আঙিনা

দেশ -১৫

 

– ডঃ গৌতম মুখোপাধ্যায়

সুব্রত ও উৎপল IAS Interviewর আগে দিল্লী গিয়ে Rao er coaching class attend করেছিল। উৎপল ৭১ যুদ্ধের পর বাংলাদেশ থেকে কলকাতা এসেছিল। ইংলিশ একদম জানত না। ওখানে শেখানো হত অম্ল ও ক্ষার মিশাইলে লবন ও পানী তৈরী হয়। এখানে এসে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে ভর্তি হয়েছিল। সুব্রত ও ওখানে পড়ত। যেটা বলতে চাইলাম ইংলিশ না জানাটা কোনো ব্যাপার নয়। পরেও শেখা যায়। ইচ্ছেটাই আসল কথা। মেধাও অবশ্যই একটা বড় ফ্যাক্টর।

বিহার, উড়িষ্যার ছেলে মেয়েরা দিল্লিতে ঘর ভাড়া নিয়ে দু তিন বছর পড়ে থেকে রাও বা অন্য কারো কোচিং নেয়, একটা ঘরে ১০-১২ জন মিলে থাকে। বিহার উড়িষ্যায় বয়স অনেক কমানো থাকে। বিহার ইউ পি তো বিখ্যাত এই ব্যাপারে। , ওড়িষাও অনেক এগিয়ে। ৬-৮ বছর কমানো থাকে।  ছোটবেলা থেকে জিকে টা পড়া উচিত। গ্রাজুয়েশন থেকে কারেন্ট এ্যাফেয়ারসের কোচিং নেওয়া প্রয়োজন। আর একটা ইমপরট্যান্ট কথা, ক্লাসে বা গ্রাজুয়েশনে খুব ভাল রেজাল্ট করা ছাত্র কে সাধারণ ছাত্র Beat করতে পারে শ্রেফ পরিশ্রমের দ্বারা।

আগের বছর টপার হয়তো পারেনি, তা বলে এবছর কোনো সাধারন ছেলে বা মেয়ে পারবে না, এমন কোনো কথা নেই।
যেমন আমাদের পরের বছর বা পরের MSc batch এর ফার্স্ট বয় সূর্য সারথী বরাট IAS interview পেয়েছিল। কিন্তু নক্সাল নিয়ে প্রশ্ন গুলোর ঠিক উত্তর দিতে পারেনি। পরের বছর আর বসেনি। কিন্তু ওকে দেখে ওই চত্বরের বহু ভাল ছেলে বসেনি। সূর্য বিয়ে করেছিল ওদের ব্যাচের সেকেন্ড গার্ল কৃষ্ণা ভদ্র কে।কৃষ্ণা আমাদের সাথে রিসার্চ করত। পরে বিদ্যাসাগর মর্ণিং এর HOD হয়ে VRS নিয়েছিল। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের নাতনি। যোগাযোগ আছে। 

উৎপল কলকাতায় পোস্টেড। কলকাতা রেলের টপ তিন জনের মধ্যে একজন হবে হয়ত। উৎপলের এক মেয়ে এক ছেলে। মেয়ে ডাক্তার। এই বছর বিয়ে হল। ছেলে অরিত্র ছোট বেলা থেকে আমার খুব ভক্ত। ওদের বাড়ি গেলে আমাকে কারো সাথে কথা বলতে দিত না। ওর সাথে ইতিহাস নিয়ে গল্প করতে হত। ও IIT Kharagpur e Physics নিয়ে পড়েছে, যদিও IIT তে Electronics এও সুযোগ পেয়েছিল।

ওদের স্কুল লা মা্রটিনিয়ার হাই ফাই স্কুল। যখন ১২ এ পড়ে আমাকে বলল স্কুল থেকে বলেছে ভাল পেপার লিখতে ফিজিক্সে। আমি তখন আমেদাবাদে। কলকাতায় এক বন্ধু কে বলে Variable Energy Cyclotron e একটা Experimenter সুযোগ করে দেই। অরিত্র Python use করে সিমুলেশন কাজে লাগিয়ে একটা ভাল পেপার লেখে। সেই পেপার দেখে পৃথিবী বিখ্যাত CERN ( World’s largest Cyclotron আছে) ওকে তিন মাসের একটা স্কলারশিপ দেয় ইউরোপে গিয়ে কাজ করার জন্য। করোনার জন্য ক্যানসেল হয়ে যায়। যাইহোক অরিত্র জার্মানিতে একটা ভাল ইন্সটিটুটে স্কলারশিপ পেয়ে Phd করতে গেল কিছুদিন আগে।

১৯৮৫ এ ONGC Ahmedabad এ join করি। আমাদের duty hours ছিল ২৪ ঘন্টা। ফিল্ড ডিউটি। একটা ওয়েল ড্রিল করে আমাদের ওয়ার্ক অর্ডার দিত পেট্রোফিজিক্যাল সা্রভের জন্য। আমরা ইমপোরটেড ট্রাক মাউন্টেড ইউনিট ও বিভিন্ন পেটরোফিজিক্যাল টুলস নিয়ে ফিল্ডে যেতাম। প্রতি জবে দুজন পেট্রোফিজিসিস্ট যেতাম। এক এক টা জব বা সার্ভে শেষ হতে ১৮-৩৬ ঘন্টা লাগত। জব বেশী এসে গেলে ৫-৬ ঘন্টা রেস্ট নিয়ে আবার যেতাম। সবাই খুব ডেডিকেটেড ছিল। টিমে একজন Winch Operator, একজন টেকনিশিয়ান ও চার পাঁচ জন খালাসী থাকত। খালাসীরা রেগুলার এমপ্লয়ী।

Winch এর সাথে লম্বা লম্বা ভারী টুল জোড়া দেওয়া, টুল বওয়া etc কাজ করত খালাসীরা। এছাড়াও টিমে থাকত দুজন কনটিনজেন্ট শ্রমিক। ওরা খুব কম পারিশ্রমিকে কাজ করত। ওনজিসি তে প্রথম দিকে যে সমস্ত কনটিনজেন্ট শ্রমিক রা কাজ করত, তাদের সবাইকে ১২-১৫ বছর কাজ করার পর রেগুলার করে নেওয়া হয়েছিল, এতে ওনারা মেডিক্যাল , ওভার টা্ইম ইত্যাদি সুবিধার অধিকারী হয়েছিলেন। সবাই ১০-১২ বছর বয়স কমিয়ে জয়েন করেছিলেন। ৯.৩০ থেকে ৫.৩০ কাজের সময়।

এর বাইরে কাজ করলে OT র মিটার চালু হত। আমাদের সময়ে OT র rate ছিল ১০০-১৫০ টাকা / ঘন্টা। ২০০৬-০৭ সালে এই রেট হয় ১০০০/- per hr. গুজরাটের শ্রমিকরা সবচেয়ে ভাল। ব্যবহার ভাল। সম্মান দিয় কথা বলে। জব এলে সবাই ফিল্ডে যাওয়ার জন্য রেডি। ওদের মাসিক ইনকাম OT নিয়ে অফিসার দের সমান সমান ছিল। প্রায় প্রত্যেকের দু তিনটে বাড়ি, গাড়ি ছিল।

আসামের শ্রমিকরা ফিল্ড তো দূর অফিসেই আসতে চায়না। গাড়ী পাঠিয়ে অফিসে আনতে হত। মাসের শেষ দিকে ধার চাইবে। না দিলে শয়তানি শুরু করবে। আসামে জোড়হাটে পোস্টেড ছিলাম। অসাধারণ ওয়েদার, অটোমেটিক এয়ার কন্ডিশনিং। একটু গরম পড়লেই বৃস্টি শুরু হত। বাতাসে ধূলো থাকত না। বৃষ্টিতে ধুয়ে যেত। ব্যাঙ্গালোরের ওয়েদারও খুব ভাল। similar..তবে নেহাত ঠেকায় না পড়লে আসাম আর বিহারে চাকরি না করতে যাওয়াই মঙ্গল। এটা ব্যক্তিগত মতামত। লাল্লুর আমলে বিহারের ওপর দিয়ে ট্রেনে করে যাওয়াও রিস্কি ছিল। ট্রেন ডাকাতি প্রায়ই হত।

কিডন্যাপিং তো বিহারের সেই সময় কুটির শিল্প হয়ে উঠেছিল। সিওয়ানের সম্রাট সাহাবুদ্দিন কে মনে আছে তো? সাক্ষাত যমদূত। লাল্লুর ডানহাত। খাদিম কর্তার কাহিনী মনে থাকবে সবার। লালুর দুই শালা ( সাধু . আর একটার নাম ভুলে গেছি)
সুন্দরী মেয়েদের যম ছিল। লালুর মেয়ের বিয়েতে সমস্ত গাড়ির ডিলার দের শো-রুম থেকে গাড়ি তুলে নেওয়া হয়েছিল অতিথি দের এয়ার পো্র্ট, স্টেশন থেকে নিয়ে আসা যাওয়ার জন্য। ফ্রী তে। জঙ্গল রাজ।

কলকাতার শ্রমিকদের কথা না বলাই মঙ্গল। তখন ক্ষমতায় বঙ্গেশ্বর।যখন তখন বাংলা বন্ধ হত। খুব জঙ্গী ছিল শ্রমিকরা। তারাতলা অফিস প্রঙ্গনে CITU র নেতারা এসে গরম গরম লেকচার দিতেন। যার কোনো মানেই হয় না। অশিক্ষিত অনেক দেখেছি। এদের মত কাউকে দেখিনি।

অফিসাররা OT পান না। তবে ছুটির দিন ফিল্ডে গেলে কমপেনসেটারি ‌অফ পেতাম। HPL, CL র সাথে C off জোড়া হত। এক সাথে ম্যাক্সিমাম ৫-৭ টা নেওয়া যেত। তারফলে CL, HPL দিয়ে বছরে দু তিন বার কলকাতা আসতে পারতাম। ট্রেনেই যাতায়াত হত। প্রথম প্রথম সেকেন্ড ক্লাসে। তখন একটাই ট্রেন হাওড়া আমেদাবাদ এক্সপ্রেস। ৪৪-৪৮ ঘন্টা নিত। প্যান্ট্রি কার ছিল না।

দেখতাম প্রচুর বাঙালি ছেলে এই ট্রেনে যাতায়াত করত। এরা মেদিনীপুরের বাসিন্দা। স্বর্ণশিল্পী। খুব অল্প পারিশ্রমিকে এরা সারা গুজরাটে সোনার দোকানে কাজ করত। এদের হাতের কাজ খুব ভাল। সোনার কাজ তো খুব সূক্ষ্ম হয়, কিন্তু সেই অনুপাতে পারিশ্রমিক পেত না। বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের দেখা পেয়েছিলাম সেই ১৯৮৫ সালে। পরে আরো দুটো ট্রেন চালু হয়। একটাতে প্যান্ট্রি কার ছিল, সময়ও কম লাগত। সপ্তাহে তিনদিন চলত।

আমেদাবাদে সরস্বতী পূজোর পরের দিন ভারত সেবাশ্রম সংঘ ওনাদের আশ্রমে ( আশ্রম রোডে, সাবরমতী আশ্রমের নামে আশ্রম রোড) পংক্তি ভোজন করাতেন। খিচুরি তরকারি চাটনি মিস্টি। এক এক ব্যাচে ৪০০-৫০০ লোক বসতেন। ONGC র বাঙালিরা প্রায় সবাই যেতাম। শহরের বিভিন্ন এলাকার বাঙালিরা আসতেন। আর আসতেন স্বর্ণশিল্পীরা, বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। কথা শুনলেই মিদনাপুরের টান বোঝা যায়। জ্যোতি বুদ্ধ অবশ্য বলত এখানে সবাই কাজ পায়। কেউ পরিযায়ী নয়।

১৯৮৫এ আহমেদাবাদের সবজি মার্কেটে গিয়ে একটু হতাশ ও অবাক হয়েছিলাম। কলকাতার মত হরেক রকম সবজি নেই। পটল নেই। তার বদলে ছিল গিলোরী। পটলের ছোট ভাই। ওখানে গিলোরীর তরকারি জনপ্রিয় পদ। আমরাও পরে অভ্যস্থ হয়েছিলাম। মেথিশাক খাওয়া ওখানে শিখেছিলাম। খুব পুষ্টিকর। উচ্ছের বদলে করলা খুব চলত। কলকাতার বাজারে আলু ১টাকা ৬০ পয়সা বা ১ টাকা ৮০ পয়সা কে জি ছিল। ( ভুল হতে পারে) এখানে ফ্রাকসনের বালাই নেই। ২৫০ গ্রাম আলু দু টাকা। বাকি সবজির দর ওইরকম ছিল।

গুজরাটিরা অঙ্কে কাঁচা বলে দর দামে ফ্রাকসন রাখত না। কলকাতার তুলনায় সবজির দাম দ্বিগুন বা তিনগুন ছিল। আমাদের গায়ে লাগত না। ONGC প্রথম থেকেই ফ্যাট স্যালারি দিত। তবে মাছ খুব সস্তা ছিল। তখন গুজরাটিরা মাছ, মাংস , ডিম সেরকম খেত না। মাছ বা ডিমের দোকান সবজি মার্কেট থেকে অনেকটা দূরে বসত। মাংসের দোকান অনেক দূরে ছিল। পাবদা মাছ ১০-১৫ টাকা কেজি। রুই কাতলা ২০ টাকা কেজি।

আমরা থাকতাম ওনজিসি ‌অফিস এলাকায় চাঁদখেড়ায়। ওটি সাবরমতী এরিয়ায় পড়ে। মেন মাছ মার্কেট তিন দরওয়াজায়। অনেকটা দূর। স্কুটার বা অফিসের গাড়ি নিয়ে যেতাম। জয়েন করার সাথে সাথে গ্যাস কানেকশন আর নতুন স্কুটার অফিস থেকে দিয়েছিল। নতুন স্কুটারে চালানো শিখেছিলাম। 

 

(লেখক পরিচিতি – অবসরপ্রাপ্ত পেট্রফিসসিস্ট: ব্যাঙ্গালোরের প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ে পেট্রোলিয়াম বিভাগের প্রাক্তন ফ্যাকাল্টি)

(ক্রমশঃ)