আঙিনাআমার ইতিহাসসাদাকালো রঙমাখা

সেন বংশীয় সামন্ত সেন কি ধর্মমঙ্গলের নায়ক লাউ সেন?

– শ্রী জ্যোতিস্মান সরকার

 

যদিও অধিকাংশ মানুষ বীর সেনকে সেন বংশের আদিপুরুষ মনের করেন তথাপি আনন্দভট্টের বল্লাল চরিতে আছে বীরসেন কর্ণের বংশে জন্মগ্রহণ করেন ও অঙ্গ দেশ হৈতে গৌড়ে আসেন।[১] বল্লাল চরিত বহু পরে লিখিত হওয়ায় সময়কাল সংক্রান্ত সন্দেহ থাকতে পারে তথাপি তাঁরা অঙ্গ থেকে এসেছেন এটি বোধহয় ভুল না।

মিথিলায় কর্ণাটবংশীয় ঐনোয়াররা শাসন করতেন তাই এটি অবাস্তব বোধ হয় না। কর্ণাটসৈন্য সারা দেশেই ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে কাজ করতেন। এমনকি গজনবীর মতো হিন্দুদ্বেষীরো কর্ণাটের ভাড়াটে সৈন্য ছিল । তাদের অল বিরুণি লিখেছেন সিপাহসালার-ই-হিন্দুয়ান হিসেবে। অল বিরুণী এও লিখেছেন তাঁরা মাহমুদের বাহিনীতে সার্ভ করার আগে শ্রীলঙ্কার রাজার অধীনে কাজ করতেন।

অনুমান করা যায় গৌড়ে কর্ণাট সেন বংশীয়রা সেভাবেই এসেছিলেন। শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন কর্ণসেনের একটি তাম্রশাসন পাঠ করে জানাচ্ছেন, ১০৪২ খ্রিস্টাব্দে কর্ণসেন কাশীর কাছে ভূমিদান করেছেন। এই তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, কর্ণসেন বাংলায় আসেন পালরাজ নয়পালের সময় অর্থাৎ আনুমানিক ১০২৭-১০৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। এই তাম্রশাসন থেকে আরও জানা যাচ্ছে, কর্ণসেনের পুত্র লাউসেন ছিলেন খ্রিস্টিয় একাদশ শতাব্দীর শেষপাদের লোক।

গৌড়েশ্বর দ্বিতীয় ধর্মপালের স্ত্রী ভানুমতির ভাই অর্থাৎ সম্পর্কে গৌড়েশ্বরের শ‍্যালক এবং মন্ত্রী মহামদের বোন রঞ্জাবতীর সঙ্গে দাহলপতি বৃদ্ধ কর্ণসেনের বিয়ে হয়। এজন্য কর্ণকে কেউ কেউ বলেছেন, দাহলপতি কর্ণ। এই “দাহল” বা ত্রিপুরী হলো মধ্য প্রদেশের জব্বলপুরের কাছে একটি গ্রাম। তিনি ছিলেন শৈবাধর্মাবলম্বী। কাশীতে তৈরি করেন একটি শিবমন্দির। আর ত্রিপুরী (দাহল)-র কাছে প্রতিষ্ঠা করেন কর্ণবতী নগর। এই বংশের আদি বাসস্থান ছিল নর্মদা উপত্যকা অঞ্চলে। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর কলচুরিগণ এই নর্দমা উপত্যকায় নিজেদের রাজ‍্য গড়ে তুলেছিলেন।

বাংলার ইতিহাসে আমরা দু’ জন লাউসেনকে দেখতে পাই।

১) প্রথম লাউসেন: প্রথম লাউসেন হলেন ভারত সম্রাট দেবপালের (৮১৫-৮৫৪ খ্রি: ) মাসতুতো ভাই তথা সেনাপতি, যিনি কামরূপ ও উড়িষ্যা জয় করেন। কাশ্মীরী লেখক কলহনের “রাজতরঙ্গিণী” -তে যে সুহ্ম বংশের রাজা দেবসেনের কথা লেখা আছে, সেই বংশের মানুষ ছিলেন এই লাউসেন।

২) দ্বিতীয় লাউসেন: খ্রিস্টিয় একাদশ শতাব্দীর মানুষ এই লাউসেন মঙ্গলকাব্যে “লাল্বাদিত‍্য” নামেও পরিচিত। ঘনারামের “ধর্মমঙ্গল” কাব্যের তিনিই নায়ক। প্রথমে বর্ধমানের সেনপাহাড়ি এবং পরে মেদিনীপুরের ময়নাগড়ের সামন্তরাজা কর্ণসেনের ( ১০৪১-১০৭১ খ্রি:) পুত্র এই লাউসেন গৌড়েশ্বর দ্বিতীয় ধর্মপালের হয়ে অনেক যুদ্ধ করেছেন। জয় করেছেন কামরূপ। বর্ধমান-বীরভূমের ঢেকুরগড়ের যুদ্ধে ইছাই ঘোষকে পরাজিত ও নিহত করে উদ্ধার করেন পিতৃরাজ‍্য ।

লাউ সেন বা লবসেনের জন্মবৃত্তান্ত –

‘রাঢ়ের জাতীয় মহাকাব্য’ (ধর্মমঙ্গল) থেকে জানা যায়, স্বর্গের নর্তকী জাম্ববতী শাপগ্রস্থ হয়ে বমতি নগরে বেণুরায়ের মেয়ে রঞ্জাবতী হয়ে জন্মান।

রঞ্জাবতীর দিদি ছিলেন গৌড়েশ্বরের রাণী এবং তাঁর দাদা মহামদ ছিলেন গৌড়েশ্বরের মন্ত্রী। বিদ্রোহী সামন্ত ঈশ্বরী ঘোষ ছিলেন দেবী চণ্ডীর আশীর্বাদে বলীয়ান। তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে গৌড়েশ্বরের আরেক সামন্ত ময়নাগড়ের কর্ণসেনের ছয় ছেলে মারা যায় যুদ্ধে। কর্ণসেন নিজেও পরাজিত হন। তখন সান্ত্বনা হিসেবে গৌড়েশ্বর কর্ণসেনের বিয়ে দেন নিজের শ্যালিকা রঞ্জাবতীর সঙ্গে। বিয়ের পর রঞ্জাবতীকে নিয়ে কর্ণসেন ময়নাগড়ে নতুন সামন্তের পদে বসেন। এদিকে বুড়ো কর্ণসেনের সঙ্গে বোনের বিয়ে হলে রেগে যান মহামদ। গৌড়েশ্বরের কাজের প্রতিবাদ করতে না পেরে কর্ণসেনের সঙ্গেই শত্রুতা করেন তিনি।

এতে কষ্ট পেয়ে রঞ্জাবতী পুত্রের আশায় ধর্মঠাকুরের পুজো করতে থাকেন। তারপর রঞ্জাবতীর গর্ভে জন্ম নেন এক স্বর্গভ্রষ্ট দেবতা। নাম রাখা হয় লাউসেন। রেগে গিয়ে মহামদ লাউসেনকে অপহরণ করলেন।ধর্মঠাকুরের আদেশে হনুমান লাউসেনকে উদ্ধার করে রঞ্জাবতীর কোলে ফিরিয়ে দিলেন।

এরপর লাউসেন বড়ো হয়ে উঠল ধীরে ধীরে। ভাই কপূর ধবলকে নিয়ে যাত্রা করল গৌড়ের দিকে। কিন্তু গৌড়ে পৌঁছেই লাউসেন বন্দি হল মহামদের চক্রান্তে। যদিও গৌড়েশ্বরকে খুশি করে সে মুক্তি পেল সহজেই। গৌড়েশ্বর তাঁকে প্রচুর পুরস্কার ও ময়নাগড়ের শাসন দিলেন। ফেরার পথেলাউসেনের বন্ধুত্ব হল কালু ডোেম ও তার স্ত্রী লখ্যার সঙ্গে। লাউসেন এদেরও ময়নাগড়ে নিয়ে এল। কালুকে করল সেনাপতি।এরপর গৌড়েশ্বর তাঁকে প্রেরণ করেন ঢেকুর গড়ের অধিপতি ইছাই ঘোষের বিরুদ্ধে

ইচ্ছাই ঘোষের পরিচয়:

শ্রী বিনয় ঘোষের লেখা থেকে জানা যায় রাঢ়ের তৎকালীন অধীশ্বর মহিপালের অধীনস্ত সামন্তরাজা ইছাই ঘোষ ছিল বর্ধমানের ঢেকুর গড় বা ঢেকুর গড়ের একচ্ছত্র আধিপতি। পশ্চিমবঙ্গের দিনাজপুর জেলার রামগঞ্জ গ্রামে ঈশ্বর ঘোষের একটি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক ননীগোপাল মজুমদারের মতে এটি পাল যুগের ইতিহাসের সাক্ষ। এই তাম্রশাসন থেকে জানা যায় ইছাই ঘোষ বা ঈশ্বর ঘোষ ছিলেন ধবল ঘোষের পুত্র, বাল ঘোষের পৌত্র, ও ধূর্ত ঘোষের প্রপৌত্র।

অজয়-দামোদরের দোয়াবে অবস্থিত সুপ্রাচীন গোপভূমে প্রাচীন কাল থেকে যে সমস্ত রাজা মহারাজারা রাজত্ব করেছেন তাদের মধ্যে সব থেকে উল্লেখ্য হল গড় জঙ্গলের গোপরাজা মহামাগুলিক ঈশ্বর ঘোষ বা ইছাই ঘোষ।

“সখলু ঢেক্করীত: মহামাগুলিক: শ্রীমদীশ্বর ঘোষঃ কুশলী”- রামগঞ্জের তাম্র শাসনে ও তিনি ঢেক্করীর রাজা এবং ঘোষ কুলোদ্ভব মহামাগুলিক বলে নিজেকে উল্লেখ করেছেন।[৫]

আর অজয়ের দক্ষিণে ঢেকুর গড়েই তার রাজধানী প্রতিষ্ঠিত ছিল। এখন বিভিন্ন পণ্ডিতগণের বক্তব্য অনুযায়ী বলা যায় ঢেক্করী গড়ই ত্রিষষ্টী গড় নামে খ্যাত ছিল। এবিষয়ে আলোচ্য মহামাগুলিক ঈশ্বর ঘোষেব কাহিনী নিয়ে পরবর্তী কালে মধ্যযুগে যে সকল ধর্মমঙ্গল কাব্য রচিত হয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখ্য কবি রূপরাম ও ঘনরাম চক্রবর্তী ঐ একই মতামত প্রকাশ করেই বলেছেন-

যার নাম ঢেকুর ত্রিষষ্ট তারে কয় (রূপরাম) [৪]

ত্রিষষ্টী ঘুচায়ে নাম হয়েছে ঢেকুর। (ঘনরাম)[৭]

রামগঞ্জ তাম্রশাসনে বলা হয়েছে।

……তস্য ঈশ্বর ঘোষ এষ তনয়:
হে ধামা জয়ত্যেকো দুর্ধরসাহস:
কিম পরং কান্ত্যা জিত্যেন্দুদ্যতি:
যশ্য প্রোজিতশৌর্ধনিজিতরিপোঃ

চন্দ্রের ছাতিকেও ঈশ্বর ঘোষের কান্তি হার মানায়, তার শৌর্যবীর্ষের তুলনা হয় না। এর থেকে বোঝা যায় কিছুকাল পাল সাম্রাজ্যের মহামান্ডলিক হিসেবে উত্তর বঙ্গে ইচ্ছাই ঘোষ শাসন করেছেন এবং বেশ দাপটের সঙ্গেই শাসন করেছেন কারণ মহামান্ডলিক নিজের তাম্রশাসন জারি করেছেন খুব ক্ষেত্রেই দেখা যায় [২]

মা শ্যামরুপা

ধর্মমঙ্গলের এক উল্লেখ্য কবি ঘনরাম চক্রবর্তীও ঈশ্বর ঘোষ সম্পর্কে যা বলেছেন-

কি কহিব ভাগ্য কত গোয়ালা বাঞ্ছিল যত,

মহামায়া পুরিল কামনা।

কনক প্রতিমা করি, শ্যামারূপা মহেশ্বরী,

গড়ে গোপ করিল স্থাপনা ।। [৪] [৫]

ঢেকুর গড়ের অধিপতি শিব ও শক্তির উপাসক ঈশ্বরী ঘোষ অজয় নদের দক্ষিণ তীরে ভগবান শিবের উদ্দেশ্যে নির্মাণ করেছিলেন এই রেখ দেউলটি। আর পার্শ্ববর্তী বিষ্ণুপুর ও থেরওয়ারীর গ্রামের মধ্যবর্তী জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে নির্মাণ করেছিলেন দুর্গা মন্দির, যা পরবর্তী কালে সেনযুগে ‘শ্যামরূপা দুর্গা’ নামে পরিচিতি লাভকরে এবং ঐ এলাকার নাম হয়ে যায় ‘শ্যমরূপা গড়। রহস্যময় এই মন্দিরকে ঘিরেও রয়েছে অনেক লোকগাথা। এই শ্যামরূপার গড়ের পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে ইছাই ঘোষের রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ আজও আছে। এই গড় জঙ্গলের কোনো অজ্ঞাত উৎস থেকে আজও শোনা যায় কামানের আওয়াজ আর তখনই শুরু হয় শ্যামারূপার মন্দিরের অষ্টমীর সন্ধি পুজো।

শ্যামরুপা নামকরণের কারণ?

মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত প্রস্তরনির্মিত সুদর্শনা দুর্গামূর্তি আছে। উচ্চতায় প্রায় দশ বার ইঞ্চি। মন্দিরপ্রাঙ্গণে রয়েছে একটি হাড়িকাঠ। লোকমুখে শোনা যায়, আগে এখানে কাপালিকেরা নরবলি দিতেন। একবার অজয়নদের ওপারে অবস্থিত কেন্দুলি গ্রাম থেকে গীতগোবিন্দের রচয়িতা বৈষ্ণব কবি জয়দেব আসেন এই মন্দির দর্শনে। তিনি কাপালিককে প্রস্তাব দেন যদি তিনি তাঁকে চাক্ষুষ মাতৃদর্শন করাতে পারেন তবেই প্রমাণ হবে যে কাপালিকের উৎসর্গীকৃত নরবলি দেবী গ্রহণ করেন। যদি কাপালিক তা না পারেন তাহলে কবি জয়দেব তাঁকে শ্রীকৃষ্ণ বা শ্যাম রূপ দর্শন করাবেন।তবে তাতে শর্ত আছে একটা, নরবলি বন্ধ করতে হবে। ভক্ত কবি জয়দেবের এই প্রস্তাবে রাজি হলেন কাপালিক। চেষ্টা করলেন তাঁর উপাস্যদেবীকে দর্শন করাতে। ব্যর্থ ন। এরপর জয়দেবের ভক্তিপূর্ণ আকুল প্রার্থনায় শ্যামামা শ্যাম রূপ ধারণ করে দর্শন দিলেন কাপালিককে। আনন্দে আবেগে কাপালিক লুটিয়ে পড়লেন প্রেমিক সাধক জয়দেবের চরণতলে। সেই থেকেই মন্দিরে পূজিত দেবীর নাম হল ‘শ্যামরূপা’ দুর্গা আর বন্ধ হল নরবলি।

ইচ্ছাই ঘোষ ও লবসেনের যুদ্ধ:

যাই হোক আবার মূল প্রসঙ্গে ফিরি ।অজয়ের দক্ষিণ তীরস্থ যে অঞ্চলে ইছাই ঘোষ তথা ঈশ্বর ঘোষের সঙ্গে লাউসেনের যুদ্ধ হয়েছিল সেই জায়গার বর্তমান নাম ‘কাঁদুনে ডাঙা।

স্থানীয় অধিবাসীদের বিশ্বাস, লাউ সেনের সঙ্গে যে যুদ্ধে ইছাই ঘোষ পরাজিত ও নিহত হন তার আগে দেবী শ্যমরূপা ইছাই ঘোষকে স্বপ্নাদেশ দেন যে, সপ্তমীতে যুদ্ধে না গিয়ে অষ্টমীতে যেতে কিন্তু দেবীর কথা অমান্য করে তিনি সপ্তমীতেই যুদ্ধে যান এবং পরাজিত হয়ে প্রাণহারান।

স্থানীয় লোকেদের আজও বিভিন্ন পালাপার্বন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রচলিত একটি লোকগীতি গাইতে শোনা যায় –

“শনিবার সপ্তমী সামনে বারবেলা।
আজি রণে যাইওনা ইছাই গোয়ালা ।।”

মা দুর্গা নাকি ঐ ডাঙায় ভক্ত ইছাইয়ের জন্য কেঁদে বেড়ান তাই ঐ ডাঙার নাম কাঁদুনে ডাঙা ।অজয়ের উত্তর তীরে লাউসেনতলা’ নামে এক গ্রাম আছে। স্থানীয় প্রবাদ অনুসারে লাউসেন এই গ্রামেই তাঁর সৈন্য শিবির স্থাপন করেছিলেন। এখনো ডোম সম্প্রদায়ের বহু মানুষ দূরদূরান্ত থেকে প্রতি বছর ১৩ই বৈশাখ তারিখে এই অঞ্চলে আসেন তাঁদের স্বজাতি কালুবীরের পুজো করতে।

মা শ্যামরুপার মূর্তির কি হল ?

ইছাই ঘোষ নিহত হলে লাউসেনের পুরোহিত নাকি দেবী মূর্তিকে গড় জঙ্গলের ধারে অজয় নদে বিসর্জন দেয়।

পঞ্চকোট রাজবংশে নাকি বল্লাল সেনের সাথে কন্যা কল্যাণীর বিবাহ হয় । যৌতুক হিসেবে নাকি ঐ বিগ্রহ শিখর রাজারা পান ।[৩] নিজের শ্বশুরবাড়ী যাবার সময় সাথে করে ওই অষ্টধাতুর মূর্তি নিয়ে যান।

আসানসোলের বরাকরের কাছে হঠাৎই সেই মূর্তি তাঁর হাত থেকে পরে যায়। দেবী মূর্তি সেই স্থানেই থাকতে চাইছেন’ এমন ধারণার বশবর্তী হয়ে তিনি ওখানেই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন রাজা কল্যাণশেখর দেও। বরাকরের সেই দেবীই আজ কল্যাণেশ্বরী নামে পরিচিত। তবে গড় জঙ্গলের নবনির্মিত মন্দিরে পরে একটি প্রস্তরমূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়, যা আজও পূজো হয়।

রাণী কল্যাণীর পিতৃপরিচয় নিয়ে যথেষ্ট দ্বিমত আছে কারো মতে তিনি ইচ্ছাই ঘোষের পালিত কণ্যা। কারো মতে তিনি কাঁকশার কঙ্কসেন রায়ের কণ্যা । আবার কারো মতে বল্লাল সেনের কণ্যা। যাই হোক না কেন একটি তথ্য ঠিক শ্যামরুপা মূর্তিই কল্যাণেশ্বরী রুপে প্রতিষ্ঠিত।স্থানীয় লোককথা ও লোক সঙ্গীতেও ধ্বনিত হতে শোনা যায়-

পূর্বে বাড়ী সেন পাহাড়ী ছিলেন মা কল্যাণী।
শ্যামারূপা নাম ধর মা গহন বাসিনী।। [৫] [৮]

ইচ্ছাই ঘোষ ও লবসেনের সময়কাল নির্ণয়:

অনেকেই তাকে ২য় মহিপাল (১০৭০-৭১খ্রীঃ) কিংবা ১ম মহিপালের (৯৭৭- ১০২৭খ্রীঃ) সমসামযিক বলে মনে করেন। এ প্রসঙ্গে বলা যায় ২য় মহিপাল তার সিংহাসন আরোহনকালে অন্যান্য ভাইদের কারাবদ্ধ করেছিলেন ফলে “এই গৃহযুদ্ধের সুযোগে সম্ভবতঃ সামন্ত ও প্রদেশ শাসকবা আপনাদের স্বার্থ সাধনের চেষ্টায় বিদ্রোহ কবেছিলেন। এব মধ্যে দিব্বোক নামক জনৈক কৈবর্ত জাতীয কর্মচারী সম্ভবতঃ বিগ্রহ পালের আমলে উত্তব বাংলার শাসন কর্তা ছিলেন। বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধে ২য় মহীপাল নিহত হন এবং ববেন্দ্র দেশে দিব্যের স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

সেখানে ঈশ্বর ঘোষ ২য় মহিপালের রাজত্ব কালেও বৈদেশিক আক্রমণে (চোল ও কলচুরী) পশ্চিমবঙ্গে যে রাজনৈতিক বিপর্যয় ঘটে, সেই সুযোগেই মনে হয় ঈশ্বর ঘোষ বর্ধমানের গোপভূমের বিস্তৃত অঞ্চল দখল করে ঢেকুরে রাজধানী স্থাপন করেন এবং পালরাস্ট্রকে কর দেওয়া বন্ধ করেন।

ধর্মমঙ্গলের প্রাচীন কবি বলে পরিচিত ময়ূরভট্ট বিরচিত ধর্মমঙ্গলেও রয়েছে-

ঢেকুরের গঢ় তাহে ইছাই গোয়ালা রহে
রাজকর না দেয় য়ামার।
তুমি বট ধৰ্ম্মপুত্র তোমায় কথ্য কীত্য
জয়করি দেহ দুরাচার।।[৬]

 

সামন্ত সেন কি লবসেন ?

লব সেন বা লাউ সেনই বাস্তবে সামন্ত সেন ছিলেন এটা প্রমাণ করে দেওয়া যায়

১) বল্লালচরিতে সেন বংশকে কর্ণের বংশে জন্মানো লেখা পূর্বে লেখা হয়েছে। দীনেশচন্দ্র সেন কর্ণসেনের একটি তাম্রশাসন পাঠ করে জানাচ্ছেন, কর্ণসেন ১০৪২ খ্রিস্টাব্দে কাশীর কাছে ভূমিদান করেছেন। এই তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, কর্ণসেন বাংলায় আসেন পালরাজ নয়পালের সময় অর্থাৎ আনুমানিক ১০২৭-১০৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। এই তাম্রশাসন থেকে আরও জানা যাচ্ছে, কর্ণসেনের পুত্র লাউসেন ছিলেন খ্রিস্টিয় একাদশ শতাব্দীর শেষপাদের লোক।এখানে কর্ণ সেনের যে সময়কাল দেখাচ্ছে সেটা আদতে সামন্ত সেনের সাথে কাছাকাছি ই। সুতরাং এটি হওয়া খুবি সম্ভব ।

২) পূর্বে বাড়ী সেন পাহাড়ী ছিলেন মা কল্যাণী।
শ্যামারূপা নাম ধর মা গহন বাসিনী।।

পঞ্চকোট রাজবংশের তথ্য অনুযায়ী যদি বল্লাল সেনের থেকে যৌতুক হিসেবেই যদি তাঁরা শ্যামরুপা মূর্তিটি পেয়ে থাকেন। তবে সেন বংশের কাছে ঐ মূর্তিটি এল কিভাবে?

৩) ‘রাজারক্ষাসুদক্ষ’ ছিল হেমন্ত সেনের উপাধি, অর্থাৎ তিনি বা তাঁর পিতা রাজাকে রক্ষা করেছিলেন, সুতরাং বলা যায় এখানে রাজা বলতে নিশ্চয়ই পাল সম্রাট হবেন সুতরাং সামন্ত সেন মহীপাল দ্বিতীয়র সময়ে ছিলেন এবং সেই সময়েই রাঢ়ে ইছাই ঘোষের উত্থান হয়, এরপরে যখন রামপাল ক্ষমতায় আসেন তখন সামন্ত সেন ইছাই ঘোষকে পরাজিত করে রাঢ়ে পাল শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। তাহলে সামন্ত সেন লাউসেন অভিন্ন হবার কথা।

৪) আমাদের এই চতুর্থ প্রমাণটিই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ।কারণ এটাকে মোটামুটি প্রাথমিক সূত্র বলা চলে। পঞ্জরক্ষা নামে একটি নেওয়ারি পান্ডুলিপি পাঠোদ্ধার করা গেছে। মোটামুটিভাবে ১২৯০ খ্রি বৌদ্ধ লামা তারানাথ একটি পুঁথিতে লেখেন – চন্দ্রবংশীয় (?) লবসেনের বংশধরেরা আশী বৎসর রাজত্ব করিয়াছিলেন। মগধে এই সময় তীর্থিক (ব্রাহ্মণ্য) ধর্ম ক্রমশ বিস্তার লাভ করেছিল, এবং তাজিক (ইসলাম) ধর্মবিশ্বাসী অনেক লোকের উদয় হইতেছিল।[৯]

সেন বংশীয়রা সর্বত্র নিজেদের সোমবংশী লিখেছেন। এবং সেন বংশীয়রা বল্লাল ও লক্ষণ সেনের সময়কাল মিলিয়ে প্রায় ৮০ বছর মগধে শাসন করেন। সুতরাং উনি সেন বংশের কথা বলেছেন এতে সন্দেহ নেই।

৫) সেন বংশীয়দের আচার আচরণে কিছু ক্ষেত্রে প্রমাণ পাওয়া যায় ।বল্লালচরিত অনযায়ী বল্লাল সেন ডোম কণ্যাকে বিবাহ করেন। পদ্মিণীকে সেখানে বল্লাল সেন বলেছেন

“তুমি নিশ্চয়ই কোন নীচকূল সম্ভবা নও আমার বিশ্বাস তুমি ক্ষত্রিয়াণী”। এমন উদাহরণ পশ্চিম ভারতেও পাওয়া যায়। ভিলরা রাজপুতদের হয়ে লড়তেন। কিছু ক্ষেত্রে ভিলদের বিবাহের উল্লেখো পাওয়া যায়।

বল্লাল ডোমকণ্যাকে বিবাহে অপরাধ খুঁজে পাননি
কারণ তাঁর পূর্ব পুরুষ লবসেনের সেনাপতি কালু ডোম ছিল। সেই কারণে অনুমান করা যায় সেন রাস্ট্রের সাথে ডোমজাতির সম্পর্ক খুব খারাপ ছিল না।

৬) হাকন্দ মন্দির:-

লবসেনের রাজধানী ময়নাগড়ে একটি হাকন্দের দেউল পাওয়া যায়। ধর্মমঙ্গলে এই মন্দিরের উল্লেখ আছে।
লাউ সেন এখানে হাকন্দের উপাসনা করেন।

“দিবস দ্বাদশ দণ্ডে
হাকন্দতে নব খণ্ডে
হবে যবে রঞ্জার তনয়”

(‘ধর্মমঙ্গল’, ঘনরাম চক্রবর্তী)

অনুমান করা যায় লবসেন এই মন্দির তারপর প্রতিষ্ঠা করেন। ASIর ঐ মন্দিরের প্রতিষ্ঠাকাল নিয়ে মতামত পুরোপুরি মিলে যায় তাঁদের মতে এটি ১১ শতাব্দীর নির্মীত । যা সামন্ত সেনের সময়কালের সাথে সম্পূর্ণ মিলে যায়।

৭) এই প্রমাণটি গুরুত্বপূর্ণ এটি সম্ভবত সমস্ত বিন্দুকে একি সুত্রে গাঁথতে সক্ষম

অচরমপরমাত্মজ্ঞানভীষ্মাদ
মুষ্মানিজভূজমদমত্তা রাতিমারাঙ্কবীরঃ।
অভবদন বসানোদ্ভিন্ন নির্নীক্ততত্তদ্
গুণঐনিবহমহিম্নাং বেশ্ম হেমন্তসেনঃ।

কুলজী-গ্রন্থে লিখিত আছে, হেমন্তসেন, সুবর্ণরেখা তীরে কাশীপুরীতে রাজত্ব করিতেন। মেদিনীপুর জেলার কাশীয়াড়ির প্রাচীন নাম কাশীপুরী।[1]

এই সমস্ত প্রমাণ অনুযায়ী ধারণা করা যায় লব সেন ও সামন্ত সেন অভিন্ন|

 

উপসংহার:

লাউসেনের পর ময়নাগড়ে তাঁর পুত্র চিত্রসেন এবং তারপর এই বংশের উত্তরাধিকারী হিসেবে ধর্মসেন, কীর্তিচন্দ্র সেন, ২য় চিত্রসেন ও তিলকচন্দ্র সেনের নাম পাওয়া যায়। অনুমান করা যায় লব সেনের অপর পুত্র হেমন্ত সেন প্রথম জীবনে মেদিনীপুরে শাসন করতেন(যেমন লেখা) পরে দক্ষিণ ও পূর্ব বঙ্গে নিজের শাসন প্রসারিত করেন।

কেন সেন বংশীয়রা নিজেরা কোথাও লবসেনের উত্তরাধিকার স্বীকার করেননি সর্বত্র পাল সামন্ত হিসেবেই লিখেছেন। ( কারণ ?)

এখানে সামন্ত সেনের জন্মের সময়কাল নিয়ে অনেকের মতানৈক্য থাকতে পারে তবে যেহেতু বিজয় সেনের আগে কারো শিলালিপি পাওয়া যায়নি। তাই কুলজীভিত্তিক আলোচনাটি উহ্য থাকল। যদি আমরা এক্ষেত্রে জাতিগত বিতর্ক দূরে সরিয়ে রাখি (মাহিষ্য না বৈদ্য) তবেই প্রকৃত ইতিহাস উদ্ধার সম্ভব । 

* হাকন্দ উপাসনা পদ্ধতি সেই সময় খুব কস্টদায়ক ছিল।শরীরের মাংস কেটে যজ্ঞকুণ্ডে আহুতি দিতে হত ।

একভাবে পুজে হর কঠোর করিয়া ।। কুণ্ড করি জজ্ঞ করে নানা বস্তুদানে। কাটিয়া গায়ের মাংস ঘৃত দিয়া হুনে।।

মনে করা যায় শৈব গাজন হাকন্দ সাধনা থেকেই এসেছে ।[১০]

 

তথ্যসূত্র:

১). গৌড়ের ইতিহাস রজনীকান্ত চক্রবর্তী পৃ ১০০-৩
২) পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি বিনয় ঘোষ
৩) অহল্যাভূমি পুরুলিয়া
৪) ধর্মমঙ্গল- রূপরাম চক্রবর্তী।…. পৃঃ-৩০
৫) গোপভূমের স্বরুপ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি
৬).ধর্মমঙ্গল- ময়ূরভট্ট।…. পৃঃ-৭৪
৭) শ্রীধর্মমঙ্গল- ঘনরাম চক্রবর্তী।…. পৃঃ-১৭
৮) লোকগীতি-সংগ্রাহক- হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় (বীরভূম বিবরণ ২য়)।…. পৃঃ-২৪৫
৯) বাঙালির ইতিহাস নিহার রঞ্জন রায় পৃ ৫৫৬
১০) শ্রীকৃষ্ণবিজয়

 

লেখক পরিচিতি –  BTech. Ceramic Technology 

Comment here