সংস্কৃতিস্বভূমি ও সমকাল

হারিয়ে যাওয়া লেখা –

 

— শ্রী পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায়

 

স্নিগ্ধ শ্যামল পল্লীপ্রকৃতি, সুনিবিড় আলো-ছায়া
জাগে সে হরিৎ প্রান্তরে আজও, তবু কোন মিছে মায়া
টানে নির্মম শূন্যের দিকে, কী বিপুল বিস্মৃতি !
জাগিয়ে আত্ম-বিসর্জনের নষ্ট সংস্কৃতি —
মুছে দিল ছোট তুলসীমঞ্চে সাঁঝের পিদিমটিকে
ভাঙা একতারা, নিরুৎসবের আঁধার চতুর্দিকে।
পূণ্যিপুকুর, মাঘমণ্ডল, সেঁজুতির ব্রতগুলি !
আমরা ভুলেছি, নিমাই-অঙ্গে সোনা হয়ে যাওয়া ধূলি।
নবান্নে পাওয়া নতুন ফসল, শস্যে ছাপানো গোলা
মনে পড়ে আজও, কত না দৃশ্য স্মৃতিজুড়ে থাকে তোলা।

চড়কের মাঠে গিয়েছি মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে চোখে
যেন অবিরত পাকে বেঁধে ফেলা প্রকাণ্ড সূর্যকে !
শলাকাবিদ্ধ ছাইমাখা দুটি উড়ন্ত সন্ন্যাসী —
আজও ঘুরে চলে, শিবের গাজনে বহুরূপী ক্ষ্যাপা কাশী
ব্রতচারী — লাঠি খেলার সঙ্গী, পালিয়ে গিয়েছে কবে !
খুশিতে পৌষ-পার্বণ ছিল পিঠে-পুলি উৎসবে।
আর ছিল রাসপূর্ণিমা তিথি, শিশুদের মণিমেলা
ছোট্ট উঠোনে পুতুল সাজিয়ে ছিল ঝুলনের খেলা।
বালু দিয়ে গড়া মরুভূমি, আর পাহাড়ের ছোট নুড়ি
কত না লড়াকু মাটির সৈন্য — গল্পে ছিল না জুড়ি।

ভুলিনি, পয়লা বৈশাখে পাওয়া রসভরা সন্দেশ
গানে-কবিতায় পুলকিত প্রাণ, কেটে গেছে তার রেশ।
দোলপূর্ণিমা, ছিল যে আগের রাত্তিরে নেড়াপোড়া!
দু’পয়সা ফুটকড়াই ও মঠ, লুটের বাতাসা ছোঁড়া —
সবই মনে পড়ে, বড় ভালো হতো সেই দিন ফিরে পেলে
কার্তিক মাসে সন্ধ্যাবেলায় আকাশপ্রদীপ জ্বেলে
কী যে অফুরান আনন্দ, তাকে যায় না সেভাবে বলা
বিশ্বকর্মা পুজোয় ছাদেতে ঘুড়ি কেটে পথ চলা —
তবে কি এবার শেষ হয়ে গেল ? মাহেশের রথ টেনে
কত মজা হতো, ইতিহাস থেকে নিতে হবে তাকে জেনে ?

ভাবতে পারি না, চোখের পাতায় অজান্তে আসে জল !
ছিল সরস্বতী পুজোর সকালে গোটাসেদ্ধর চল।
ভোরবেলা তেল হলুদ মেখেছি, সকালেই অঞ্জলি
তারপরে খাওয়া প্রসাদের কুল, কাকে সেই কথা বলি ?
মনে পড়ে ইতুপুজোর সে ছবি ! মায়েদের ব্রতকথা !
সে কি ভোলা যায় ? মনের ভিতরে শুধুই বিষণ্নতা।
বুড়ো শিব আর অন্নপূর্ণা পুজোর সকালে ভিড়
সে-ও মনে আছে, জন-কলরোলে ভরা গঙ্গার তীর,
বাসন্তী পুজো — মনে পড়ে যায়, কী-বা হবে মনে রেখে ?
আকাশের রঙ পাল্টাবে ফের, ঘুঘুপাখি যাবে ডেকে।

 

(লেখক পরিচিতি – মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক। জাতীয়তাবাদী কবি ও প্রাবন্ধিক। প্রকাশিত গ্রন্থ : রাত বারোটার সূর্য (কাব্যগ্রন্থ), প্রকাশ্য আড়াল ( কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধগ্রন্থ ), লিমেরিক ৫০ (ননসেন্স ভার্স), এবং ‘বাঙালি হিন্দুর ধূসর ভবিষ্যৎ’ (নিবন্ধগ্রন্থ)।)

 

Comment here