সংস্কৃতিস্বভূমি ও সমকাল

মৃত্যু

 

শ্রী হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

“ভয়াৎ অস্য মৃত্যুর্ধাবতি”
“ইহার ভয়ে মৃত্যু সঞ্চরণ করিতেছে”

 

বৃক্ষ সকলেরও পত্রহীন হইবার নির্দিষ্ট সময় আছে, উত্তম উত্তম পুষ্প সকলও এক এক বিশেষ ঋতুতে নষ্ট হইয়া যায় এবং চন্দ্র সূর্য প্রভৃতি গ্রহ নক্ষত্রগণও যে কোন কোন সময়ে আমাদিগের দৃষ্টির অগোচর হয় তাহাও আমরা বলিতে পারি, কিন্তু হে মৃত্যু! তুমি সকল ঋতুতে ও সকল কালেতেই আমাদামদিগের উপর রাজত্ব করিতেছ। আমরা ইহাও জ্ঞাত আছি, যে কখন চন্দ্রকোলার হ্রাস আরম্ভ হইবে, কোন ঋতুতে পক্ষী সকল একদেশ পরিত্যাগ পূর্ব্বক অন্যত্র গমন করিবে, বা কোন সময়ে শরৎ কালের প্রচন্ড তপনোত্তাপ ধান্যময় ক্ষেত্র সকলকে হরিদ্বর্ণ করিবে; কিন্তু ইহা কে বলিতে পারে যে, আমি কোন দিবস মৃত্যুগ্রাসে প্রতি হইব।

যখন বসন্ত আসিয়া মন্দ মন্দ বায়ু ব্যাজন করতঃ বৃক্ষদিগকে নব পল্লবে সুসজ্জিত করে, সেই সময় কি মনুষ্যের মৃত্যুর কাল? অথবা যে ঋতুতে গোলাব প্রভৃতি উত্তমোত্তম পুষ্প সকল প্রস্ফুটিত হইতে নিরস্ত হয়, সেই সময় মনুষ্যের মৃত্যুর কাল? না; বৃক্ষ সকলের প্রায় একটি কালই নিরূপিত, কিন্তু মনুষ্যের সকল কালই মৃত্যুর কাল।

হে মৃত্যু! তুমি গভীর সমুদ্রের তরোগের উপর দন্ডায়মান আছ, যে অট্টালিকায় নৃত্যগীত বাদ্য দ্বারা সকলেই আমোদিত হইতেছে সেখানেও তুমি আছ, তুমি বন্ধুদিগের পরামর্শস্থলেও আছ, তুমি বটবৃক্ষতলে ক্লান্ত ও বিশ্রাম রত পথিকের নিকটেও আছ, তুমি প্রতি গৃহে গৃহে ও প্রতি পরিবারের মধ্যেও স্থিতি কর এবং ঘোরতর সংগ্রামেও তুমি আরও ভীষণ মূর্ত্তি ধারণ কর। তুমি এ পৃথিবীতে একাধিপতি হইয়া এক পুরীর ন্যায় ইহাকে শাসন করিতেছ। তোমার হভয়ে রাজাধিরাজ সম্রাটগণাবিধি নীচ জাতি প্রজা পর্য্যন্ত সকলেই কম্পান্বিত নিজ নিজ কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইতেছে।

হে মৃত্যু! তুমি ন্যায়পরায়ণ হইয়া প্রজার সুখের নিমিত্ত ধর্ম্মতই রাজত্ব করিতেছ। ইহা তোমার দোষ নহে, যে বিদ্রোহী পাপীরা তোমাকে ভয়ানক বলিয়া মানে। তুমি তোমার প্রজাদিগকে, তাহাদেরই মঙ্গলের নিমিত্ত পরমেশ্বরের প্রতি আন্তরিক ভক্তি শ্রদ্ধা করিতে ও পাপ কর্ম্ম হইতে নিরস্ত কইতে কহ; কিন্তু যাহারা তোমার এই সুহৃদাক্য লঙ্ঘন করে, তাহারা ইহলোকে ও পরলোকে তদুপযুক্ত দণ্ড প্রাপ্ত হয়। তুমি মদ্য অহিফেন প্রভৃতি মত্তকারী ও আয়ুনষ্টকারী দ্রব্য সকল গলাধঃকরিতে নিষেধ কর, কিন্তু তোমার বাক্য অবহেলন করিয়া, তাহারা নিত্যই আপন আপন দোষবশতঃ তোমার করাল গ্রাসে পতিত হইয়া প্রাণত্যাগ করে। তুমি যুদ্ধেতে, মনুষ্যদিগের প্রতি স্নেহবশতঃ অতিশয় বিমুখ, কিন্তু তোমাকে যাহারা না ভয় করিয়া উহাতে প্রবৃত্ত হয়, তাহাদিগের শত সহস্রকে এক এক মুহূর্তে ধ্বংস করিয়া ফেল; কিন্তু ইহা তুমি রাগান্বিত বা অহিতার্থী হইয়া কর না; বরং সর্ব্বসাধারণের মঙ্গলেরই নিমিত্ত করিয়া থাক।

যদি কোন এক দেশীয় লোকেরা তোমার অভিপ্রায় স্পষ্টরূপে অবগত হইয়াও তাহা অগ্রাহ্য করিয়া, তোমার অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধে কর্ম্ম সংকল্প ক্রমাগতই করিয়া থাকে, তাহা হইলে তাহাদিগের দুৰ্ভাগ্যের ন্যায় আর কাহারও দুর্ভাগ্য এজগৎ সংসারে দেখিতে পাওয়া যায় না। হয় তাহারা যে অবধি তাহাদিগের ধর্মোন্নতি না হয়, সেই পর্য্যন্ত, অন্য এক দেশের অধীনত্ব স্বীকার করিয়া অসহ্য ক্লেশ সহ্য করে, অথবা অচিরে বিনাশ প্রাপ্ত হয়। যেমন কোন চিত্রকর কতকগুলিন বস্তু উত্তমরূপে চিত্রে অংকিত করিবার কালে যদি তাহার মধ্যে দুটি একটি চিত্র মন্দ হইয়া উঠে, তাহা হইলে সেই মন্দগুলিকে পুঁছিয়া ফেলিতে কষ্ট বোধ করেন না, কিম্বা কৃষক যেমন কোন স্থান আবাদ করিতে গেলে, উহার কণ্টকময় ও অন্যান্য হানিকর আগাছা সকল কাটিয়া ফেলিতে কুন্ঠিত হয় না, মৃত্যুও সেইরূপ পাপী ব্যক্তিদিগের দণ্ডদানে বা তাহাদিগের বিনাশ সাধনে কোনরূপ সঙ্কোচ প্রকাশ করে না। সংসারের মঙ্গলের নিমিত্তই পরমেশ্বর এখানে মৃত্যকে প্রেরণ করিয়াছেন। মৃত্যু তাঁহার প্রহরী।

মৃত্যুর দণ্ডভয়েই জগতে শান্তি বিরাজ করিতেছে।

 

সংক্ষেপে – মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয় পুত্র হলেন শ্রী হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৪ – ১৮৮৪)। বংশগত সংস্কৃতি, নব্যলব্ধ ব্রাহ্ম আদর্শ ও জীবনবোধ, অসামান্য শারীরিক শক্তি ও মলযুদ্ধে পারদর্শিতার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন তিনি সমাজ মাঝে। তাঁর পুত্র শ্রী ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিভাস্কর দ্বারা সম্পাদিত ‘হেমজ্যোতি’ (প্রকাশিত – ১৩১১ সাল) হতে গৃহীত হয়েছে এই অনুপম প্রবন্ধটি।