স্বভূমি ও সমকাল

বেঙ্গল কেমিক্যালসের বেসরকারীকরণ বন্ধ হোক

‘বেঙ্গল ক্যেমিক্যালস সুহৃদ সমাজ’ –এর উদ্যোগে আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়-এর ১৬১ তম জন্ম জয়ন্তীর প্রাক্কালে সম্পূর্ণ দেশীয় উদ্যোগে বিংশ শতকের প্রথম বর্ষে স্বদেশী আন্দোলনের পর্বেই আচার্য্যদেব পরিকল্পিত ও প্রতিষ্ঠিত ভারতের প্রথম কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি বা রাসায়নিক শিল্প প্রতিষ্ঠান ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’ বর্তমানে ‘বেঙ্গল ক্যেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিটিকলস লিমিটেড’ ………ঔষধ ও দৈন্যন্দিন ব্যবহার্য রাসায়নিক দ্রব্যসামগ্রী প্রস্তুতকারী কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রনাধীন সংস্থাকে [১৯৮০ অধিগৃহীত] সরকার বিলগ্নীকরণ এবং কোন ব্যক্তি মালিকানাধীন কর্তৃপক্ষের কাছে বিক্রির করার প্রতিবাদে একটি সাইকেল মিছিল গতকাল রবিবার সকালে [পয়লা অগাস্ট] কাঁকুড়গাছি বেঙ্গল ক্যেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিটিক্যাল লিমিটেডের কারখানা গেট থেকে বেরিয়ে সমগ্র অঞ্চল পরিক্রমা করে বাগমাড়ি বাজারে শেষ হয়।

কারখানার সঙ্গে দীর্ঘদিনের যুক্ত স্থায়ী ও অস্থায়ী কর্মচারীরা এই মিছিলে যোগ দেন। কর্মমুখী বাঙ্গলা এবং বাঙ্গালীর গর্বের ও আত্মনির্ভরশীলতার প্রতীক এই সংস্থাটিকে শুধুমাত্র নেতিবাচক ক্ষমতার জোরে বিক্রি করার এই পরিকল্পনাকে আমরা ধিক্কার জানাচ্ছি। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনের শোষণযন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিস্পর্ধী একটি দেশীয় স্বক্ষমতার প্রেরণাদায়ী এবং সমগ্র ভারতবর্ষের কাছে দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী ঐতিহ্যমণ্ডীত এই ঔষধ ও রাসায়নিক দ্রব্যপ্রস্তুতকারী এই সংস্থাটিকে বিক্রি করার পরিকল্পনার মধ্যে সরকারের অপদার্থতা এবং কর্তব্যহীন ক্ষমতাভোগের নজির সৃষ্টি করছে।

আসুন দেখে নিই সরকারি পোর্টালে এই সরকারি সংস্থাটি সম্পর্কে দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তার পূর্বতন ও বর্তমান অবস্থা। ‘বেঙ্গল ক্যেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিটিক্যাল লিমিটেড’ সংস্থাটি ১৯০১ সালের ১২ এপ্রিল বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও উদ্যোক্তা আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যেটি ছিল ভারতের প্রথম কোন রসায়ন প্রস্তুতকারক কারখানা। ১৯০৫ সালে মানিকতলায় (কলকাতা) এই সংস্থাটি পূর্ণমাত্রায় একটি প্রথম বাণিজ্যিকভাবে রাসায়নিক দ্রব্যপ্রস্তুতকারী কারখানা হিসাবে যাত্রা শুরু করে এবং পরবর্তীকালে, আরও তিনটি কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয় – ১৯২০ সালে পানহাটি (উত্তর ২৪ পরগনা, পশ্চিমবঙ্গ), একটি ১৯৩৮ সালে মুম্বাই ও ১৯৪৯ সালে কানপুরে এর শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। ৬, গণেশ চন্দ্র এভিনিউ, কলকাতায় এর রিজিস্টার অফিসও খোলা হয়। এছাড়াও, কোম্পানির ১১ টি বিক্রয় কেন্দ্র রয়েছে এবং ১০টি সি এন্ড এফ এজেন্সি সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে। কোম্পানিটি ১৯৫০ এর দশকের গোড়া পর্যন্ত খুব ভাল কাজ করে কিন্তু ১৯৫০ সালের মাঝামাঝি থেকে লোকসান শুরু হয়। ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭৭, ভারত সরকার বেঙ্গল ক্যেমিক্যালসের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৮০ সালের ১৫ডিসেম্বর তারিখে সংস্থাটির জাতীয়করণ করে। ১৯৮১ সালের ২৭ মার্চ এই সংস্থাটির Bengal Chemicals & Pharmaceuticals Ltd. (BCPL) নামে নয়া উদ্যমে তার পথচলা শুরু করে। সরকারের দেওয়া ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী সংস্থাটি তাদের উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ করে ১০৬.৭০ কোটি টাকা ২০১৬ মার্চ-এপ্রিল অর্থ বর্ষে মুনাফা অর্জন করে পূর্বতন ২০১৫ মার্চ-এপ্রিল-এর ৬৪.১০ কোটি টাকার তুলনায় । ২০১৫-১৬ সালে সংস্থাটির বিক্রির পরিমাণ ছিল প্রায় দ্বিগুণ ৮৮ কোটি টাকা, যেখানে ২০১৪-১৫-এর সালে ছিল ৪৫ কোটি টাকা।

বর্তমানে সংস্থাটি আন্টিবায়োটিক ড্রাগ হিসাবে Streptomycin, Gentamicin, Ampicillin, Amoxycillin, Cephalexin, Cefadroxil, Ceftriaxone, Ceftazidime ইত্যাদির বাণিজ্যিক উৎপাদন করে থাকে। এছাড়াও সালফিউরিক অ্যাসিড এবং ফেনল, ন্যাপথালিন, ব্লিচিং পাউডার, ক্যান্থারিডিন হেয়ার অয়েল, আগরু সুগন্ধি ইত্যাদির বাণিজ্যিক উৎপাদনও করা হয়। এছাড়াও সংস্থাটি ট্যাবলেট, বড় ভলিউম প্যারেন্টেরালস, লিকুইড ওরালস ইত্যাদি ফার্মাকোপোসিয়াল স্ট্যান্ডার্ডের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ দ্রব্যসামগ্রী প্রস্তুত করে থাকে। এছাড়াও BCPL বিভিন্ন ধরণের গৃহস্থালি ব্যবহার্য বৈচিত্র্যময় দ্রব্যসামগ্রীর উৎপাদন করে থাকে। কোম্পানি কোলকাতার মানিকতলা কারখানায় নতুন মলম ব্লক, বেতাল্যাক্টাম ব্লক (ট্যাবলেট এবং ক্যাপসুল) এর মতো সম্প্রসারণ পরিকল্পনার অংশ হিসাবে নতুন সুবিধা চালু করেছে এবং নতুন ইনস্টল করা যন্ত্রপাতির বাণিজ্যিকীকরণ চালু করেছে। ইনজেকশনযোগ্য বিভাগের অন্যান্য ব্লক ২ মাসের মধ্যে কাজ করবে। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে নাগালের জোরদার করার জন্য BCPL বিতরণ নেটওয়ার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার প্রক্রিয়াও চলছে। এখন, আমাদের দেশে ১১ টি ডিপো, ৫৪৫টি স্টকিস্ট এবং ১০ টি সিএন্ডএফ এজেন্সি রয়েছে।

অত্যন্ত আক্ষেপের বিষয় হল বিগত ২০১৯-২০ অর্থবর্ষ থেকেই সংস্থাটির পরিচালকমণ্ডলী হঠাৎই দীর্ঘ ১৭-১৮ বছর কর্মরত অস্থায়ী কর্মীদের ছাটাই করা শুরু করে। বিগত ২-৩ বছর ব্যাপী সংস্থাটি ক্রমশ রুগ্ন শিল্পে পরিণত করার ধ্বংসাত্মক প্রচেষ্টা কেন্দ্রীয় পরিচালক কর্তৃপক্ষের তরফে দেখা গেছে। কোন অজ্ঞাত কারণে সংস্থার কর্তৃপক্ষ কারখানার অস্থায়ী কর্মচারী এবং স্থায়ী কর্মচারীদের সঙ্গে রাজার দুয়ো রাণীর ন্যায় আচরণ শুরু করেছে। আশ্চর্যজনকভাবে,বর্তমান কেন্দ্রের সরকার এই সংস্থাটিকে বেসরকারিকরণে উদ্যোগী হয়েছেন। অথচ জনস্থাস্থ্যের সাথে জড়িত গুরুত্বপূর্ণ জেনেরিক ঔষধ প্রস্তুতকারক হিসাবে এই সংস্থার সুনাম দীর্ঘদিনের। সমগ্র দেশ ও জাতির কাছে একটি গর্বের প্রতিষ্ঠান এবং একদা কর্মকুশল গঠনমূলক দেশীয় উদ্যোগের প্রতীক এবং জাতির স্বক্ষমতা ও আত্মনির্ভরতার প্রতীক বাঙ্গালীর এই প্রতিষ্ঠানটিকে বিক্রি করে তার চড়ামূল্যের জমিটি রিয়েল এস্টেট জমিহাঙড়দের হাতে তুলে দেবার এক প্রবণতা ইদানিং শহরের বিভিন্ন সরকারি সংস্থাগুলির ক্ষেত্রে দেখা গেছে। আমাদের আশঙ্কা, কর্তৃপক্ষের সেইরকমই কিছু অসাধু উদ্দেশ্য রয়েছে। এই অতিমারীর সময়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে লাভজনক অত্যাবশকীয় ঔষধ প্রস্তুতকারক সংস্থাকে বেঁচে দেবার অর্থ সরকার জনস্বাস্থ্য দায়িত্ব গ্রহণে অনিচ্ছুক এবং বেসরকারিকরণের এই প্রচেষ্টার অর্থ সরকার একটি কুচক্রী ধ্বংসাত্মক দালাল আমলাতন্ত্রের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।

‘বেঙ্গল কেমিক্যালস সুহৃদ সমাজ’ কর্তৃক প্রচারিত একটি লিফলেট প্রকাশ করে বলা হয়েছে “ … বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে এই কারখানা আর চালাবে না, এটা বেচে দেওয়া হবে কোন বেসরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে। অথচ প্রায় একর বেশি জমি নিয়ে গড়ে ওঠা কাকুঁড়গাছির কারখানাটিতে অত্যাধুনিক মেশিন বসানো হয়েছে এবং এর উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রীর বাজারে সুনাম এবং চাহিদা দুইই রয়েছে। ঐতিহাসিক এই কারখানার সঙ্গে রয়েছে বাঙ্গালী জাতির আবেগ। আর পাঁচটি কোম্পানির সাথে এর ফারাক এই যে এটি বর্তমান কোভিড মহামারী সময়কালেও জনস্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয় জীবনদায়ী ঔষধ তৈরিতে সক্ষম। সরকারে পক্ষে বর্তমান মহামারীতে টীকাকরণের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ বেঙ্গল কেমিক্যালসের মতো সংস্থাকে টীকা প্রস্তুত করার কাজে ব্যবহার না করে তাকে বিক্রি করে দেবার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। অথচ সরকারি দেওয়া তথ্যই জানাচ্ছে সংস্থাটি ২০১৩-১৪ সাল থেকে মুনাফা অর্জন করছে।

আমাদের প্রশ্ন দেশের স্বনির্ভর সামগ্রিক জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার স্বার্থে একটি স্বনির্ভর ঔষধপ্রস্তুতকারী সংস্থাটির পরিচালনার দায়িত্ব থেকে সরকার নিজেকে সরিয়ে নেবার অর্থ কি? কি বার্তা সরকার দেশের মহামারীর সময়ে জনগণের কাছে দিতে চাইছে? সর্বোপরি পশ্চিমবঙ্গের ন্যায় একটি অবশিল্পায়নমুখী রাজ্যকে সহযোগীতার পরিবর্তে, এই ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ করার অর্থ সরকারে দেউলিয়া মানসিকতা। শ্রী দত্তাপন্থ ঠেঙ্গারীজির জন্মশতবর্ষ পালনকারী কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলটির এই দেউলিয়া অকর্মন্য মানসিকতা শুধু বাঙ্গালীজাতি নয়, সমগ্র দেশবাসীই আজ বিস্মিত ও ব্যথিত।

অনস্বীকার্য, শ্রী মনসুখ লক্ষণভাই মান্দভিয়া একজন রাষ্ট্র বিজ্ঞান ডিগ্রীধারী ও কৃষিবিজ্ঞানের সম্পর্কে অভিজ্ঞ এবং গুজরাট থেকে মনোনীত রাজ্যসভার সদস্য হিসাবে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের কেমিক্যাল ও ফার্টিলাইজারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির এহেন ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করছেন যিনি করছেন তাঁর পক্ষে দেশের বর্তমান জনস্বাস্থ্য ও মহামারী মোকাবিলায় ঔষুধ বিজ্ঞান এবং তাঁর গবেষণা ও উৎপাদনমুখী কারখানা পরিচালনা সম্পর্কিত পর্যাপ্ত জ্ঞান কতটুকু। নিঃসন্দেহে, জনস্বাস্থ্যের জন্য ভারতবাসীকে আত্মনির্ভরশীল করার ক্ষেত্রে তাঁর আন্তরিকতাই এখন প্রশ্নের মুখে!

Comment here