-শ্রী সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়
স্বাধীনতা যখন আসন্ন তখন বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্তে চূড়ান্ত করতে হচ্ছিল। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান দুটি বিষয় ছিল জাতীয় পতাকা এবং মুদ্রায় রাজা ষষ্ঠ জর্জের ছবির বদলে কী থাকবে। জাতীয় পতাকায় শেষ পর্যন্ত অশোকচক্র ব্যবহার করা হবে বলে চূড়ান্ত হয়ে গেলে, জাতীয় পতাকা সম্পর্কে ১৯৪৭ সালের ৬ অগস্ট মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, “আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, ভারতীয় যুক্তরাজ্যের পতাকায় যদি চরকার চিহ্ন না থাকে তাহলে আমি সেই সেই পতাকাকে সম্মান জানাতে পারব না।” (“I must say If the Flag of the Indian Union will not embody the emblem of the Charkha, I will refuse to salute the flag.”) তবে জাতীয় চিহ্ন হিসাবে সারনাথ অশোকস্তম্ভশীর্ষ বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে এমন কোনও বিতর্কের কথা জানা যায় না।
মৌর্যসম্রাট অশোকের কথা পুনরাবিষ্কৃত হয় মূলত কয়েকটি সিংহলী পুঁথি থেকে। জানা যায় ভারতে অশোক নামে একজন শক্তিশালী সম্রাট ছিলেন। সারনাথে ধমেক বৌদ্ধ স্তূপের আশপাশে উৎখনন করে সেখান থেকেই পাওয়া যায় মৌর্যযুগের অনন্য শিল্প-নিদর্শন চারদিকে মুখ বিশিষ্ট সিংহ। সম্রাট অশোক সারা ভারতে যেসব স্তম্ভ তৈরি করেছিলেন, তার শীর্ষে যা ছিল তাকেই স্তম্ভশীর্ষ বলে। যেমন রামপূর্বায় পাওয়া রামপূর্বা অশোকান বুল ক্যাপিটাল (রামপূর্বা অশোকস্তম্ভশীর্ষের ষণ্ড) যেটি রাষ্ট্রপতিভবনে রয়েছে কিংবা রামপূর্বা অশোকান লায়ন ক্যাপিটাল (রামপূর্বা অশোকস্তম্ভশীর্ষের সিংহ) যেটি কলকাতায় ভারতীয় সংগ্রহালয়ে রয়েছে। সারনাথে এমন বিশাল নিদর্শন একটিই পাওয়া গেছে বলে আলাদা করে প্রাণীর নাম উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। ১৯০৪-০৫ সালে এটি উৎখনন করে বের করেন ফ্রেডরিক অস্কার ওয়েরটেল।
সারনাথ অশোকস্তম্ভশীর্ষটি সব অর্থেই অনন্য়। চারদিকে চারটি এশীয় সিংহের মুখ ও থাবা সমেত সামনের পা এই মূর্তিতে রয়েছে। এরও উপরে ছিল একটি একটি পাথরের চক্র যার সামান্য অংশই অবশিষ্ট ছিল। সিংহের পায়ের নিচে চারটি প্রাণী: হস্তি, ষণ্ড, ছুটন্ত ঘোড়া ও সিংহ। এই চারটি প্রাণী গৌতমবুদ্ধের প্রতীক। মায়াদেবী তাঁর সন্তান সিদ্ধার্থের জন্মের আগে যে শ্বেতহস্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন সেটির প্রতীক হস্তি। সিদ্ধার্থের যৌবনের প্রতীক ষণ্ড, তাঁর সংসার ত্যাগের প্রতীক ছুটন্ত ঘোড়া এবং বুদ্ধ হয়ে ওঠার প্রতীক সিংহ। সমান বিচারের প্রতীক চারমুখ ওয়ালা সিংহ। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের প্রথম মহানির্দেশক স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম মনে করেন, এই শিল্পকলায় গ্রিক প্রভাব রয়েছে। উপরের চক্র ছাড়া মূল স্তম্ভশীর্ষের দৈর্ঘ্য ৭ ফুট। এর নিচে ঘণ্টার মতো উল্টানো ১৬টি পাপড়ি-বিশিষ্ট আরও ২ ফুট দৈর্ঘের পদ্ম রয়েছে।
সিংহের যে চারটি মুখ রয়েছে তার মধ্যে একটির নিচের চোয়াল ভাঙা, তাই যেদিক থেকে এটি অক্ষত দেখায় সেই দিক বেছে নেওয়া হয়। এই দিকে ছুটন্ত ঘোড়া ও ষণ্ড দৃশ্যমান। অর্থাৎ হস্তি ও সিংহ যেদিক থেকে দেখা যায় সেই দিকটি জাতীয় চিহ্ন নয়।
অশোক চক্রের মোট সাতটি খণ্ড পাওয়া যায়, চক্রের বেড়়ের চারটি অংশ এবং ২৪টি দণ্ডের মাত্র তিনটি খণ্ড। যদিও সাঁচিতে পাওয়া ভাস্কর্য থেকে এটি প্রকৃতপক্ষে কেমন দেখতে ছিল তা অনুমান করা কঠিন হয়নি। বিধান পরিষদে অশোকচক্র ও অশোকস্তম্ভের প্রস্তাব করেছিলেন জওহরলাল নেহরু, তবে আদতে কে এটি মনোনীত করেছিলেন সে সম্পর্কে কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। অনেকে মনে করেন, ভীমরাও রামজি আম্বেদকর (দলিত ঘরে জন্ম, শিক্ষকের পদবী গ্রহণ করে আম্বেদকর হন, পরে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন) রয়েছেন অশোকচক্র ও সারনাথ অশোকস্তম্ভশীর্ষ নির্বাচনের নেপথ্যে।
১৯৫০ সাল লেখা স্বাধীন ভারতের প্রথম কয়েনেই ছবি রয়েছে অশোকস্তম্ভের। ১ পয়সার (তখন ইংরেজিতে Pice লেখা হত) মুদ্রায় ব্যবহার করা হয় ছুটন্ত ঘোড়া এবং আধ আনা, এক আেনা ও দুই আনা মুদ্রায় ব্যবহার করা হয় ষণ্ডের ছবি। এই দুটিই সারনাথ অশোকস্তম্ভশীর্ষের অংশ। তবে হস্তিটি কোনও দিন কোনও কয়েনে ব্যবহার করা হয়নি।
ভারতের একটিমাত্র মুদ্রায় দুই দিকেই অশোকস্তম্ভ ব্যবহার করা হয়েছে। তার মধ্যে এক দিকে একই সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে উপরে অশোকচক্র ও তার নিচে সারনাথ অশোকস্তম্ভশীর্ষ। এটিতে ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের নামও উল্লেখ করা হয়েছে। ভারতীয় গণরাজ্য প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এই ২ টাকার স্মারকমুদ্রা তৈরি করা হয়।
বিশ্বে ভারত ছাড়া দ্বিতীয় এমন কোনও দেশ নেই যে দেশের প্রতিটি মুদ্রায় টানা ৭৫ বছর ধরে নির্দিষ্ট এমন একটি ছবি ছাপা হচ্ছে যেটি সেই দেশের ঐতিহ্যের প্রতীক। সঙ্গে মুণ্ডক উপনিষদের একটি বাণীর প্রথম দুটি শব্দ গ্রহণ করা হয় যার অর্থ, সত্যের জয় হবেই বা সত্য প্রকাশিত হবেই। দেশ স্বাধীন হলে এই শব্দবন্ধ গ্রহণ করা হয়। তবে ১৯৮২ সালে এই শব্দবন্ধ প্রথম মুদ্রায় লেখা শুরু হয়।
মুণ্ডক উপনিষদের সেই বাণী:
সত্যমেব জয়তে নানৃতং সত্যেন পন্থা বিততো দেবযানঃ।
যেনাক্রমন্ত্যৃষয়ো হ্যাপ্তকামা যত্র তৎ সত্যস্য পরমং নিধানম্।।
১৯১৮ সালে পণ্ডিত মদনমোহন মালবীয় এই শ্লোকের প্রথম দুটি শব্দ ভারতের ন্যায়বাক্য হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব করেন। অর্থাৎ, সত্যমেব জয়তে।
(লেখক পরিচিতি – প্রাক্তন সাংবাদিক, বর্তমানে ভাষাতত্ত্ববিদ; ইতিহাস চর্চা ও মুদ্রা সংগ্রহ তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান অঙ্গ)
Comment here