাকোটা মূর্তি প্রচুর সংখ্যায় পাওয়া গেছে। এর থেকে ধারণা করা যায় এই সময়েও মাতৃকা পূজা হতো, এই মূর্তি অবশ্য পক্ষীমাতৃকার মতো নয় বরং পুর্নাবয়ব নারীমূর্তি। বর্তমানে মথুরা পুরাতাত্ত্বিক জাদুঘর এ এই ধরনের বহু মূর্তি আছে।
🛑কুষাণ যুগ:-
কুষাণ যুগ এর মহিষমর্দিনী বিভিন্ন মাতৃকা মূর্তি পাওয়া গেছে। এই মূর্তি গুলি ও টেরাকোটা মূর্তি এবং এই মূর্তি তে কোন সিংহ নেই, দেবী স্বয়ং হাঁটুর উপর একটি মহিষ কে বধ করছেন দেখা যায়, মূর্তিতে দেবীর পিছন দিকে থাকা শূল বা ত্রিশুল বিশেষ লক্ষণীয়। মনে করা হয় এই মূর্তি থেকেই মহিষমর্দিনী তথা মহিষাসুরমর্দিনী রূপ এসেছে।
🛑 গুপ্ত যুগ:-
গুপ্ত যুগেই প্রথম আজকের দিনের সিংহবাহিনী দশভূজা মায়ের মূর্তি ও ছবি খোদাই করা সিল পাওয়া যায়। গুপ্ত যুগে হিন্দু ধর্মের ব্যাপক উন্নতি হয় এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে উৎকর্ষ চরমে পৌঁছায়। বাংলার বুকে এই সময়ে প্রথম সিংহবাহিনী মাতৃকা সিল পাওয়া গিয়েছিল। সিংহবাহিনী এবং অষ্টভূজা বা দশভূজা মাতৃকা, তাঁর প্রত্যেক হাতে সজ্জিত অস্ত্র সম্ভার… মায়ের এই রূপের মূর্তি প্রথম পাওয়া যায় গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়কালেই। কৌলাচারী শাক্ত সম্প্রদায়ের প্রসার এই সময় থেকেই বৃদ্ধি পেতে থাকে।
🛑 পাল যুগ:-
পাল যুগ নিঃসন্দেহে বাংলার ইতিহাসের স্বর্ণযুগ ছিলো। সমগ্র আর্যাবর্তে সেইসময় পাল বংশের রাজত্ব ছিল, দক্ষিণ ভারতের শেষ অবধি গৌড়ীয় সেনাবাহিনী অভিযান করতো। ধর্ম চর্চায় এবং সংস্কৃতিতেও চরম উন্নতি হয় সেই সময়।
আজকের দিনে আমরা মা দুর্গার যে অসুরমর্দিনী সিংহবাহিনী দশভূজা রূপ দেখি তা মূলত পালযুগেই আসে, এই মাতৃকা দশায়ুধা মাতৃকা । সারা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত দেবীমূর্তি গুলি অধিকাংশ ই এই রকম। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য বাংলার প্রাচীনতম তিনটি দুর্গাপূজা যা আজও চলছে গত হাজার বছরের বেশি সময় ধরে সেই তিনটির ই সূচনা পালযুগে হয়। পালযুগে গৌড়ীয় সেনা দুর্গাপূজায় অংশগ্রহণ করতেন, বীরাষ্টমী তে মঙ্গল ঘটের পবিত্র জল দিয়ে পূজা করা অস্ত্র নিয়ে মায়ের আশীর্বাদ ধন্য তারা দশমীর দিন দিগ্বিজয় করতে বেরোতেন। পাল সম্রাট গৌড়েশ্বর মহীপাল শিবশক্তির সমান রূপ ঈশানচিত্রঘন্টা র উপাসক ছিলেন। মাহমুদ গজনভি কে হারিয়ে বারাণসী ধাম এ একশো মন্দির তৈরি করেন। তাঁর পুত্র গৌড়েশ্বর নয়পাল ছিলেন মাতা চামুণ্ডা বা চর্চিকার উপাসক। ” নমঃচর্চিকায়ৈ ” বলা চর্চিকা স্তব ওনার আমলেই লিখিত হয়। পালযুগে শুরু হওয়া শক্তি আরাধনা গত হাজার বছর ধরে চলছে এই ভূমিতে।
🛑 সেন যুগ:-
সেনযুগ বাংলার ইতিহাসে এক মাহেন্দ্রক্ষণ। একদিকে এসময় শুরু হয় বৈদেশিক যবন আক্রমণ যার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ তৈরি হয়, ঠিক তেমনই এই সময়ে শাক্ত সম্প্রদায়ের উপাসনা বৃদ্ধি পায় এবং কৌলাচারী শাক্ত উপাসনা চরমে পৌঁছায়। সেনযুগে মূলত তামা বা ব্রোঞ্জ দিয়ে অসাধারণ সুন্দর মাতৃকা মূর্তি তৈরি হতো। এইসময়ে সমগ্র বাংলায় দশমহাবিদ্যার চর্চা হতো প্রচুর। সেনরাজা দের মদতে তন্ত্র সাধনা হতো অভিজ্ঞ তান্ত্রিক দের দ্বারা। বাংলা তখন শাক্ত ভূমি হয়ে উঠেছিল। দশমহাবিদ্যা সংক্রান্ত বিভিন্ন পুস্তক ঐসময়ে লেখা হয়েছিল।
গৌড়েশ্বর বল্লাল সেন নিজস্ব জীবনে শাক্ত ছিলেন। তিনি প্রখ্যাত ঢাকেশ্বরী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন, যেখান থেকে আজ ঢাকা শহরের নাম এসেছে। বরেন্দ্রভূমে তিনি গৌড়চণ্ডী বা জহুরাকালী মন্দির তৈরি করান। সেন রাজাদের মদতে বিশাল করে দুর্গাপূজা হতো।
সেন যুগের পর দেব বংশীয় শাসনকাল এবং পরবর্তীকালে স্বাধীন হিন্দু রাজ্যগুলিও মা আদ্যাশক্তি মহামায়ার আরাধনা করেছেন ধুমধাম করে। এরপর আমরা বাংলার সবথেকে প্রাচীন পাঁচটি দুর্গাপূজা র কথা বলবো যেগুলি এখনও চলছে। এইরকম পূজা সারা বাংলায় বহু বহু আছে তাই এক্ষেত্রে কিছু পূজা বাদ চলে যেতে পারে, সেরকম কিছু থাকলে অবশ্যই জানাবেন।
🔶 বাংলার সর্বাপেক্ষা প্রাচীন পাঁচটি দুর্গাপূজা 🔶
🛑 মা শ্যামারূপা:-
বাংলার সর্বাধিক প্রাচীন দুর্গাপূজা যা আজও চলে আসছে তা হলো মা শ্যামারূপার পূজা।
আজ থেকে প্রায় ১১০০ বছর আগে এই পূজা শুরু করেছিলেন মহামাণ্ডলিক ঈশ্বর ঘোষ বা ইছাই ঘোষ। গৌড়েশ্বর দেবপাল পরবর্তী সময়ের পাল শাসকদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অধুনা পশ্চিম বর্ধমান জেলার দুর্গাপুর-কাঁকসা-পানাগড়-বুদবুদ বিস্তীর্ণ অঞ্চল তিনি স্বাধীনভাবে শাসন করতে থাকেন। ঢেকুরগড় নামে দুর্গ গড়ে তোলেন তিনি। দুর্গাপুর মহকুমার সমষ্টি ব্লক এর কাঁকসা থানার গড়জঙ্গল অঞ্চলে পরমশাক্ত ইছাই ঘোষ এক দেউল গড়ে তোলেন এবং সেখানে মা দুর্গার উপাসনা শুরু করেন। মা দুর্গার আশীর্বাদ ধন্য ইছাই ঘোষ অপরাজিত হয়ে ওঠেন। কথিত আছে মা দুর্গার দুটি মূর্তি তৈরি করা হয়:- একটি সোনার এবং একটি অষ্টধাতুর। অষ্টধাতুর মূর্তি নিত্য পূজা হতো এবং স্বর্ণ মূর্তি রাখা থাকতো গর্ভগৃহের ভিতর।
৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে গৌড়ের সিংহাসনে আসীন হন গৌড়েশ্বর মহীপাল। তিনি রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য প্রচেষ্টা করতে থাকেন। মহীপালের রাঢ়বঙ্গের সামন্ত এবং ধর্মমঙ্গল এর নায়ক লবসেন বা লাউসেন এর সঙ্গে ইছাই ঘোষ এর যুদ্ধ হয়। মা ভগবতীর আদেশ অমান্য করে ইছাই ঘোষ যুদ্ধে যান এবং যুদ্ধে মারা যান।
“শনিবার সপ্তমী সামনে বারবেলা।
আজি রণে যাইওনা ইছাই গােয়ালা”
ইছাই ঘোষ এর মৃত্যুর পর তাঁর পূজিত অষ্টধাতুর দুর্গামূর্তি জলে ভাসিয়ে দেন মন্দিরের পুরোহিত।
স্বর্ণমূর্তিটি পূজিত হতে থাকে অন্য মন্দিরে। বৈষ্ণব কবি জয়দেব এই মন্দিরে আসেন এবং মা দুর্গার মধ্যে শ্যাম বা শ্রীকৃষ্ণ র রূপ দেখতে পান, তখন তিনি মা এর নাম দেন ” মা শ্যামারূপা “।
পরবর্তীকালে সোনার মূর্তিটি চুরি হয়ে যায় এবং অন্য শ্বেতপাথরের মূর্তি বসানো হয়। গত প্রায় ১১০০ বছর ধরে মা শ্যামারূপার পূজা চলছে আজও। মা শ্যামারূপা অত্যন্ত জাগ্রতা, দুর্গাপূজার সময় ছোট্ট মন্দির চত্বর ভরে যায় ভক্তদের ভিড়ে। এখানে মহাষ্টমীর সন্ধিক্ষণে নাকি তোপধ্বনি শোনা যায়। এই অঞ্চলের সমস্ত দুর্গাপূজা শুরু হয় মা শ্যামারূপার পূজা শেষ হবার পরে। জনশ্রুতি অনুসারে এবং মন্দিরের পুরোহিত শ্রী ভগবত রায় ও শ্রী হরিনাভ চক্রবর্তী র মতে, একসময় দামোদর দিয়ে বজরা ভাসিয়ে যাবার সময় শ্রী ভবানী পাঠক এই মন্দিরে এসেছিলেন, বন্দেমাতরম ধ্বনিতে ধ্বনিত হয়েছিল এই অঞ্চল, দুর্গাপুর শহরের অভ্যন্তরে নাকি তার পরেই তিনি একটি কালীমন্দির তৈরি করেছিলেন।
মা শ্যামারূপা ইতিহাস, জনশ্রুতি ও লোককথা র মিশেলে এক কিংবদন্তি হয়ে অবস্থান করছেন গড়জঙ্গলের ভিতরে।
🛑 মা মৃন্ময়ী:-
মল্লভূমেশ্বরী মা মৃন্ময়ী দেবীর পূজা হল বাংলার দ্বিতীয় প্রাচীনতম দুর্গোৎসব। ২০২২ সালে এই পূজা ১০২৬ তম বর্ষে পড়ল। বিষ্ণুপুরে অবস্থিত মা মৃন্ময়ী ছিলেন মল্ল রাজবংশের কুলদেবী। ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে এই পূজা শুরু করেন মল্লভূমের ১৯ তম শাসক রাজা জগৎমল্ল।
বন বিষ্ণুপুর অঞ্চলে তখন মানুষ বলতে কিছু ছিলনা, পুরোটাই ঘন জঙ্গলে ভরা। জঙ্গলে নিজের পোষা বাজপাখি কে নিয়ে শিকার করতে এসেছিলেন রাজা জগৎমল্ল। একটি বটগাছের তলায় তিনি এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখেন:- তাঁর শিকারী বাজপাখি কে একটি বগলা বক অতি সহজেই হারিয়ে দিচ্ছে এবং বাজপাখিটি উল্টে মার খাচ্ছে। এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে তিনি অবাক হন এবং ঐ স্থানে কিছু অলৌকিক শক্তি আছে বুঝতে পারেন। তখন তিনি মায়ের আওয়াজ শুনতে পান, মায়ের আদেশে রাজা জগৎমল্ল বটগাছের পাশে মাটি খুঁড়ে মা এর একটি মুখাবয়ব খুঁজে পান এবং মাটি দিয়ে সম্পূর্ণ মূর্তি তৈরি করে প্রতিষ্ঠা করেন ” মা মৃন্ময়ী ” রূপে। তিনি মায়ের আদেশে রাজধানী বিষ্ণুপুরে স্থানান্তরিত করেন এবং জঙ্গল কেটে জনপদ তৈরি করেন। ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে আজ অবধি মা মৃন্ময়ী র পূজা চলে আসছে। মা মৃন্ময়ীর আশীর্বাদে মল্লরাজারা বারবার বৈদেশিক শক্তির বিরুদ্ধে কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।
মা মৃন্ময়ীর পূজার কিছু বিশেষ নিয়মাবলী আছে। রাজবাড়ীর পুজোয় মা মৃন্ময়ী ছাড়াও বড় ঠাকুরণ বা বড়মা, মেজ ঠাকুরণ বা মেজমা ও ছোট ঠাকুরণ বা ছোটমা আছেন:- এনারা হলেন যথাক্রমে মা মহাকালী, মা মহালক্ষ্মী ও মা মহাসরস্বতী। প্রাচীন রীতি মেনে এই তিনজনের কোন প্রতিমা হয়না বরং পটচিত্রে পুজো হয়ে থাকে। পূজা শুরু হয় জীমূতবাহনের ব্রত বা জীতাষ্টমীর পরের দিন থেকে। কৃষ্ণানবমীর দিন অর্থাৎ নবম্যাদি কল্প থেকে বড় ঠাকুরাণী অর্থাৎ দেবী মহাকালীর পুজো শুরু হয়। এদিন সকালে রাজবাড়ি সংলগ্ন গোপাল সায়রে বড়ঠাকুরাণীর পটের স্নান পর্ব শেষে মন্দিরে প্রবেশের পর প্রথানুযায়ী তিন বার মূর্চ্ছা পাহাড়ে কামানের তোপধ্বনি দেওয়া হয়। পরে গর্ভগৃহে প্রবেশের মুহূর্তেও তোপধ্বনি দেওয়া হয়।
পরে দেবীকে অন্নভোগ নিবেদনের সময় আরো তিনবার কামানের তোপধ্বনি দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে বড় ঠাকুরাণীর পুজোর দিন থেকেই মল্ল রাজাদের প্রাচীন এই রাজধানীতে শারদোৎসবের সূচনা হয়। দেবী পক্ষের চতুর্থীর দিন থেকে রাজপরিবারের মেজ ঠাকরুন অর্থাৎ দেবী মহালক্ষী ও সপ্তমীর দিন থেকে ছোটো ঠাকরণী অর্থাৎ দেবী মহাসরস্বতীর পুজো শুরু হয়। বড়, মেজো ও ছোটো ঠাকরুণী এই তিনজনকেই দেবী মহামায়ার রূপ হিসেবে মল্লরাজাদের হস্ত লিখিত বলীনারায়নী পুঁথি অনুযায়ী পূজা করা হয়। মহানবমীর পুজো এখানে বিশেষ প্রাধান্য পায়। কাকপক্ষীতেও টের পাবে না এভাবে মায়ের ঘট এনে পুজো করা হয়।’ পরিবারের সদস্যরা ধারাবাহিকতা মেনে আজও প্রতি বছর বড় ঠাকুরাণী, মেজ ঠাকুরাণী ও ছোটো ঠাকুরাণীর আলাদা-আলাদা তিনটি পট আঁকেন। মন্দিরে দেবী মৃন্ময়ী প্রতিমার পাশেই নির্দিষ্ট জায়গায় এই তিনটি পট রেখে পুজো হয়। দশমীর দিন প্রাচীন নিয়মানুসারে নীলকন্ঠ পাখি উড়িয়ে দেন মল্ল রাজবংশের বর্তমান প্রজন্মের সদস্যরা। লোককথায় বলা হয়:- ” মল্লে রা, শিখরে পা “।
মল্ল রাজবংশের প্রত্যক্ষ শাসন ১৭৬১ সালে শেষ হয়ে গেলেও মা মৃন্ময়ী র পুজো কে কেন্দ্র করে সমগ্র অঞ্চল যেন ফিরে যায় মল্ল রাজবংশের শ্রেষ্ঠ সময়ে। অন্যান্য পুজো কালিকাপূরাণ মতে হলেও এই রাজ্যে একমাত্র বিষ্ণুপুর রাজ পরিবারে বলিনারায়ণী মতে দুর্গাপূজা হয় বলে দাবী করা হয় । একসময় এখানে পূজোয় বলি প্রথা চালু থাকলেও মহারাজা বীর হাম্বির মল্ল বৈষ্ণব মতে দীক্ষা নেওয়ার পর চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় বলি প্রথা। সারা বছরের পাশাপাশি পুজোর এই দিন গুলিতে মন্দির নগরীতে বিষ্ণুপুরে পর্যটকদের ঢল নামে। প্রাচীন ঐতিহ্য আর পরম্পরার সাক্ষী থাকতে আজও জেলা, রাজ্য, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশ থেকেও প্রচুর মানুষ ভীড় করেন। সব মিলিয়ে মল্লরাজারাদের রাজত্ব না থাকলেও তাদের কীর্তির জেরে বিষ্ণুপুর আছে বিষ্ণুপুরেই।
🛑 মালদার মা সিদ্ধেশ্বরী:-
পুরাতন মালদার সাহাপুর পঞ্চায়েত এর নাগেশ্বরপুর এলাকার সুকুল রাজবাড়ির পূজা এই বছর পড়লো ৯৯০ তম বর্ষে। দেবী এখানে মা সিদ্ধেশ্বরী বা বড় ঠাকুরণ নামে অত্যন্ত প্রসিদ্ধ।
রাজবাড়ীর বর্তমান প্রজন্ম শ্যামল কুমার সুকুলের মতে তাঁদের পারিবারিক নথি অনুযায়ী মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই পূজা শুরু করেন শ্রী ধুরন্ধর সুকুল এবং বংশধর সুকুল নামের দুই ভাই যাঁরা সেই সময়ে সামন্ত জমিদার ছিলেন। প্রায় ৫০০ বছর আগে তাঁদের উত্তরপুরুষেরা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় । এক ভাগ চলে আসে অবিভক্ত বাংলাদেশের রাজশাহীতে । সেখানকার জমিদারি পায় পরিবারের সেই অংশ । তখন থেকে দু’জায়গাতেই এই পুজো হত । বাংলাদেশ থেকে তাঁদের পূর্বপুরুষরা প্রায় ৭০ বছর আগে পুরাতন মালদার সাহাপুরে চলে আসেন । তখন থেকে পারিবারিক পুজো এখানে চলে আসে । বংশ ভাগ হতে থাকলেও পারিবারিক এই পুজোয় কখনও ছেদ পড়েনি।
প্রাচীন রীতি অনুযায়ী কৃষ্ণা নবমী তিথি থেকে এই পুজো শুরু হয়, চলে দুই সপ্তাহ ধরে। মহালয়ার দিন বড় ও মেজো ঠাকুরণের পুজো হয় । পঞ্চমীর দিন বেদিতে মা-কে তোলা হয় । প্রতিপদের দিন লাল শাক ও ঘি মাখানো রুটি দিয়ে মা-কে ভোগ দেওয়া হয় । তৃতীয়াতে পাঁচ হাঁড়ি ভাত ও পাঁচ হাঁড়ি ডাল তৈরি করে মা-কে পঞ্চসতীর ভোগ নিবেদন করা হয় । এই পুজোয় বলি প্রথা চালু রয়েছে। সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত বলি হয় । তবে দু’বছর আগে মোষ বলি বন্ধ হয়েছে । মোষের পরিবর্তে এখন পাঁঠা ও চালকুমড়ো বলি দেওয়া হয় । এই পুজোয় নিরঞ্জন নেই । মা এখানে পাষাণী রূপে পূজিত হন । দশমীতে নদীতে গিয়ে তিনি নারায়ণী রূপ পান । তাই পাষাণী মা-কে ঘুঁটের ধোঁয়া আর লণ্ঠনের আলো দিয়ে বিদায় দেওয়া হয় । গ্রামের মানুষজন নদীতে প্রদীপ জ্বালায় । বড় ঠাকুরণ এখানে ঘোরাঘুরি করার জন্য এই এলাকায় কোনও অপঘাতে মৃত্যু হয় না কিংবা কেউ কঠিন রোগে আক্রান্ত হয় না ।
সুকুল পরিবার সূত্রে জানা গেছে, প্রতিপদের দিন এখানে দেবীকে ৫৫ প্রকারের ভোগ নিবেদন করা হয় । দ্বিতীয়াতে ফল নৈবেদ্য, তৃতীয়াতে অন্নভোগ, চতুর্থীতে দেবীকে দুগ্ধ স্নান করানো হয় । পঞ্চমীতে মূল পুজোর আয়োজন শুরু হয় । মহাষষ্ঠী তিথিতে ফল নৈবেদ্য নিবেদন করে সপ্তমীর সকালে দেবীকে কচুর শাক, ডাল, আলু সিদ্ধ ও খুদের ভাত দেওয়া হয় । রাতে ছাগল বলির পর দেবীকে মাছ ও মাংসের ভোগ দেওয়া হয় । মহাষ্টমীতেও একাধিক বলির পর দেবীকে মাছ ও মাংসের ভোগ নিবেদন করা হয় । নবমীতেও সেই ভোগের ব্যতিক্রম হয় না । দশমীতে মাছ-মাংসের ভোগ নিবেদনের পর লণ্ঠন-মশালের আলোয় পথ দেখিয়ে ও ঘুঁটের ধোঁয়া দিয়ে দেবীকে মহানন্দার ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয় ।
মা সিদ্ধেশ্বরী অত্যন্ত জাগ্রত এবং বলা হয় তাঁর কাছে কিছু চাইলে সর্বদা তা পাওয়া যায়। এমনকি মা বিভিন্ন রূপে বোধনের দিন দেখা দেন বলে জানা যায়। মাত্র দশ বছর পর এই পুজোর এক সহস্রাব্দ পূর্ণ হতে চলেছে।
🛑 মা কল্যাণেশ্বরী ও মা রাজরাজেশ্বরী:-
বরাকর নদের তীরে পশ্চিমবঙ্গ ঝাড়খণ্ড সীমান্তে আসানসোল সদর সাবডিভিশনে অবস্থিত মা কল্যাণেশ্বরী র মন্দিরের বয়স ৮০০ বছরেরও বেশি। এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন শিখরভূমের শাসক মহারাজা কল্যাণ শেখর। মা কল্যাণেশ্বরী অত্যন্ত জাগ্রত এবং বহু বহু মানুষ প্রতিদিন এখানে আসেন পুজো দিতে। এই মন্দিরে সন্তানহীনা নারীরা বটগাছে পাথর বেঁধে মানত করলে তা পূর্ণ হয়।
মা রাজরাজেশ্বরী দেবী রাঢ়বঙ্গের প্রখ্যাত শিখরভূম রাজবংশের কুলদেবী। এই পূজার ও বয়স ৮০০ বছরেরও বেশি। রাজপরিবারের মতানুসারে এই পূজা শুরু করেছিলেন মহারাজা কল্যাণ শেখর। সেই থেকে চলে আসছে কাশীপুর রাজ পরিবারের (শিখরভূমের বর্তমান প্রজন্ম) শ্রী শ্রী রাজ রাজেশ্বরী মাতার পুজো। তবে সেকালের মতো জাঁকজমক না হলেও সেই নিয়ম রীতি মেনে আজও চলে আসছে এই পুজো। বর্তমানে কাশীপুরের রাজ পরিবারের সদস্যরা এই পুজো চালিয়ে যাচ্ছেন। শ্রীরামচন্দ্রের করা ষোড়শ কল্প নিয়ম মেনে এই রাজ রাজেশ্বরী মাতার পুজো হয় ১৬ দিন ধরে। কাশীপুর রাজপরিবারের কুলদেবী এখানে অষ্টধাতুর তৈরি। কাশীপুর রাজ পরিবারের এই পুজো দেখতে বহু মানুষ আসেন। এবারও প্রাচীন প্রথা মেনে থালায় সিঁদুর রাখা হবে বন্ধ ঘরে, জানিয়েছেন কাশীপুর রাজ পরিবারের সদস্য শ্রী সমেশ্বরলাল সিংদেও।
ইতিহাসে মহারাজা কল্যাণ শেখর বরাকর নদের তীরে অবস্থিত মা কল্যাণেশ্বরী মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য এবং শিখরভূমের কুলদেবী মা রাজরাজেশ্বরীর প্রতিষ্ঠার জন্য পরিচিত। তাঁর সময়কাল নিয়ে সামান্য কিছু দ্বিমত আছে ঐতিহাসিকদের মধ্যে এবং তাঁর দুই দেবী প্রতিষ্ঠা নিয়েও দুটি মত বর্তমান।
প্রথমটি হল:- মহারাজা কল্যাণ শেখর এর সাথে গৌড়েশ্বর বল্লাল সেনের কনিষ্ঠা কন্যা সাধনার বিবাহ হয়। তিনি যৌতুক রূপে সেনবংশে পূজিতা মা শ্যামারূপা (যা ছিল ইছাই ঘোষ দ্বারা পূজিত) র মূর্তি, দেবীর তরোয়াল এবং কালো ঘোড়া পান। এই দেবীমূর্তিকে তিনি বরাকর নদের তীরে চাল্লাদহ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং তাঁর নামে নাম হয় মা কল্যাণেশ্বরী। পরবর্তী কালে তিনি স্বপ্নাদেশ পান এবং মা শ্যামারূপার অনুরূপ অষ্টধাতু চতুর্ভূজা মূর্তি শিখরভূম রাজবংশে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং মা রাজরাজেশ্বরী নামে পূজিতা হতে থাকেন। এই মত মূলত কাশীপুর রাজবাড়ী (শিখরভূমের বর্তমান প্রজন্ম) র সদস্যদের দেওয়া।
দ্বিতীয় মত টি হল:- ১২০৩এ বখতিয়ার প্রথম আক্রমণ করে সেনভূম অর্থাৎ কাঁকসা গড় অঞ্চলে। কাঁকসার শাসক তখন মহারাজা কঙ্ক সেনরায়, তাঁর পুত্র কনক সেনরায় স্থানীয় লোকদের নিয়ে একটি বাহিনী তৈরি করেন এবং “জয় কঙ্কেশ্বর মহাদেবের জয়” রণধ্বনি দিয়ে যুদ্ধে নামেন। সম্মুখযুদ্ধে কনক সেনরায় বখতিয়ারের সেনাপতি সৈয়দ বুখারীকে পরাজিত ও হত্যা করেন। এইসময় হঠাৎ বখতিয়ার পিছন থেকে কাঁকসা গড়ে আক্রমণ করে, বৃদ্ধ কঙ্ক সেনরায় অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে প্রতিরোধ করতে গিয়ে মারা যান, কাঁকসা গড় ধ্বংস হয়। এই সময় কনক সেনরায় পার্শ্ববর্তী মিত্র রাজ্য ভাল্কিতে আশ্রয় নেন এবং কঙ্ক সেনরায়ের কন্যা মা শ্যামারূপা ( ইছাই ঘোষ দ্বারা পূজিত) র মূর্তি নিয়ে বরাকরের জলে ঝাঁপ দেন। এই রাজকন্যাকে মহারাজা কল্যাণ শেখর উদ্ধার করেন ও তাঁর পাণিগ্রহণ করেন। এরপর বরাকরের তীরে মা কল্যাণেশ্বরী রূপে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী কালে স্বপ্নাদেশ পেয়ে নিজ রাজ্যে মা রাজরাজেশ্বরীর প্রতিষ্ঠা করেন।…..এই লোককথা টি গোপভূমের মানুষের মুখে বহুল প্রচলিত।
প্রকৃত ঘটনা যাই হয়ে থাক না কেন এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে মায়ের পূজা চলছে গত ৮০০ বছরের বেশি সময় ধরে।
🛑 মা শিবাখ্যা:-
রাঢ়বঙ্গের গোপভূম ভাল্কি রাজ্যের কুলদেবী মা শিবাখ্যার পূজা চলছে গত প্রায় ৭০০ বছর ধরে। চতুর্দশ শতাব্দীর দ্বিতীয় বা তৃতীয় দশকে এই পূজা শুরু করেছিলেন ভাল্কি রাজ্যের শ্রেষ্ঠ শাসক মহারাজা মহেন্দ্র সিংহ। মায়ের বর্তমান মন্দির পশ্চিম বর্ধমান জেলার আউশগ্রামের অমরার গড় গ্রামে অবস্থিত।
১০৩৪ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন রাজ্য গোপভূম প্রতিষ্ঠা করেন রাজা রাঘব সিংহ ভল্লুপাদ। তাঁর প্রপৌত্র ছিলেন মহারাজা মহেন্দ্র সিংহ। স্বপ্নাদেশ পেয়ে মহারাজা মহেন্দ্র সিংহ খাজুরডিহির উগ্রক্ষত্রিয় জমিদার জগত সিংহকে পরাজিত করে তাঁর পূজিত দশভূজা দনুজমর্দিনী দেবীকে নিয়ে চলে আসেন তাঁর অমরার গড়ে এবং ” মা শিবাখ্যা ” নামে প্রতিষ্ঠিত করেন। মায়ের আশীর্বাদে চতুর্দশ শতাব্দীর সমগ্র বাংলা জুড়ে তৈরি হওয়া যবন শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের রাঢ়বঙ্গের নেতৃত্ব দেন তিনি। অধুনা পানাগড় বুদবুদ থেকে জামতাড়া অবধি তাঁর রাজ্য বিস্তৃত ছিল। এই বংশেরই বংশধর রাজা বৈদ্যনাথ নিয়োগী বর্গী আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন শিখরভূমের সাথে। বৈদ্যনাথ বর্গীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বীরগতি প্রাপ্ত হবার পর বর্ধমান রাজের আক্রমণে এই রাজত্ব ভেঙে পড়ে।
আজ ভগ্ন অমরার গড় রাজবাড়ী ছাড়া আর কিছুই নেই। তালপাতা ও হোগলাপাতার ছাউনিতে পরবর্তীকালে শিবাখ্যার পুজো হত। রাজার বংশধররা পালা করে পুজোর দায়িত্ব নেন। সম্প্রতি গ্রামের বাসিন্দাদের উদ্যোগে কংক্রিটের মন্দির তৈরি হয়েছে। তবে রাজবাড়ির এই পুজো এখন কার্যত সর্বজনীন হয়ে উঠেছে। মহালয়ার এক সপ্তাহ আগেই শিবাখ্যাদেবীর পুজো শুরু হয়ে যায়। পুজোর সময় পরিবারের কোন মহিলা পায়ে আলতা পরতে পারেন না। শাক্তমতে পুজো হয়। দেবীকে দুধ-পাটালি দিয়ে নিত্যসেবা দেওয়া হয়। পুজোর বিশেষ আকর্ষণ দেবীর পরিক্রমা। নবমীতে ব্রাহ্মণরা দেবীকে মন্দির থেকে বের করেন। তার পর প্রতিমা কোলে নিয়ে ছাতা মাথায় দিয়ে গ্রাম পরিক্রমায় বের হন। পুরো গ্রাম ঘোরানো হয় শিবাখ্যাকে। গ্রামের উত্তরপাড়ায় তিন মাথার মোড়ে রায়বাড়ির মন্দিরে দেবীকে রাখা হয়। সেখানেই হয় বলিদান পর্ব। নবমীর পুজোর পরে দেবীকে আবার নিয়ে আসা হয় মূল মন্দিরে। শিবাখ্যার দর্শনে হাজার হাজার মানুষ হাজির হন অমরারগড়ে।
উপরিউক্ত যুগ ভিত্তিক আলোচনা এবং বাংলার প্রাচীনতম পাঁচটি দুর্গাপূজার কথা থেকে এটি অত্যন্ত স্পষ্ট যে বাংলার দুর্গাপূজা ৫০০ বছর আগে জমিদারদের শুরু করা কোন অনুষ্ঠান নয়, কোন আকস্মিক উৎসব নয়, দুর্গাপূজার শিকড় বাঙ্গালী জাতির হৃদমাঝারে। তাই সমস্ত রকম ৫০০ বছরের প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে গর্জে উঠুন এবং বাঙ্গালী জাতির সর্ববৃহৎ আরাধনা তথা উৎসবে সামিল হোন।
।। যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।।
।। ওঁ নমশ্চচণ্ডীকায়ৈ।।
(লেখক পরিচিতি: পদার্থবিদ্যা স্নাতক, সঠিক ইতিহাস সন্ধানী ও প্রচারক, চরমপন্থী জাতীয়তাবাদী, শক্তিচর্চায় নিবেদিত এক বাঙ্গালী যুবক)
Comment here