আঙিনা

দেশ – ১৭

– ডঃ গৌতম মুখোপাধ্যায়

ছোটবেলায় আমরা পার্কসাকাস সি আই টি রোড়ের কাছে সি আই টি বিল্ডিংস এ থাকতাম। তিনটে বাস স্টপেজ দূরে ছিল চিত্তরঞ্জন বা ন্যাশনাল মেডিক্যাল হসপিটাল। আমি ১৯৬০ সালের আশপাশের কথা বলছি। তখন আমাদের ছোট খাটো শরীর খারাপ বা জ্বর জ্বারি হলে আমরা যেতাম চিত্তরঞ্জন হাসপাতালে। একটা খুব অল্প পয়সায় কার্ড করিয়ে সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্টে গিয়ে অপেক্ষা করতে হত। কিছুক্ষন পর ডাক আসত।

ডাক্তারবাবু দেখে ওষুধ লিখে দিতেন। হাসপাতাল থেকেই ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হত। ওষুধের মধ্যে একটা থাকত, শিশিতে তরল ওষুধ , শিশির পেছনে খাঁজকাটা কাগজের সরু স্টিকার লাগানো থাকতো। ওতেই রোগ সেরে যেত। একদিন রাতের বেলায় খাওয়ার সময় গলায় রুই মাছের কাঁটা বিধেছিল। অনেক শুকনো ভাতের দলা গলাধকরণ করেও কাঁটা বের হল না। তখন বাবার সাথে হাঁটতে হাঁটতে হাসপাতাল গেলাম।

কয়েকজন জুনিয়র ডাক্তারবাবু ছিলেন, বললেন কার্ড করাতে হবে না, রোজ এরকম কয়েকটা কেস আসে। কয়েক মিনিটের মধ্যে কাঁটা বার হল। ওনারা বললেন এর গলায় একটা আঁচিল , পরে নিয়ে আসবেন অপারেশন করে দেব। করে দিয়েছিলেন। ফুটবল খেলতে গিয়ে দাদার পা ভাঙ্গল, চিত্তরঞ্জন হাসপাতাল। সাথে সাথে প্লাস্টার। ১-২ মাস পর ঠিক হয়ে গেল। 

সেই ছোটবেলার বন্ধু , আমাদের বিল্ডিং এ থাকত। ওর টনসিলাইটিস অপারেশন ওই চিত্তরঞ্জনেই হল। কয়েকদিন থাকতে হয়েছিল। গেছিলাম দেখতে। মনে আছে ছিমছাম পরিস্কার পরিবেশ। নোটন এখানেও আছে। আরো ‌অনেক উদাহরণ আছে আছে রাশি রাশি।

এটাই বোঝাতে চাইছি পুরো ৬০ এর দশকে বা তার কিছু পরেও সরকারি হাসপাতাল বলে একটি ব্যবস্থা ছিল। সেখানে মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত রা নাম মাত্র খরচে চিকিত্সা ও ওষুধ পেত। পরিবেশ পরিস্কার পরিছন্ন ছিল। এল ১৯৭১। ১-২ কোটি লোক অত্যাচারিত হয়ে এপারে পালিয়ে এলেন নিঃস্ব অবস্থায়।

মাইমুনা বেগম লক্ষাধিক পাক সৈন্য কে বিনাশর্তে জামাই আদরে মুক্তি দিলেন। ওদের খোজা বানানো যেত। এর বিনিময়ে POK পুনরাধিকার করা যেত। পালিয়ে আসা হিন্দুদের ভরণপোষণ এর জন্য মোটা টাকা আদায় করা যেত। কিছুই করা হয়নি। ন্যাচারাল ডেমোগ্রাফিক গ্রোথ হঠাৎ বহুগুণ বৃদ্ধি পেল। সমস্ত পরিকাঠামোর ওপর চাপ পড়ল। ওদিকে কলিমুদ্দিন শামস বাংলাদেশ থেকে লোক জন নিয়ে এসে ভোট ব্যাংক বা মিনি পাকিস্তান বানাচ্ছে। ততদিনে ভদ্রলোক অজয় মুখার্জি কে সামনে রেখে গদীর কাছাকাছি পৌঁছলেন।

১৯৬৭ তে অজয় মুখার্জির বাংলা কংগ্রেসের ফ্রন্ট আর বাম দলের ফ্রন্ট যৌথভাবে সরকার গড়ল। সরকার পড়ে গেল। ১৯৬৯ এ আবার গড়ল টিকল না। ১৯৭২ এ সিদ্ধর্থ শঙ্কর রায় ব্যাপক রিগিং করে কংগ্রেস সরকার গঠন করে। সেই প্রথম বাঙালি রিগিং দেখল। নতুন কং নেতা প্রিয় রঞ্জন দাশমুন্সি , সুব্রত মুখোপাধ্যায় আরো অনেক উঠে আসেন।

নক্সাল আন্দোলন জোর কদমে চলছে। বড় বড় ডাক্তাররা ফীস জমিতে নামিয়ে আনলেন। স্কুল-কলেজ প্রায়ই বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। কলেজ স্কোয়ারে বিদ্যাসাগরের মুর্তি ভাঙ্গা হল। নক্সাল আন্দোলন হয়েছিল স্বাধীন ভারতে। আর মাস্টারদা ইত্যাদির সহিংস স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়েছিল পরাধীন ভারতে। দুই আন্দোলোনের মধ্যে কিছু মিল পাই। চারু মজুমদার, সুশীতল বাবু , ওদিকে মাস্টারদা প্রভৃতি কখনো ভারত ভ্রমণ করেছেন বলে আমার মনে হয় না। সূর্য সেন চোখে ঠুলি পরে বসে লোকাল হিরো হতে চেয়েছিলেন। বিশাল জনসংখ্যা ( মেজরিটি) যে মুসলিম, তারা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ গ্রহন করছেন না rather খোচরবৃত্তি করে সেটা খেয়াল করেননি। দেশ স্বাধীন হলে তাদের রোল কি হতে পারে ৮০০ বছরের ইতিহাস পড়েও কিছু বোঝেননি।

ওরা ওদের ধর্ম অনুযায়ী হত্য রেপ সহ ২-৩ কোটি হিন্দু বাঙালি কে নিজের দেশ ছাড়া করেছে। দেখুন ইসলাম তো এসেছে ১৪০০ বছর আগে। কিন্তু যেখানে যেখানে এরা proliferate করেছে, সেখানে সেখানে অন্য ধর্মাবলম্বীদের অস্তিত্ব আর নেই। এটাই বুঝতে হবে।

সিদ্ধার্থ রায় কড়া হাতে নক্সাল দমন করেন। নক্সাল নেতাদের ক্ষমতা লোভ, চোর পুলিশ খেলার নেশা , অদূরদর্শিতা ও সর্বোপরি অপদার্থতা অনেক ভালো ও সাধারণ ছেলের জীবন, কেরিয়ার শেষ করে দিয়েছিল। সরোজ দত্তর হত্যা, অর্চনা গুহ, লতিকা গুহ ও গৌরী চ্যাটার্জি র ওপর রুনু গুহ নিয়োগীর অকথ্য অত্যাচারের কথা মহাশ্বেতা দেবীর কলম থেকে ‘হাজার চুরাশীর মা’ হয়ে ঝরে পড়েছিল। ওনার এই লেখাটি কলকাতার কোন বড় বা নামকরা পত্রিকা ছাপতে রাজী হয়নি।

ওটি প্রকাশিত হয়েছিল উল্টোরথ নামে একটি সিনেমা পত্রিকার পূজো সংখ্যায়। আমি কলেজে পড়তাম। তখন পড়ি। সেসময় উল্টোরথ , সিনেমা জগত চালু ছিল। বইটি বেশ কয়েকবার নোবেল কমিটি তে শর্ট লিস্টেড হয়েছিল। নিরীহ সজ্জন নেতা হেমন্ত বসুর হত্যা। এই সব ঘটনা গুলো ওই অশান্ত টালমাটাল সময়ের কোলাজ হয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছে।

সিদ্ধার্থ রায় পরে ইন্দিরা গান্ধীর চীফ এ্যাডভাসার। ওনার পরামর্শে ১৯৭৫ এ কালা এমার্জেন্সী চালু হয়। পাঞ্জাবে খালিস্থানি দমনে ওনাকে গভর্নর করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেসময় একটা গুজব চালু ছিল, সন্ধ্যেবেলায় নাকি আকাশে চারজন লোক কে একটা মরদেহ বহন করতে দেখা যেত। আসল ঘটনা হল চারু মজুমদার খুব অসুস্থ ছিলেন। অথচ ওনাকে ঘন ঘন ডেরা পাল্টাতে হত, তাই ওনার পার্টির লোকেরা ওনাকে মৃতদেহ সাজিয়ে, সাদা চাদরে ঢেকে শহরের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিয়ে যেত।

চাদরের নীচে অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকত। সেসময় প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়তাম। ফিজিক্স। খুব কাছ থেকে নক্সাল আন্দোলন দেখেছিলাম। এখনকার বার কাউন্সিলের সভাপতি ও কংগ্রেস নেতা অরুনাভ ঘোষ ফিজিওলজি নিয়ে পড়ত প্রেসিডেন্সীতে।
তথাগত ও সৌগত রায়ের ছোটভাই সোমক রায় আমাদের সাথে পড়ত, ছাত্র পরিষদ করত। অরুনাভ আর আমি কলেজ ক্রিকেট টিমে খেলতাম।

১৯৭৭ এ ইলেকশন এ সারা ভারতে কংগ্রেসের ভরাডুবি হয়। কংগ্রেস সিম্বল গাই ও গরু , ইন্দিরা গান্ধী ও পুত্র সঞ্জয় গান্ধী পরাজিত হন। ইন্দিরা কে রায়বেরিলিতে হারান মাথায় সবুজ ফেট্টি বাঁধা রাজনারায়ণ। ন্যাশানাল হিরো বনে গেলেন। নিজেকে হনু ভাবতে শুরু করলেন। দিল্লিতে মিলি জুলি সরকার তৈরী হল। মোরারজী দেশাই প্রধানমন্ত্রী হলেন। দেশে এমারজেন্সী চলছিল বলে কোনো পেপার বা পত্রিকা ফল বেরোবার আগে কেউ লিখতে সাহস করেনি। কিন্তু বাইরের পত্রিকা ‘The Economist’ and Time magazine result বেরোবার আগে ফল প্রেডিক্ট করেছিল। মোরারজি দেশাই ১৯৭৮ এ ১০০০, ৫০০০ ও ১০০০০ টাকার নোট বাতিল করেছিলেন। স্বাধীন ভারতে প্রথম নোটবন্দী। সাধারন লোকের হাতে অত বড় বড় নোট থাকত না বলে তাদের ওপর প্রভাব পড়েনি।

সেমূর হার্স সেই সময়কার একজন বিশ্ববিখ্যাত সাংবদিক, উনি একটা বইতে লিখলেন মোরারজি দেশাই CIA r pay list e আছেন। সবাই বললেন কেস করো। কেস করা হয়নি। সেমূর ১৯৬৯ এ ভিয়েটনামে মাই লাই গ্রামে বীভৎস হত্যাকাণ্ড ( আমেরিকান সৈন্য দের দ্বারা) ( নাপাম বোমা) তুলে ধরেছিলেন। এর জন্য পুলিৎজার প্রাইজ পান।

পরে কোথাও পড়েছিলাম যে পাকিস্তানে ভারতের যে সব স্পাই ছিলেন তাদের নাম গান্ধীবাদী মোরারজী পাকিস্তানের প্রসিডেন্ট কে বলে দিয়েছিলেন। প্রত্যেক কে হত্যা করা হয়। এই মিলি জুলি সরকারের মধ্যে কোন তাল মিল ছিল না। রাজনারায়ণ ছিলেন foul mouth পাগল গোছের। ইন্দিরা গান্ধী চৌধূরী চরণ সিং কে ভাঙ্গিয়ে নিয়ে সরকার ফেলে দিলেন। চৌধুরী চরণ সিং PM হলেন।

সেইসময় একটা ঘটনা ঘটেছিল। রিজার্ভেশন আইন এক্সপায়ার করে যাচ্ছিল। চরণ সিং রিনিউ করবেন না জানালেন। ইন্দিরা অনাস্থা প্রস্তাব আনলেন। যদি সিপিএম সেই প্রস্তাবে চরণ সিং কে সাপোর্ট করত, তবে সরকার পড়ত না। এক্সপায়ারী ডেট এসে যেত ভারত একটি অভিশাপ থেকে মুক্ত হত। বাবা মা IAS. , বছরে আয় কোটির কাছাকাছি, তাদের ছেলে মেয়েরা কোটার সুবিধা শিক্ষা, চাকরিতে পাচ্ছে।

কি হাস্যকর কিন্তু বাস্তব। তারপর তো যাদব ইত্যাদি পয়সাওলারাও OBC quota বানিয়ে নিল। 

এদিকে পশ্চিম বঙ্গে ১৯৭৭ এ বামফ্রন্ট সরকার গড়ল। জ্যোতি বাবু বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হলেন। ইতিমধ্যে সিপিএম ক্যাডার ভিত্তিক সংগঠন বাড়িয়ে নিয়েছে। তার চূড়ান্ত অশ্লীল প্রদর্শন ১৯৭০ সালে বর্ধমানের সাঁই বাড়ির নির্মম হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ঘটেছে। ১৯৭১ এ সাঁই বাড়ির বড় ছেলেকে হত্যা করা হল। যেসব কমিউনিস্ট-ক্যাডার-রা এই হত্যাকাণ্ডের সাথে সরাসরি জড়িত ছিলো, তাদের অনেকেই বামফ্রন্ট সরকারের আমলে মন্ত্রী হয়েছেন কিংবা পার্টির উঁচু পদে আসীন হয়েছিলেন। জড়িতদের কাউকেই আইনের আওয়াতায় আনা হয় নি। কমিউনিস্ট রাজনীতিবিদ বিনয়কৃষ্ণ কোনার, অনীল বসু, পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী নিরুপম সেন অমল হালদার এই হত্যাকাণ্ডের সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন বলেই জনশ্রুতি।

আপাত অবাক কান্ড ১৯৭২ এ সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় মুখ্যমন্ত্রী হয়ে ৫ বছর শাসন করলেন, কিন্তু সাঁই বাড়ি হত্যা কান্ডের সাথে জড়িত কাউকে শাস্তি দিলেন না। একটা কারণ মনে হয় তখন সিদ্ধার্থ বাবু নক্সাল নিধন যজ্ঞে পৌরহিত্য করছিলেন এবং তাতে সিপিএম সাহায্য করছিল।

(Pic courtesy: Old Indian Photos) 

(ক্রমশঃ)

 

(লেখক পরিচিতি – অবসরপ্রাপ্ত পেট্রফিসসিস্ট: ব্যাঙ্গালোরের প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ে পেট্রোলিয়াম বিভাগের প্রাক্তন ফ্যাকাল্টি)