অতীত যা লেখেনিরাজনীতিস্বভূমি ও সমকাল

ইনকিলাবি জিহাদী: বাম ও ইসলামিক শক্তির আঁতাতের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস – ১

– শ্রী অনির্বাণ দে

 

২০২১ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি। কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে বাম ও কংগ্রেসের যৌথ রাজনৈতিক প্রচারসভা। মঞ্চে বক্তৃতারত প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। তারই মাঝখানে সময়ে সিপি(আই)এমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম হাত ধরে নিয়ে এলেন এক ব্যক্তিকে। এমন একজন, জনমানসে যাঁর পরিচয় তেমন জানা নেই। মাত্র মাসখানেক আগে অর্থাৎ ২১ জানুয়ারি তিনি ইন্ডিয়ান সেক‍্যুলার ফ্রন্ট নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের কথা ঘোষণা করেছেন, এই অবধি। বরং লোকে তাকে চেনেন বিশিষ্ট ইসলামিক ধর্মগুরু হিসেবে। তিনি ফুরফরা শরীফের আলেম পীরজ়াদা আব্বাস সিদ্দিকী। জনমানসে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হল। বামশিবির দৃশ্যতঃ সঞ্জীবিত। অপরদিকে যাঁরা মনে করেন কমিউনিস্টরা আসলে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’, ধর্ম তাঁদের কাছে ‘জনতার আফিম’, তাঁরা বেশ আশ্চর্য হলেন। রাজ্যের তথা দেশের প্রধান বামপন্থী দল, যার নেতৃত্বে একাধিক রাজ্যে দশকের পর দশক ক্ষমতায় থেকেছেন কমিউনিস্টরা, তাঁদের সঙ্গে এমন কট্টর ধর্মীয় নেতার বা তাঁর সংগঠনের একমঞ্চে আসা কিভাবে সম্ভব? যাঁরা আশ্চর্য হলেন, তাঁরা হয়ত জানতেন নাবাম ও ইসলামের এই রসায়ন আসলে কতখানি পুরোন। জানলে আদৌ অবাক হতেন না। এই বিষয়নিয়েই আমাদের এখনকার আলোচনা।

প্রসিদ্ধ মার্কিন ঐতিহাসিক উইল ডুরান্ট তাঁর ‘দ্য স্টোরি অফ সিভিলাইজেশন’ গ্রন্থের তৃতীয় খন্ডের রোম সাম্রাজ্যের পতন সংক্রান্ত বিষয়ের উপসংহারে মন্তব্য করেছিলেন, “A great civilization is not conquered from without until it has destroyed itself from within.” আর যে মৌলবাদ ভারতবর্ষকে বাইরে থেকে দীর্ঘ এক সহস্রাব্দ ধরে ক্রমাগত ক্ষতবিক্ষত করেছে, কিন্তু তাও তাকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়নি, ঊনবিংশ শতকের গোড়া থেকে তারই আরেকটি সমান্তরাল প্রক্রিয়া সুপরিকল্পিতভাবে শুরু হয় – দেশের সীমানার ভিতর থেকেই দেশের তথা রাষ্ট্রের ভিতকে ভঙ্গুর করে ফেলার। এক্ষেত্রে ইসলামিক মৌলবাদের এক ঘনিষ্ঠ দোসর ছিল বামপন্থী মৌলবাদ। বস্তুতঃ এই দুই মতাদর্শের মধ্যে শুধু যে আশ্চর্যরকম সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়, তাই নয়, ভারতের সহনশীলতা ও বহুত্বের আদর্শের বিরুদ্ধে ঘোষিত ও অঘোষিত জেহাদের কর্মকান্ডে এই দুই গোষ্ঠীর পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতাও শতাব্দীপ্রাচীন। উল্লেখ্য যে ভারতে যাবতীয় সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ মূলতঃ বিভক্ত বাম ও ইসলাম এই দুই গোষ্ঠীতে। এবং কয়েক বছর আগে পর্যন্তও দেশে ইসলামিক এমন হামলায় যত মানুষ নিহত হতেন, প্রায় সমসংখ্যক মানুষ প্রাণ হারাতেন বাম চরমপন্থীদের হাতেও। কিন্তু এই দুটি ভাবধারার মধ্যে আদৌ কি কোনো তাত্ত্বিক সম্পর্ক রয়েছে? একটু খতিয়ে দেখা যাক।

ইসলাম একটি সংগঠিত ধর্ম যার প্রতিটি আচার আচরণ নির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত। বিশিষ্ট গ্রন্থকার, গবেষককলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ রাধেশ্যাম ব্রহ্মচারী তাঁর’ইসলামের তিন সিদ্ধান্ত: কোরানের সংক্ষিপ্তসার’ পুস্তিকায় (বঙ্গীয় সনাতন পরিষদ) লিখেছেন, “ইসলামের মোট ছটা কলেমা বা সঙ্কল্পবাক্য আছে। যার মধ্যে প্রথম কলেমা বা কলেমা তৈয়ব-কে বলা হয় ইসলামের প্রাণ। এই কলেমা তৈয়ব হল, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লা, মহম্মদুর রসুলুল্লা’। অর্থাৎ আল্লা ব্যতীত উপাস্য নাই এবং মহম্মদ আল্লার রসুল বা বার্তাবাহক বা পয়গম্বর। ইসলামে এই কলেমার এতই গুরুত্ব যে বলা চলে, এই কলেমা তৈয়বে যারা বিশ্বাস করে না, তারাই কাফের।…যে সমস্ত ব্যক্তি আল্লার কোরান ও নবী মহম্মদের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং কলেমায় বিশ্বাস করে, তারাই হল আত্মসমর্পণকারী ইমানদার মুসলমান বা মোমেন। যারা তা করে না তারাই হল কাফের।”

এরপরে ডঃ ব্রহ্মচারী ইসলামের সিদ্ধান্তগুলির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেন, “প্রথম সিদ্ধান্ত ‘মিল্লাৎ ও কুফর’ -এর মিল্লাৎ বলতে বোঝায় সৌভাতৃত্ব, বা ভাইচারা।… মৃত্যুর ঠিক আগের বছর নবী মহম্মদ মক্কায় হজ করতে গিয়ে আরাফৎ (মিলন)- এর ময়দানে যে বিদায় ভাষণ (Farewell address) দেন, তাতে তিনি মুসলমানদের তিনটি উপদেশ দেন। এই উপদেশ তিনটির মধ্যে সর্বপ্রধান উপদেশই ছিল ‘কুল্ল মুসলেমীন ইখুয়াতুন’। এই উপদেশ থেকেই আজকের বিশ্বব্যাপী মুসলিম ভ্রাতৃত্ব বা ‘ইসলামী উন্মা’র জন্ম হয়। “ অর্থাৎ দুনিয়ার সব মুসলিম ভাই-ভাই। অপরদিকে একই অঞ্চলে এমনকি একই পরিবারে বেড়ে ওঠা দুজনের ইসলামে বিশ্বাসী অপর জন অবিশ্বাসী হলে অবিশ্বাসী ব্যক্তি ওই মুসলিমের স্বাভাবিক শত্রু।

ইসলামের দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত দার-উল-ইসলাম ও দার-উল-হার্ব বলছে যে, এই পৃথিবীতে যত দেশ আছে তা দুইভাগে বিভক্ত। দার-উল-ইসলাম হচ্ছে সেই সমস্ত দেশ, যেগুলো ইতিমধ্যে ইসলামের অধিকারে চলে এসেছে।” বর্তমানে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান ইত্যাদি ইসলামিক রাষ্ট্রসমূহ। দার-উল-হার্ব এর আক্ষরিক অর্থ হল সন্ত্রাসের দেশ। সেইসমস্ত দেশ, যেগুলো এখনও মুসলমানদের অধিকারে আসেনি এবং যেখানে মুসলমান ও কাফেরদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। ডঃ ব্রহ্মচারীর কথায়, “ইসলামের অন্তিম লক্ষ্য হল পৃথিবীর সমস্ত দার-উল-হার্বকে দার-উল-ইসলামে পরিণত করে সমগ্র বিশ্বে আল্লার রাজত্ব কায়েম করা।” জিহাদের মাধ্যমে কায়েম করতে চাওয়া এই মতাদর্শকে বলা হয়সর্বব্যাপী ইসলামবাদ (pan Islamism)যার মধ্যে ধর্মের আঙ্গিকে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের লক্ষ্য স্পষ্ট। এইপ্রসঙ্গে ইজরায়েলের হাফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয় সুরক্ষা সংক্রান্ত পঠনপাঠন বিভাগের প্রধান, অধ্যাপক গ্যাব্রিয়েল বেন-ডর ও তাঁর সহগবেষক আমি পেদাজুর তাঁদের এক প্রবন্ধে (The Uniqueness of Islamic fundamentalism and the fourth wave of international terrorism, 2003 দ্য ইউনিকনেস অফ ইসলামিক ফান্ডামেন্টালিজম অ্যান্ড দ্য ফোর্থ ওয়েভ অফ ইন্টারন্যাশনাল টেররিজম, ২০০৩) উল্লেখ করেছিলেন, “In no other major religion is there such an intimate interrelationship between religion and state, hence religious extremism in Islam had more greater political implications and ramifications than in other cases”।

পৃথিবীর সমস্ত দার-উল-হার্বকে দার-উল-ইসলামে পরিণত করতে হবে কোন পদ্ধতিতে? ইসলাম অনুযায়ী সেই পদ্ধতি হল জিহাদ।জিহাদ কথাটির ব্যুৎপত্তি আরবি শব্দ ‘জাহাদা’ হতে, যার অর্থ কোনো কার্যসাধনের জন্য শক্তি এবং প্রচেষ্টা নিয়োজিত করা। এই প্রসঙ্গে এই প্রসঙ্গে লেবানিজ বংশোদ্ভূত প্রখ্যাত মার্কিন লেখিকা, সাংবাদিক, সমাজকর্মী এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রাজনৈতিক বক্তা ব্রিজিট গ্যাব্রিয়েলের ‘দে মাস্ট বি স্টপড’ বইটির একটি পর্যবেক্ষণ প্রণিধানযোগ্য। তা হল, “when you examine the history of Islam and the commandments of the Koran that endorses jihad as a military tool, that it becomes clear that the term Jihad refers mostly to war against non-believers.” 

এবার একটু তুলনা করে দেখা যাক সেই বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদের সঙ্গে যাঁরা আহ্বান করে থাকেন “দুনিয়ার মজদুর এক হও”। এই মতবাদের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন দুনিয়ার সকল সর্বহারা ভাই-ভাই এবং যাঁরাই তাঁদের নীতিতে বিশ্বাসী নন, তাঁরাই হলেন শ্রেণীশত্রু।আদি ইসলামে ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। অর্থাৎধর্মীয় ক্ষেত্রে ইসলামিক মৌলবাদের চরিত্রটিকে যেমন বলা হয় totalitarian, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বামপন্থী মৌলবাদের চরিত্রও তাই।ইসলাম যেমন ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে গোটা মানবসভ্যতাকে মোমেনও কাফের এই দুই ভাগেভাগ করে কমিউনিজ়ম ভাগ করে সর্বহারা ও বুর্জোয়া এই দুই শ্রেণীতে। ইসলামের লক্ষ্য লাগাতার জিহাদ অর্থাৎ সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পৃথিবীকে সম্পূর্ণরূপে কাফেরমুক্ত করে সেখানে দার-উল-ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা। অপরদিকে কমিউনিজ়মের উদ্দেশ্য নিরন্তর শ্রেণীসংগ্রামের মধ্য দিয়ে সমস্ত বুর্জোয়া শ্রেণীতথারাষ্ট্রের বিলোপ ঘটিয়ে বিশ্বজুড়ে সর্বহারার একনায়কতন্ত্র কায়েম করা। লক্ষ্যনীয় যে উভয় ক্ষেত্রেই ক্ষমতার অধিকারী হল একটি ঐ একটিমাত্র সম্প্রদায় এবং বিকল্প বা বহুত্বের কোন অবকাশ নেই। উভয় ক্ষেত্রেই সেই ক্ষমতা কায়েম করা ও টিঁকিয়ে রাখার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল হিংসা, বলপ্রয়োগ ও সামরিক রেজিমেন্টেশন।

আদি ইসলামিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সমাজতন্ত্রের ধারণা সঞ্চারের পথিকৃত বলা যায় হজরত মহম্মদের সঙ্গী আবুযর আল-গিফারি’কে (Abu Dharr al-Ghifari, Oxford Islamic Studies Online,২৩ জানুয়ারি ২০১০)। খৃষ্টীয় সপ্তম শতকে ওসমান গাজির শাসনকালে ৬৪৭ খৃষ্টাব্দে ইফ্রিকিয়া (আফ্রিকার অংশবিশেষ, বর্তমান টিউনিশিয়া, পূর্ব আলজিরিয়া ও পশ্চিম লিবিয়া) হতে লুন্ঠিত সম্পদ বন্টনের সময়ে কিছু শাসকের সম্পদের পরিমাণ অত্যধিক বৃদ্ধি পেলে তিনি এর বিরোধিতা করে সম্পদের সুষমবণ্টনের দাবি তোলেন। প্রথম মুসলিম খলিফা আবু বকর সর্বসাধারণের জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে ভাতার ব্যবস্থা করেন। সেই নিয়ম অনুসারে, সকল পুরুষ, নারী ও শিশুকে বছরে ১০ দিরহাম করে দেয়া হত। পরে তা বাড়িয়ে ২০ দিরহাম করা হয়। (Towards a Social Wage, Medialternatives, David Robert Lewis, March 10, 2014)

উনিশ শতকের শেষের দিকে কোরানে উল্লিখিত কিছু ধারণারসূত্র ধরে মুসলিম সমাজতন্ত্রীগণের সামনে ইসলামের আদর্শ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার একটা সুযোগ তৈরি হয়। এঁরা মনে করতেন যে জ়াকাতের মত কোরানের শিক্ষা অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমতার নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ইসলামী শরিয়ত নির্ধারিত সীমা বা নিসাব এর অধিক উপার্জনকারী প্রত্যেক স্বাধীন, পূর্ণবয়স্ক মুসলমান ব্যক্তির বার্ষিক আয় ও সম্পত্তির একটি নির্দিষ্ট অংশ গরীব-দুঃস্থমুসলিমদের মধ্যে বিতরণের নিয়মকে বলা হয়জ়াকাত।সমাজতন্ত্রকে ধর্মীয় রূপ দেওয়ার উদ্দেশে জন্য এইসবমুসলিম নেতা ইসলামী সমাজতন্ত্রের (Islamic socialism) ধারণা সৃষ্টি করেন। এঁরা হজরত মহম্মদকে প্রথম সমাজতন্ত্রী হিসেবে এবং তাঁর সময়ে সৃষ্ট ইসলামিক সমাজকেই প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরতে থাকেন। ,টেক্সাসে বেলর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও বেলর রিলিজিয়ন সার্ভে’র অধিকর্তা পল ফ্রোজ তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন কিছু মুসলিম কমিউনিস্ট মহম্মদকে প্রথম আদর্শ কমিউনিস্ট বলে প্রচার করা শুরু করেন (Religion and State: The Muslim Approach to Politics)।

ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে ভারতসহ এশিয়ার একাধিক মুসলিম জনবহুল দেশের রাজনীতির প্রবাহের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে কমিউনিস্ট আন্দোলনের মক্কা রাশিয়ার মাটিতে। ইসলামিক জিহাদি শক্তিকে শ্রেণীসংগ্রামের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে বিপ্লবকে প্রসারিত করার অন্যতম ব্যক্তিত্ৱছিলেন ইউনিয়ন অফ সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকসের প্রধান ভ্লাদিমির লেনিন। যদিও ইসলাম একটি সম্পূর্ণরূপে একটি সংগঠিত ধর্ম তথাউপাসনাপদ্ধতিভিত্তিক সমাজগঠনের কথা বলে, তবুও, মধ্য এশিয়ার মুসলিমদের সঙ্গে রুশ কমিউনিস্টদের এক আশ্চর্য সহযোগিতা গড়ে উঠল। কারণ রাশিয়ায় কমিউনিস্টরা তখনো সমগ্র দেশ দখল করার মত যথেষ্ট সংখ্যায় ছিলেন না। পূর্ব ইউরোপে ততদিনে শুরু হওয়া সমাজতন্ত্রের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ইসলামিক ধারণাটিরও প্রসার ঘটতে থাকে। এই সময় রাশিয়ার তাতারস্তান ও অন্যান্য তাতার অধ্যুষিত এলাকায় মুসলিমদের মধ্যে ওয়েইসি আন্দোলন নামক এক ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে ওঠে যার সূচনা করেন বাহাওয়েতদিন ওয়েইসেভ। এর মধ্যে শ্রেণীসংগ্রামের ধারণাও ছিল। তাঁকেই রাজনৈতিক ইসলামের প্রথম প্রবক্তা হিসেবে ধরা হয় যা পরবর্তীকালে ইসলামিক সমাজতন্ত্রের পথ প্রশস্ত করে।

কিছু বিশেষজ্ঞের মতে আধুনিক যুগে ইসলামিক সমাজতন্ত্রের প্রথম প্রকাশ ঘটে এই ওয়াইসি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ওয়েইসেভের লক্ষ্য ছিল শরিয়া ও সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে মুসলিম-তুর্কি রাষ্ট্র গঠন করা। এঁরা রুশি সাম্রাজ্যের বিরোধীতা করেন। সরকারি আইনকানুন ও প্রশাসনিক বিধি অবজ্ঞা করে শুধু শরিয়া ও কোরান মান্য করে চলা, জরিমানা দিয়েও কাফির সেনাবাহিনীতে যোগদান ও রাশিয়ান পাসপোর্ট এড়িয়ে চলা – এইসবই মূলতঃ ছিল তাঁর কর্মসূচি। এই আন্দোলন মুসলিম কৃষক, দিনমজুর ও পেটি বুর্জোয়ার যথেষ্ট সমর্থন পায়। ক্রমে রুশ কর্তৃপক্ষ একে দমন করা শুরু করলে তাঁরা গা ঢাকা দেন ও গোপনে কমিউনিস্ট, সোশ্যালিস্ট ও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের সাথে সহযোগিতা শুরু করেন এবং ১৯০৫ সালে রুশ বিপ্লবের সময়ের প্রাক্কালে নিজেদের আন্দোলনকে ইসলামিক সোশ্যালিস্ট হিসেবে তুলে ধরতে শুরু করেন। ওয়েইসি আন্দোলনকে লেনিন বলশেভিক বিপ্লবের চূড়ান্ত মহড়া বলে অভিহিত করেন। ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবের সময়ে এঁরাও একই নীতিগত অবস্থান গ্রহন করেন এবং প্রথম পরীক্ষামূলক ইসলামিক কমিউন গঠন করেন। (“Islamic Socialism: A history from left to right”,dawn.com, 21 February 2013, Paracha, Nadeem F.) তাতারস্তানের বৃহত্তম শহর কাজানের মুসলিম সোশ্যালিস্ট কমিটিও এই সময় সক্রিয় হয়ে ওঠে, যাতে মেনশেভিক, বলশেভিক, সোশ্যাল রেভেলিউশনারি ও অ্যানার্কিস্ট মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিরা জায়গা পান।

ততদিনে একটি ধর্মভিত্তিক স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক স্বৈরতন্ত্রের মেলবন্ধনের প্রয়াস ফলিত এবং তাত্ত্বিক উভয় স্তরেই শুরু হয়ে গিয়েছে। এই বিষয়ে ১৯১২ সালে উত্তরপ্রদেশের আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ মুসির হুসেন কিদোয়াইয়ের রচিত প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘ইসলাম অ্যান্ড সোশ্যালিজ়ম’ এর বক্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য, যেখানে তিনি বলেছেন, “the idea of Socialism in Islam is not less than thirteen centuries old and cannot be attributed to European influence. I do not mean to say that any organised Socialistic propaganda existed then as it does now, but I may safely assert that the principles of Socialism were not unknown to the Muslim society of the time of Muhammad himself, and that in many respects those principles were made more adaptable then than at any time afterwards in Europe”. (Kidwai, S. M. H., Islam and Socialism, London, 1912)।

পরবর্তীকালে কিদোয়াই খিলাফত আন্দোলনের সমর্থক হয়ে ওঠেন যার উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়ে দক্ষিণ এশিয়ায়। অপরদিকে ১৯১২ সালে ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ়ের (বর্তমান ইন্দোনেশিয়া) মহম্মদ মিসবাক বা হাজি মিসবাকের নেতৃত্বেচিনা সাম্রাজ্যবাদ, খৃষ্টান মিশনারি ও ডাচ রাজত্বের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা ‘সারেকাত ইসলাম’ নামক গণ আন্দোলন ছিল দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলাম ও কমিউনিজ়মের প্রথম সখ্যতার নিদর্শন।ইনিছিলেন ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ়ের অন্তর্গত সুরাকার্তার এক ইসলামিক নেতা। ১৯১০ সালে তিনি সেদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন সারেকেত ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে ওঠেন এবং ইসলাম ও কমিউনিজ়মের সামঞ্জস্যের পক্ষে সওয়াল করা শুরু করেন।হাজি মহম্মদ মিসবাকের মত ব্যক্তিত্বের সক্রিয়তায় এই সখ্যতা আরও শক্তিশালী হয়। বিশেষতঃ ১৯২৫ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধ ‘ইসলাম অ্যান্ড কমিউনিজ়ম’ এই দুটি মতবাদকে একেবারে অভিন্ন বলে তুলে ধরে।

প্যান-ইসলামিজ়মের সঙ্গে কমিউনিজ়মের সেতুবন্ধনের  এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেনভারতের বুটা সিং ওরফে মৌলভি ওবেইদুল্লাহ সিন্ধী নামক দেওবন্দি পন্ডিত। শিখ থেকে ইসলামে ধর্মান্তরিত এই নেতা তথা মুহাজির ১৯১৫ সালে আফগানিস্তানের আমিরের সহায়তায় উত্তর পশ্চিম প্রান্তের মুসলিম জনজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে বৃটিশ ভারত আক্রমণের উদ্যোগ নেন। একাজে তাঁর সহযোগীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মৌলানা আবুল কালাম আজাদ। এরপর তিনি নিজের কিছু শিষ্যসমেত তুরস্কের বৃটিশ বিরোধী জিহাদে অংশ নেওয়ার মনস্হ করলেও শেষে ভারতে প্যান ইসলামিক শাসন প্রতিষ্ঠায় অধিক মনোযোগী হন। ১৯১৫ সালের ১লা ডিসেম্বর আমির হাবিবুল্লাহ’র’ বাগ-এ-বাবুর’ প্রাসাদে তুর্কি প্রতিনিধির উপস্থিতিতে কাবুলের নির্বাসনে ভারতের অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী হন বরকতুল্লা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ওবেইদুল্লাহ।

বৃটিশ কূটনীতিক চাপে ঐ সরকার অবলুপ্ত হলে ওবেইদুল্লাহ সোভিয়েত আমন্ত্রণে রাশিয়ায় গিয়ে সাত মাস কাটান। সেখানে সোশ্যালিশম নিয়ে পড়াশোনা করতে করতে তিনি ইসলাম ও সমাজবাদের মধ্যে গভীর সাদৃশ্য আবিষ্কার করেন। পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও এশিয়া চর্চা বিভাগের অধ্যাপক মাইয়া রামনাথ তাঁর ‘হজ টু ইউটোপিয়া’ গ্রন্থে লিখেছেন, “Obeidullah also made connections between the techniques and institutional formations of Communism and Islam considering the disciplined Leninist revolutionary party as comparable to the original form of jama’a (ie the active organization religious society ad it had existed in Muhammad’s day) and of course the Marxian social revolution as atheistic analogue to the theistic jihad in all its myriad forms – offensive and defensive; personal, psychological, cultural, literary, political and military”।

১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লব ছিল খৃস্টান সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বৃহত্তম সাফল্য। বিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার পরেও মুসলিমসম্প্রদায়ের মানুষদের সম্পূর্ণ সমর্থন করে লেনিন ঘোষণা করলেন, “To all toiling Moslems of Russia and the East, whose mosques and prayer-houses have been destroyed, whose beliefs have been trampled on by the Czars and the oppressors of Russia. Your beliefs and customs, your national and cultural institutions are declared henceforth free and inviolable. Organise your national life freely and without hindrance. This is your right. Know your rights…are protected by the entire might of the revolution and its organs…Support this revolution and its government!” যেহেতু এই সম্প্রদায়ের বেশিরভাগই ছিলেন কৃষক, এই কৌশল কমিউনিস্টদের জমি শক্ত করার কাজে যথেষ্ট সফল হয়।

এই সময়ে তুরস্কে ইসলামী খলিফাতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে ব্রিটিশ ভারতের মুসলমানরা এক প্যান ইসলামিকরাজনৈতিক প্রতিবাদ আন্দোলন সংঘটিত করেন,যাপরিচিত হয় খিলাফত আন্দোলননামে। উসমানীয় খিলাফতের একজন সুন্নি মুসলমানদের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতা হিসাবে বিবেচিত হন।এই খিলাফত আন্দোলন ভারতীয় মুসলিম আন্দোলন (১৯১৯-১৯২৪) নামেও পরিচিত।প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তুরস্ক ও ইরাকের সৃষ্টি ও অটোমান সাম্রাজ্যের তথা খলিফাতন্ত্রের পতনে বিশ্বজুড়ে মুসলিম ভাবাবেগের অভ্যুত্থান ঘটে। বিশেষতঃ দক্ষিণ এশিয়ার বিপুল সংখ্যক মুসলিমদের মধ্যে এক স্বতন্ত্র ইসলামিক জাতীয়তাবাদ এই সময়ে লক্ষ্য করা যায়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও তার পরবর্তী সময়ে বৃটিশ ভারত থেকে অনেক কট্টর ইসলামপন্থী হিজরত করে মুসলিম শাসনাধীন অঞ্চলে বাস করছিলেন, বিশ্বব্যাপী ইসলামের শাসন (pan islam) প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। এঁদের বলা হয় ‘মুহাজির’। আরবি ‘হিজরত’ শব্দের অর্থ হল দেশান্তর বা মাতৃভূমি পরিত্যাগ। কোরানে হিজরত সম্পর্কিত আয়াতসমূহে আখেরাতের বরকত (আশীর্বাদ) ও সামর্থ্য থাকা সত্বেও দারুল-কুফর থেকে হিজরত না করার কারণে শাস্তির বিধান রয়েছে। উল্লেখ্য, যে দেশে কুফুরী (কাফেরগণের আচরিত) বিধান প্রয়োগ হবে, সেটাই দার-উল কুফুর। যেমন ভারতবর্ষ। এমন দেশ থেকে হিজরত করাই ফরয (কর্তব্য) গণ্য হয়েছে এবং তা না করা প্রায় কুফরীর আওতাভুক্ত গণ্য করা হয়েছে। ভারতের এমনই এক তরুণ মুহাজির ও ইসলামিক পন্ডিত মৌলভি বরকতুল্লা ১৯১৫ সালে জার্মান সহায়তায় কাবুলে গঠিত ভারতের ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী’ হন। তিনি ১৯১৯ সালে ‘বলশেভিজম অ্যান্ড ইসলামিক বডি পলিটিক্’ নামক এক প্রচার পুস্তিকার রচনা করেন। বৃটিশদের হাতে ওটোমান সাম্রাজ্যের পতনের প্রতিশোধে বিশ্বব্যাপী দ্বিতীয় খিলাফতের প্রস্তাব নিয়ে পৃথিবী ভ্রমণকালে তিনি আফগানিস্তানের অল্পবয়স্ক আমির আমানুল্লাহের বিশেষ দূত হিসেবে লেনিনের সঙ্গে মিলিত হন।

১৯২০ সালে তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের যুদ্ধমন্ত্রী ইসমাইল এনভার ওরফে এনভার পাশা রাশিয়ায় লেনিনসহ বিভিন্ন বলশেভিক নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রগতিশীল গণতন্ত্রে বিশ্বাসী কামাল পাশার তুলনায় মৌলবাদী এনভার পাশা লেনিনের কাছে তুলনায় অধিক গ্রহণযোগ্য ছিলেন, তুরস্ক থেকে পলায়ন করার আগের পর্যায়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ৮ থেকে ১৮ লক্ষ আর্মেনিয়, ৩ লক্ষ আসিরিয় ও ৭ লক্ষ ৫০ হাজার গ্রিকের গণহত্যার জন্য দায়ী সাব্যস্ত এনভার চিনা তুর্কিস্তানে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র গঠনে লেনিনের সাহায্য চান। বিনিময়ে তিনি ওই অঞ্চলে এক বিপ্লবী সেনাবাহিনী গড়ে তুলে ভারতবর্ষ আক্রমণ করার প্রস্তাব দেন।

অপরদিকে ভারতের শীর্ষ কমিউনিস্ট নেতা নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ওরফে মানবেন্দ্রনাথ রায় লেনিনকে পরামর্শ দেন বাইরে থেকে শক্তিপ্রয়োগের পরিবর্তে ভারতের মাটিতেই ইসলামিক জিহাদ সংঘটিত করে ক্ষমতা দখলের জন্য। এই প্রস্তাবটিই সোভিয়েতের ভরপুর সমর্থন পায়। এম.এন.রায়ের সামনে এই ভাবনার আরেকটি দৃষ্টান্ত মজুত ছিল। লেনিনের পৃষ্ঠপোষকতায় মির্জা সুলতান গালিয়েভ নামক তার্তার বলশেভিক নেতার হাতে গড়ে তোলা ইসলামিক জাতীয়তাবাদী কমিউনিজম। ১৯১৭ সালে এপ্রিলে সুলতান গালিয়েভ মুসলিম সোশ্যালিস্ট কমিটি গড়ে তুলেছিলেন। এম.এন.রায়ের মাধ্যমেই এই সোভিয়েত ইসলামিক জাতীয়তাবাদী কমিউনিজম তৃতীয় বিশ্বে প্রবেশ করে। একেশ্বরবাদী ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা তথা জিহাদকে ভারতের বহু-ঈশ্বরবাদী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এক ‘প্রগতিশীল মুক্তিকামী’ শক্তি হিসেবে তুলে ধরে এম.এন.রায় মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য একটি খসড়া গড়ে দেন। তাঁরা ভারতে হিন্দু ও মুসলিমদের যে কোনও প্রকার সংঘর্ষকে এই তত্ত্বের নিরিখেই দেখতে থাকেন।

১৯২১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ভারতে মুসলিমের সংখ্যা ছিল ৬ কোটি ৮৭ লক্ষ ৩৫ হাজার, যা মোট জনসংখ্যার ২২%। আর ৯৭ লক্ষ ৭৫ হাজার ছিলেন জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ,জনসংখ্যার নিরিখে ৩%। কমিউনিস্টদের এই কাজের লক্ষ্য ছিল দেশের মুসলিম সম্প্রদায় ও জনজাতি সম্প্রদায়ের এই ২৫% মানুষকে বাম রাজনীতির ছত্রছায়ায় নিয়ে এসে তাঁদের শোষিত সর্বহারা হিসেবে তুলে ধরা। সেই সঙ্গে জনসংখ্যার মোট ৬৮% বর্ণহিন্দু, যার সিংহভাগই বামপন্থার সমর্থক নন, তাঁদের শোষণকারী বুর্জোয়া তথা শ্রেণীশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা। এর ফলে একদিকে যেমন জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অনুসারী দেশের জনবিন্যাসে এক আড়াআড়ি ফাটল ধরিয়ে তুলনায় নতুন শ্রেণী রাজনীতিকে প্রাসঙ্গিক করে তোলা সম্ভব হয়েছিল, অপরদিকে বামনীতির বিরুদ্ধ অবস্থানে থাকা ভারতবাসীর সঙ্গে রাজনৈতিক লড়াইয়ে তীব্র ইসলামিক মৌলবাদকে যুক্ত করে কমিউনিস্টদের দ্রুত শক্তিবৃদ্ধিও সম্ভব হয়েছিল। এই প্রক্রিয়া আরও ত্বরাণ্বিত হয় পরিস্থিতি অনুকূল থাকায়। এবং এই তত্ত্বের অনুসারীগণ ক্রমশঃ ভারতের সীমা ছাড়িয়ে সমগ্র এশিয়ার মুক্তির লক্ষ্যে আল্লাহর সেনা গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিতে থাকেন।

লেনিন বরকতুল্লার ‘প্যান ইসলাম’ প্রসারের পরিকল্পনাকে গ্রহণ করেন। এবং ১৯২০ সালের অক্টোবরে এম.এন.রায়ের হাতে কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (তাশখন্দ) প্রতিষ্ঠার সময়ে বরকতুল্লাহ এবং ওবেইদুল্লাহ উপস্থিত থাকেন। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন সংক্রান্ত দলিলের ‘ইনিশিয়েটিভস ইন দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন শীর্ষক রচনায় (১৩ই অক্টোবর ২০২১, কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া ২০২১) এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে, “In January-April 1920, nine radical nationalists arrived in Tashkent and seven of them including Mohammad Ali, Mohammad Shafiq (these two were on a mission of the “Provisional Government”), Abdul Majid and Abdul Fazil were constituted into an “Indian Communists Section” of the Sovinter-prop on April 17,1920.” এখানে ‘র‌্যাডিকাল ন্যাশনালিস্ট’ বলতে ইসলামিক জাতীয়তাবাদীদের বোঝান হয়েছে।

এম.এন.রায় ও তাঁর স্ত্রী এভেলিন রায় ট্রেন্ট মহম্মদ শফিক, মহম্মদ আলি প্রমুখ বহু তরুণ মুহাজিরকে কমিউনিস্ট পার্টিতে সদস্য হিসেবে যুক্ত করতে থাকেন। এঁরা মাতৃভূমি ভারতবর্ষ থেকে হিজরত করে আফগানিস্তান ও তুরস্কে যাওয়ার চেষ্টায় ছিলেন। এঁদের অনেকে নর্থ ইস্ট ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্স পেরিয়ে আফগানিস্তান হয়ে মধ্য সোভিয়েত এশিয়ায় পৌঁছে যান। বলশেভিক রাশিয়ায় তাঁদের মতাদর্শকে পরিমার্জিত করে তার বাহ্যিকরূপে বামপন্থী আদল নিয়ে আসা হয়। কার্যতঃ কাফেরের শাসনবিরোধী ‘প্যান ইসলামিক’ জিহাদের কট্টরবাদী প্রক্রিয়াকেই ‘সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী’ লড়াই হিসেবে আখ্যা দিয়ে বহু ক্ষেত্রে মগজধোলাই করা হয়। পরবর্তীকালে রফিক আহমেদ, শওকত উসমানি প্রভৃতি নবীন মুহাজির মস্কোর নবগঠিত কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয় ‘ইউনিভার্সিটি অফ টয়লার্স অফ দ্য ইস্ট’ এ ভর্তি হন।

এবিষয়ে কমিউনিস্ট পার্টির নিজস্ব বয়ান, “According to Muzaffar Ahmad, one of the pioneers of the communist movement in India, at least twenty-one names of young Muhajir students could be identified from the records.” অনেক ইতিহাস বিশেষজ্ঞের অনুমান, পরবর্তী দশকগুলিতে এই পার্টির কট্টর পাকিস্তান সমর্থন শুধু রাজনৈতিক কারণে ছিল না। সঙ্গে ছিল ইসলাম ধর্মের মৌলবাদী প্রভাবও। পাকিস্তান ভারতের কিম্বা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজফ্ফর আহমেদ কিম্বা পার্টির উত্তর প্রদেশের সাধারণ সম্পাদক, ভারতীয় গণনাট্য সংঘ ও সারা ভারত কিষাণ সভার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও পরবর্তীকালে পাকিস্তানে চলে যাওয়া সঈদ সাজ্জাদ জাহির প্রমুখ মুসলিম নেতৃবৃন্দের পাকিস্তানের দাবি সমর্থনের পিছনে হিজরতের আকাঙ্ক্ষা অন্যতম কারণ বলে অনেকের অভিমত।

১৯২০-৩০ এই সময়কালে ওবেইদুল্লাহর মতই সামাজিক গঠন ও অর্থনীতির বহু ক্ষেত্রে ইসলাম ও মার্কসবাদের যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছিলেন আরেকজন অপেক্ষাকৃত স্বল্প পরিচিত দেওবন্দী সুন্নি ইসলামি পণ্ডিত হিফজুর রহমান সিওহারভি। ইনি পরবর্তীকালে জমিয়ত-এ-উলেমা-এ-হিন্দের চতুর্থ সাধারণ সম্পাদক হন এবং স্বাধীনতার পরে আমৃত্যু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সংসদ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।১৯২৩ সালে ওবেইদুল্লাহ তুরস্কে চলে যান। ১৯২৪ সালে ইস্তাম্বুলে তিনি কাবুল কংগ্রেস কমিটির তরফে ‘চার্টার ফর দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্স অফ ইন্ডিয়া’র মুদ্রিত রূপরেখা তুলে দেন লালা লাজপত রাইয়ের হাতে (রিমেম্বারিং ইন্ডিয়া’জ ডেট টু লালা লাজপত রাই, অরবিন্দন নীলাকন্দন, ১৮ ই নভেম্বর ২০১৬)। এই ওবেইদুল্লাহ প্ল্যানে’ ভারতকে অনেকগুলি ভাষার ভিত্তিতে গঠিত প্রজাতন্ত্রের সমষ্টি বা ফেডারেশন হিসেবে বিভাজনের পরিকল্পনা করা হয়। সেই সঙ্গে তৈরি হয় তুরস্ক রাষ্ট্রের সীমানার ওপারে ইন্দো-আফগান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে প্যান ইসলামিক খলিফাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার রূপরেখা। এমন পরিকল্পনায় শঙ্কিত লালাজি বিষয়টি নিয়ে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে তাঁর এক চিঠিতে লেখেন, “I think the seven crores (of muslims) of Hindustan plus the armed hosts of Afghanistan, Central Asia, Arabia, Mesopotamia and Turkey will be irresistible. Are we then doomed?” (লাইফ অফ সাভারকর, ইন্দ্র প্রকাশ)।উল্লেখ্য ১৯২৫ সালে  স্ট্যালিনও ভারতবর্ষ সম্বন্ধে মন্তব্য করেছিলেন, “Now-a-days India is spoken of as a single whole. Yet there can be hardly any doubt that in the case of a revolutionary upheaval in India many hitherto unknown nationalities each with its own language and its own distinctive culture will emerge on the scene.” ভারতের কমিউনিস্টগণ এই স্ট্যালিনপন্থী সোভিয়েত মতবাদ অনুসরণ করে ভারতবর্ষকে ভাগ করে পৃথক পাকিস্তানের দাবিকে সমর্থন করেন।

চিত্র ঋণ: ডন/Dawn (পাকিস্তানের প্রখ্যাত সংবাদপত্র)

(ক্রমশঃ)

 

লেখক পরিচিতি – পদার্থবিদ্যায় স্নাতক আর বিজনেস ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। তৎসহ ইলেকট্রনিক্স ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক স্তরের ডিগ্রিও। আর তথ্য প্রযুক্তি নিয়ে নানা পড়াশোনা। স্কুল ও কলেজের শিক্ষকতাসহ সরকারি-বেসরকারি নানা চাকরি করার সুযোগ হয়েছে। তবে কাজের বিষয় প্রায় সবক্ষেত্রেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক কিংবা নিরস প্রশাসনিক বিষয় সংক্রান্ত। ছোটোবেলা থেকেই লেখার অভ্যেস। বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতি। লিখেছেন ফিকশন ও নন-ফিকশন দুধরণের লেখাই। ইতিমধ্যে আরও দুটি বই প্রকাশিত, সর্বশেষটি ইংরেজিতে। কলকাতার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন শহরে বাংলা পত্রিকা ও লিটল ম্যাগাজিনেও নিয়মিত লেখেন।

 

 

Comment here