শাশ্বত সনাতন

নাসদীয় সূক্ত : অনুবাদ ও আলোচনা

– শ্রী রাকেশ দাশ

নাসদাসীন্নো সদাসীৎ ইত্যাদি মন্ত্রের দ্বারা প্রারব্ধ এই সূক্তটি বেদের তো বটেই, সমগ্র জগতের উচ্চতম দার্শনিক ভাবনাগুলির মধ্যে অন্যতম। এই সূক্তটিতে সৃষ্টির বর্ণনা রয়েছে। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রূপক গর্ভিত এই সূক্তটিতে চরাচর সৃষ্টির আদিতে কী ছিল এবং কীভাবে এই সৃষ্টির সূত্রপাত হল– তার একটি অনবদ্য বর্ণনা রয়েছে। এই সূক্তে সৃষ্টির আদিতে দেশ (space) এবং কালের (time) অস্তিত্বের নিষেধ করা হয়েছে। জীবের কর্মফলই সৃষ্টির কারণ– সেই বিষয়ে আলোচনা রয়েছে। জীবের ফলপ্রদানোন্মুখ সুপক্ব কর্মফলের অভাব প্রলয়ের কারণ সেই বিষয়টিও এখানে বর্ণিত।

স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর ‘ধর্মবিজ্ঞান’ নামক প্রবন্ধে লিখেছেন, “জগতের মধ্যে প্রাচীনতম শাস্ত্র ঋগ্বেদে সৃষ্টি বর্ণনাত্মক অপূর্ব্ব কবিত্বময় শ্লোক আছে; যথা— নাসদাসীন্নো সদাসীত্তদানীং, তম আসীৎতমসা গুঢ়ম্ অগ্রেঽপ্রকেতং, কিম্ আবরীবঃ ইত্যাদি। (নাসদীয় সূক্ত) অর্থাৎ যখন সৎও ছিল না, অসৎও ছিল না, তমের দ্বারা তম আবৃত ছিল, তখন কি ছিল? আর ইহার উত্তর দেওয়া হইয়াছে যে, আনীদ্ অবাতং ইত্যাদি। ইনি (সেই অনাদি অনন্ত পুরুষ) গতিশূন্য বা নিশ্চেষ্ট ভাবে ছিলেন। প্রাণ ও আকাশ তখন সেই অনন্ত পুরুষে সুপ্তভাবে ছিল, কিন্তু কোনরূপ ব্যক্ত প্রপঞ্চ ছিল না। এই অবস্থাকে অব্যক্ত বলে— উহার ঠিক শব্দার্থ স্পন্দনরহিত বা অপ্রকাশিত। ক্রমবিকাশের জন্য একটা নূতন কল্পের আদিতে এই অব্যক্ত স্পন্দিত হইতে থাকে, আর প্রাণ আকাশের উপর ক্রমাগত ঘাতের পর ঘাত দিতে দিতে ক্রমশঃ উহা স্থূল হইতে থাকে, আর ক্রমে আকর্ষণবিকর্ষণ-শক্তিদ্বয়ের বলে পরমাণু গঠিত হয়।”

এই সূক্তটিকে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি সম্বন্ধে হিন্দু ধারণার উদ্গম স্থল বলা চলে। হিন্দু সৃষ্টি তত্ত্বের সঙ্গে অহিন্দু সৃষ্টি তত্ত্বের মূল পার্থক্য হল চেতনায়। হিন্দু মতে সৃষ্টি হল চেতন থেকে চেতনের বিস্তার, চেতনার সূক্ষ্মতম স্তর থেকে স্থূলের অভিব্যক্তি। অন্যদিকে পাশ্চাত্ত্য ধারণায় চেতনা আকস্মিক। জড় থেকে জড়েরই বিস্তার হল সৃষ্টি। দ্বিতীয় মতটিতে সর্বব্যাপ্ত, সর্বদা স্পন্দনশীল এবং স্বতঃসিদ্ধ, স্বয়ং প্রকাশিত চেতনার তত্ত্বটি অধরা থেকে যায়। কিন্তু এই সূক্তে সৃষ্টির যে ক্রম এবং বিকাশের বর্ণনা রয়েছে সেখানে সৃষ্টির চেতনাময়তা ছত্রে ছত্রে পরিস্ফুট।

বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম আচারসংহিতা, সমাজবিজ্ঞান এবং আইন সংক্রান্ত গ্রন্থ মনুস্মৃতিতে দেখা যায় যে, স্মৃতিকার মনু নিজের রচনা শুরু করেছেন নাসদীয় সূক্তে বর্ণিত প্রলয়কালীন অবস্থার বর্ণনা দিয়ে।
আসীদ্ ইদং তমোভূতম্ অপ্রজ্ঞাতম্ অলক্ষণম্।
অপ্রতর্ক্যম্ অবিজ্ঞেয়ম্ প্রসুপ্তম্ ইব সর্বতঃ॥ (মনুস্মৃতি ১/৫)
এই সমস্ত কিছুই তমঃস্বরূপ ছিল, অজ্ঞাত ছিল। এর কোন লক্ষণ বা পরিচয় সূচক চিহ্ন ছিল না। একে কল্পনা করা যায় না, জানা যায় না। সেই তত্ত্ব যেন সর্বত্র প্রসুপ্ত অবস্থায় ছিল।

স্বামী বিবেকানন্দ এই সূক্তটির একটি সার্থক, গম্ভীর, পদ্যাত্মক ইংরেজি ব্যাখ্যা করেছেন। সেই রচনাটির নাম The Hymn of Creation। বিখ্যাত দার্শনিক রাইমন পাণিক্করও এই সূক্তের একটি ইংরেজি অনুবাদ করেছন। প্রসঙ্গতঃ, রাইমন পাণিক্কর ভারতীয় পিতা এবং স্পেনীয় মাতার সন্তান ছিলেন এবং প্রসিদ্ধ ক্যাথলিক Priestছিলেন।বিখ্যাত বিজ্ঞান প্রবন্ধ লেখক কার্ল সাগান তাঁর Cosmos: A Personal Voyage নামক গ্রন্থমালার দশম খণ্ডে এই সূক্তের উল্লেখ করেছেন। ভারত সরকারের অধীন Public Service Broadcaster প্রযোজিত ভারত : এক খোজ নামক ধারাবাহিকের ৬৩তম পর্বের আনুষঙ্গিক রূপে এই সূক্তের একটি হিন্দী অনুবাদ উপস্থাপন করা হয়েছে।

বেদের অনুবাদকর্তাদের মধ্যে Max Muller, Horace Herman Wilson, R T H Griffith, A A Macdonell, A L Basham, Wendy Doniger, Joel E Bereton, Tulsi Ram প্রভৃতিরা এই সূক্তের অনুবাদ করেছন।

নাসদ্ শব্দের সঙ্গে ছ-প্রত্যয়ের যোগে নাসদীয় শব্দের নিষ্পত্তি। ‘নাসদ্’ এই শব্দ যে সূক্তে আছে (নাসদ্ শব্দঃ অস্তি অস্মিন্ সূক্তে) সেই সূক্তের নাম নাসদীয়। এই প্রসঙ্গে ‘মতৌ ছঃ সূক্তসাম্নোঃ’ (অষ্টাধ্যায়ী ৫.২.৫৯) এই সূত্রটি পর্যালোচনীয়। যেহেতু সূক্তটি সুরু হচ্ছে নাসদাসীন্নো আদি মন্ত্র দিয়ে শুরু হচ্ছে এবং সূক্তটির প্রথমেই নাসদ্ এরকম উচ্চারণ পাওয়া যায় সেজন্য এর নাম হয়েছে নাসদীয়।

সূক্তটি ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ১২৯ তম সূক্ত। এটি দশম মণ্ডলের একাদশ অনুবাকের প্রথম সূক্ত। দশম মণ্ডলের একাদশ অনুবাকে ২৩টি সূক্ত বর্তমান। এই সূক্তটিতে সাতটি মন্ত্র। প্রত্যেক মন্ত্রেরই ছন্দ ত্রিষ্টুপ্। পরমেষ্ঠী নামক প্রজাপতি এই সূক্তের ঋষি। এই সূক্তে আকাশাদি ভাব পদার্থ সমূহ এবং সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের বর্ণনা রয়েছে। সেজন্য এই সমস্ত কিছুর কর্তা পরমাত্মাই এই সূক্তের দেবতা। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণের দ্বিতীয় অষ্টকে অষ্টম প্রপাঠকের নবম অনুবাকে শুক্ল ও কৃষ্ণ পশুর সংস্কার প্রসঙ্গে এই সূক্তের বিনিয়োগ বলা হয়েছে। অমাবস্যা ও পূর্ণিমাতে একই গর্ভে উৎপন্ন শুক্ল ও কৃষ্ণ পশুর দ্বারা উপহোমের নির্দেশ রয়েছে। আপস্তম্ব শ্রৌতসূত্রের ঊনবিংশ প্রশ্নের ষোড়শ কণ্ডিকায় এই কাম্যপশুযাগের বিস্তৃত বর্ণনা পাওয়া যায়। সেখানে ২৩ তম সূত্রে (তত্র সলিলম্ উপজুহুয়াৎ) জল দ্বারা উপহোমের উল্লেখ রয়েছে। সেই সলিলোপহোমে এই সূক্তের মন্ত্রগুলির বিনিয়োগ। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণের ভাষ্যে (২/৮/৯) সায়ণ বলেছেন, “যদ্ উক্তং সূত্রকারেণ– তত্র সলিলম্ উপজুহুয়াদ্ ইতি। তত্র পূর্বোক্তে কর্মণি নাসদীয়সূক্তগতৈর্মন্ত্রৈর্জলদ্রব্যেণোপহোমাঃ কর্তব্যা ইত্যর্থঃ।” সূত্রকার অর্থাৎ আপস্তম্ব বলেছেন, আলোচ্য কাম্যপশুযাগে নাসদীয় সূক্তের মন্ত্রোচ্চারণ পূর্বক জলের দ্বারা উপাহুতি দিতে হবে। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণের শ্রুতি অনুসারে এই যজ্ঞের বিস্তৃত বিধান আপস্তম্ব নিজ শ্রৌতসূত্রে করেছেন। সেই যজ্ঞের বর্ণনা প্রসঙ্গে সলিলহোমের কথা বলা হয়েছে।

উল্লেখ্য, এই সূক্তটি ব্রহ্ম তত্ত্বেরই ব্যাখ্যা করে। সেই অর্থে এই মন্ত্রগুলি উপনিষৎ-পদবাচ্যও হতে পারত। কারণ, যে শ্রুতির অজ্ঞান নাশ পূর্বক ব্রহ্মপ্রাপ্তিতে সহায়ক হয়, এবং সেই শ্রুতি কোন কর্মে বিনিযুক্ত নয় সেই শ্রুতিকেই উপনিষৎ বলা হয়। নাসদীয় সূক্তের মন্ত্রগুলিও ব্রহ্মতত্ত্বেরই বিবরণ দেয়। কিন্তু কাম্য কর্মে বিনিয়োগ থাকার দরুন এই শ্রুতিকে উপনিষৎ বলা হয় না। কিন্তু, এই শ্রুতির বিষয় উপনিষদেরই সমতুল।
প্রথম মন্ত্র–
नास॑दासी॒न्नो सदा॑सीत्त॒दानीं॒ नासी॒द्रजो॒ नो व्यो॑मा प॒रो यत्।
किमाव॑रीवः॒ कुह॒ कस्य॒ शर्म॒न्नम्भः॒ किमा॑सी॒द्गह॑नं गभी॒रम्॥१॥
নাসদাসীন্নো সদাসীৎ তদানীং নাসীদ্ রজো নো ব্যোমা পরো যৎ।
কিমাবরীবঃ কুহ কস্য শর্মন্নম্ভঃ কিমাসীদ্ গহনং গভীরম্॥১॥
অন্বয়
তদানীং ন অসৎ আসীৎ, নো সৎ আসীৎ, ন রজঃ আসীৎ, নো ব্যোমা, যৎ পরঃ। কিম্ আবরীবঃ? কুহ? কস্য শর্মন্? গহনং গভীরম্ অম্ভঃ কিম্ আসীৎ?
প্রতিপদার্থ
তদানীং– সেই সময়ে
ন অসৎ আসীৎ– অসৎ ছিল না
নো সৎ আসীৎ– সৎ ছিল না
ন রজঃ আসীৎ– লোকসমূহ এবং ত্রিগুণ ছিল না
নো ব্যোমা– আকাশাদি পঞ্চ ভূত, অন্তরিক্ষ প্রভৃতি লোকসমূহও ছিল না
যৎ পরঃ– অন্তরিক্ষলোকের ঊর্ধ্বতন সত্যলোক পর্যন্ত সমস্ত লোকও ছিল না
কিম্ আবরীবঃ?– এই সমস্ত লোকসমূহের অভাবে তাদের আবরক বা সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডের আবরক সূক্ষ্মভূতসমূহও ছিল কি? (ছিল না। আবরণীয় পদার্থের অভাবে আবরক কেন থাকবে?)
কুহ?– কোথায় বা থাকবে?
কস্য শর্মন্?– কার ভোগের জন্য থাকবে?
গহনং গভীরম্ অম্ভঃ কিম্ আসীৎ?– গহন, গভীর জল কি ছিল?

ভাবানুবাদ –

প্রলয়াবস্থায় যখন সমস্ত সৃষ্টি নিজ কারণে লয়প্রাপ্ত হয় তখন অসৎ অর্থাৎ অত্যন্ত অলীক বা শূন্যস্বরূপ কিছু ছিল না, আবার নাম-রূপ বিশিষ্ট অস্তিত্বশীল রূপে প্রতীয়মান এই জগৎও ছিল না। এই লোকসমূহ ছিল না। সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ এই তিন গুণ ছিল না। আকাশ, বায়ু, অগ্নি প্রভৃতি পঞ্চভূত ছিল না। অন্তরিক্ষ লোক, দ্যুলোক প্রভৃতি অর্থাৎ পাতাল থেকে সত্যলোক পর্যন্ত চতুর্দশ ভুবন ছিল না। এই লোকসমূহাত্মক ব্রহ্মাণ্ডই যখন ছিল না তখন সেই ব্রহ্মাণ্ডের আবরক তত্ত্ব সূক্ষ্মভূত সমূহ কিংবা মহৎ, অহঙ্কারাদি তত্ত্বসমূহও ছিল না। আবরণীয় বস্তুই যদি না থাকে তবে আবরকের প্রয়োজন কী? কোথায়ই বা থাকবে? অর্থাৎ কোন স্থান বা দেশ ছিল না। কার ভোগের জন্য থাকবে? জগতের প্রয়োজন ভোগ, ভোগকর্তার অভাবে ভোগ্যের কী প্রয়োজন? আচ্ছা, সেই সময়ে কি গহন গভীর জল ছিল? কারণ, শ্রুতি তো বলেছেন, ‘আপো বা ইদম্ অগ্রে সলিলম্ আসীৎ’ (তৈত্তিরীয় সংহিতা ৭/১/৫/১)। সেই কারণ স্বরূপ জলও তখন ছিল না।

ব্যাখ্যা –
এই মন্ত্রের বর্ণনীয় বস্তু অবান্তর প্রলয়কালীন অবস্থা। সেই অবস্থায় কী থাকে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মাধ্যমে দেখানো হচ্ছে যে, কিছুই থাকে না।

এই সৃষ্টির প্রয়োজন হল জীবের উপভোগ। জীবের কর্মফল ভোগের জন্য এই সৃষ্টি রচিত হয়। যখন সমস্ত জীবের সমস্ত উপভোগার্হ কর্মফল সমাপ্ত হয়ে যায়, সমস্ত জীবের অবশিষ্ট কর্মফল অপক্ব অবস্থায় থাকে তখন পরমেশ্বর প্রয়োজনাভাবে এই সৃষ্টিকে সংহৃত করেন। সেই অবস্থায় কী থাকে? সেই অবস্থায় কি অত্যন্ত অসৎ, অলীক শূন্য থাকে? তা সম্ভব নয়। কারণ, এই অসৎ অলীক থেকে ভবিষ্যতে কোন সৃষ্টি সম্ভব নয়। তাহলে কি সৎরূপে প্রতীয়মান এই চরাচর জগৎ ছিল? সেটা তো ছিলই না। তাহলে কী ছিল? সৎ এবং অসৎ রূপে যাকে বর্ণনা করা যায় না, তেমন অনির্বাচ্য কিছু ছিল। সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ এই ত্রিগুণ ছিল না। আকাশাদি পঞ্চভূত ছিল না। ভূলোক, অন্তরিক্ষ লোক, দ্যুলোক প্রমুখ চতুর্দশ ভুবন ছিল না। এই সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডই ছিল না। সেই ব্রহ্মাণ্ডের আবরক সূক্ষ্মভূত বা মহৎ, অহঙ্কার প্রভৃতি তত্ত্বও ছিল না। স্থান বলে কিছু ছিল না। থাকবেই বা কেন? কর্মফল ভোগের জন্য নির্মিত সৃষ্টি, কর্মফলের উপভোক্তাই যদি না থাকে তাহলে এই উপভোগ্য জগৎ থাকবে কেন? কেউ কেউ মনে করতে পারেন যে, তখন দুষ্প্রবেশ্য, অগাধ কারণ স্বরূপ জলরাশি হয়ত ছিল। কিন্তু তাও ছিল না।

এই মন্ত্রে রজঃ শব্দের অর্থ ভূলোকাদি লোক হতে পারে। তার প্রমাণ নিরুক্তের ‘লোকা রজাংস্যুচ্যন্তে’ (৪/১৯) এই বাক্য। আবার এই শব্দের অর্থ রজোগুণও হতে পারে। এখানে রজোগুণ উপলক্ষণ। এর দ্বারা তিনগুণেরই নিষেধ হচ্ছে। সায়ণাচার্য এই শব্দটির দুইরকম ব্যাখ্যাই করেছেন।
একই রকম ভাবে ব্যোমা শব্দটিরও দুই রকম অর্থ করা হয়েছে। ব্যোম মানে আকাশ এবং আকাশ উপলক্ষিত পঞ্চ ভূত। আবার ব্যোম মানে অন্তরিক্ষ লোক।
ব্যোমাপরঃ এই শব্দটিকে দুইভাবে ভাঙ্গা যায়।
১. ‘ব্যোমা পরঃ’ তার অর্থ হবে অন্তরিক্ষ লোক এবং তার থেকে ঊর্ধ্বতন দ্যুলোক প্রভৃতি।
২. ‘ব্যোম অপরঃ’। এই পক্ষে ব্যোম শব্দ আকাশ উপলক্ষিত পঞ্চভূতের বাচক। পূর্ণ বাক্যটির অর্থ হয়, রজ আদি তিন গুণ এবং আকাশাদি পঞ্চ ভূতের নিষেধ হলে তার থেকে অপর বা ভিন্ন পর্বত, নদী, সমুদ্র প্রভৃতি প্রাপঞ্চিক বস্তু আর কিছুই থাকে না।

কিম্ আবরীবঃ এই বাক্যাংশে আবরক তত্ত্ব রূপে দুইটি বস্তুর উল্লেখ পাওয়া যায়। এক হল পঞ্চ ভূত। এই পঞ্চ ভূতের দ্বারাই ব্রহ্মাণ্ড আবৃত। কারণ এর দ্বারাই প্রপঞ্চ নির্মিত হয়েছে। যে পক্ষে ব্যোম শব্দের অর্থ অন্তরিক্ষ লোক সেই পক্ষে আবরক তত্ত্ব রূপে পঞ্চ ভূতের কথা বলা হয়েছে। যে পক্ষে ব্যোম শব্দের দ্বারা পঞ্চ ভূতের উপলক্ষণ হয় সেই পক্ষে আবরক তত্ত্ব হল পুরাণাদিতে উক্ত মহৎ, অহঙ্কার প্রভৃতি তত্ত্বসমূহ। বলা হয় যে, আটটি তত্ত্বের দ্বারা সম্পূর্ণ সৃষ্টি আবৃত। এই আটটি তত্ত্বকে পরমেশ্বরের অষ্ট প্রকৃতি বলা হয়।

ভূমিরাপোঽনলো বায়ুঃ খং মনো বুদ্ধিরেব চ।
অহঙ্কার ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা॥ (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৭/৪)
পরমেশ্বরের এই আটটি প্রকৃতিই সম্পূর্ণ চরাচর সৃষ্টিকে আবৃত করে রাখে। শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে–
এতদ্ ভগবতো রূপং স্থূলং তে ব্যাহৃতং ময়া।
মহ্যাদিভিশ্চাবরণৈরষ্টভির্বহিরাবৃতম্॥ (শ্রীমদ্ভাগবতম্ ২/১০/৩৩)
মন্ত্রে গহন শব্দের অর্থ দুষ্প্রবেশ্য। গভীর শব্দের অর্থ অগাধ।

এই মন্ত্রে বলা হয়েছে ‘নো সৎ আসীৎ’ অর্থাৎ সৎও ছিল না। সৎ শব্দের দ্বারা অত্যন্ত-সৎ পরমাত্মাকে বোঝায়। কারণ, পরমাত্মাই পরমার্থতঃ সত্তাবান্। কিন্তু আম্নাত মন্ত্রে সৎ ছিল না এই বাক্য দ্বারা সেই অত্যন্ত সৎ পরমাত্মারও অনস্তিত্ব প্রতিপাদন হয় বলে শঙ্কা উৎপন্ন হয়ে থাকে। এই প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, পরমার্থতঃ সত্তাবান্ তথা সৃষ্টির মূল কারণ স্বরূপ পরমাত্মার নিষেধ এখানে অভীপ্সিত নয়। পরের মন্ত্রেই ‘আনীদ্ অবাতম্’ ইত্যাদি বাক্যে পরমাত্মার অস্তিত্বের কথা বলা হবে। সেজন্য এখানে সৎ শব্দের দ্বারা পারমার্থিক সত্তা সম্পন্ন পরমাত্মাকে নয়, বরং ব্যাবহারিক সত্তা সম্পন্ন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্রহ্মাণ্ডকে বোঝানো হয়েছে।

এখানে প্রলয়াবস্থার বর্ণনা রয়েছে। এই প্রলয়াবস্থাতে সমগ্র সৃষ্টি তার কারণে বিলীন হয়ে যায়। যেমন অতি ক্ষুদ্র বীজের মধ্যে মহীরুহের অবস্থান তেমনই এই সৃষ্টির তার কারণে অব্যক্ত অবস্থায় থাকে। এই কারণই পরমাত্মা, প্রত্যগাত্মা, পরব্রহ্ম ইত্যাদি শব্দের দ্বারা প্রকটিত। সেই মূলকারণ আকাশকুসুমের মত অত্যন্ত অসৎ নন। অত্যন্ত অসৎ অর্থাৎ অলীক বস্তু থেকে অর্থক্রিয়াকারী অর্থাৎ ব্যবহারের যোগ্য কোন কিছুর সৃষ্টি হয় না। এই জগৎ বা সৃষ্টি অর্থক্রিয়াকারী। সেজন্য অলীক বস্তু থেকে তার সৃষ্টি সম্ভব নয়। আবার বর্তমানে দৃশ্যমান জগতের মত ব্যাবহারিক সত্তা সম্পন্নও তিনি নন। তাহলে প্রলয় শব্দটিই নিরর্থক হয়ে যায়। সেজন্য সৎ ও অসৎ থেকে বিলক্ষণ ব্রহ্মে প্রতিষ্ঠিত মায়ার সত্তাই এখানে বর্ণিত হচ্ছে। দ্বিতীয় মন্ত্রে এই ধারণাই স্পষ্টীকৃত হয়েছে। শ্রীমদ্ভাগবতে এই ধরণের বর্ণনা পাওয়া যায়।

ন যত্র বাচো ন মনো ন সত্ত্বং তমো রজো বা মহদাদয়োঽমী।
ন প্রাণবুদ্ধীন্দ্রিয়দেবতা বা ন সন্নিবেশঃ খলু লোককল্পঃ॥ (১২/৪/১৯)
যেখানে বাক্য, মন, সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ, মহৎ (অহঙ্কার) প্রভৃতি, প্রাণ, বুদ্ধি, ই্ন্দ্রিয়, দেবতা কিছুই ছিল না। লোক বলে কিছুই ছিল না।
দ্বিতীয় মন্ত্র
প্রলয়ে সমস্ত সৃষ্টির সংহার ঘটে। সুতরাং, সেই অবস্থায় সৃষ্টির সংহারক মৃত্যু তাহলে নিশ্চয় ছিল! এই সম্ভাবনার নিরাকরণের জন্য দ্বিতীয় মন্ত্রের আরম্ভ।
न मृ॒त्युरा॑सीद॒मृतं॒ न तर्हि॒ न रात्र्या॒ अह्न॑ आसीत्प्रके॒तः।
आनी॑दवा॒तं स्व॒धया॒ तदेकं॒ तस्मा॑द्धा॒न्यन्न प॒रः किं च॒नास॑॥२॥
ন মৃত্যুরাসীদ্ অমৃতং ন তর্হি ন রাত্র্যা অহ্ন আসীৎ প্রকেতঃ।
আনীদ্ অবাতং স্বধয়া তদ্ একং তস্মাদ্ ধান্যন্ন পরঃ কিং চনাস॥২॥
অন্বয়
মৃত্যুঃ ন আসীৎ, তর্হি অমৃতং ন, রাত্র্যা অহ্ন ন আসীৎ প্রকেতঃ। তৎ একং স্বধয়া অবাতম্ আনীৎ। তস্মাৎ হ অন্যৎ পরঃ ন কিং চনাস॥
প্রতিপদার্থ
মৃত্যু– সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডের সংহারকর্তা মৃত্যু
ন আসীৎ– ছিল না
তর্হি– তাহলে
অমৃতম্– মৃত্যুহীনতা বা জীবন ছিল?
ন– ছিল না
রাত্র্যাঃ– রাত্রির
অহ্নঃ– দিনের
প্রকেতঃ– জ্ঞান
ন আসীৎ– ছিল না
তৎ– সেই
একম্– একমাত্র
স্বধয়া– নিজের মায়ার সহিত
অবাতম্– বায়ু ছাড়াই
আনীৎ– প্রাণিত হয়েছিলেন
তস্মাৎ হ– তার থেকে
অন্যৎ কিং চন– ভিন্ন কোন কিছু
পরঃ– সৃষ্টির পরবর্তীকালে দৃশ্যমান এই ব্রহ্মাণ্ড
ন আস– ছিল না
ভাবানুবাদ
মৃত্যু ছিল না তখন। জীবনও ছিল না। রাত্রি এবং দিনের বোধ ছিল না। সেই এক অদ্বিতীয় তত্ত্ব নিজ মায়ার সহিত ওতপ্রোত অবস্থায় বায়ু ছাড়াই প্রাণ ধারণ করেছিল। তার থেকে ভিন্ন কিছুই ছিল না, সৃষ্টির পরে দৃশ্যমান এই চরাচর জগৎও ছিল না।

ব্যাখ্যা
প্রশ্ন ওঠে– সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড ছিল না, তবে কি প্রাণীদের অন্তকারী মৃত্যু ছিল? উত্তর হল– না, মৃত্যুও ছিল না। কারণ প্রাণিসমূহের অন্তকারক মৃত্যুও সেই পরব্রহ্মের উপসেচন (চাটনি) স্বরূপ (কঠোপনিষৎ ২.২৫)। অর্থাৎ, সেই ব্রহ্মের অন্ন স্বরূপও মৃত্যু হতে পারে না। সেজন্য মৃত্যুরও থাকার সম্ভাবনা নেই। তবে কি মৃত্যুর অভাব স্বরূপ জীবন ছিল? তাও ছিল না। কারণ, প্রাণিকুলই যদি না থাকে তবে কার জীবন, কারই বা মৃত্যু!

তাহলে এই সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের ধারক কাল নিশ্চয় ছিল! না, কালও ছিল না। আর দিন, রাত্রি প্রভৃতি কালের খণ্ডসূচক সূর্য, নক্ষত্রাদিও ছিল না। দিন এবং রাত্রির দ্বারা সমগ্র কালকেই প্রত্যাখ্যান করা হল। মাস, ঋতু, সংবৎসর প্রভৃতি কালখণ্ডের বিষয়ে সংশয়েরই অবকাশ থাকে না। কিন্তু, পূর্ব মন্ত্রে ‘তদানীং’ শব্দটিতে তো কালবাচক প্রত্যয়ের ব্যবহার আছে। কালই যদি না থাকে তাহলে কালবাচক প্রত্যয় কেমন করে? এটি ঔপচারিক প্রয়োগ। অর্থাৎ, কোন ভাবেই ভাষার দ্বারা সেই অবস্থাকে বোঝানো সম্ভব নয়। কিন্তু, আমাদের বোধের উপযোগী করে করুণাময়ী শ্রুতি কালহীন সেই অবস্থাকে বোঝানোর জন্য এই শব্দটিকে প্রয়োগ করলেন। এই শব্দের দ্বারা ব্রহ্মাণ্ডের প্রলয়কালীন অবস্থাকে নির্দেশ করা হল মাত্র। কারণ, এটি ব্যতীত অন্য কোনভাবেই সেই অবস্থাকে বোঝানো সম্ভব নয়। ঔপচারিক ভাবে কালবাচক প্রত্যয়ের ব্যবহারের কারণে কালের অস্তিত্ব সূচিত হল না। এখানে প্রত্যয়ার্থ কাল গৌণ। তার দ্বারা সূচনীয় অদ্বৈত অবস্থাটিই মুখ্য।

সেই অবস্থায় একমাত্র পারমার্থিক সত্তাসম্পন্ন ব্রহ্ম তাঁর মায়ার সহিত ওতপ্রোত অবস্থায় প্রাণিত হচ্ছিলেন বা স্পন্দিত হচ্ছিলেন। স্বধা শব্দের অর্থ মায়া। স্বধা শব্দের ব্যুৎপত্তি “স্বস্মিন্ ধীয়তে ইতি স্বধা”। যিনি নিজের মধ্যে আশ্রিত তিনি স্বধা। মায়া ব্রহ্মের থেকে পৃথক কিছু নয়। ব্রহ্মের সহিত অবিভাগাপন্ন, ওতপ্রোত অনির্বচনীয় বস্তু মায়া। সেই মায়া ব্রহ্ম থেকে পৃথক নয়, আবার ব্রহ্মও নয়। তাঁকে সৎ বা অসৎ কিছুই বলা চলে না। স্বধয়া শব্দে তৃতীয়া বিভক্তির প্রয়োগ হয়েছে। “সহযুক্তেঽপ্রধানে” সূত্র দিয়ে এখানে সহিততা বোঝাতে অপ্রধান পদার্থবাচক শব্দের উত্তর তৃতীয়া বিভক্তি। সুতরাং শব্দের মহিমাতেই স্বধা বা মায়ার অপ্রাধান্য সূচিত। সুতরাং, এই মায়াকে স্বতন্ত্র বা স্বাধীন বলা চলে না। সেই ব্রহ্মেই তার অবস্থান। অবস্থান বলার বদলে বলা উচিত অধ্যাস। কারণ, সর্বতন্ত্রস্বতন্ত্র, সঙ্গরহিত ব্রহ্মের মায়ার সঙ্গে সম্বন্ধ থাকা সম্ভব নয়। তবুও ব্রহ্মের সঙ্গে মায়ার একটি অবাস্তব সম্বন্ধ কল্পিত হয়ে যায়। যেমন, রজ্জুতে সর্পদর্শন হলে রজ্জুর সঙ্গে সর্পের একটি সম্বন্ধ কল্পিত হয়, তেমনই। এই সম্বন্ধের জ্ঞানই অধ্যাস।

সেই ব্রহ্ম, যাঁতে মায়া অধ্যস্ত, তিনি “আনীৎ অবাতম্” বায়ু ছাড়াই প্রাণিত হচ্ছিলেন। ‘√অন প্রাণনে’ ধাতুর লঙ্ লকারে প্রথমপুরুষের একবচনে আনীৎ পদটি নিষ্পন্ন হয়। প্রাণন শব্দের অর্থ হল নিঃশ্বাস। লঙ্ লকারের অর্থ অতীত কাল। সুতরাং এই বাক্যবন্ধের অর্থ হয়, “তিনি অতীতকালে বায়ু ছাড়া নিঃশ্বাস ফেলছিলেন।” নিঃশ্বাস ফেলে জীব।

শঙ্কা– এর থেকে একটি শঙ্কা উত্থিত হয়। প্রাণনকর্তা যিনি, তিনি জীবের সমানই হবেন। সুতরাং, সেই প্রলয়াবস্থায়ে যে ব্রহ্মের সত্তার কথা বলা হচ্ছে তিনিও জীবের ন্যায়ই মায়া বা অজ্ঞানে উপহিত বা আচ্ছাদিত। নিরুপহিত শুদ্ধ ব্রহ্মের কথা এখানে বলা হচ্ছে না। শ্রুতি সেই ব্রহ্ম সম্পর্কে বলেছেন, ‘অপ্রাণো হ্যমনাঃ শুদ্ধঃ’– তিনি প্রাণরহিত, মনরহিত শুদ্ধ। অতএব প্রাণনকর্তা কখনওই নিরুপহিত ব্রহ্ম হতে পারেন না।

সমাধান– উপর্যুক্ত এই শঙ্কা অমূলক। এখানে নিরুপহিত ব্রহ্মের কথাই বলা হচ্ছে। আনীৎ শব্দে প্রাণন, তার কর্তা এবং অতীতকালের সঙ্গে সেই কর্তার সম্বন্ধ উক্ত হয়। কিন্তু এখানে এই তিনটিই শ্রুতির বিবক্ষিত নয়। শ্রুতির বিবক্ষিত কেবল কর্তা। কর্তাকে উল্লেখ করে তাঁর অতীতকালিক সম্বন্ধ রূপ গুণ বিহিত হচ্ছে। এখানে অতীতকাল মুখ্য নয়, গৌণ। কর্তার সত্তাই মুখ্য। যেমন, ‘আগ্নেয়োঽষ্টাকপালঃ’– ‘অগ্নি দেবতার উদ্দেশ্যে আটটি কপালে সংস্কার করবে’। এখানে অগ্নি দেবতা বা আটটি কপালের বিধান করা হচ্ছে না। অগ্নিহোত্রপ্রকরণে বিধান রয়েছে ‘দধ্না জুহোতি’– দধি দ্বারা হোম করবে– এই বাক্যটির সঙ্গে আগ্নেয়োঽষ্টাকপালঃ এই বাক্যটির একবাক্যতা হয়। তার ফলে অর্থ দাঁড়ায় ‘অগ্নি দেবতার উদ্দেশ্যে আটটি কপালে সংস্কৃত দধি দ্বারা হোম করবে’। এখানে বিহিত হয়েছে হোম এবং আহুতি দ্রব্য দধি। আটটি কপালে সংস্কার গৌণ, কারণ সেটি দধির বিশেষণ। তেমনই আনীৎ শব্দটিতে প্রাণন বা ভূতকালসম্বন্ধ গৌণ। মুখ্য হল কর্তা। সেই কর্তা বর্তমানের ন্যায় অতীতেও ছিলেন এটাই প্রতিপাদ্য। আর তাঁর প্রাণন বা নিঃশ্বাসটি সত্তার উপলক্ষণ– প্রাণনের দ্বারা কেবল তাঁর চেতনাবিশিষ্ট সত্তা বোঝাচ্ছে। বাস্তবিক নিঃশ্বাস নয়। কারণ বাস্তবিক নিঃশ্বাস বায়ু ছাড়া সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি ‘আনীৎ অবাতম্’– বায়ু ছাড়াই প্রাণন করছেন। তার মানে প্রাণন বা নিঃশ্বাস বিবক্ষিত নয়। বিবক্ষিত হল তার চেতন সত্তা।

পরঃ শব্দটির দুই প্রকার অর্থ করা হয়। ১) পরে বা উত্তরকালে, ২) উৎকৃষ্ট। এই সৃষ্টির পরে দৃশ্যমান বা প্রতীয়মান এই চরাচর জগৎ তখন ছিল না– এটি একপ্রকার অর্থ। ব্রহ্মের থেকে উৎকৃষ্ট কোন পদার্থ ছিল না– এটি দ্বিতীয় অর্থ।

বিষ্ণুপুরাণের প্রথম অংশে দ্বিতীয় অধ্যায়ের ২৩ তম শ্লোকে বলা হয়েছে–
নাহো ন রাত্রির্ন নভো ন ভূমির্
নাসীৎ তমো জ্যোতিরভূন্ন চান্যৎ।
শ্রোত্রাদিবুদ্ধ্যানুপলভ্যম্ একং
প্রাধানিকং ব্রহ্ম পুমাংস্তদাসীৎ॥

সেখানে দিন ছিল না, ছিল না রাত্রি। আকাশ ছিল না, ছিল না ভূমি। ছিল না অন্ধকার, ছিল না প্রকাশ। শ্রোত্রাদি ইন্দ্রিয়ের অগোচর, বুদ্ধি দ্বারা অনুপলভ্য অদ্বিতীয় প্রাধানিক ব্রহ্মপুরুষ কেবল তখন ছিলেন।

প্রসঙ্গতঃ, এই শ্লোকটির টীকাতে শ্রীধরস্বামী তিনটি অস্তিত্বের কথা বলেছেন। প্রধান অর্থাৎ প্রকৃতি, ব্রহ্ম এবং পুমান্। সূক্তের এই মন্ত্রে পরমাত্মাতে বিলীন স্বধা অর্থাৎ মায়ার কথা রয়েছে। বলা হয় যে, জীবও এই সময়ে ব্রহ্মে বিলীন হয়েই থাকে। পুমান্ অর্থাৎ জীব এবং প্রাধানিক অর্থাৎ প্রকৃতির সঙ্গে একীভূত ব্রহ্ম ছিলেন। শ্লোকের একং পদটি সেই একীভূত অবস্থারই দ্যোতক।
শুক্লযজুর্বেদীয় সুবালোপনিষদের দ্বিতীয় খণ্ডে বলা হয়েছে–

… সোঽন্তে বৈশ্বানরো ভূত্বা সন্দগ্ধ্বা সর্বাণি ভূতানি পৃথিব্যপ্সু প্রলীয়ত আপস্তেজসি প্রলীয়ন্তে তেজো বায়ৌ বিলীয়তে বায়ুরাকাশে বিলীয়ত আকাশম্ ইন্দ্রিয়েষ্বিন্দ্রিয়াণি তন্মাত্রেষু তন্মাত্রাণি ভূতাদৌ বিলীয়ন্তে ভূতাদির্মহতি বিলীয়তে মহান্ অব্যক্তে বিলীয়তেঽব্যক্তম্ অক্ষরে বিলীয়তে অক্ষরং তমসি বিলীয়তে তমঃ পরে দেব একীভবতি পরস্তান্ন সন্নাসন্নাসদসদ্ ইত্যেতন্নির্বাণানুশাসনম্…

সেই (পূর্ববর্ণিত) বিরাট পুরুষ অন্তে বৈশ্বানর রূপে সমস্ত প্রাণীকে দহন করে। পৃথিবী জলে, জল তেজে, তেজ বায়ুতে, বায়ু আকাশে, আকাশ ইন্দ্রিয়ে, ইন্দ্রিয় তন্মাত্রে, তন্মাত্র ভূতাদিতে (অহঙ্কারে), অহঙ্কার বুদ্ধিতে, বুদ্ধি অব্যক্তে বিলীন হয়। অব্যক্ত অক্ষরে বিলীন হয়। অক্ষর তমস্ অর্থাৎ অন্ধকারে বিলীন হয়। সেই অন্ধকার পরম দেবতাতে একীভূত হয়। তার থেকে উৎকৃষ্ট কিছু নেই। না সৎ, না অসৎ, না সদসৎ কিছুই না। এই হল নির্বাণের অনুশাসন…

এই বর্ণনাতে দেখা যায় যে প্রলয়কালে সমস্ত প্রপঞ্চ অব্যক্তে মিলিত হয়, অব্যক্ত অক্ষরে, অক্ষর তমস্-এ এবং তমস্ পরদেবতাতে বিলীন হয়। অব্যক্ত, অক্ষর এবং তমঃ মায়ারই তিনটি পৃথক অবস্থা। অব্যক্ত হল গুণত্রয়ের সাম্যাবস্থা। অক্ষর অবস্থা হল সেটি যেখানে তিন গুণের পৃথক্ প্রতিভাস নেই। তার পরের অবস্থা তমস্। মায়া যখন ব্রহ্মে বিলীন একীভূত সেটি হল তমঃ। মন্ত্রে বলা হয়েছে ব্রহ্মের সহিত অবিভাগাপন্না স্বধা। এই সূক্তটিতেওপরের মন্ত্রে এই তমস্ শব্দেরও প্রয়োগ দেখা যায়।
যদি সৃষ্টি না থাকে, তবে তার জন্ম কীভাবে হল? যে বস্তুর জন্ম হচ্ছে সেই বস্তুও জন্মরূপ ক্রিয়ার প্রতি কারণ। সুতরাং, সৃষ্টির অস্তিত্ব সম্পূর্ণরূপে অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। সেজন্য বলা হচ্ছে যে, সৃষ্টির পূর্বেও এই সৃষ্টি ছিল। কিন্তু তা ছিল অব্যক্ত অবস্থায়।

এই বিষয়টিই তৃতীয় মন্ত্রে বর্ণনা করা হচ্ছে।
তৃতীয় মন্ত্র–
तम॑ आसी॒त्तम॑सा गू॒ळ्हमग्रे॑ऽप्रके॒तं स॑लि॒लं सर्व॑मा इ॒दम्।
तु॒च्छ्येना॒भ्वपि॑हितं॒ यदासी॒त्तप॑स॒स्तन्म॑हि॒नाजा॑य॒तैक॑म्॥३
তম আসীৎ তমসা গূঢ়ম্ অগ্রেঽপ্রকেতং সলিলং সর্বমা ইদম্।
তুচ্ছ্যেনাভ্বপিহিতং যদ্ আসীৎ তপসস্তন্মহিনাজায়তৈকম্॥৩॥
অন্বয়
অগ্রে তমসা গূঢ়ং তমঃ আসীৎ। অপ্রকেতং, সলিলম্ আঃ। যৎ আভু তুচ্ছ্যেন অপিহিতম্ আসীৎ, তৎ একং তপসঃ মহিনা অজায়ত।
প্রতিপদার্থ
অগ্রে– পূর্বে, সেই প্রলয়কালিক অবস্থায়
তমসা– আত্মতত্ত্বের আবরক মায়ার দ্বারা
গূঢ়ং– আচ্ছাদিত
তমঃ– জগদ্রূপী আবরণীয় তত্ত্ব
আসীৎ– ছিল
অপ্রকেতম্– অজ্ঞেয়
সলিলম্– কারণের সহিত অপৃথক্
আঃ– ছিল
যৎ– যে
আভু– উৎপদ্যমান জগৎ
তুচ্ছ্যেন– মায়ার দ্বারা
অপিহিতম্– আবৃত
আসীৎ– ছিল
তৎ– সেই
একং– কারণের সহিত একীভূত জগৎ
তপসঃ– সৃষ্টিসঙ্কল্পময় তপস্যার
মহিনা– মহিমায়
অজায়ত– উৎপন্ন হল

ভাবানুবাদ – 

সেই প্রলয়কালে অন্ধকারের সমান আবরক মায়ার দ্বারা এই সম্পূর্ণ অন্ধকাররূপী জগৎ আবৃত ছিল। তাদেরকে একের থেকে অপরকে পৃথক ভাবে জানার কোন উপায় ছিল না। সেই জগৎ নিজ কারণ মায়ায় মিশ্রিত অবস্থায় ছিল। নিজ কারণের সহিত অবিভক্ত অবস্থায় বর্তমান, অগ্রে উৎপদ্যমান সেই জগৎ তুচ্ছ মায়ার দ্বারাই আবৃত ছিল। সৃষ্টিসঙ্কল্পময় তপস্যার মহিমায় সে উৎপন্ন হল।

ব্যাখ্যা –

এই মন্ত্রটি সৃষ্টির প্রারম্ভের বর্ণনা করে। মন্ত্রে দুইবার তমঃ শব্দের প্রয়োগ হয়েছে। তমঃ শব্দের অর্থ অন্ধকার। ‘তমঃ আসীৎ তমসা গূঢ়ম্’ এই অংশটি দুইভাবে ব্যাখ্যা করা হয়।

প্রথম ব্যাখ্যা– ‘অন্ধকারের দ্বারা আচ্ছাদিত অন্ধকার ছিল’। মায়া ব্রহ্মতত্ত্বকে আচ্ছাদিত করে রাখে বলে তাকে অন্ধকারের সঙ্গে তুলনা করে অন্ধকার বলা হল। সেই অন্ধকারের দ্বারা অন্ধকারই আবৃত ছিল। এই দ্বিতীয় অন্ধকার হল জগতের মূলকারণ ভাবরূপ অজ্ঞান। সুতরাং, অজ্ঞানই অজ্ঞানকে আবৃত করে রেখেছে। অর্থাৎ, আবরণ ক্রিয়ার কর্তা এবং কর্ম উভয়ই হল অজ্ঞান। এটি কীভাবে সম্ভব? উত্তরে বলা হল, সলিলম্ অপ্রকেতম্। সলিল শব্দের অর্থ কারণের সহিত অবিভক্ত। এবং অপ্রকেতম্ শব্দের অর্থ অজ্ঞেয়। আসলে মায়ার দ্বারা জগৎ আবৃত। এই জগৎ নিজের কারণ মায়ার সঙ্গে অবিভক্ত অবস্থায় রয়েছে। ফলে সেটি অপ্রকেত বা অজ্ঞেয়। সেজন্য মায়ার দ্বারা জগৎ আবৃত এই কথাটিকে এমন ভাবে বলা হল– অজ্ঞানের দ্বারাই অজ্ঞান আবৃত। অথবা যেমন সলিল বা জল দুধের সঙ্গে অবিভক্ত হয়ে মিশে থাকে– তাদেরকে আলাদা করা যায় না– তেমনই জগৎ অজ্ঞানের সঙ্গে অবিভক্ত অবস্থায় মিশেছিল বলে তাকে আলাদা করে জানার উপায় ছিল না।

দ্বিতীয় ব্যাখ্যা– তমঃ আসীৎ। অর্থাৎ, ব্রহ্মতত্ত্বের আচ্ছাদক সেই মায়া ছিল। তমসা গূঢ়ম্। অর্থাৎ, সেই মায়ার দ্বারাই জগৎ আচ্ছাদিত ছিল। যেমন মৃৎপিণ্ডে কলশ, কিংবা বীজের মধ্যে বৃক্ষ গূঢ় অবস্থায় বা অব্যক্ত অবস্থায় থাকে তেমন। অব্যক্ত থাকার দরুন সে অপ্রকেত অর্থাৎ অজ্ঞেয়। তাকে বোঝার উপায় নেই। যেমন সলিল। বর্ষার জল যখন জলাশয়ে পড়ে তখন সেই বর্ষার জলবিন্দুকে পৃথক করা যায় না। তেমনই নিজের মূলকারণের সঙ্গে ওতপ্রোত অব্যক্ত জগৎকে আলাদা জানা যায় না।

উভয় ব্যাখ্যাতেই পূর্বে বিদ্যমান জগতেরই ব্যক্ত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। অব্যক্ত দশা থেকে ব্যক্ত দশায় বিবর্তনই হল উৎপত্তি বা জন্ম।
যৎ তুচ্ছ্যেনাভ্বপিহিতম্ আসীৎ– তুচ্ছের দ্বারা উৎপদ্যমান জগৎ আবৃত ছিল। মায়াকে তুচ্ছ বলা হয়েছে। আত্মজ্ঞান স্ফুরিত হলেই মায়া অপসৃত হয়। সেজন্য সে তুচ্ছ। তারা দ্বারা উৎপদ্যমান জগৎ আবৃত।
একম্– কারণ অজ্ঞানের সহিত অবিভক্ত।
তপস্যার মহিমায় তার জন্ম হল। সৃষ্টির পূর্বে পরমেশ্বর জ্ঞানময় তপস্যায় নিরত হন। শ্রুতি বলেছেন, যঃ সর্বজ্ঞঃ সর্ববিৎ যস্য জ্ঞানমং তপঃ– সেই ব্রহ্ম সর্বজ্ঞ, সর্ববিৎ। তাঁর তপস্যা হল জ্ঞানময়। সিসৃক্ষা বা সৃষ্টির ইচ্ছায় পরমেশ্বরের সঙ্কল্পই হল তপস্যা। সেই তপস্যার মহিমায় এই জগৎ উৎপন্ন হল।
একম্ শব্দটিও দুই ভাবে ব্যাখ্যাত। একটি হল কারণ অজ্ঞানের সহিত অবিভক্ত বলে জগৎ এক বা একীভূত। অপর ব্যাখ্যায় বলা হয়– সিসৃক্ষা প্রযুক্ত সঙ্কল্প রূপ তপস্যায় যার উৎপত্তি সেই জগৎ আসলে ব্রহ্মের থেকে ভিন্ন নয়– একই।
এই মন্ত্রের বর্ণনার একটি রূপকল্প পুরাণে পাওয়া যায়।

পুরাণে এর একটি রূপকল্প পাওয়া যায়।
উদাপ্লুতং বিশ্বম্ ইদং তদাসীদ্ যন্নিদ্রয়া মীলিতদৃঙ্ ন্যমীলয়ৎ।
অহীন্দ্রতল্পেঽধিশয়ান একঃ কৃতক্ষণঃ স্বাত্মরতৌ নিরীহঃ॥
সোঽন্তঃশরীরেঽর্পিতভূতসূক্ষ্মঃ কালাত্মিকাং শক্তিম্ উদীরয়াণঃ।
উবাস তস্মিন্ সলিলে পদে স্বে যথানলো দারুণি রূদ্ধবীর্যঃ॥(শ্রীমদ্ভাগবতম্ ৩/৮/১০-১১)

যখন যোগনিদ্রায় আসীন পরমাত্মা চোখ বুজেছিলেন জগৎ তখন জলে ভরে ছিল। সর্পশয্যায় শয়ান অদ্বিতীয় পরমাত্মা আত্মরতিতে নিমগ্ন, নিশ্চেষ্ট হয়েছিলেন। সমস্ত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভূতসমূহকে নিজের শরীরে অন্তর্লীন করে রেখেছিলেন যেমন কাষ্ঠে অগ্নি লীন থাকে। পুনরায় সৃষ্টির সময়ে কালশক্তিকে প্রেরিত করার উদ্দেশ্যে সেই সলিলে তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন।
সৃষ্টির ঠিক পূর্ব মুহূর্তে এক সলিলের কথা শ্রুতিতে এবং পুরাণে বহুল প্রসিদ্ধ। তৈত্তিরীয় সংহিতায় সপ্তম কাণ্ডে প্রথম প্রপাঠকে

পঞ্চম অনুবাকের সূচনায় বলা হয়েছে–
আপো বা ইদমগ্রে সলিলম্ আসীৎ। তস্মিন্ প্রজাপতির্বায়ুর্ভূত্বাচরৎ…

এই সৃষ্টির আগে সলিল বা জলই ছিল। তাতে প্রজাপতি বায়ু হয়ে সঞ্চার করেছিলেন…

এই মন্ত্রে যে জলের কথা বলা হয়েছে সেটি কিন্তু পঞ্চভূতান্তর্ভূত জলতত্ত্ব বা জল তন্মাত্র নয়। কারণ, জলের সৃষ্টি আকাশ, বায়ু, অগ্নির পরে হয়। এখানে যে সময়ের উল্লেখ রয়েছে সেটি সৃষ্টির প্রাক্কালের কথা। সেজন্য এই জল কী ধরণের পদার্থ তা কল্পনা করা কঠিন। এই মন্ত্রের ভাষ্যে আচার্য সায়ণ বলেছেন, “এই জলে কেবল জলই ছিল অন্য কোন ভূত ছিল না। তখন মূর্ত রূপ ধারণ কারী প্রজাপতির থাকার মত কোন জায়গা না থাকায় তিনি বায়ুরূপে অবস্থিত ছিলেন।” সৃষ্টির পূর্বকালের কোন এক অকল্পনীয় অবস্থার বর্ণনা এটি। আধুনিক জড়বিজ্ঞানীদের মতে সৃষ্টির প্রাঙ্মুহূর্তে ব্রহ্মাণ্ড একপ্রকার অত্যন্ত সূক্ষ্ম কণায় আবৃত ছিল যার পোশাকি নাম Quark Gluon Plasma। এই পদার্থটি আমাদের ইন্দ্রিয়ের অগোচর। এর চরিত্র তরলের সমান। আধুনিক জড়বিজ্ঞানে মনে করা হয়, সৃষ্টির মুহূর্তে ব্রহ্মাণ্ড ছিল এক শক্তি সমুদ্রের মত যা অতি দ্রুত বিস্তার লাভ করতে শুরু করেছিল।
সৃষ্টির এই প্রাথমিক মুহূর্ত বা তার পূর্বের ঘটনার কথা অত্যন্ত দুর্জ্ঞেয় এবং অনুমান নির্ভর। সেই কথা এই সূক্তেও বলা হয়েছে। সেজন্য এই সলিল বা জল বা তরল আসলে কী সেটা দুর্জ্ঞেয়। কিন্তু শ্রুতি সৃষ্টির আদিতে একধরণের তরলের উপস্থিতির কথা বহু স্থানেই উল্লেখ করেছেন। এই একই ধরণের আরেকটি মন্ত্র নৃসিংহতাপনীয়োপনিষদের শুরুতেই পাওয়া যায়।
আপো বা ইদম্ আসন্ সলিলম্ এব। স প্রজাপতিরেকঃ পুষ্করপর্ণে সমভবৎ। তস্যান্তর্মনসি কামঃ সমবর্তত ইদং সৃজেয়ম্ ইতি।
সৃষ্টির প্রারম্ভে সলিলই কেবল ছিল। তাতে একটি পদ্মপাতায় একা প্রজাপতি ছিলেন। তাঁর হৃদয়ে কামনা জাগল যে এই জগৎ সৃষ্টির করব।

এই একই ধরণের কথা এই সূক্তেও বলা হয়েছে। এই কথাগুলিরই অনুরণন শ্রীমদ্ভাগবতেও পাওয়া যায়। আমরা সেই সন্দর্ভও উল্লেখ করব।

নাসদীয়ের এই মন্ত্রে বলা হয়েছে যে, পরমাত্মার সঙ্কল্পরূপী তপস্যাই সৃষ্টির মূল কারণ। তৈত্তিরীয় উপনিষদের ষষ্ঠ অনুবাকের প্রথম মন্ত্রে রয়েছে–
সোঽকাময়ত বহু স্যাং প্রজায়েয়েতি। স তপোঽতপ্যত। স তপস্তপ্ত্বা। ইদং সর্বম্ অসৃজত।
পরমাত্মা কামনা করলেন যে, আমি বহু হব। তিনি তপস্যা করলেন। তপস্যা করে এই সমস্ত কিছু সৃষ্টি করলেন।

এই মন্ত্রেও পরমাত্মার কামনা এবং তপস্যার কথা বলা হয়েছে। এই কামনা পরমাত্মারই কামনা। অন্য জীবদের কামনা নয়। তাঁর কামনা হল আমি প্রজা উৎপন্ন করব। এই প্রজা উৎপন্ন করা ঠিক পুত্রের জন্ম দেওয়ার মত নতুন বস্তু বা বিষয়ের বিকাশ নয়। নিজের মধ্যেই নাম ও রূপ রহিত অবস্থায় অনভিব্যক্ত বস্তুর নাম ও রূপের অভিব্যক্তির মাধ্যমে বহু হওয়া। যখন আত্মাতে বিলীন নাম ও রূপের অভিব্যক্তি ঘটে তখন আত্মস্বরূপ পরিত্যাগ না করেই, ব্রহ্মের সহিত দেশকৃত ও কালকৃত ভেদে বিভক্ত না হয়েই নাম ও রূপের অভিব্যক্তি ঘটে। এই নাম ও রূপে বিকশিত হওয়াই হল বহু হওয়া। নিরবয়ব ব্রহ্মের অবয়বকৃত ভেদ সম্ভব নয়। যেমন আকাশ বা স্থান অখণ্ড হলেও একটি ঘটে আবদ্ধ হয়ে ক্ষুদ্র বলে প্রতিভাত হয় তেমনই ব্রহ্ম নাম ও রূপের বিভিন্নতার কারণে দ্বারা বহু রূপে প্রতিভাত হয়।

যেমন সমুদ্র থেকে উৎপন্ন তরঙ্গ সমুদ্র থেকে অতিশয় ভিন্ন নয়। তেমনই ব্রহ্মের শক্তি মায়াতে অনভিব্যক্ত আকাশাদি পদার্থসকল ভিন্ন ভিন্ন নাম ও রূপে বিকশিত হয়ে ব্রহ্মের সদ্রূপতা পরিত্যাগ না করে সৎ রূপেই প্রকাশিত হয়।

পরমাত্মার এই তপস্যা হল জ্ঞানময়। মুণ্ডকশ্রুতিতে বলা হয়েছে, যস্য জ্ঞানময়ং তপঃ (মুণ্ডকোপনিষদ্ ৯)– যাঁর জ্ঞানময় তপস্যা। পরমেশ্বর এই স্রষ্টব্য জগৎকে কেবল পর্যালোচনা করেন। এটিই তাঁর তপস্যা। পরমাত্মা প্রাণীদের পূর্বকৃত কর্মের অনুরূপ এই সম্পূর্ণ সৃষ্টিকে দেশ, কাল, নাম ও রূপে ব্যবস্থিত করেন। সেই ভাবেই প্রাণীরা এই সৃষ্টিকে অনুভব করে। এই কামনা, সঙ্কল্প এবং জগতের স্রষ্টৃত্বের দ্বারা পরমাত্মার সত্তা এবং সচেতনতার কথাও বলা হল।

শ্রীমদ্ভাগবতেও পরমেশ্বরের এই তপস্যার উল্লেখ রয়েছে। সেখানে দ্বিতীয় স্কন্ধে, নবম অধ্যায়ে ২১ থেকে ২৩ শ্লোকে ব্রহ্মাকে ভগবান্ বলেছেন–
মনীষিতানুভাবোঽয়ং মম লোকাবলোকনম্।
যদ্ উপশ্রুত্য রহসি চকর্থ পরমং তপঃ॥
প্রত্যাদিষ্টং ময়া তত্র ত্বয়ি কর্মবিমোহিতে।
তপো মে হৃদয়ং সাক্ষাদ্ আত্মাহম্ তপসোঽনঘ॥
সৃজামি তপসৈবেদং গ্রসামি তপসা পুনঃ।
বিভর্মি তপসা বিশ্বং বীর্যং মে দুশ্চরং তপঃ॥
সৃষ্টির আদিতে তুমি রহস্যে ‘তপ’ এই শব্দবন্ধ শুনেছিলে। সৃষ্টির আদিতেতুমি যখন কর্ম নিশ্চিত করতে অক্ষম হয়েছিলে তখন আমি এই সমস্ত লোককে পর্যালোচনা করে তোমাকে এই সৃষ্টির জ্ঞান দিয়েছিলাম। তপস্যাই আমার হৃদয়। আমিই তপস্যার আত্মা। আমি তপস্যার দ্বারাই সৃষ্টি করি, তপস্যার দ্বারাই গ্রাস করি। তপস্যার দ্বারাই এই জগৎকে ধারণ করি। দুশ্চর তপস্যাই আমার বীর্য।

উপরে পরমেশ্বরের যে কামনার কথা বলা হল, পরের মন্ত্রে সেই কামনার কথাই বলা হচ্ছে।

চতুর্থ মন্ত্র–
বলা হল যে, ঈশ্বরের সঙ্কল্পই এই সৃষ্টির উৎপত্তির কারণ। কিন্তু, এই সঙ্কল্পের কারণ কী? সেই প্রশ্নের সমাধানের জন্য চতুর্থ মন্ত্র বলা হল।
काम॒स्तदग्रे॒ सम॑वर्त॒ताधि॒ मन॑सो॒ रेतः॑ प्रथ॒मं यदासी॑त्।
स॒तो बन्धु॒मस॑ति॒ निर॑विन्दन्हृ॒दि प्र॒तीष्या॑ क॒वयो॑ मनी॒षा॥४॥
কামস্তদগ্রে সমবর্ততাধি মনসো রেতঃ প্রথমং যদাসীৎ।
সতো বন্ধুমসতি নিরবিন্দন্ হৃদি প্রতীষ্যা কবয়ো মনীষা॥৪॥
অন্বয়
অগ্রে মনসঃ কামঃ অধিসমবর্তত। রেতঃ প্রথমং যৎ আসীৎ। সতঃ বন্ধুং কবয়ঃ হৃদি মনীষা প্রতীষ্য অসতি নিরবিন্দন্।
প্রতিপদার্থ
অগ্রে– পূর্বে
কামঃ– কামনা
অধিসমবর্তত– সমধিক ভাবে বিদ্যমান ছিল
মনসঃ– অন্তঃকরণের
রেতঃ– সৃষ্টির বীজস্বরূপ
প্রথমং– পূর্বকল্পে জীবগণ কর্তৃক আচরিত কর্মের ফল
যৎ– যা
আসীৎ– ছিল
সতঃ– সৎ রূপে প্রতিভাত এই সৃষ্টির
বন্ধুং– বন্ধনের কারণ
কবয়ঃ– ক্রান্তদর্শী যোগীরা
হৃদি– হৃদয়ে
মনীষা– বুদ্ধির দ্বারা
প্রতীষ্য– বিচার করে
অসতি– অসৎ রূপে প্রতিভাত অব্যক্ত কারণ স্বরূপ মায়াতে
নিরবিন্দন্– নিশ্চিত করেছেন

ভাবানুবাদ –

সৃষ্টির পূর্ব মুহূর্তে কামনার উদ্রেক হয়েছিল। পূর্ব পূর্ব কল্পে জীবকুল কর্তৃক আচরিত যে কর্মের ফল বাসনা রূপে মায়াতে বিলীন হয়ে প্রবলভাবে বিদ্যমান ছিল। সেই কর্মফলই সৎ রূপে প্রতীয়মান এই সৃষ্টির বন্ধনের কারণ। সেই কর্মফল রূপী বন্ধনের কারণ অসৎ রূপে প্রতীয়মান অব্যাকৃত কারণ রূপী মায়াতে বিলীন আছে বলে যোগীরা নিজেদের হৃদয়ে বুদ্ধির দ্বারা বিচার করে নিশ্চিত ভাবে জেনেছেন।

ব্যাখ্যা –

সৃষ্টির পূর্বে পরমেশ্বরের হৃদয়ে সঙ্কল্প উৎপন্ন হয়েছিল। সেই সঙ্কল্পের কারণ কামনা। কামনা যথেষ্ট প্রবলভাবে সৃষ্টির পূর্বেও বিদ্যমান ছিল।
সূক্তে ‘মনসঃ’ শব্দের অর্থ অন্তঃকরণের। পূর্ব কল্পে প্রাণীরা যেমন যেমন কর্ম করেছে সেই কর্ম অপরিপক্ব অবস্থায় বাসনা বা সংস্কার রূপে মায়াতেই বিলীন অবস্থায় থাকে। সেই বাসনাই কামনার জন্ম দেয়।
‘রেতঃ’ শব্দের অর্থ বীজ। সেই পূর্ব কল্পে কৃত কর্মই বর্তমান সৃষ্টির কারণভূত বীজস্বরূপ। সেই কর্মবাসনা জনিত কামনাই আবার “সতঃ বন্ধুম্” অর্থাৎ, বর্তমানে সৎ রূপে প্রতীয়মান এই জগতের বন্ধনের কারণ।
যাঁরা ক্রান্তদর্শী যোগী তাঁরা তপস্যার প্রভাবে নিজ নিজ হৃদয়ে এই সত্য উপলব্ধি করেছেন যে, প্রাণিকুল দ্বারা আচরিত কর্ম অপরিপক্ব অবস্থায় বাসনা রূপে অব্যাকৃত কারণ স্বরূপ মায়াতেই বিলীন থাকে।
পরমেশ্বরের সঙ্কল্পই সৃষ্টির কারণ। প্রাণীরা পূর্ব কল্পে যে সমস্ত কর্ম করেছে সেই কর্মের মধ্যে যেগুলি অপরিপক্ব অবস্থায় ছিল সেগুলিই বাসনা রূপে মায়াতে বিলীন হয়ে থাকে। সেই বাসনা যখন পরিপক্ব হয়ে ফলদানের উপযুক্ত হয় তখন সেই বাসনাই পরমেশ্বরের সিসৃক্ষা রূপী সঙ্কল্প বা মন বা অন্তঃকরণ রূপে প্রকাশিত হয়। সেই সিসৃক্ষারূপী সঙ্কল্প বা মনই সৃষ্টির প্রথম পদার্থ। এই সিসৃক্ষা রূপী কামনা বা সঙ্কল্পের বিষয়ে উপনিষদে বলা হয়েছে, “সোঽকামত বহু স্যাং প্রজায়েয়”– তিনি কামনা করলেন যে, আমি বহু হব, প্রজার সৃষ্টি করব। অদ্বিতীয় এক আমি নিজেকে বহুরূপে বিকশিত করি।
এই কামনাই আবার সৎরূপে প্রতীয়মান দৃশ্যমান এই জগতের বন্ধনের কারণ। কামনাই অজ্ঞান বা মায়াতে সমস্ত বস্তুকে বেঁধে রাখে। যেমন, নিদ্রিত পুরুষের হৃদয়ের কামনাই নানাবিধ বস্তুকে স্বপ্নে আবদ্ধ করে, অথবা, অত্যন্ত দুর্লভ বস্তুর প্রতি জাগ্রত ব্যক্তির কামনা যেমন সেই ব্যক্তির মনোরাজ্য সুখ বা দুঃখের জন্ম দেয়, তেমনই পরমেশ্বরের এই কামনাই সমস্ত সৃষ্টিকে বন্ধনে আবদ্ধ করে।
যে সমস্ত যোগিপুরুষ সাধনার দ্বারা বেদান্তপ্রসিদ্ধ সেই ব্রহ্মতত্ত্বকে জেনেছেন তাঁরাই সাধনালব্ধ সেই বুদ্ধির দ্বারা জগতের বন্ধনের হেতু এই কামনাকে অব্যাকৃত কারণ রূপী মায়াতে বিলীন অবস্থায় থাকে বলে নিশ্চিত রূপে জেনেছেন।

এই কামনাই সমস্ত ব্যবহারের হেতু। কেউ কেউ মনে করেন যে, পুণ্য ও পাপ কর্মই সৃষ্টির মূল কারণ। কিন্তু এই মতের বিপরীতে বৃহদারণ্যক উপনিষদে চতুর্থ প্রপাঠকের দ্বিতীয় ব্রাহ্মণে (শারীরকব্রাহ্মণ) সপ্তম মন্ত্রে বলা হয়েছে, “অথো খল্বাহুঃ। কামময় এবায়ং পুরুষ ইতি স যথাকামো ভবতি তথাক্রতুর্ভবতি যথাক্রতুর্ভবতি তৎ কর্ম কুরুতে যৎ কর্ম কুরুতে তদ্ অভিসম্পদ্যতে”– এই পুরুষ কামময়। কামনার অনুরূপ তার অধ্যবসায় হয়। অধ্যবসায় হল শারীর ক্রিয়ার প্রবর্তক মানসিক ক্রিয়া। এই অধ্যবসায়কেই ক্রতু বলা হয়। যে বিষয়ের অভিলাষে কামনার অভিব্যক্তি ঘটে সেই বিষয়ে পরিস্ফুট হয়, আত্মা সেই বিষয়ে তন্ময় হয়ে ওঠে। যেমন তার ক্রতু বা অধ্যবসায় হয় তদনুরূপ কর্ম সে করে। যেমন কর্ম করে তেমন ফল প্রাপ্ত করে।
অর্থাৎ, কর্মফলের হেতু কর্ম, কর্মের হেতু ক্রতু বা অধ্যবসায়, অধ্যবসায়ের হেতু কাম বা কামনা। সুতরাং, কামনাই সৃষ্টির মূলভূত কারণ।

মহর্ষি বেদব্যাস মহাভারতের শান্তিপর্বে ২৫৭ অধ্যায়ে সপ্তম শ্লোকে বলেছেন–
কামবন্ধনম্ এবেদং নান্যদ্ অস্তীহ বন্ধনম্।
কামবন্ধনমুক্তো হি ব্রহ্মভূয়ায় কল্পতে॥

এই সমস্ত বন্ধনই কামবন্ধন। এতদ্ ব্যতীত অন্য বন্ধন নেই। কামবন্ধনমুক্ত পুরুষই ব্রহ্মকে প্রাপ্ত করেন বা ব্রহ্মলীন হন।
সাধারণ ভাবে আমরাও অনুভব করি যে, ব্যক্তি প্রথমে কিছু কামনা করে, তার পরে কামনা অনুরূপ ক্রিয়া করে এবং সেই ক্রিয়ার দ্বারাই সুখ বা দুঃখ অনুভব করে। সুতরাং, সুখ-দুঃখময় এই সৃষ্টির মূল কাম।

পঞ্চম মন্ত্র–

আগের মন্ত্রগুলি থেকে জানা গেল যে, সৃষ্টির কারণ অবিদ্যা, কাম এবং কর্ম। নাসদাসীন্নো সদাসীৎ ইত্যাদি প্রথম মন্ত্রে অবিদ্যাকে, কামস্তদগ্রে ইত্যাদি দ্বারা কামনাকে এবং মনসঃ রেতঃ অংশে রেতঃ শব্দের দ্বারা ফলদানোন্মুখ কর্মকে সৃষ্টির হেতু বলে বর্ণনা করা হল। পঞ্চম মন্ত্রে এদের ক্রম ও শীঘ্রতার কথা বলা হচ্ছে।
ति॒र॒श्चीनो॒ वित॑तो र॒श्मिरे॑षाम॒धः स्वि॑दा॒सी३दु॒परि॑ स्विदासी३त्।
रे॒तो॒धा आ॑सन्महि॒मान॑ आसन्स्व॒धा अ॒वस्ता॒त्प्रय॑तिः प॒रस्ता॑त्॥५॥
তিরশ্চীনো বিততো রশ্মিরেষাম্ অধঃ স্বিদ্ আসীদ্ উপরি স্বিদ্ আসীৎ।
রেতোধা আসন্মহিমান আসন্ত্ স্বধা অবস্তাৎ প্রয়তিঃ পরস্তাৎ॥৫॥
অন্বয়
এষাম্ রশ্মিঃ বিততঃ আসীৎ। স্বিৎ তিরশ্চীনো আসীৎ, স্বিৎ অধঃ আসীৎ, স্বিৎ উপরি আসীৎ। রেতোধাঃ আসন্। মহিমানঃ আসন্। স্বধা অবস্তাৎ, প্রয়তিঃ পরস্তাৎ।
প্রতিপদার্থ–
এষাম্– এদের
রশ্মিঃ– প্রকাশ
বিততঃ– বিস্তৃত
আসীৎ– ছিল।
স্বিৎ– (বিকল্পসূচক অব্যয়)
তিরশ্চীনো– তির্যক্ রূপে
অধঃ– নীচে
উপরি– উপরে
রেতোধাঃ– বীজভূত কর্মের কর্তা এবং কর্মফলের ভোক্তা
আসন্– ছিলেন
মহিমানঃ– মহান্ আকাশ প্রভৃতি
স্বধা– ভোগ্যপ্রপঞ্চ
অবস্তাৎ– নিকৃষ্ট
প্রয়তিঃ– ভোক্তা
পরস্তাৎ– উৎকৃষ্ট

ভাবানুবাদ –   

সৃষ্টির হেতু স্বরূপ অবিদ্যা, কামনা এবং কর্ম থেকে উৎপন্ন তাদের কার্যভূত সৃষ্টি সূর্যরশ্মির সমান সমস্ত সৃষ্টিতে ব্যাপ্ত হয়েছিল। সেই কার্যস্বরূপ সৃষ্টি কি মধ্যস্থানে ছিল, নাকি নীচে ছিল, নাকি উপরে ছিল? বস্তুতঃ, এরা একই সময়ে সমস্ত দিকে পরিব্যাপ্ত হয়েছিল। সেই উৎপন্ন কার্যবস্তু সমূহের মধ্যে ছিল বীজভূত কর্মের ধারক– অর্থাৎ কর্মের কর্তা এবং ফলের ভোক্তা– জীবসমূহ এবং মহান আকাশ প্রমুখ ভোগ্য বস্তু সকল। এই দুই প্রকার সৃষ্টির মধ্যে ভোগ্য বস্তু সমূহ নিকৃষ্ট এবং ভোক্তা জীব উৎকৃষ্ট।

ব্যাখ্যা –

এই মন্ত্রটিকে সায়ণ দুইভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।
প্রথম ব্যাখ্যায়– এষাং রশ্মিঃ এই বাক্যাংশের অর্থ হবে অবিদ্যা, কামনা এবং কর্ম থেকে তাদের কার্য সমূহ সূর্যরশ্মির ন্যায় সমগ্র সৃষ্টিতে ব্যাপ্ত হয়েছিল।
রেতোধাঃ শব্দের দ্বারা সৃষ্টির বীজস্বরূপ কর্ম ও কর্মফলের কর্তা ও ভোক্তা জীবকে বোঝানো হয়েছে। কারণ, জীবই কর্তা ও ভোক্তা রূপে এই কর্মরূপী বীজকে ধারণ করে আছে।
মহিমানঃ শব্দের দ্বারা মহান্ আকাশ প্রভৃতি পঞ্চভূত এবং তাদের দ্বারা নির্মিত ভৌতিক প্রপঞ্চকে বোঝানো হয়েছে।
স্বধা শব্দের দ্বারা ভোগ্য বস্তুসমূহকে বোঝানো হয়েছে। প্রযতিঃ শব্দের দ্বারা জীবকে বোঝানো হয়েছে।
সৃষ্টির হেতু স্বরূপ অবিদ্যা, কামনা এবং কর্মের থেকে উৎপন্ন সমস্ত কার্যস্বরূপ পদার্থ তৎক্ষণাৎ, অতি শীঘ্র, অবিলম্বেই সমস্ত সৃষ্টিতে ব্যাপ্ত হয়। যেমন সূর্য উদিত হলে সূর্যরশ্মি তৎক্ষণাৎই সর্বত্র ব্যাপ্ত হয় তেমনভাবে। সেই কার্য রূপ পদার্থ মধ্যে, নীচে বা উপরে– কোথায় থাকে? যেমন বিদ্যুৎ ও তার প্রকাশ। বিদ্যুৎ চমকিত হলে তার প্রকাশ নিমেষেই উপরে, নীচে, মধ্যে পরিব্যাপ্ত হয়। অত্যন্ত শীঘ্রতার সেই প্রকাশের বিস্তারের কোন ক্রম নির্ধারণ দুঃসাধ্য। তেমনই সৃষ্টিতেও উৎপন্ন পদার্থসমূহ নিমেষেই পরিব্যাপ্ত হয়।

এই সৃষ্টির দুইটি ভাগ। একটি রেতোধাঃ অর্থাৎ জীব। অপরটি মহিমা অর্থাৎ মহৎ আকাশ প্রভৃতি জড় বস্তু। মায়াসহিত পরমেশ্বর এই সম্পূর্ণ সৃষ্টির জন্ম দিয়ে তাতে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে তাকে দুই ভাগে ভাগ করে নেন। এই দুই প্রকার সৃষ্টির মধ্যে আকাশাদি ভোগ্য বস্তু রূপ যে সৃষ্টি সেটি নিকৃষ্ট। জীব উৎকৃষ্ট। আকাশাদি জড় সৃষ্টিকে ভোক্তা জীবের ভোগ্য রূপে বিকশিত করা হয়েছে।

দ্বিতীয় ব্যাখ্যায়– এষাং রশ্মিঃ বাক্যাংশের অর্থ, এই সমস্ত পাঞ্চভৌতিক জাগতিক বস্তুসমূহের মধ্যে রশ্মি অর্থাৎ সূর্যরশ্মির সমান স্বয়ংপ্রকাশ চৈতন্য সর্বত্র ব্যাপ্ত ছিল।
রেতোধাঃ শব্দের দ্বারা সমগ্র সৃষ্টিকে বোঝানো হয়েছে। রেতঃ শব্দের অর্থ সার। সারকে যে ধারণ করে আছে সে রেতোধাঃ। সচ্চিদানন্দ স্বরূপ পরমাত্মার সারভূত হল সৎ। সমস্ত পদার্থই সৎ রূপে প্রতিভাত হয়। সেজন্যই সত্তাই পরমাত্মার সার। সেই সত্তা রূপ সারকে ধারণ করার জন্য সমস্ত পদার্থই রেতোধা।
মহিমানঃ শব্দের দ্বারা পর্বতাদি স্থূল মহৎ আকৃতি বিশিষ্ট বিষয়জাতকে বোঝানো হয়েছে।

সূর্যের রশ্মির সমান স্বয়ংপ্রকাশ চৈতন্য ভৌতিক, জাগতিক সমস্ত পদার্থেরই মধ্যে, ঊর্ধ্বে এবং নিম্নে পরিব্যাপ্ত। যখন বিচার করা হয় যে, চৈতন্য এই পাঞ্চভৌতিক সৃষ্টির মধ্যে সুতোর মত বিস্তৃত, নাকি তাদের নীচে বিস্তৃত, নাকি উপরে বিস্তৃত? দেখা যায় যে, সেই চৈতন্য এই সমস্ত কার্যভূত সৃষ্টির মধ্যে, উপরে, নীচে সর্বত্রই ব্যাপ্ত। যেমন ঘটের উপাদান স্বরূপ মৃত্তিকা সমস্ত ঘটকে পরিব্যাপ্ত করে থাকে, তেমনই মায়াসহিত পরমেশ্বর এই সমস্ত সৃষ্টিকে সৃষ্টি করে তাকে পরিব্যাপ্ত করে আছেন। তিনি উপরে, নীচে বা মধ্যে কোথায় আছেন সেটা নিশ্চয় করা সম্ভব নয়। তিনি সর্বত্র ব্যাপ্ত। সমস্ত পদার্থই রেতোধা, অর্থাৎ, পরমাত্মার সারভূত সত্তাকে ধারণ করে আছে। সমস্ত পদার্থেরই সৎ রূপে অবভাস ঘটে। সমস্ত পদার্থকেই সৎ বলেই ধারণা হয়। সত্তাবিশিষ্ট পদার্থ মহান আকৃতি বিশিষ্ট পর্বত, নদী প্রভৃতি রূপে অবস্থিত।

স্বধা শব্দের বাচ্য মায়া বা অবিদ্যা– পরমেশ্বরের শক্তি– হল সৃষ্টির অধম কারণ। আর সেই মায়া যেখানে প্রযত্ন করে সেই পরমাত্মা উত্তম কারণ। এই ভাবে মায়াশক্তি এবং পরমেশ্বরকেই সৃষ্টির কারণ রূপে নির্দেশ করা হয়েছে। এই শক্তি এবং পরমেশ্বরকেই শাস্ত্রে প্রকৃতি ও পুরুষ বলা হয়ে থাকে।

শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে–
নিরোধোঽস্যানুশয়নম্ আত্মনঃ সহ শক্তিভিঃ।
মুক্তির্হিত্বান্যথারূপং স্বরূপেণ ব্যবস্থিতিঃ॥
আভাসশ্চ নিরোধশ্চ যতশ্চাধ্যবসীয়তে।
স আশ্রয়ঃ পরং ব্রহ্ম পরমাত্মেতি কথ্যতে॥ (শ্রীমদ্ভাগবতম্ ২/১০/৬-৭)

যোগনিদ্রায় শয়ান হরিকে অনুসরণ করে জীবগণ নিজ নিজ শক্তি বা উপাধি সহিত অনুশয়িত হয়। কর্তৃত্ব-ভোক্তৃত্ব প্রভৃতি অন্যথা রূপ পরিত্যাগ করে স্বরূপে অবস্থিতিই মুক্তি। সৃষ্টি, প্রলয়, যার থেকে সৃষ্টি হয় সেই আশ্রয়ই পর ব্রহ্ম। তাকেই পরমাত্মা বলা হয়।

ষষ্ঠ মন্ত্র –

ভোক্তা ও ভোগ্য– এই দুই শ্রেণীতে বিভাজিত করে সৃষ্টির প্রতিপাদন করা হল। এই ভোগ্য ও ভোক্তা সম্বন্ধে এরকমও বলা হয়– অন্ন ও অন্নাদ। কখনও বা ভোগ্যকে সোম এবং ভোক্তাকে অগ্নি বলা হয়। যেমন– এতাবদ্ বা ইদম্ অন্নং চৈবান্নাদশ্চ, সোম এবান্নম্ অগ্নিরন্নাদঃ (শতপথব্রাহ্মণ চতুর্দশ কাণ্ড, তৃতীয় প্রপাঠক, ত্রয়োদশ মন্ত্র। বৃহদারণ্যক উপনিষদ, প্রথম প্রপাঠক, দ্বিতীয় ব্রাহ্মণ, ত্রয়োদশ মন্ত্র)। এই সৃষ্টি অত্যন্ত দুর্জ্ঞেয় বলে তার বিস্তার সম্পর্কে অধিক বলা হয়নি। বর্তমান মন্ত্রে সেই সৃষ্টির প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে।

को अ॒द्धा वे॑द॒ क इ॒ह प्र वो॑च॒त्कुत॒ आजा॑ता॒ कुत॑ इ॒यं विसृ॑ष्टिः।
अ॒र्वाग्दे॒वा अ॒स्य वि॒सर्ज॑ने॒नाथा॒ को वे॑द॒ यत॑ आब॒भूव॑॥६॥
কো অদ্ধা বেদ ক ইহ প্র বোচৎ কুত আজাতা কুত ইয়ং বিসৃষ্টিঃ।
অর্বাগ্ দেবা অস্য বিসর্জনেনাথা কো বেদ যত আবভূব॥৬॥
অন্বয়
কঃ অদ্ধা বেদ। ইহ কঃ প্রবোচৎ। কুতঃ আজাতা? ইয়ং বিসৃষ্টিঃ কুতঃ? অস্য বিসর্জনেন দেবা অর্বাক্। অথ যতঃ আবভূব কঃ বেদ?
প্রতিপদার্থ–
কঃ– কে
অদ্ধা– পারমার্থিক ভাবে
বেদ– জানে
ইহ– এই জগতে
কঃ– কে
প্রবোচৎ– বলতে পারে
কুতঃ– কোথা থেকে
আজাতা– এল
কুতঃ– কোথা থেকে
ইয়ং– এই
বিসৃষ্টিঃ– বিশিষ্ট সৃষ্টি
অস্য– এই জগতের
বিসর্জনেন– সৃষ্টির দ্বারা
দেবা– দেবতারা
অর্বাক্– অর্বাচীন
অথ– এর পরে
যতঃ– যার থেকে
আবভূব– উৎপন্ন হয়েছে
কঃ– কে
বেদ– জানে

ভাবানুবাদ –

পারমার্থিক ভাবে কোন ব্যক্তি জানে? কে এই সৃষ্টির সম্পর্কে বলতে পারে? কোথা থেকে এই সৃষ্টির উৎপত্তি? কে এর স্রষ্টা? এই জাগতিক ভৌতিক সৃষ্টি দেবতাদের থেকেও প্রাচীন। সেজন্য দেবতারাও এর সম্পর্কে বলতে অক্ষম। ফলে, যার থেকে এই সম্পূর্ণ সৃষ্টি উৎপন্ন হয়েছে, তাকে কে জানতে পারে?

ব্যাখ্যা –

অদ্ধা শব্দের অর্থ পারমার্থিক ভাবে। অর্থাৎ, সুনিশ্চিত ভাবে। প্রশ্ন করা হচ্ছে– কোন ব্যক্তি পরমার্থতঃ অর্থাৎ নিশ্চিত ভাবে এই সৃষ্টির সম্পর্কে জানে? এই জগতে কে বলতে পারে এই সৃষ্টি সম্পর্কে?

মন্ত্রে কুতঃ শব্দটি দুইবার প্রয়োগ হয়েছে। কুতঃ আজাতা শব্দের অর্থ কোন নিমিত্ত কারণ দ্বারা এই সৃষ্টির রচনা? বিসৃষ্টি শব্দের অর্থ বিবিধ সৃষ্টি। পূর্ব মন্ত্রে দেখানো হয়েছে সৃষ্টি মূলতঃ দুই প্রকার– ভোক্তা এবং ভোগ্য। ভোগ্য সৃষ্টিও নানা রূপে বিকশিত। কুতঃ ইয়ং বিসৃষ্টিঃ শব্দের অর্থ হল, এই সম্পূর্ণ ভৌতিক, জাগতিক সৃষ্টির উপাদান কারণ কী?

সৃষ্টির এই দুই প্রকার কারণ সম্পর্কে কে-ই বা জানে? সমস্ত লৌকিক বিষয়ের জ্ঞাতা দেবতারা কি জানেন? তাঁরা যদি জানেন তবে তাঁরা বলতেও পারবেন। উত্তরে বলা হল, এই পঞ্চভূতের সৃষ্টির পরে বিবিধ ভৌতিক সৃষ্টি দেবতাদেরও অর্বাচীন করেছে। অর্থাৎ, সৃষ্টির উন্মেষের পরে পঞ্চভূতের বিকাশ, তার পরে ভৌতিক পদার্থ বা স্থূল ভূতগুলির বিকাশের পরেই দেবতাদের আবির্ভাব। সুতরাং, দেবতারাও সৃষ্টির প্রাক্ মুহূর্তটি সম্পর্কে কিছু বলতে পারবেন না।

যেহেতু, সৃষ্টির প্রক্রিয়া দেবতাদেরও অজ্ঞাত সেজন্য এই সৃষ্টি দুর্বিজ্ঞেয়। সেজন্য তদ্ব্যতিরিক্ত কে-ই বা থাকতে পারে যে এই সৃষ্টির মূল কারণ সম্পর্কে বলতে পারে?

এর আগে বলা হয়েছে সৃষ্টির কারণ ক্রমশঃ অবিদ্যা, কামনা এবং কর্ম। অনেকেই পরমাণুকে সৃষ্টির কারণ বলে মনে করে। কেউ বা স্বাধীন, জড় প্রকৃতিকে সৃষ্টির মূল কারণ বলে মনে করেন। কেউ কেউ শূন্যকে সৃষ্টির কারণ বলে মনে করেন। অনেকে আবার বলেন, সৃষ্টির কোন প্রারম্ভ নেই। সৃষ্টি চিরকাল এই অবস্থাতেই রয়েছে।

এই মন্ত্রে এই সমস্ত মতবাদীদেরকেই একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন করা হচ্ছে, কে সঠিক ভাবে এই সৃষ্টির কারণ এবং প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলতে পারে?

সৃষ্টির উন্মেষের পরেই যেহেতু দেবতাদের আবির্ভাব সেজন্য এই সৃষ্টির মূল কারণকে কেউ প্রত্যক্ষ করেননি। এর অনুমানও অসম্ভব। কারণ, সৃষ্টির কারণ অনুমানের কোন হেতু ও দৃষ্টান্ত অসম্ভব। লৌকিক হেতু, দৃষ্টান্তাদি সবই সৃষ্টির অভ্যন্তরীণ। তার দ্বারা সৃষ্টির পূর্ববর্তী অবস্থার অনুমান অসম্ভব।

সেজন্য এই সুগভীর সৃষ্টিতত্ত্বকে কেবলমাত্র শ্রুতির অনুশীলনের দ্বারাই জানা সম্ভব।

সপ্তম মন্ত্র –

इ॒यं विसृ॑ष्टि॒र्यत॑ आब॒भूव॒ यदि॑ वा द॒धे यदि॑ वा॒ न।
यो अ॒स्याध्य॑क्षः पर॒मे व्यो॑म॒न्सो अ॒ङ्ग वे॑द॒ यदि॑ वा॒ न वेद॑ ॥ ७
ইয়ং বিসৃষ্টির্যত আবভূব যদি বা দধে যদি বা ন।
যো অস্যাধ্যক্ষঃ পরমে ব্যোমন্ত্সো অঙ্গ বেদ যদি বা ন বেদ॥৭॥
অন্বয়
যতঃ ইয়ং বিসৃষ্টিঃ আবভূব। যদি বা দধে যদি বা ন। যঃ অস্য অধ্যক্ষঃ পরমে ব্যোমন্ সঃ অঙ্গ বেদ যদি বা ন বেদ।
প্রতিপদার্থ
যতঃ– যে কারণ থেকে
ইয়ং– এই
বিসৃষ্টিঃ– বিবিধ সৃষ্টি
আবভূব– উদ্ভূত হয়েছে
যদি বা দধে যদি বা ন– যদি ধারণ করে থাকে, অথবা, যদি ধারণ না করে
যঃ– যে
অস্য– এর
অধ্যক্ষঃ– নিয়ন্তা ঈশ্বর
পরমে– উৎকৃষ্ট
ব্যোমন্– আকাশের সমান সুনির্মল আত্মপ্রকাশে
সঃ– সেই
অঙ্গ– প্রসিদ্ধ
বেদ– জানে
বা– অথবা
যদি– যদি
ন– না
বেদ– জানে

ভাবানুবাদ –

যে পরমেশ্বর থেকে এই সৃষ্টির উদ্ভব তিনিই একে ধারণ করে আছেন। তিনি ভিন্ন আর কে-ই বা এই সৃষ্টিকে ধারণ করতে সক্ষম? এই বিবিধ সৃষ্টির যিনি নিয়ন্তা, ঈশ্বর তিনি নিজের উৎকৃষ্ট আকাশের সমান সুনির্মল নিজ প্রকাশে প্রতিষ্ঠিত আছেন। সেই অত্যন্ত প্রসিদ্ধ পরমেশ্বরই এই সৃষ্টিকে জানেন। তিনি ব্যতীত আর কেউ জানতে পারে না।

ব্যাখ্যা – 

যতঃ ইয়ং বিসৃষ্টিঃ আবভূব– যার থেকে এই সৃষ্টির উদ্ভব।
যদি বা দধে যদি বা ন– তিনিই এই সৃষ্টিকে ধারণ করে আছেন। তিনি যদি সৃষ্টিকে ধারণ না করেন, তবে আর কারও শক্তি নেই একে ধারণ করার।

আগের মন্ত্রে বলা হয়েছে এই সৃষ্টির উপাদান বা নিমিত্ত কারণ কী, সেকথা সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত কেউই জানতে বা জানাতে সক্ষম নয়। এই মন্ত্রে বলা হচ্ছে, এই বিবিধ ভৌতিক সৃষ্টিকে কে ধারণ করে আছেন? উত্তর– যাঁর থেকে এই সৃষ্টির উদ্ভব, তিনিই ধারণ করে আছেন। তিনি ব্যতীত আর কারও ক্ষমতা নেই এই সৃষ্টিকে ধারণ করার। তিনি হলেন পরমেশ্বর স্বয়ম্। যেহেতু বলা হল যাঁর থেকে উদ্ভব তিনিই ধারণ করা করে আছেন, সুতরাং, সৃষ্টিকে ধারণকারী পরমেশ্বরই সৃষ্টির উপাদানভূত কারণ।

মন্ত্রের এই পূর্বার্ধটি অন্য ভাবেও ব্যাখ্যা করা সম্ভব। আগের মন্ত্রে বলা হয়েছিল যে, এই সৃষ্টির সূচনা দুর্বিজ্ঞেয়। সেই কথাটিই এখানে আরও দৃঢ় ভাবে প্রতিপাদন করা হচ্ছে। বলা হল, কো বেদ? কে জানে? এই সৃষ্টি যার থেকে উদ্ভূত তাকে কে জানে? কেউ বলে, সৃষ্টির সূচনা নেই। এটি সবসময়ই ছিল। কেউ বা বলে, জড়, স্বাধীন প্রকৃতি থেকে জগতের সৃষ্টি। কেউ বা বলে পরমাণু থেকে জগতের সৃষ্টি। এরা সকলেই ভ্রান্ত। যার থেকে এই জগতের সৃষ্টি তাকে কে জানে? যে এই জগতের উপাদান তিনি যদি এই জগৎকে নিমিত্তরূপে সৃষ্টি না করেন তবে তিনি ব্যতীত আর কে সৃষ্টি রচনা করতে পারে? (যদি বা দধে যদি বা ন)। সুতরাং, যারা বলে যে জগতের উপাদান থেকে ভিন্ন তটস্থ কোন ঈশ্বর আছেন তারাও ভ্রান্ত।

প্রশ্ন ওঠে, যদি কেউই এই সৃষ্টির কথা না-ই জানে তবে তার অস্তিত্বের প্রমাণ কী? তার উত্তরে মন্ত্রের দ্বিতীয়ার্ধে বলা হচ্ছে, ঈশ্বরই এর প্রমাণ।

যঃ অস্য অধ্যক্ষঃ– এই পঞ্চভূত এবং ভৌতিক জগতের অধ্যক্ষ অর্থাৎ নিয়ন্তা যিনি, তিনি পরমে ব্যোমন্ অর্থাৎ, নিজের উৎকৃষ্ট মহিমাতেই প্রতিষ্ঠিত।

ব্যোমন্ শব্দটির অনেক ভাবে নিষ্পত্তি সম্ভব।

১. ব্যোমন্ শব্দের অর্থ আকাশ। পরমেশ্বরের মহিমাকে সুনির্মল আকাশের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে।
২. বি উপসর্গ পূর্বক অব্ ধাতু থেকে ব্যোমন্ শব্দের নিষ্পত্তি। তৃপ্তি অর্থে প্রযুক্ত অব্ ধাতুর উত্তর মনিন্ প্রত্যয় করে ব্যোমন্ শব্দটি নিষ্পন্ন হয়। তার অর্থ হবে বিশেষ ভাবে তৃপ্ত। অর্থাৎ নিরতিশয় আনন্দ। পরমেশ্বর তাঁর স্বরূপভূত আনন্দে প্রতিষ্ঠিত।
৩. অব্ ধাতুর অর্থ গতি। বিশেষ ভাবে গত বা ব্যাপ্ত। দেশ ও কালের পরিচ্ছেদ ব্যাপ্তিকে সীমিত করে। যা দেশ ও কালের দ্বারা পরিচ্ছিন্ন নয় বা সীমিত নয় সেটিই বিশেষ ভাবে ব্যাপ্ত। সেই দেশ-কাল পরিচ্ছেদহীনতায় প্রতিষ্ঠিত।
৪. অব্ ধাতুর অর্থ জ্ঞান। ব্যোমন্ অর্থাৎ বিশেষ জ্ঞান। স্বরূপভূত জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত।

ছান্দোগ্য উপনিষদে নারদ-সনৎকুমার-সংবাদে বলা হয়েছে– ‘স ভগবঃ কস্মিন্ প্রতিষ্ঠিত ইতি স্বে মহিম্নি’– সেই পরমাত্মা কোথায় প্রতিষ্ঠিত? তিনি নিজের মহিমাতেই প্রতিষ্ঠিত। সেজন্য পরমেশ্বরের প্রতিষ্ঠা তাঁর মহিমা বা তাঁর স্বরূপে। এই মন্ত্রে পরমে ব্যোমন্ শব্দদুইটি দিয়ে এই কথাই বোঝানো হয়েছে।

সেই পরমেশ্বর নিশ্চিত ভাবে সৃষ্টির উপাদানভূত পরমেশ্বর সম্বন্ধে জানেন। যদি তিনি না জানেন, তবে কে-ই বা জানবে?

এখানে বলা হল পরমেশ্বরই পরমেশ্বরকে জানেন। এই কথাটি লৌকিক জগতের সাপেক্ষে বলা হল। কারণ, পরমেশ্বর যখন অদ্বৈত অবস্থায় বিরাজমান তখন জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের পৃথক অস্তিত্বের সম্ভাবনা নেই। যেমন বলা হয়েছে– ‘যত্র ত্বস্য সর্বম্ আত্মৈবাভূৎ। তৎ কেন কং পশ্যেৎ। তৎ কেন কং জিঘ্রেৎ। তৎ কেন কম্ অভিবদেৎ। তৎ কেন কং শৃণুয়াৎ। তৎ কেন কং মন্বীত। তৎ কেন কং বিজানীয়াৎ। যেনেদং সর্বং বিজানাতি তং কেন বিজানীয়াদ্ বিজ্ঞাতারম্ অরে কেন বিজানীয়াদ্ ইতি।’ (শতপথব্রাহ্মণে চতুর্দশ কাণ্ডে চতুর্থ প্রপাঠকে ষোড়শ মন্ত্র)

যেখানে অবিদ্যাই নেই সেখানে পরমাত্মা ব্যতিরিক্ত অপরের অভাবের ফলে কে কীভাবে কাকে দেখবে, কে কীভাবে কাকে শুঁকবে, কে কীভাবে কার অভিবাদন করবে, কে কীভাবে কাকে শুনবে, কে কীভাবে কাকে মনন করবে, কে কীভাবে কাকে বিশেষ ভাবে জানবে। যার দ্বারা সমস্ত কিছুকে জানা যায় সেই সমস্ত কিছুর বিজ্ঞাতাকে কে কীভাবে জানবে?

অর্থাৎ, সেই পরমার্থ অদ্বৈত দশায় কেউ কাউকে জানতে পারে না। সেজন্যই বলা হল পরমেশ্বর নিজ মহিমা বা নিজ স্বরূপভূত জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত। একেই অদ্বৈত অবস্থা বলা হয়। যেখানে একত্বও তিরোহিত। যেমন দশটি জলপূর্ণ ঘটে সূর্যের দশটি প্রতিবিম্বকে দেখে ১টি সূর্য বিম্ব ও তার ১০টি প্রতিবিম্ব বলা চলে। সমস্ত ঘট ভেঙ্গে গেলে আর একটি সূর্য বিম্ব বলা চলে না। কারণ, বিম্ব প্রতিবিম্বকে অপেক্ষা করে। সেখানে সূর্য অদ্বিতীয়, কেবল। তাকে আর ১ বলা যায় না।

শ্রী রাকেশ দাশ – (অধ্যাপক, সংস্কৃত ও দর্শন বিভাগ
রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ শৈক্ষিক ও গবেষণা সংস্থা)
(মানিত বিশ্ববিদ্যালয়)
বেলুড় মঠ, হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ ৭১১২০২)

 

Picture courtesy: The Straits Times 

Comment here