আঙিনা

দেশ – ১৮

– ডঃ গৌতম মুখোপাধ্যায়

১৯৭৭ এর নির্বাচনে বামফ্রন্ট জিতল। জ্যোতিবাবু গদীতে আসীন হলেন। সরকারে এসে বামফ্রন্ট কয়েকটি ভাল কাজ করলেন। 

১) ইস্কুল টিচারদের মাইনে বাড়িয়ে যথেষ্ট ভদ্রস্থ করা হল। তার আগে নিম্নবিত্ত পরিবারের বাপও মেয়ের বিয়ে স্কুল টিচারের সাথে দিতে চাইতেন না। সেই মানসিকতার পরিবর্তন হল। পরিবর্তে সিপিএম পেল এক দুর্দান্ত ভোট পরিচালনার মেসিনারি। অসাধারণ অনুগত এক বাহিনী। যাদের পিঠ চড়ে দীর্ঘ ৩৪ বছর রাজত্ব করল চরম অপদার্থতা সত্তেও। তখন তো ব্যালট পেপারে ভোট হত। কোনো পার্টি ১০ টা ভোট পেলে একটা বান্ডিল বানানো হত। পরে গোনার সুবিধার জন্য। বামফ্রন্টের প্রার্থী ৬ টা ভোট পেলেই একটা বান্ডিল করা হত। আর কংগ্রেসের ১৫-১৬ টা ব্যালট দিয়ে একটা বান্ডিল হত। Swing কথাটা তো শুনেছেন। ২-৩% স্যুইং হলে জয় পরাজয় নির্নয় হয়। ব্যালট কারচুপিতে কত % manipulated Swing হয়. Scientific Riggingerআরো অনেক মেথড আছে। মনে থাকলে লিখব।

২) বাংলায় ভূমি শ্রমিকরা পেত সকালে জমিতে কাজ করলে ৬-৮ টাকা, আর খাওয়া দাওয়ার পর বিকেলে কাজ করার জন্য পেত ৩-৪ টাকা। বামফ্রন্ট ফিক্স করলো সকালে কাজের জন্য ১৬ টাকা আর বৈকালা ৮ টাকা। জমি শ্রমিকরা দুহাত তুলে সিপিএম কে আশীর্বাদ করল।

৩) জমি বন্টন। বিহারে গান্ধী শিষ্য বিনোবা ভাবে ভূদান আন্দোলন করেছিলেন। বাংলায় সিপিএম জমির সিলিং বেঁধে দিল, তার বেশী জমি থাকলে সেটা কেড়ে নিয়ে ভূমিহীনদের মধ্যে বন্টন করতে থাকল। গ্রামে ক্যাডার বেস তৈরী হল। এখন একটা গুন্জন শোনা যায় হিন্দু জোতদার দের জমি কেড়ে মুসলিম শ্রমিকদের দেওয়া হয়েছিল। এটার পূর্ণ রিপোর্ট জনগনের জানা দরকার। যে মুসলিম দের লাথি খেয়ে মেয়ে বৌ এর ইজ্জত খুইয়ে এপারে এলি, তাদেরই পা চাটলি ভোট ব্যাঙ্কের জন্য? তোরা তো ক্ষমতার জন্য মা বোন দেশ পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে পারিস। ১৯৬২ তে চীন কে নির্লজ্জ সাপোর্ট করা এর সাক্ষ্য দেয়। সাধারন মানুষ ও শিক্ষিত বাঙালি এই সরকার কে আন্তরিক সমর্থন জানিয়েছিল। সায়েন্স কলেজে লেকচারার রিডার রা সবাই সিপিএম র সমর্থক ছিলেন। সিনিয়ররা মানে প্রফেসররা ছিলেন কংগ্রেসের সমর্থক।

রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে বিনায়ক দত্ত রায় ছিলেন খুব নামকরা ফিজিক্সের প্রফেসর। ওইসময় সায়েন্স কলেজে অশিক্ষক কর্মচারী ইউনিয়ন মাইনে বাড়াবার জন্য আন্দোলন করছিলেন। সায়েন্স কলেজ কিসের ট্রেড করত জানা নেই, তবে ট্রেড ইউনিয়ন ছিল। বিনায়ক বাবু কলেজের গেটে লেকচার দিতে উঠলেন। একথা সেকথার পর বললেন যারা যারা এই আন্দোলনে যোগ দেননি, তাদের আমরা পরে দেখে নেব। আমরা স্তম্ভিত হয়ে ওনার জ্বালাময়ী বক্তিমে শুনলাম।

এটা একটা উদাহরণ। এরকম আবহাওয়া সেসময় চলছিল। সেসময় এ্যাকাডেমী তে তৃপ্তি মিত্রের গন্ডার নাটক চলছিল। দেশের অবস্থা ভাল বোঝানো হয়েছে, যদিও নাটকটা বিদেশী, কিন্তু কালজয়ী নাটক তাকেই বলে যা স্থান কাল পাত্রের সীমানা ছাড়িয়ে যায়। নাটকটি আয়োনেস্কোর দ্য রাইনোসরাস এর বাংলা adoption.নোটনের সাথে এ্যাকাডেমিতে দেখেছিলাম।

১৯৭৭ এ জ্যোতি বাবু ক্ষমতায় এসে ভোট ব্যাঙ্ক, ভোট মেশিনারি তৈরী তে বিশেষ মনোযোগী হলেন। যোগ্য সাথী বা উপদেষ্টা
হিসেবে পেয়েছিলেন প্রমোদ দাশগুপ্ত বা
পো মদ দাশগুপ্ত কে। মদ ছাড়া সন্ধ্যেবেলায় চলত না। পোমোদ বেলুড় মঠ দেখে বলেছিল এটাকে একটা কফি হাউস বানিয়ে ছাড়ব। জামা মসজিদ বা নিতান্ত কলকাতার নাখোদা মসজিদ কে চায়ের দোকান বানাবার কথা এই অশিক্ষিতটা বা ওর কোনো বাবা বলতে সাহস করতো? বাংলাদেশ থেকে লাথ খেয়ে এখানে এসেছিল, এখান থেকে আবার লাথ খেতো। তবে উনি ওনার এক যোগ্য উত্তরসূরি রেখে গেছিলেন অনিল বিশ্বাস। যাই হোক মাঠে ঘাটে গরম গরম বক্তৃতা দেওয়া এক জিনিস, আর রাজ্য চালানো অন্য কথা।

যেমন ১৯৬৭ সালে বনগাঁ র এক প্রত্যন্ত গ্রামে কান্তি বিশ্বাসকে দেখেছিলাম একটা গাছ লায় বসে থাকতে। উনি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন অপূর্বলাল মজুমদারের বিরুদ্ধে। হেরে গেছিলেন। পরে কালক্রমে বিজন সেতু হত্যাকাণ্ডের হোতা ছিলেন। চেহারা দেখে বুঝেছিলাম পেটে বোমা মারলেও ইংলিশ বেরোবে না। পরে প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রী হয়েছিল। ১৯৭৭ এবং পরেও বাম মন্ত্রীরা বাজেটিং কাকে বলে বুঝত না। Budget estimate , Revised Estimate etcবুঝত না। সেন্টার থেকে বিভিন্ন দফতরে টাকা স্যাংসন হয়ে আসতে আসতে আগে সেপ্টেম্বর -নভেম্বর হয়ে যেত। ফাইনান্সিয়াল বছর শুরু হত এপ্রিল থেকে পরের মার্চ অবধি। বাজেট এর জ্ঞান না থাকায় এরা হাত গুটিয়ে বসে থাকত। মাঠে ময়দানে জনসভা করত।

যখন বিভিন্ন খাতে কোটি কোটি টাকা আসত, তখন টেন্ডারিং করে কাজ উঠিয়ে ( ধরা যাক রাস্তাঘাট, সেচ বিদ্যালয় নির্মান ইত্যাদি) পেমেন্ট করা হয়ে উঠত না। মার্চের শেষে স্যাংসনড টাকার ৭০% – ৯০% ফেরত চলে যেত এদের অপদার্থতার জন্য। নিয়ম অনুযায়ী পরের বছর স্যাংসন অনেক কমে যেত। ধরা হত এই রাজ্যের টাকার দরকার নেই। দলের নেতারা কেন্দ্রের বঞ্চনা কেন্দ্রের বঞ্চনা করে বুক চাপড়াতো, অশিক্ষিত ক্যাডারে দল ভারী হত।

এটা চলত বছরের পর বছর। গুজরাট মহারাস্ট্রে সারা রাজ্যে রাস্তা ঘাট ছিল দেখার মত, সেখানে আমাদের রাজ্যে কাঁচা রাস্তার আধিক্য দেখা যেত। পাকা রাস্তা গুলো থাকত খানা খন্দে ভরা। এমনকি ৯৫-৯৬ তে কলকাতা থেকে ত্রিবেণী যাচ্ছিলাম গাড়ী ভাড়া করে। দিল্লী রোড ধরে। কলকাতা ছাড়ানোর পর বিশাল জ্যাম। শম্বুক গতিতে গাড়ী চলছিল। রাস্তা এত খারাপ যে উল্টো দিক দিয়ে যে বিশাল বিশাল ট্রাক আসছিল সেগুলো মোচার খোলার মত দুলছিল। যেন সমুদ্রে নৌকা। যেকোনো সময় আমাদের গাড়ীর ওপর এসে পড়বে ব্যালান্স হারিয়ে। ড্রাইভার কে বললাম গাড়ী ঘুড়িয়ে কলকাতা ফিরে চল। ফিরে এলাম।

ওই সময়কার লোকজনের মনে থাকতে পারে টাকা ফেরত যাওয়ার খবর। এনাদের সৎ ইমেজ রাখারও একটা প্রচ্ছন্ন ইচ্ছা কাজ করত। এখন আবার উল্টো হচ্ছে টাকা এলেই কাগজে কলমে পুকুর কাটা, রাস্তা তৈরী সব হচ্ছে। কাজ কিছু হচ্ছে না।
টাকাটা দেবালয়ের প্রনামী দিয়ে ভাগ করে খাওয়া হচ্ছে। দলের সহসম্পাদক ভেনোয়া দ্বীপে পালিয়েছে। বাড়ির বৌ ব্যাঙ্কক লন্ডনে টাকা রাখছেন দুয়ারে ইডি, সিবিআই। রাজ্যটাকে আর্জেন্টিনা বানানো হচ্ছে।

১৯৮২ তে পো মদ চীন ভ্রমনে গেলেন। অনেকে বলেন চীনের সাথে নতুন রেট বানাতে গেলেন। সেই ১৯৬২ বা তারও আগে থেকে চীনের নীতি, ভারত আক্রমণ সব নির্লজ্জ বেহায়া দু কান কাটার মত সাপোর্ট করেছেন। তাই রেট বাড়াতে গেলেন। এবং সেখানেই অক্কা পেলেন। সাথে গেছিলেন বুদ্ধু ভটচায। তিন দিন বডি ফেলে রেখে তারপর বডি ভারতে এল। চায়নার সাথে দরাদরি ভালো নয়। জ্যোতি বাবু ৪০-৫০ বার সরকারী খরচে ইউরোপ, আমেরিকা গেছেন কিন্তু একবারও পিতৃভূমি বা তীর্থস্থান
চীনে যাননি।

অপরাধমূলক ঘটনার আলোচনায় আজও উঠে আসে ডিসি পোর্ট বিনোদ মেহতা-র খুনের প্রসঙ্গ। সেটা ছিল ১৯৮৩ সালের ১৮ মার্চ। দোল পূর্ণিমার সকাল। হঠাৎ খবর এল গার্ডেনরিচ, খিদিরপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে দাঙ্গা লেগেছে৷ খবর পৌঁছল ডিসি পোর্ট দফতরেও।

মেহেতা সাব লোকাল থানায় খবর দিয়ে চললেন অকুস্থলে। এর আগে ওই অঞ্চলে কয়েকবার রেড করে খুব অপ্রিয় হয়েছিলেন। তিনি একা দেহ রক্ষী কে নিয়ে ওই গার্ডেনরিচ এলাকায় পৌঁছে উপলব্ধি করলেন তিনি ট্র্যাপড হয়েছেন। যে পুলিশ অফিসারদের বাহিনী নিয়ে আসার কথা কেউ আসেনি। তখন তিনি একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন। কুকুরের দল তাঁকে ওই বাড়ী থেকে বের করে নির্মম ভাবে হত্যা করে। দেহরক্ষী কেও।

‌ডি সি পোর্ট বিনোদ মেহতার হত্যাকান্ডের কিছুদিন পরের ঘটনা। বিধানসভার অধ্যক্ষ কলিমুদ্দিন শামস সাহেবের হঠাৎ মোগলসরাই যাওয়ার দরকার হয়ে পড়ল। এ সি কোচে শামস সাহেব যথারীতি হাওড়া থেকে মোগলসরাই চলে গেলেন। এই পর্যন্ত সব কিছুই স্বাভাবিক। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার শামস সাহেবের ড্রাইভার তাঁর সরকারী গাড়ী নিয়ে জি টি রোড ধরে গাড়ি ছুটিয়ে পৌঁছে গেল মোগলসরাই স্টেশনে, সাহেবকে রিসিভ করতে। আশ্চর্যের ব্যাপার, যেখানে উত্তরপ্রদেশ সরকারকে একটা ফোন করলেই মোগলসরাই স্টেশনে ইউপি গভর্নমেন্টের আধিকারিকরা সরকারী গাড়ি নিয়ে সৌজন্য দেখাতে সাহেবকে রিসিভ করতে হাজির হয়ে যেত, সেখানে সাহেবের এইরকম কাজ করার দরকার কি পড়েছিল? বিরোধী দল দাবি করেছিল এভাবে বিনোদ মেহতার হত্যাকারীকে মোগলসরাই পাচার করা হয়। বঙ্গেশ্বর জ্যোতি বসু অবশ্য শামস সাহেবের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। তারপর বেরিয়ে এসে স্থিতপ্রজ্ঞ ঋষি বলেছিলেন,” আমি সবকিছু খতিয়ে দেখেছি।সব ঠিক আছে । অস্বাভাবিক কিছুই হয়নি।” (তথ্যসূত্র: এমনটা তো হয়েই থাকে। নারায়ণ সান্যাল।)

এক জন কে গ্রেফতার করা হয়েছিল। রাতে থানায় পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল। সাক্ষ্য প্রমাণ লোপ করতে। পুলিশের উচিত ছিল পরে বড় ‌অভিযান চালিয়ে জড়িত দের গ্রেপ্তার করা , অবৈধ বাড়ী গুলো জ্বালিয়ে দেওয়া বা বুলডোজার চালানো। কিন্তু করবে কে? ওই সম্প্রদায়কে তো জ্যোতির দল পিতা জ্ঞানে মাথায় চড়িয়ে রেখেছিল।

(ক্রমশঃ)

(লেখক পরিচিতি – অবসরপ্রাপ্ত পেট্রফিসসিস্ট: ব্যাঙ্গালোরের প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ে পেট্রোলিয়াম বিভাগের প্রাক্তন ফ্যাকাল্টি)

Comment here