সংস্কৃতিসাদাকালো রঙমাখাস্বভূমি ও সমকাল

চড়ুইভাতি

সুকান্ত সেতুর উপর যাদবপুর স্টেশন স্টপেজে নেমে রোজকার মত আজও সুলেখাগামী বাসটা ছেড়ে দেওয়া অব্দি অপেক্ষা করলাম। এই সময় ব্রিজের উপর যান চলাচল মোটামুটি কমই থাকে। রেলিংয়ে হেলান দিয়ে মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে থাকলাম, উল্টোদিকের পানে তাকিয়ে। আপের ট্রেনটার বেরিয়ে যাওয়ার আওয়াজে সম্বিত ফিরল, কিন্তু দৃষ্টি তখনও রোজকার মত খুঁজছে,অন্য কিছুকে।
– “কি হল?রোজ কি দেখোএইরকম করে?”
– “কিছু না তো!”
– “তাহলে চলো। আরেকটু পরেই তো সকালের বাস ধরতে হবে।”
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে প্রসারিত হাতখানায় নিজেরটা জমা দিয়ে পা বাড়ালাম রাতের আস্তানার উদ্দেশ্যে। সে তো দিব্যি মানিয়ে নিয়েছে এই ব্যাস্ত জীবনের সাথে নিজেকে। আমার মনটাই খালি খুঁজে বেড়ায় একটু ফাঁক, একটু ফোঁকর। একঘেঁয়ে ব্যাস্ত জীবন যেন রোজ খোঁজে সারা বছরের অপেক্ষার সেই শীতের চড়ুইভাতি।

কলকাতায় প্রথম শীতে বেড়াতে গেলাম মায়াপুর। নৌকা এসে পৌঁছল সাদা কালো জলস্রোতের মিলনস্থলে। যথারীতি অত্যুতসাহী উঁকিঝুঁকি শুরু হয়ে গেলো সেই প্রাকৃতিক আশ্চর্য দেখার জন্য। অভিভাবকদের ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের সতর্কবাণীও আসতে লাগলো সাবধানে উঁকি মারার কথা মনে করিয়ে দিয়ে। স্থান কাল পাত্র বদলালেও জল হইতে সাবধানের এই বাণী কিন্তু চিরাচরিত। অনেক ছোটবেলায় একবার এইরকমই এক ধূসর শীতের সকালে সবাই মিলে গেছিলাম পিকনিকে, লোহাগড়ে। আদতে চা বাগান, পিকনিক স্পটটা মেচি নদীর পাড়ে। সেইবার প্রথম এক কাকুর কাছে গল্প শুনেছিলাম যে পাহাড়ি নদী যেমন সুন্দর, তেমনই ভয়ঙ্কর। মায়ায় ভুলিয়ে ডেকে নিয়ে গিয়ে হঠাৎ সর্বনাশা রূপ ধারণ করে নিজের সাথে টেনে নিয়ে চলে যায়। কাকুর ছেলেকে অনেক খোঁজা হয়েছিল।

কলেজের শেষ বছরে ঠিক হল পিকনিক ভালো একটা কোথাও করতে হবে। দুধিয়া, রোহিণী, সেবক, কালিঝোরা, চালসা মেটেলি, লাটাগুড়ি, রকি আইল্যান্ড, আমবাড়ী, গজলডোবা সব পুরনো হয়ে গেছে। অতএব সবাই মিলে বাসে করে চললাম ত্রিবেণী। কালিম্পং পাহাড়ের কোলে। কালিম্পং আলাদা জেলা হয়নি তখনও। চারপাশে উঁচুনিচু ঘন সবুজের সমারোহ। তার বুক চিরে দার্জিলিঙ পাহাড় থেকে রঙ্গীত এসে মিলিত হয়েছে তিস্তার সাথে। রূপালী সাদা বালুচরের বুকে দুই নদীর মিলনের তরঙ্গ জোড়ায় জোড়ায় মনে দোলা জাগালেও একজোড়া মনের মিলন ঘটাতে সক্ষম হলনা। চার বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের শেষে ব্যর্থ মনোরথে আমাদের ফিল্মের বীরু বেচারা জলের ট্যাঙ্কের অভাবে অগত্যা মাঝ নদীকেই অবলম্বন করলো।বলাই বাহুল্যতার পিছন পিছনএকাধিক জয়কে উদ্ধারকার্যে নামতে হল, কারণ বাসন্তিকে যে আজও কিছুতেই রাজি করানো গেল না…

ভালো পিকনিক করার নেশা এমন নেশা, কুচবিহার দিনহাটা আলিপুরদুয়ারের মানুষ এসে উপস্থিত হয় সেবক পাহাড়ে আর শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ির মানুষ গিয়ে উপস্থিত হয় জয়ন্তী নদীর ধারে। কে কতদূর পিকনিকে গেলো এইটাই ছিল এক সময়ের একটা জবরদস্ত প্রতিযোগিতা। পিকনিকে গিয়ে রোমাঞ্চকর ঘটনার সাক্ষী হওয়াও ছিল আরেক মজার প্রতিযোগিতা। একবার বাবার কর্মস্থলের বার্ষিক পিকনিকে যাওয়া হল রোহিণী। এলাকায় হাতির উপদ্রব লেগেই থাকে। সেই সূত্রেই হাতির পাল্লায় পড়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে নানান রোমাঞ্চকর গল্প হচ্ছে, হঠাৎ এক কাকু হন্তদন্ত হয়ে এসে জানালো যে একটু দূরেই শিমূলবনের কাছে হাতির পা দেখা গেছে। অন্য পিকনিক পার্টির কেউ খবর দিয়েছে। আর সেকি উত্তেজনা! সবাই মিলে পড়িমরি করে ছুটলাম হাতি দেখতে। গিয়ে দেখি হাতি তো দূরঅস্ত, হাতির ল্যাজটিরও দেখা নাই। অমনি খোঁজ পড়ল সেই ব্যাক্তির। তিনি হাসি হাসি মুখ করে আমাদের নিয়ে গেলেন একটি বৃহৎ শিমূলগাছের তলায়। একদম গাইড সুলভ ভঙ্গিতে দেখালেন, “ঐ দ্যাখেন, কত্ত বড় হাতির পায়ের ছাপ! কালকে রাত্রেই আসছিল।” উত্তরবঙ্গে পর্যটকরা এই সমস্ত জায়গাগুলোকে ছোটখাটো ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে চেনে। উত্তরের মানুষ চেনে তাদের নানান রঙ্গীন কীর্তির ইতিহাসমণ্ডিত একেকটা পিকনিক স্পট হিসেবে।

সেবক পাহাড় যেইখানে সমতলে এসে মিশেছে, সেবক রেল ব্রিজের তলায় তিস্তা নদীর ধার ঘেঁষে পিকনিক স্পট। তিস্তার চরের সাদা বালির বীচ। নীলচে সবুজ জল এইখানে অপেক্ষাকৃত শান্ত। যেন আপাত শান্ত বঙ্গোপসাগর।কেউ বোধয় ভালোবেসে নাম দিয়েছিল আন্দামান আইল্যান্ড। বারো ক্লাসে পড়তে মামাতো মাসতুতো ভাইবোনেরা মিলে গেছিলাম একবার পিকনিকে। কেরিয়ার গড়ার একঘেঁয়ে চাপের মধ্যে ছোট্ট একটু ফাঁকি। এক বেলার চড়ুইভাতি। নদীর চরেপড়ে থাকা গাছের গুঁড়ির উপর বসে জলে পা চুবিয়ে চলছে আড্ডা।“এই তো আর কয়টা দিন তোর। তারপর তো এইসব ছেড়ে অন্য কোনো ‘বেটার’ জায়গার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিতে হবে। আমাদের এইখানে এর পরে আর কীই বা আছে?”

সেদিন সবুজ বন পাহাড়ে ঢাকা মা সেবকেশ্বরীর মন্দিরের পানে চেয়ে পড়ন্ত বেলার সোনালী রঙে রাঙ্গানো তিস্তাকে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যে এই ভূস্বর্গ ছেড়ে কোথাও যাবোনা। কোত্থাও। পরবর্তী চারটা বছর সেই প্রতিজ্ঞা অটুট রাখতে পেরেছিলাম। তারপর থেকে চলছে চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যেকার অনাদি অনন্ত সেই দ্বন্দ্ব। আজও…

Comment here