আঙিনাশক্তিচর্চাশাশ্বত সনাতন

সরলা – বাঙ্গালীর ক্ষাত্রশক্তির বিস্মৃত দেবী

– শ্রী সৌগত বসু

 

১৯১১ সালের ২৯শে জুলাই খাঁটি ভারতীয়দের ফুটবল দল হিসেবে মোহনবাগান যখন প্রথম “আই-এফ-এ শিল্ড” জিতল – টানা কয়েক শতাব্দী যাবৎ অত্যাচারিত, অবহেলিত পরাধীন ভারতবাসীর জন্য সেই জয় নিছক ফুটবল খেলায় জেতা ছিল না। সে ছিল দোর্দণ্ডপ্রতাপ বিদেশী শাসকের বিরুদ্ধে যেন এক যুদ্ধ জেতার সামিল। টানা কয়েক’শ বছর পরাধীন। যার মধ্যে শেষ প্রায় দেড়’শ বছর আবার তাদেরই শাসন ক্ষমতার মুঠোয় থাকা একটা দেশের প্রায় হীনবল হয়ে যাওয়া একটা জাত। তাদেরই ছেলেদের নিয়ে গড়া একটা দল – খেলার মাঠে হলেও সেই তারাই একের পর এক শক্তিশালী ব্রিটিশ দলকে পর্যদুস্ত করে শেষ পর্যন্ত্য শিরোপা জিতে নিচ্ছে।

প্রবল পরাক্রমী ব্রিটিশদের জন্য খুব স্বাভাবিক ভাবেই এমন ঘটনাক্রম ছিল সীমাহীন গ্লানির। আর হতাশারও। অন্যদিকে দীর্ঘ পরাধীনতার কারণে অত্যাচারে, অপমানে, অবহেলার গ্লানিতে জর্জরিত আর তাতেই অভ্যস্ত হয়ে ওঠা এই ভারতভূমির সন্তানদের জন্য প্রবল পরাক্রমী শাসকের বিরুদ্ধে কোনও লড়াইতে এমন নির্ণায়ক জয়ের গৌরব উদযাপন করার মতন ঘটনা এর আগে খুব একটা ঘটে নি। তখন এমন একটা সময় – যার বছর ছ’য়েক আগে ১৯০৫-এর ১৬ই অক্টোবর লাগু হয়েছে সেই বছরেরই ৭ই জুলাই ঘোষণা করা তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের ফরমান। ১৯০২-তে অনুশীলন সমিতি, ১৯০৬-এ যুগান্তর, তারও আগে শুরু হওয়া আত্মোন্নতি সমিতির মতন শাক্ত ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ বাঙ্গালী সংগঠনগুলোর চরমতম আত্মত্যাগের অজস্র উদাহরণ তৈরী করা প্রবল স্বদেশী আন্দোলনে তখন উত্তাল পূর্ব সীমান্তের চট্টগ্রাম থেকে একেবারে পশ্চিমের মানভূম, সাঁওতাল পরগনা ছাড়িয়ে গোটা বাংলা। তখনকার ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী শহর কলকাতা যার ভরকেন্দ্র। সেই আন্দোলনও তখন চরমে। যে আন্দোলনের উত্তাপ বাংলার সীমা ছাড়িয়ে পৌঁছে গিয়েছিল আসমুদ্রহিমাচল ভারতভূমির সব প্রান্তে। যে আন্দোলনের অভিঘাতে ১৯১১-র ১২ই ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গের ফরমান প্রত্যাহার করে শেষ পর্যন্ত্য পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল প্রবল প্রতাপী ব্রিটিশ সরকার। যদিও কলকাতা থেকে তাদের রাজধানী সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল দিল্লীতে। আর সেই কারণেই বাধ্য হয়েছিল প্রাচীন দিল্লী শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে মোটামুটি ৩ মাইল দক্ষিণে ‘নতুন দিল্লী’ তৈরী করতে।

এ দেশে এসে যার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের তৎকালীন রাজা পঞ্চম জর্জ। স্বাভাবিক ভাবেই এমন একটা আবহে বাঙ্গালী তথা ভারতীয়দের মালিকানা আর পরিচালনায় চলত এমন প্রায় সবকটা খবরের কাগজ, পত্র পত্রিকাগুলো খাঁটি স্বদেশী দল মোহনবাগানের এই জয় নিয়ে ছিল ভীষণ উচ্ছাস্বিত। যদিও বলাই বাহুল্য, এ দেশ থেকে প্রকাশিত ইউরোপিয়ান, মূলত ব্রিটিশদের পরিচালিত পত্র পত্রিকাগুলোর পাশাপাশি বিলেতের কাগজগুলোও নিজেদের এমন হেরে যাওয়া সহজে মেনে নিতে পারেনি। তা সত্ত্বেও সাংবাদিকতার দায়িত্ব আর মর্যাদা রক্ষার্থে নিজেদের পরাজয়ের এই সংবাদ পুরোপুরি উপেক্ষা করে তার থেকে মুখ ফিরিয়েও থাকতে পারে নি। এ নিয়ে তাদের প্রায় সবার অবস্থান ছিল খানিকটা “ধরি মাছ, না ছুঁই পানি” মার্কা।

তবে ঐ সময়ের বিরল ব্যতিক্রম বোধ হয় ছিলেন একজন – স্যামুয়েল কেরখাম র‍্যাটক্লিফ। যিনি নিজেও জন্মসূত্রে একজন ব্রিটিশ। ১৯০২ থেকে ১৯০৭ পর্যন্ত্য যিনি ছিলেন শহর কলকাতারই বাসিন্দা। আর কলকাতা থেকেই প্রকাশিত, মূলত ব্রিটিশরাজের ধামাধারী বলে সেইসময়ে বিশেষ ভাবে পরিচিত ইংরেজী সংবাদপত্র “দ্য স্টেটসম্যান”-এর “ভারতীয়দের প্রতি সহানুভূতিশীল” এক ব্যতিক্রমী সম্পাদক। যদিও ১৯১১-তে মোহনবাগান যখন শিল্ড জিতছে তিনি তখন বিলেতে। সেখানকার বিখ্যাত সংবাদপত্র “দ্য ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান”-এর সম্পাদকের দায়িত্বে। বছর চারেক আগে কলকাতা থেকে প্রায় বাধ্য হয়েই সস্ত্রীক র‍্যাটক্লিফ ফিরে গিয়েছেন তাঁর নিজের দেশে। আর খোদ বিলেতের মাটি থেকেই মোহনবাগানের শিল্ড জয়ের খবর আর বাঙ্গালী তথা ভারতীয়দের কাছে সেই জয়ের গুরুত্ব “ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান”-এর পাতায় অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে তিনি ছাপালেন। সেই সঙ্গে তাঁর খবরের কাগজে এ কথাও স্যামুয়েল র‍্যাটক্লিফ লিখলেন – “আমরা জানি এ ঘটনায় সবচেয়ে বেশি আনন্দিত যিনি হবেন তিনি হচ্ছেন – সরলা দেবী – বাঙলার এক নন্দিনী।”

যখন এ যুগেও সার্বিক ভাবে ভারতীয় তথা বাঙ্গালী মেয়েদের মধ্যে খেলা হিসেবে ফুটবল নিয়ে উৎসাহ খুব একটা বলার মতন নয় – তখন আজ থেকে এক’শ বছরেরও বেশি সময় আগে, বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সুদূর বিলেতবাসী ব্রিটিশ সংবাদপত্র সম্পাদকের মনে হচ্ছে তাবড় ব্রিটিশ দলগুলোকে নাস্তানাবুদ করে তাদের স্বজাতিদের নিয়ে গড়া একটা দল ফুটবল খেলায় জিতে যাওয়ার কারণে সব থেকে বেশি আনন্দিত হবেন চরম রক্ষণশীল বাঙ্গালী সমাজের এক কন্যা। যদিও র‍্যাটক্লিফ জানতেন মোহনবাগানের শিল্ড বিজয়ী দলের সাথে কোনও প্রত্যক্ষ যোগাযোগ সরলা দেবীর কখনই ছিল না। তার থেকেও বড় কথা মোহনবাগান সে’বছর যখন প্রথম শিল্ড জিতল তার বছর ছ’য়েক আগে থেকেই তিনি বিবাহ সূত্রে কলকাতা থেকে বহুদূরে, সুদূর পঞ্জাবের লাহোর শহরের বাসিন্দা। আসলে যে বছর পাঁচেক র‍্যাটক্লিফ কলকাতায় ছিলেন মাঝে মধ্যেই ডিনারে, বিভিন্ন পার্টিতে তার সাথে দেখা হতো সরলা দেবীর। তাঁর কার্যকলাপও মোটেই অজানা ছিল না স্যামুয়েল র‍্যাটক্লিফের। যা নিয়ে তাঁদের মধ্যে খোলাখুলি অনেক আলোচনাও হতো। আর সেকারণেই সুপন্ডিত ও দূরদর্শী র‍্যাটক্লিফ ঠিক বুঝতে পেরেছিলেন খেলার মাঠের বাঙ্গালী তথা ভারতীয়দের এই জয়, নিছক খেলায় জেতা নয়। ফুটবলের মতন খেলায় যেখানে সাফল্য পেতে ক্রীড়া নৈপুণ্যের সাথেই সমান প্রয়োজন দৈহিক শক্তি, সাহস, শৌর্য আর পুরুষকারের সেখানে হীনবল শুধু নয় দীর্ঘ হীনমন্যতায় ভুগতে থাকা স্বজাতির এমন অভূতপূর্ব সাফল্যে – তাদের ক্ষাত্রশক্তির জয়ের গৌরবে – যিনি সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হবেন তিনি – সরলা দেবী।

তাঁর আঠারো কি উনিশ বছর বয়সে লেখা, দু’টো প্রবন্ধ পড়ে এতটাই বিস্মিত হয়েছিলেন স্বয়ং সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন সদ্য কৈশোর পার করা সেই মেয়েকে। এমনকি গানে – গানের সুর করায় – নানারকম বাজনায় – তাঁর বিরল প্রতিভায় মুগ্দ্ধ বঙ্কিমচন্দ্র নিজের কবিতায় সুরারোপ করার ফরমায়েশ পর্যন্ত্য করেছিলেন তাঁর কাছে। এমন কাজ তাঁকে প্রায়ই দিতেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেকারণেই রবীন্দ্রনাথের বহু কালজয়ী গানের সুরের নেপথ্যে তিনিই। এমনকি রবীন্দ্রনাথের এক কথায় বঙ্কিমের “বন্দে মাতরম”-এর শেষ চারটে স্তবকের সুরও তাঁরই করা। মূর্তি পুজোর ঘোর বিরোধী মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিরল প্রতিভার কৃতিত্ব দেখে তাঁকে বলেছিলেন – “তুমি সরস্বতী”। ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রাম আন্দোলনের অন্যতম তিন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক, “লাল-বাল-পাল” – লালা লাজপত রায়, লোকমান্য বাল গঙ্গাধর তিলক আর বিপিন চন্দ্র পাল – তিনজনেই যে শুধু তাঁর গুণমুগ্ধ ছিলেন তাই নয় – বয়সে ছোট সেই নারীর প্রতি এঁদের প্রত্যেকেরই ছিল প্রশ্নাতীত সম্ভ্রম। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর সম্বন্ধে সিস্টার নিবেদিতাকে বলেছিলেন – ওঁর education perfect। দেশের সব মেয়ের ওঁর মতন education হওয়া চাই। মনে প্রাণে চেয়েছিলেন সে যেন তাঁর সাথে বিলেতে গিয়ে তাঁর সাথে একই সঙ্গে পাশ্চাত্যের সমাজে শোনান প্রাচ্যের গরিমার কথা – সংস্কৃতির কথা – অধ্যাত্মের কথা – মাহাত্ম্যের কথা। তাঁর জ্ঞানে, গুণে, ব্যক্তিত্বে আপ্লুত মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ১৯২০-র ১০ই অগাস্ট, জার্মান-পোলিশ বংশদ্ভুত স্থপতি, বন্ধুস্থানীয় হেরমান কালেনবাখ-কে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন – তাঁর সাথে ওঁর নিজের সম্পর্ক beyond definition – তিনি নাকি গান্ধীজীর spiritual wife। যদিও তাঁর দিক থেকে গান্ধীজীর প্রতি এমন কোনও অনুভূতির কণামাত্র যে কোনওদিন ছিল এমন কস্মিনকালেও কেউ কখনও শোনেন, জানেন বা দেখেন নি। তিনিই শ্রীমতী সরলা দেবী – জন্মসূত্রে সরলা ঘোষাল।

প্রতাপাদিত্য উৎসব :

শ্রী মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন সেকালের বিখ্যাত পত্রিকা “Dawn”-এর সম্পাদক শ্রী সতীশ মুখোপাধ্যায়ের ভাগ্নে। সতীশবাবু মাঝে মধ্যেই আসতেন সরলা দেবীর সাথে দেখা করতে। মণিলালেরও সাহিত্যের প্রতি একটা ঝোঁক ছিল। এমনকি ভবানীপুরে ছেলেদের একটা সাহিত্য সমিতিও ছিল মণিলালের পরিচালনায়। ১৯০৩-এর শুরুর দিকে একদিন সেই মণিলাল এসে অনুরোধ করলেন তাদের সাহিত্য সমিতির বাৎসরিক উৎসবের দিন আসছে – সরলা যেন তাতে সভানেত্রীত্ব করেন। দেশের বহু প্রান্তে একা একা ঘুরে আসলেও সেকালের শহর কলকাতায় ছেলেদের উৎসবে সভানেত্রীত্ব করার কথা তখন সরলার কল্পনারও বাইরে। তাই এমন অনুরোধ রাখতে তিনি খানিক ইতস্ততঃ করায় মণিলাল পীড়াপীড়ি শুরু করলেন। এমন একটা অবস্থায় মণিলালকে কয়েকটা প্রস্তাব দিলেন সরলা। বললেন তিনি যাবেন ওদের সভায় – সভানেত্রীত্বও করবেন। যদি তারা সাহিত্য সভা না করে সেদিন “প্রতাপাদিত্য উৎসব” করে। তবে তারা যেন দিনটা আরও কয়েকদিন পিছিয়ে ১লা বৈশাখ করে – যেদিন প্রতাপাদিত্যের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল। সভায় যেন কোনও গান, বক্তৃতা ইত্যাদি না রাখা হয়। বদলে সমস্ত কলকাতা ঘুরে খুঁজে খুঁজে বের করতে হবে কোথায় কোন বাঙ্গালী ছেলে কুস্তি জানে, তলোয়ার খেলতে পারে, বক্সিং করে, লাঠি চালায়। তাদের খেলার প্রদর্শনী করতে হবে। আর সরলা তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগে সেই সব ছেলেদের একটা করে মেডেল দেবেন। গোটা অনুষ্ঠানে একটাই মাত্র প্রবন্ধ পাঠ করা হবে। সেটা তাদের সাহিত্য সভার বার্ষিক রিপোর্ট নয়। মহারাজ প্রতাপাদিত্যের জীবনী। বই আনাও – পড়ো তাঁর জীবনী, তার সার শোনাও সভায়। মণিলাল রাজী হলেন। লেগে পড়লেন অনুষ্ঠানের আয়োজনে।

তলোয়ার খেলা দেখানোর জন্যে আনলেন তাদের পাড়ায় দীর্ঘদিন থেকে প্রায় বাঙ্গালী হয়ে যাওয়া রাজপুত ছেলে, হরদয়ালকে। কুস্তির জন্য গোয়াবাগান অঞ্চলের মসজিদবাড়ী স্ট্রীটের বিখ্যাত গুহদের বাড়ীর ছেলেরা এলেন। পরবর্তীতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছিলেন শ্রী ভূপেন বসু। তাঁর ভাইপো শ্রী শৈলেন বসু – যিনি পরে মোহনবাগান ক্লাবের সচিব হয়েছিলেন। সেই সুবেদার মেজর শৈলেন বসু এলেন তাঁর দলবল নিয়ে বক্সিংয়ের জন্যে। লাঠি খেলার জন্যেও এলেন বেশ কয়েকজন। সরলা যেমনটা চেয়েছিলেন তেমন ভাবেই অনুষ্ঠান হলো। কেবল শুরুতেই মণিলালের অনুরোধে প্রতাপাদিত্যের সম্পর্কে কিছু কথা বললেন সরলা। একটা আবহ তৈরী হয়ে গেলো। তারপরে মণিলালের লেখা প্রতাপাদিত্যের জীবনী পাঠের পরেই শুরু হলো একের পর এক খেলাধূলার অনুষ্ঠান। শেষে সরলার হাত থেকে দেওয়া হলো প্রত্যেক খেলোয়াড়কে একটা করে মেডেল। সেই মেডেলগুলোর একদিকে দেবনাগরীতে খোদাই করা ছিল –”দেবাঃ দুর্বলর্ঘাতকাঃ”।

সেদিনের অনুষ্ঠানে শহর কলকাতা জুড়ে শুধু নয় – গোটা বাংলায় তথা ভারতের অন্যত্রও ব্যাপক সাড়া পড়ে গেলো। সেদিন কলকাতার দৈনিক সংবাদপত্র আর সাময়িক পত্র পত্রিকার প্রতিনিধিরা প্রায় সবাই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সেকালের বিখ্যাত পত্রিকা কৃষ্ণকুমার মিত্রের “সঞ্জীবনী” লিখলো – “কলিকাতার বুকের উপর যুবক-সভায় একটি মহিলা সভানেত্রীত্ব করিতেছেন দেখিয়া ধন্য হইলাম।” আরেক বিখ্যাত পত্রিকা “বঙ্গবাসী” লিখলো – “মরি মরি কি দেখিলাম ! এ কি সভা ! বক্তিমে নয়, টেবিল চাপড়া-চাপড়ি নয় – শুধু বঙ্গবীরের স্মৃতি আবাহন, বঙ্গ যুবকদের কঠিন হস্তে অস্ত্রধারণ ও তাদের নেত্রী এক বঙ্গললনা – ব্রাহ্মণ কুমারীর সুকোমল হস্তে পুরস্কার বিতরণ। দেবী দশভুজা কি আজ সশরীরে অবতীর্ণা হইলেন? ব্রাহ্মণের ঘরে কন্যা জাগিয়াছে, বঙ্গের গৌরবের দিন ফিরিয়াছে।”

দেশবরেণ্য বিপ্লবী-নেতা, স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম দিশারী শ্রী বিপিনচন্দ্র পাল বুঝতে পারলেন সার সত্যটা – সরলার আসল উদ্দেশ্য। তাঁর “Young India”-তে লিখলেন – “As necessity is the mother of invention, Sarala Devi is the mother of Pratapaditya to meet the necessity of a hero for Bengal”। আর এর পরেই যেন একটা জোয়ার এলো। বাংলার ঘরে ঘরে – বাঙ্গালীর মনে প্রবেশ করলেন – তাদের স্বপ্নের বীর, তাদের Hero – ষোড়শ আর সপ্তদশ শতকে যশোরের মহারাজ প্রতাপাদিত্য গুহরায়। যার প্রথম বহির্প্রকাশ হলো প্রফেসর শ্রী ক্ষীরোদ প্রসাদ বিদ্যাবিনোদের “প্রতাপাদিত্য” নাটক রচনায় আর সেই সময়ে ষ্টার থিয়েটারে রাতের পর রাত তার হাউসফুল শো গুলোতে। সেই দেখাদেখি মিনার্ভা থিয়েটারেও শ্রী অমর দত্তের “প্রতাপাদিত্য” নাটকের অভিনয় শুরু হলো।

ঠিক সেই সময়েই অদ্ভুতভাবে একটা অপ্রত্যাশিত আঘাতও এসে ধাক্কা দিল সরলাকে। তাও সেটা তাঁর রবিমামা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের থেকে। তবে সাক্ষাতে নয়। দূত মারফতে। সাহিত্যিক শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন একদিন এসে জানালেন – সরলার রবিমামা ভীষণ চটে গেছেন তাঁর উপর। সেই সময়ের বছর দশেক আগে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত উপন্যাস “বৌ ঠাকুরানীর হাট”। সরলা তাঁর সেই উপন্যাসে চিত্রিত “খলনায়ক”, প্রতাপাদিত্যের “ঘৃণ্যতা” অপলাপ করে আর এক প্রতাপাদিত্যকে দেশের মনে আধিপত্য করাচ্ছেন। এটাই তাঁর রবিমামার উষ্মার কারণ। তাঁর মতে প্রতাপাদিত্য কখনও কোনও জাতির “Hero Worship”-এর যোগ্য হতে পারেন না। তাঁর দূত দীনেশ সেন-কে এই অভিযোগের একটা যুৎসই উত্তর সেদিন দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের নিজেরই ভাগ্নী। বলেছিলেন – তিনি যেন গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে বলেন – প্রতাপাদিত্য-কে তিনি মোটেই Moral মানুষের আদর্শ বলে খাড়া করেন নি। প্রতাপাদিত্য যে নিজের পিতৃব্যকে হত্যা করেছিলেন সে কাজও কোথাও এতটুকু সমর্থন করেন নি। কিন্তু প্রতাপাদিত্য যে Politically Great ছিলেন, বাংলার “শিবাজী” ছিলেন, মোগল-বাদশার বিরুদ্ধে একলা এক হিন্দু জমিদার খাড়া হয়ে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, নিজের নামে মুদ্রা চালিয়েছিলেন – সেই পৌরুষ, সেই সাহসিকতার হিসেবে তিনি যে গৌরব অর্জন করেছেন – শুধু তাই প্রতিষ্ঠা করেছেন। এতে যদি ইতিহাসগত কোনও ভুল থাকে তাহলে যেন রবীন্দ্রনাথ তা সংশোধন করে দেন – তিনি মাথা পেতে স্বীকার করে নেবেন। যদিও এর কোনও উত্তর নিয়ে দীনেশ সেন আর কখনও ফিরে আসেন নি। রবীন্দ্রনাথও আর কোনও উচ্চবাচ্য করেন নি। বাঙ্গালীর বীর পুজো চলতে থাকলো। এরপরে “বঙ্গের বীর” সিরিজের ছোট ছোট বই প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন সরলা দেবী চৌধুরানী।

উদয়াদিত্য উৎসব :

সরলা দেবী লক্ষ্য করেছিলেন রানা প্রতাপের কাহিনীর মতনই গোরা, বাদল এমন সব রাজপুত বীরের কাহিনী পড়ে শুধু রাজপুতনা নয় গোটা দেশ এমন কি বাংলার ছেলেমেয়েরাও অভিভূত হয়, তাঁদের গৌরবে গৌরব অনুভব করে, কবিতা বানায়। কিন্তু বাঙ্গালীর ঘরের ছেলে উদয়াদিত্য – যিনি মোগলদের বিরুদ্ধে বাঙালীর স্বাধীনতা রক্ষার চেষ্টায় মুখোমুখি যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিলেন – তাঁর খবর এই বাংলাতেও কেউ রাখে না। তাঁর স্মৃতি বাংলার যুবক-যুবতীদের ধমনীতে ধমনীতে প্রবাহিত হওয়া দরকার। তাই প্রতাপাদিত্য উৎসবের অভূতপূর্ব সাফল্যে আর সমাজে তার ব্যাপক প্রভাবে উৎসাহিত হয়ে মনস্থ করলেন এবার প্রতাপাদিত্যের ছেলে উদয়াদিত্যের নামেও একটা অনুষ্ঠান করতে হবে। সেই সময়ে অর্থাৎ ঊনবিংশ শতকের শেষ আর বিংশ শতকের একেবারে গোড়ার দিকে স্যার সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের “Bengalee” ছিল বাঙ্গালী পরিচালিত প্রধান ইংরেজী কাগজ। সেই “Bengalee”-তে খুব উৎসাহের সঙ্গে সরলা দেবীর পরিচালিত সমস্ত অনুষ্ঠানের খবর ছাপা হতো।

সরলা দেবী উদয়াদিত্য উৎসবের কথা ঘোষণা করতেই সেখানে লেখা হলো – সরলা দেবী দেশের উপর নতুন নতুন ‘surprise spring’ করছেন – আমরা তাঁর সঙ্গে দৌড়ে দৌড়ে হাঁপিয়ে পড়ছি। রোজ ভোরে উঠে মনে হয় – অতঃ কিম? সেই সময়ে সরলা দেবীর কাছে প্রচুর ছেলের দল নিয়মিত আসা যাওয়া করতো। তাদের মধ্যে একটা বিশাল সংখ্যা ছিল যথেষ্ট উচ্চ শিক্ষিত। কেউ কেউ ছিলেন কলেজের অধ্যাপক। তেমনই একজন ছিলেন শ্রীশচন্দ্র সেন – যিনি উদয়াদিত্য উৎসবের মূল দায়িত্ব নিলেন। তখন “Indian Mirror” পত্রিকার সম্পাদক আর অ‍্যালবার্ট হলের trustee ছিলেন বৃদ্ধ নরেন্দ্রনাথ সেন। তাকে একটা চিঠি লিখে সাথে টাকা পাঠিয়ে অনুষ্ঠানের জন্য অ‍্যালবার্ট হল ভাড়া করিয়ে দিলেন সরলা দেবী। কিন্তু একটা ছোট মুশকিল হলো। উদয়াদিত্যের তো কোনও ছবি নেই। অনুষ্ঠানে তাঁর পরিচয় বহন করবে এমন আর কি থাকতে পারে? ভেবে দেখলেন ক্ষত্রিয় বীরের স্বরূপ হতেই পারে তাঁর অস্ত্র – তাঁর তলোয়ার। অতএব ঠিক করলেন একটা তলোয়ার থাকবে মঞ্চের উপর আর উদয়াদিত্যকে স্মরণ করে তাতেই পুষ্পাঞ্জলী দেওয়া হবে অনুষ্ঠানে। আর সেই মতন একজন অবাঙ্গালী জমিদারের থেকে হাতলে হীরে জহরত খোদাই করা সুন্দর ঝকঝকে একটা তলোয়ার জোগাড় করা হলো। প্রখ্যাত নাট্যকার শ্রী ক্ষীরোদ বিদ্যাবিনোদ অনুষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব পালন করতে সম্মত হলেন। সেই মতন প্রচুর হ্যান্ডবিল ছড়ানো হলো। কাগজে পত্রেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে অনুষ্ঠানের খবর ছাপা হলো। শহর জুড়ে বেশ ভালো একটা সাড়া পড়ে গেল। যেদিন বিকেল চারটের সময় অনুষ্ঠান সেদিন উদ্যোক্তারা, স্বেচ্ছাসেবকরা সব দলে দলে সকাল দশটার থেকেই অ‍্যালবার্ট হলে উপস্থিত। এরই মধ্যে বেলা বারোটা নাগাদ শ্রীশ বাবু হাঁফাতে হাঁফাতে গিয়ে উপস্থিত হলেন বালিগঞ্জে সরলা দেবীর বাড়ীতে। এসে জানালেন নরেন সেন লোক মারফৎ চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন তাঁদের অ‍্যালবার্ট হলে এ অনুষ্ঠান হতে পারবে না। কারন তিনি শুনেছেন ছেলেরা তলোয়ার পুজো করবে। এ সব ভয়াবহ রাজবিদ্রোহের কাজ – তাতে তিনি অনুমতি দিতে পারবেন না। এমন খবর পেয়ে আর এক মুহূর্ত দেরী করলেন না সরলা দেবী। শ্রীশচন্দ্র সেনকে বললেন – যত টাকা লাগে লাগুক – অ‍্যালবার্ট হলের কাছাকাছি অন্য যে কোনও জায়গা, কোনও থিয়েটারের স্টেজ হোক কি অন্য কোনও উপযুক্ত জায়গা – ভাড়া করে হাতে রাখুন। তিনি একটা চেষ্টা করছেন অনুষ্ঠান অ‍্যালবার্ট হলেই করাতে পারেন যদি।

তক্ষুনি সরলা দেবী বৃদ্ধ নরেন সেনকে লিখলেন – “আপনি পরম হিন্দু – ভালো করেই জানেন হিন্দুর পূজা তিন রকমে হয় – ঘটে পটে ও খড়্গে। পটের অভাবে এক বীর ক্ষত্রিয়ের আত্মার প্রতিনিধিস্বরূপ বাঙ্গালী ছেলেরা খড়্গে তাঁর পূজার আয়োজন করেছে – এক অবাঙ্গালী রাজা খুশী হয়ে সেজন্য নিজের তলোয়ার তাদের পাঠিয়ে দিয়েছেন। আজ আপনি যদি তাদের এ পূজা বন্ধ করেন, সংবাদপত্রের সূত্রে সমস্ত ভারতবর্ষে ঢিঢি পড়ে যাবে। সবাই বলবে বাঙ্গালী যুবকেরা খড়্গপূজা করতে চেয়েছিল, একজন নেতৃস্থানীয় বাঙ্গালী বৃদ্ধ হিন্দু তাতে বাধা দিয়েছেন, তাঁর অতিমাত্রার রাজভক্তি তাতে রাজদ্রোহীতার গন্ধ পেয়ে থরহরি কম্পমান হয়েছে, তাঁর তথাকথিত হিন্দুত্বের পরীক্ষায় তিনি সম্পূর্ণ ভাবে Fail করেছেন।” সাথে লিখলেন এ জন্য দেশের লোক তো তাঁকে ধিক্কার দেবেই সেই সঙ্গে মামলাতেও ফেঁসে যাবেন। কারন তিনি উদয়াদিত্য উৎসব হবে জেনেই অগ্রিম চার টাকা নিয়ে হল ভাড়া দিয়েছেন আর সেই টাকা ফেরত না দিয়েই যদি একেবারে শেষ মুহূর্তে তা বাতিল করেন তবে ছেলেরা ক্ষতিপূরণের মামলা করবে। আইনত তিনিই দায়ী থাকবেন। বৃদ্ধ নরেন সেন সেই চিঠি পেয়ে সরে আস্তে বাধ্য হলেন আগের অবস্থান থেকে – নিজের মত বদল করলেন – লিখলেন – “তবে তাই হোক। ছেলেরা উৎসব করুক। কিন্তু এর জন্য সব দায়িত্ব আপনার।” অর্থাৎ সরলা দেবীর।

এর মধ্যেই শ্রীশবাবুর পাঠানো লোক এসে খবর দিল – প্রায় দ্বিগুন টাকা দিয়ে শ্রীশবাবু অ‍্যালবার্ট হলের কাছেই হ্যারিসন রোডের উপরে অ‍্যালফ্রেড থিয়েটার ভাড়া নিয়েছেন। সেখানকার মালিককে তাঁরা খুলে বলেছেন – তারা তলোয়ার পুজো করবেন। সেই শুনে সেই মাড়োয়ারী মালিক বলেছেন যে হলের ভাড়ার টাকা তিনি হাতে হাতে পেলেই হল। ছেলের দল সেখানে নাচন কোঁদন যাই করুক না কেন সে নিয়ে তার কোনও মাথাব্যথা নেই। শ্রীশবাবুর সেই লোকের হাতে নতুন হল ভাড়ার টাকাটা পাঠিয়ে দিলেন সরলা দেবী। সাথে সম্মতি জানিয়ে লেখা নরেন সেনের চিঠিখানাও। কিন্তু তারপরে শ্রীশবাবুরা কেউ আর রাজী হলেন না অ‍্যালবার্ট হলে অনুষ্ঠান করতে। শেষ পর্যন্ত্য অনুষ্ঠান হলো অ‍্যালফ্রেড থিয়েটারেই। অ‍্যালবার্ট হলের সামনে কয়েকজন সেচ্ছাসেবককে রেখে দেওয়া হয়েছিল সেদিন। হ্যান্ডবিল ইত্যাদির প্রচার অনুসারে লোকজন অ‍্যালবার্ট হলের সামনে আসলে তাদের অ‍্যালফ্রেড থিয়েটারে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্যে। সেদিন সভাপতির ভাষণে মৎস পুরাণের কাহিনী উদ্ধৃত করে শ্রী ক্ষীরোদ বিদ্যাবিনোদ বলেছিলেন – প্রাচীনকালে এক ঋষি একটা ছোট্ট মাছকে প্রথমে একটা কুঁয়োতে তারপরে একটা পুকুরে আর তারও পরে সমুদ্রে নিয়ে গিয়ে ফেলায় সেই মাছের আকারও যেমন বাড়তে বাড়তে শেষে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে বিপুল বিশাল হয়েছিল – তিনি নিশ্চিত – তেমন করেই উদয়াদিত্য উৎসবের সেদিনের সেই ছোট অনুষ্ঠানের পিছনে যে মূল পরিকল্পনা, যে চিন্তাধারা তাও একদিন বাঙ্গালী জাতির মধ্যে আকারে বেড়ে বাঙ্গালীর বীরত্বকে বিরাট করে তুলে ধরবে। সেদিন শ্রী ক্ষীরোদবিদ্যাবিনোদের সেই কথা কিন্তু পরবর্তীতে সত্যি হয়েছিল।

দেশবরেণ্য শ্রী অরবিন্দ ঘোষ ভগিনী নিবেদিতা, কাকুজো ওকাকুরার মতনই আর যাঁর সাথে, যাঁর প্রত্যক্ষ সহযোগে স্থাপন করেছিলেন এদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ত্যাগ, তিতিক্ষা, বলবীর্য আর দেশপ্রেমের নিরিখে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগঠন – অনুশীলন সমিতি। তিনি শ্রীমতী সরলা দেবী চৌধুরানী।

 

গ্রন্থঋণ :

১) জীবনের ঝরাপাতা – সরলা দেবী
২) নব-বর্ষের স্বপ্ন – সরলা দেবী
৩) ভারতী – সন ১৩৩১ – দ্বিতীয় সংখ্যা

 

(লেখক পরিচিতি: ইতিহাস চর্চায় ব্যাপ্ত নিবন্ধকার)

Comment here