-শ্রী সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়
শুভ নববর্ষ। কমন এরা নববর্ষে এই পৃষ্ঠায় লিখেছিলাম মুদ্রায় ক্যালেন্ডার স্টোন নিয়ে, বাংলার নতুন বছরেও বিষয় পঞ্জিকা, ক্যালেন্ডার বা দিনগণনা। মুদ্রায় আজ থেকে প্রায় ছ-হাজার বছর আগে তৈরি প্রাচীনতম এক মন্দিরের যজ্ঞবেদী ও সেই মন্দিরে থাকা পাথরে দিনগণনা পদ্ধতি।
ভারতের সূর্যসিদ্ধান্ত কীভাবে ইউরোপে পৌঁছেছিল সেকথা ক্যালেন্ডার প্রসঙ্গে আগেই আলোচনা করেছি। এবারের বিষয় পাথরে দিনক্ষণের হিসেব। প্রাচীনকালে একের পর পাথর গুণে গেঁথে দিন ও বছরের হিসেব রাখা শুরু করেছিলেন ভূমধ্যসাগরের ছোট্ট এক দ্বীপের মানুষ। পাথরে বিশেষ ক্রমে গর্ত করে তাঁরা দিন, সপ্তাহ, মাস ও সৌরবছর গণনা করতে শেখেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩৬০০ থেকে ৩২০০ বছরের পুরনো এই প্রত্নস্থল, বিশ্বে যত ধর্মীয় স্থান আজ অবধি আবিষ্কৃত হয়েছে তার অন্যতম। এই মন্দিরের নাম নড্রা। বিশাল এলাকায় ছড়ানো এই মন্দির যাতে আবহবিকারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে সেই জন্য এই প্রত্নস্থল বিশাল তাঁবু দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। তাঁবুটি বিশাল হবে নাই বা কেন?
৪৫৭ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৬০ হাজার বর্গকিলোমিটারের বেশি অংশ জুড়ে বিস্তৃত এই প্রত্নস্থল। ফলে তাঁবুর আকারও বিশাল। তাঁবু অবশ্য পুরো প্রত্নস্থল অন্ধকার করে দেয়নি। অর্ধস্বচ্ছ্ব বস্তু দিয়ে তৈরি এই তাঁবু।
নড্রা মন্দিরের ভিতরে রয়েছে যজ্ঞবেদী। বহু হাজার বছর আগে সেই বেদীতে পুজো ও বলি বন্ধ হয়ে গেলেও দিন গণনার পাশাপাশি আধুনিক যুগের স্থাপত্যের প্রাচীনতম নিদর্শনও এখানে রয়েছে: থাম, ছাজা প্রভৃতি। ছোট ছোট পাথরে তৈরি ছাজার (ইংরেজিতে লিন্টেন) আরও পুরনো নিদর্শন খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
ছাদের নিচে ও দরজা-জানলার উপরে যে অংশ বেরিয়ে থাকে তাকে ছাজা বলে। আলো-বাতাস ঢুকলেও যাতে বৃষ্টির জল সহজে না ঢোকে তার জন্যই এই বন্দোবস্ত। সৌন্দর্যও বাড়ে ভূমধ্যসাগরের দ্বীপ মালটার নড্রায় যে তিনটি সংলগ্ন তবে পরস্পরের সঙ্গে সম্বন্ধবিহীন প্রাচীন মন্দিরের অবশেষ পাওয়া গেছে সেগুলি কেন তৈরি করা হয়েছিল তার লিখিত বিবরণ পাওয়া যায় না। নানারকম হিসেব কষে এবং পাথর গুণ, তার বিন্যাস গবেষণা করে পণ্ডিতরা বুঝেছেন, মেগালিথিক (মেগা = বড়, লিথো= পাথর) এই প্রত্নস্থলটি শুধুমাত্র বিশ্বের প্রাচীনতম এক মন্দিরই নয়, এর মধ্যে রয়েছে বিশ্বের প্রাচীনতম এক পঞ্জিকাও। পাথরে করা গর্তের বিন্যাসে সাতদিন (চান্দ্রমাসের চার ভাগের একভাগ), মাস, চান্দ্রবছর (মোটামুটি ৩৫৪ দিন) এবং তার সঙ্গে আরও ১১ দিন যোগ করে সৌরবছর (মোটামুটি ৩৬৫ দিন) গণনা করার উপায় এই চুনাপাথরে রয়েছে।
এই প্রত্নস্থলের মধ্যে থাকা যজ্ঞবেদী স্থান পেয়েছে মালটার আধুনিক ইউরো মুদ্রায়। ইউরোপ আধুনিক হলেও তাদের আধুনিক অনেক মুদ্রাই প্রাচীনতার সাক্ষ্য দেয় যার কিছুটা তাদের একান্ত নিজস্ব, কিছুটা তারা গ্রহণ করেছে অন্য মহাদেশের সঙ্গে সাংস্কৃ্তিক আদানপ্রদানের ফলে।
নেড্রা (Mnajdra), হাজাড়িং (Ħaġar Qim), তাহাগ্রাত (Ta’ Ħaġrat) প্রভৃতি মন্দির বিশ্বের প্রাচীনতম প্রস্তরনির্মিত মন্দির যা পাথর জুড়ে নয়, পাথর সাজিয়ে তৈরি। এখানে যেসব নিদর্শন পাওয়া গেছে তা থেকে ইতিহাসবিদদের ধারনা, এইসব মন্দিরে বলি হত। পশুবলির ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেলেও নরবলির ব্যাপারে এখনও কেউ নিশ্চিত হতে পারেননি। আরও একটি আকর্ষণীয় প্রত্নবস্তু এখানে পাওয়া গেছে, পোশাকের অংশ-সহ পা। এটি কোনও দেবীমূর্তির একাংশ বলে মনে করেন পুরাবিদরা। ১৯০২ সালে আবিষ্কৃত এই প্রত্নক্ষেত্র ১৯৯২ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ইউরোজোনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে ২০০৮ সালে ইউরো মুদ্রা চালু করেছে মালটা।
ভূমধ্যসাগরের সিসিলি দ্বীপ ও আফ্রিকার মূল ভূখণ্ডের মাঝে থাকা ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র মালটার বর্তমান মুদ্রা ইউরো। ১০০ ইউরো সেন্টে ১ ইউরো। এদেশের ১, ২ ও ৫ ইউরো সেন্ট মুদ্রার একদিকে নড্রা মন্দিরের যজ্ঞবেদী ছাপা হয়েছে। দেওয়াল থেকে এগিয়ে থাকা অংশ যাতে ভেঙে না পড়ে সেই জন্য বাঁকাভাবে পাথর, ধাতু বা কাঠের ঠেকা দেওয়া অংশ উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর অসংখ্য স্থাপত্যে দেখা যায়। সেগুলি নকশা করা, নান্দনিক। ইউরোপীয় স্থাপত্যের প্রভাব বিশ্বের যেসব অংশে রয়েছে সেখানে তো বটেই, প্রাচীন ভারতের স্থাপত্যেও থাম ও ছাজার কাজ দেখা যায়। তাদের ছাজা ও থাম অবশ্য নকশা করা নয়। মালটার নড্রায় যে নিদর্শন রয়েছে যা তারা ছেপেছে তাদের আধুনিকতম মুদ্রায়।
(লেখক পরিচিতি – প্রাক্তন সাংবাদিক, বর্তমানে ভাষাতত্ত্ববিদ; ইতিহাস চর্চা ও মুদ্রা সংগ্রহ তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান অঙ্গ)
Comment here
You must be logged in to post a comment.