আঙিনা

‘ইংরেজি টিংরেজি কিছু’ –

আগের কিস্তিতে বলেছিলাম বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলোয় ইংরেজি শিক্ষার ক্ষেত্রে ত্রুটিগুলো কী বলে আমি মনে করি। অল্প কথায় বলতে গেলে, সেখানে সমস্যা হল এই যে, শিক্ষক-শিক্ষিকারা ছেলেমেয়েদের মাথায় ঢুকিয়ে দেন যে, ইংরেজি ব্যবহার করতে গেলে, বিশেষ করে বলতে গেলে, সর্বপ্রথম ইংরেজি ব্যাকরণের ওপর অসামান্য দখল অর্জন করতে হবে। তাঁরা ভুলেই যান যে, যারা ভাষা ব্যবহার করতেই ভয় পাচ্ছে তাদের কাছে ব্যাকরণ শাস্ত্রের কোনো মূল্য/প্রয়োজনীয়তাই থাকতে পারে না। ফলে, যেহেতু ব্যাকরণ ছেলেমেয়েদের “অসামান্য” হয়ে ওঠে না (সম্ভবও নয়; আলোচ্য শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ব্যাকরণ জ্ঞানই ভয়াবহ কিছু বিরল মানুষ বাদ দিলে) তাই তারা স্কুলজীবনে সাহস করে ইংরেজি – বিশেষ করে কথ্য ইংরেজি – ব্যবহারই করে উঠতে পারে না।

আবার, আরও একটা সমস্যা রয়েছে বাংলা মিডিয়মগুলোতে। ব্যতিক্রমী কোনো ছেলে বা মেয়ে, নিজস্ব মেধার কারণে, বা পারিবারিক শিক্ষার সুফল হিসেবে, অথবা এই দুই কারণেই যদি ইংরেজিতে স্বচ্ছন্দ হয়/ভবিষ্যৎ জীবনে তার জন্য ইংরেজি কতটা গুরুত্বপূর্ণ/অপরিহার্য হয়ে উঠতে চলেছে হৃদয়ঙ্গম করে ইংরেজির ওপর বাড়তি জোর দেয়া শুরু করে, স্কুলে ইংরেজিতে কথা বলতে উদ্যোগী হয়, তবে সবচাইতে বেশি discouragement আসে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরই কাছ থেকে। আর তাছাড়া বন্ধু বান্ধবের প্যাঁক ত আছেই! ফলতঃ বাংলা মাধ্যমের প্রডাক্ট অথচ ইংরেজিতে রীতিমতো সাবলীল এর’ম কেস দেখলে বুঝতে হবে ব্যক্তিটি হয় নিজে অত্যন্ত মেধাবী, অথবা কোনো অভিজাত পরিবার থেকে এসেছে, অথবা দুই-ই। এদের ইংরেজিতে দক্ষ হওয়ার পেছনে স্কুলের কোনো ভূমিকাই থাকে না।

এবার আসি গড়পড়তা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর কথায়। এগুলোতে পড়লেই কেউ শুধুমাত্র ইংলিশ মিডিয়ম বলেই দুর্ধর্ষ কিছু ইংরেজি বলতে বা লিখতে শিখে যায় না কিন্তু, তবু বলব, আজকের দিনে ইংরেজি মাধ্যম অপরিহার্য।

ইংরেজি মাধ্যমের ভালো দিকগুলো আলোচনার আগে খারাপ দিকগুলো আলোচনা করে নিই বরং।

প্রথমতঃ এসব স্কুলে যে-ইংরেজি শেখানো হয় তা খুব একটা contemporary নয়। বহু প্রায়াবলুপ্ত এমনকি অধুনা অবলুপ্ত, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কাম্পানির অচল উত্তরাধিকার হিসেবে থেকে যাওয়া শব্দ, শব্দবন্ধ, ব্যবহার, ইত্যাদি এসব স্কুলগুলোতে শেখানো হতে থাকে। দ্বিতীয়ত, আগেই বলেছি, গ্র‍্যামারের আলাদা করে ক্লাসই সাধারণত নেয়া হয় না। ফলে এসব স্কুল থেকে বেরোনো অনেকেরই ব্যাকরণের ওপর দখল হয় শোচনীয়। আর, তৃতীয়তঃ ইংরেজি উচ্চারণ! পাহাড়ের দিকে দু’একটা ইংরেজি স্কুল বাদ দিলে কোনো ব্রিটিশ (ইংরেজ, স্কটিশ, ওয়েলশ, বা আইরিশ) এসব স্কুলের সঙ্গে আজকাল রেক্টর বা অন্য কোনো দায়িত্বে যুক্ত আর থাকেন না। অতএব সাহেবী স্কুলে খোদ সাহেবের কাছ থেকে ইংরেজি শেখার সুযোগ আজকাল আর সুলভ নয়। বরং যাঁরা এসব স্কুলে তাঁদের বিকৃত উচ্চারণ নিয়ে থাকেন (দক্ষিণ ভারতীয় হলে ত কথাই নেই) তাঁদের কাছে থেকে ছাত্রছাত্রীরা কীর’ম উচ্চারণ শেখে তা ত আর আলাদা করে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন দেখি না।

কিন্তু এসব সত্ত্বেও আবারও বলব, ইংরেজি মাধ্যম অপরিহার্য। সবচাইতে বড় কথা হল, এখানকার ছাত্রছাত্রীরা এক্কেবারে শৈশব থেকেই শেখে যে, ইংরেজি আরেকটি ভাষা বই কিছু নয়। তাদেরকে বাধ্য করা হয় মাতৃভাষা চৌকাঠের ওপারেই রেখে আসতে এবং, যতক্ষণ স্কুলে তারা থাকবে ততক্ষণ ইংরেজি এবং শুধুমাত্র ইংরেজিতেই কমিউনিকেট করতে। ফলে, যে-আতঙ্ক একটা গড়পড়তা বাংলা মিডিয়মের পড়ুয়ার মনে জন্ম নেয় ইংরেজির প্রতি সেটা, এই ছেলেমেয়েগুলোর মনে তৈরী হওয়ার সুযোগই পায় না। বরং ছেলেবেলা থেকেই তারা এটা শিখে বড় হয় যে, আমার দুটো ভাষা। একটা বাড়ির অর্থাৎ মাতৃভাষা, আরেকটা স্কুল তথা ব্যবহারিক জীবনের অর্থাৎ, ইংরেজি। এটাই বাকি জীবনের জন্য বাংলা মিডিয়মদের সঙ্গে এদের পার্থক্য এমনকি বৈষম্যটাও গড়ে দেয়। এদের ইংরেজি শিক্ষা বাংলা মাধ্যমের মতো সেকন্ড হ্যান্ড অ্যাপ্রোচে (w-a-t-e-r water, water মানে জল) অর্থাৎ বাংলার সাহায্যে ইংরেজি শেখা নয়। তাই যেটা সবচাইতে প্রয়োজনীয় সেটা তারা বড় হতে হতে দিব্যি আয়ত্ত করে ফেলেঃ ইংরেজিতেই চিন্তা করার ক্ষমতা। বাংলার ক্রাচ বগলে না নিয়েই ইংরেজিতে ভাব প্রকাশ এবং ইংরেজিতে করা প্রশ্নের উত্তর বাংলায় অনুবাদ না করেই সরাসরি ইংরেজিতেই উত্তর দেয়া।

এ-আলোচনা সামনের কিস্তিতেও চলবে। কাঞ্জিক-এর সঙ্গে থাকুন।

 

(ক্রমশঃ)

Comment here