অতীত যা লেখেনিরাজনীতিস্বভূমি ও সমকাল

ইনকিলাবি জিহাদী: বাম ও ইসলামিক শক্তির আঁতাতের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস – ২

(পূর্ব অংশের পর)

 

– শ্রী অনির্বাণ দে

কমিউনিস্ট ও কংগ্রেসের ঢালাও প্রশ্রয়ে এবং মুসলিম নেতৃত্বের উত্তরোত্তর শক্তিবৃদ্ধির যৌথ প্রভাব দেশের মাটিতে ইসলামিক জেহাদের জমি প্রস্তুত করছিল। ১৯২১ সালে কেরলের মালাবার অঞ্চলে ঘটে যাওয়া মোপলা গণহত্যা ছিল মুসলিমদের প্রথম বড় আকারে সংগঠিত জেহাদ। মার্কিন নিবাসী ডাচ গ্রন্থকার ও মিশনারি জে. জে. বানিঙ্গা তাঁর ‘দ্য মোপলা রেবেলিয়ন অফ ১৯২১’ বইতে লিখেছেন, গণহত্যার ব্যাপকতা এমনই ছিল যে জলের কুয়ো ভরে যায় হিন্দুদের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহে। তাঁদের গর্ভবতী মহিলাদের টুকরো টুকরো করে কেটে ভিতরের শিশু বের করে ফেলা হয়। শিশুদের মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে হত্যা করা হয়। তাদের বাবাদের সবার সামনে জীবন্ত পোড়ানো হয়, চামড়া উপড়ে নেওয়া হয়, তাঁদের নিজেদের দিয়েই নিজেদের কবর খোঁড়ানো হয়। মহিলাদের প্রকাশ্যে তুলে নিয়ে গিয়ে পাশবিক অত্যাচার করা হয়। শতাধিক মন্দির ধ্বংস করে বিগ্রহের গলায় গোমাংস জড়িয়ে দেওয়া হয়। অ্যানি বেসান্ত ‘দ্য ফিউচর অফ ইন্ডিয়ান পলিটিক্স’ গ্রন্থে লেখেন, “They established the Khilafat Raj, crowned a King, murdered and plundered abundantly, and killed or drove away all Hindus who would not apostatise. Somewhere about a lakh people were driven from their homes with nothing but the clothes they had on, stripped of everything.”

স্বাভাবিকভাবেই এলাকার জনবিন্যাসে ঘটে যায় ব্যপক পরিবর্তন। মার্কিন ঐতিহাসিক এফ. রবিসনসনের ‘ইসলাম অ্যান্ড মুসলিম হিস্ট্রি ইন সাউথ ইস্ট এশিয়া’ বইটির তথ্য অনুযায়ী ১০ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। এঁরা মূলতঃ ছিলেন হিন্দু। ‘সার্ভন্টস অফ ইন্ডিয়া’ নিযুক্ত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ২০ হাজার হিন্দুকে বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণের তথ্য। সমস্ত দক্ষিণ ভারত জুড়ে ছড়িয়ে পড়া ভয়াবহ সন্ত্রাসের আবহে খিলাফত নেতারা একটি প্রস্তাব পাশ করেন যাতে লেখা ছিল, “congratulations to the Moplas on the brave fight they were conducting for the sake of religion”। কমিউনিস্টরা সমগ্র ঘটনাটিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের আখ্যা দেন। প্রসিদ্ধ সিপিআই নেতা সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই নারকীয় ঘটনাকে ‘জমিদার ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রথম কৃষক অভ্যুত্থান’ বলে ঘোষণা করেন। উল্লেখ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভ্রাতুষ্পুত্র সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর মুজফ্ফর আহমেদ ও কাজি নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন। তিনিই প্রথম কমিউনিস্ট ইস্তেহারের বঙ্গানুবাদ করেন, যা প্রকাশিত হয় কবি নজরুল সম্পাদিত ‘লাঙল’ পত্রিকায়। শ্রমিক কৃষক দলের দ্বিতীয় সম্মেলনে তিনি অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯২৮ সালে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট কংগ্রেসে ভারতীয় প্রতিনিধি হিসেবে মস্কো যান এবং সেসময় থেকে এই আন্দোলনের পুরোভাগে থাকেন। এই সম্মেলনেই স্হির হয় কংগ্রেসসহ সব গান্ধীবাদী ও স্বরাজপন্থী দলকে প্রতিহত করাভারতের সমস্ত কমিউনিস্টের কর্তব্য।

১৯৩৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ট্রটস্কিপন্থী সৌম্যেন্দ্রনাথ কমিউনিস্ট লিগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৪৩ সালে এর নাম হয় দ্য রেভেলিউশনারি কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (আর সি পি আই)। আরসিপিআই ভারতের স্বাধীনতার পর সশস্ত্র বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেয়। ১৯৪৮ এ গড়ে ওঠে জিন্নাহর অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগের ভারতীয় সংস্করণ, ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লিগ। ইএমএস নামবুদিরিপাদের নেতৃত্বে সিপি(আই) এম এই মুসলিম লিগের সঙ্গে জোট বেঁধে ১৯৬৫ সালে কেরলের তৃতীয় বিধানসভা নির্বাচনে লড়াই করে। সেবার কোনো পক্ষই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। কিন্তু ১৯৬৭ সালে বিধানসভায় ক্ষমতায় আসার পর কেরলের সিপি(আই)এম সরকার এই মোপলা গণহত্যার নায়ক ও খিলাফত আন্দোলনের অন্যতম প্রচারক আলি মুসলিয়ারকে ‘স্বাধীনতা সংগ্রামী’র আখ্যা পর্যন্ত দেয় যা ২০২১ সালে ভারত সরকার বাতিল করার আগে অবধি বজায় ছিল।

ভারতবর্ষের বুকে যেকজন প্রথম সারির ইসলামিক নেতা মার্ক্সিয় মতবাদের সঙ্গে ইসলামের যোগসূত্রের ওপর উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব আরোপ করেছেন তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন খোদহজরত মহম্মদ ও মৈনুদ্দিন চিস্তির সরাসরি বংশধর।তিনি ইসলামতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ দার্শনিক, ঐতিহাসিকএবং জামাত এ-ইসলামি নামক আন্দোলনের প্রবক্তা হায়দরাবাদের মৌলানা সঈদ আবুল আলা মৌদুদি।তাঁকে কানাডার উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথ উল্লেখ করেছেন “the most systematic thinker of modern Islam” হিসেবে। ভারতীয় মুসলিমদের কেউ কেউ যে হিজরত আন্দোলনে যোগদান করেছিলেন সেই বিষয়ের উপর একটি বিতর্কে মৌদুদিও অংশ নেন।অনুমান করা হয় কিদোয়াইয়ের ‘ইসলাম অ্যান্ড সোশ্যালিজ়ম বইটি তিনি পড়েছিলেন। মার্ক্সিয় ও সমাজতন্ত্রী আন্দোলন দ্বারা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত মৌদুদি তাঁর একটি রচনায় হজরত মহম্মদকে এক মহান বিপ্লবী হিসেবে তুলে ধরেন। সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে নির্মিত মার্ক্সিয় বিশ্বদর্শনকে সম্পূর্ণরূপে মিলিয়ে দেননিজের ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে। সমসাময়িক একটি কমিউনিস্ট আন্দোলনকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি লেখেন, “In the nineteenth century capitalist imposition had reached its apogee. Nobody could have predicted that the system that controls the whole world…can be overturned. But in these conditions a man named Karl Marx started proselytising for communism. He was thrown out of his home, had to move from country to country and lived like a pauper. However, before he died he was able to make a strong party of communists that not only took over Russia within 40 years…but shook the capitalist system to its roots”(Maududi: ‘Kaish mardan na kay mazhab go safandan’, Tarjuman-ul-Quran, April 1936)

১৯৩৯ সালে লাহোরে এক বক্তৃতায় তিনি ইসলামিক জিহাদের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী বিপ্লবের সমতুল্য হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। বিষয়টি নিয়ে তাঁর বক্তব্য ছিল, “When Islam becomes dominant, then in reaction, jahiliya prepares itself against Islam. When jahiliyat rises, then Islam prepares for revolution against it”। উল্লেখ্য jahiliya শব্দের অর্থ অজ্ঞতা বা তমসা। ইসলাম অনুসারে নবী মহম্মদের নবুওয়াত লাভের পূর্বে যে সময় অবধি আরবের লোকেরা ‘অজ্ঞতার অন্ধকারে’ ও মূর্তিপুজোর মত ‘পাপাচারে’ নিমজ্জিত ছিল এবং বিশ্বসমাজে ইসলামি শরীয়তের কোন জ্ঞান ছিল না – তাকে ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’ বা ‘অজ্ঞতার যুগ’ বলা হয়। মার্ক্সিয় দৃষ্টিভঙ্গির মত মৌদুদির চর্চিত ইসলামেও গণতন্ত্রকে শির্কের (মূর্তিপুজা বা বহু-ঈশ্বরবাদের মত কার্যকলাপ) মত ঘৃণ্য দৃষ্টিতেই দেখা হত, কিন্তু ঠিক মার্ক্সিয় কৌশলের মত তাঁরাও সংসদীয় গণতন্ত্রকে সাময়িকভাবে ব্যবহার করে রাষ্ট্রের অভ্যন্তর থেকেই তাকে তাকে ধংস করার উদ্দেশ্য নিহিত ছিল। পাকিস্তান গঠনের সময় জামাত-এ-ইসলাম তাকে সমর্থন করে।

এই মৌদুদির হাত ধরে ১৯২৮ সালে মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে গড়ে ওঠা জামাত-এ-ইসলাম আধুনিক ছিল ইসলামিক বিপ্লবের মতাদর্শের ভিত্তিতে সৃষ্ট পৃথিবীর প্রথম সংগঠন। পৃথিবীর জুড়ে স্হাপিত ইসলামিক সংগঠনগুলিরমধ্যে অন্যতম শক্তিশালী এই সংগঠনের শাখাপরবর্তীকালে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, কাশ্মীর ও পাক-অধিকৃত কাশ্মীর প্রভৃতি বহু স্হানে গড়ে ওঠে। দেশভাগের পর মৌদুদি ও তাঁর অনুসারীরা পাকিস্তানকে ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে সচেষ্ট হন। ১৯৫৩ সালে সেদেশের আহমেদিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে তাঁর সংগঠিত আন্দোলনের পরিণতিতে লাহোরে যে দাঙ্গা হয়, তাতে ওই সম্প্রদায়ের ২০০ মানুষ প্রাণ হারান। মনে করা হয় তাঁদেরই সহায়তায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল মহম্মদ জিয়া উল হক ১৯৭৮ সালে সেদেশে শরিয়া কায়েম করতে সক্ষম হন। এই জামাত-এ-ইসলামির বাংলাদেশ শাখা ১৯৭৫ সালে মিলিটারি শাসনকালে ওদেশে বৈধতা পায়। ২০১৮ সালে আবার ভয়ঙ্কর গণহত্যা ও বহু যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত সশস্ত্র পাকিস্তানি সেনাকে প্ররোচনা দেওয়ার অপরাধে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।

বাম ও ইসলামের মেলবন্ধনের আরেক প্রক্রিষ্ট উদাহরণ ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (সিপিআই) এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মৌলানা হসরত মোহানি। মুহাম্মদ অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজে (পরবর্তীকালের আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়) পড়ার সময়ে মহম্মদ আলি জওহর ও শওকত আলির মত ব্যক্তির মোহানির ছিলেন মোহানির সহযোগী, যাঁরা পরে খিলাফত আন্দোলনের প্রধান নেতা হয়ে ওঠেন। মোহানি নিজেও এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন।১৯২১ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগের সভাপতিত্ব করেন মোহানি। এদিকে আবার রুশ বিপ্লবের দ্বারা গভীরভাবে প্রাভাবিত মোহানির কানপুরের বাড়িটি কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সম্মেলনের প্রস্তুতিকেন্দ্র হয়ে ওঠে। ১৯২৫ সালে তিনি নিজের হাতে লাল ঝান্ডা উড়িয়ে কানপুরের প্রথম পার্টি অফিসের উদ্বোধন করেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সম্মেলন হয় কানপুরে ১৯২৫ সালের ২৬ থেকে ২৮ শে ডিসেম্বর অবধি। সেই সম্মেলনে অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন মৌলানা হসরত মোহানি। এই সম্মেলনের স্বাগত ভাষণে তিনি বলেন, “Some of our Muslim leaders un-necessarily present communism as an opponent of Islam, although the reality is totally opposite. For example, Islam opposes capitalism even more forcefully that the communist ideas.” উল্লেখ্য, ওই সম্মেলনে মোহানি পার্টির সেন্ট্রাল এক্জ়িকিউটিভ কমিটির সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯২৭ এর সম্মেলনও তিনি পুনর্নিবাচিত হন।

একই সঙ্গে তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধর্মভীরু প্রকৃতির মানুষ। জানা যায় মোহানি ১৩ বার হজ যাত্রা করেন। তিনি ১৯৩৬ সালে লখ্নৌ এ প্রতিষ্ঠিত বামপন্থী লেখক সংগঠন ‘প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনে’ যোগ দেন এবং কানপুরে এর শাখাও গড়ে তোলেন। তাঁকে প্রায়ই বলতে শোনা যেত, “I was initially a nationalist. In 1925, I abandoned this idea and adopted the principles of communism. Now I am a communist.” এবং এই জাতীয়তাবাদী নীতি থেকে সরে আসার সপক্ষে তিনি বলতেন, “Gandhi ki tarah baith ke kaatenge kyun charkha/Lenin ki tarah denge duniya ko hila hum” [গান্ধীর মত বসে চরকা কাটব কেন/লেনিনের মত বিশ্বকে নাড়িয়ে দেব]।

পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সইদ সিবতে হাসান ১৯৭০ সালে তাঁর একটি বক্তব্যে মোহানি সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, “Maulana Hasrat Mohani used to openly call himself a Muslim communist and publicly spoke in favour of communism. Despite this, neither the ulema of Deoband called him an infidel, nor the muftis of Farangi Mahal gave a fatwa of apostasy and unbelief on him.” বাম ও ইসলামের আত্মিক সম্পর্কের গভীরতা প্রকাশ পায় উর্দুতে লেখা মোহানির এই উক্তিতে, “Darweshi-o-inqilab maslak hai mera/Sufi momin hun, ishtiraki muslim” [দরবেশি ও বিপ্লব আমার ধর্ম, (কারণ আমি) সুফি মোমিন, (এবং) সমাজতন্ত্রী মুসলিম(ও)। মোহানি চেয়েছিলেন বৃটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভের পর ইউনিয়ন অফ সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক (ইউএসএসআর) এর আদলে ভারতবর্ষে ছটি পৃথক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে, যথা পূর্ব পাকিস্তান, মধ্য ভারত, দক্ষিণ পূর্ব ভারত, দক্ষিণ পশ্চিম ভারত ও হায়দরাবাদ দাক্ষিণাত্য।

প্রথমে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লড়াই অগ্রণি ভূমিকা নেওয়ার পর মোহানি ভারতীয় মুসলিমদের স্বার্থরক্ষায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা ও মুসলিম লিগের প্রতিনিধি হিসেবে গণপরিষদের (কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি) সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু স্বাধীনতার পর পাকিস্তানে না গিয়ে ভারতের মুসলিমদের স্বার্থে এদেশেই থেকে যান।১৯৪৯ সালের ২৬শে নভেম্বর ভারতের গণপরিষদ এক স্বাধীন, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে ভারতের সংবিধানের প্রস্তাব করে যা তার প্রতিটি নাগরিককে ন্যায়, সাম্য ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেবে। সমগ্র গণপরিষদে সেদিন একজনই প্রতিবাদ করে ওঠেন। মৌলানা হসরত মোহানি। বিষয়টিতে বিচলিত জওহরলাল নেহেরুকে তিনি বলেন, “I raised my voice to make sure that at least one voice of dissent was made against the proposed Indian constitution which has not done justice with Indian Muslims”

পরিশেষে আরেকটি প্রণিধানযোগ্য তথ্য। সমগ্র ভারত জুড়ে বামপন্থীদের মধ্যে সর্বাধিক প্রচলিত ও জনপ্রিয় স্লোগান ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ এর রচয়িতাও এই মৌলানা হসরত মোহানি। রচনাকাল ১৯২১, যে সালের জনগণনা অনুসারে সারা দেশে উর্দুভাষী ছিলেন মাত্র ৮.৭%। তা সত্ত্বেও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় ভাষার চেয়ে শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের ব্যবহৃত ভাষা উর্দুতে রচিত এই স্লোগানটিই এক্ষেত্রে বামেরদের সবচেয়ে মনঃপূত হয়েছিল।

যিনি প্রথমভারতবর্ষকে দ্বিখন্ডিত করে একটি আলাদা দেশ গঠনের প্রস্তাব দেন তাঁর নামস্যার মহম্মদ ইকবাল।সেই ইকবালযাঁর রচিত উর্দু গান ‘সারে জাহাঁ সে অচ্ছা’ একসময়ে ‘তরানে-এ-হিন্দ’ বা ভারতের গণসঙ্গীত হিসেবে ব্যবহার করতঅখন্ড ভারতবর্ষ।খিলাফত আন্দোলনের সক্রিয় অংশগ্রহণকারীইকবাল১৯৩০ সালের ডিসেম্বরে লক্ষ্ণৌয়ে বার্ষিক অধিবেশনেমুসলিম লিগের সভাপতি হিসেবে ভাষণ দিতে গিয়ে মুসলিম লিগের বরিষ্ঠ পদাধিকারীইকবালভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে একটি পৃথক রাষ্ট্রগঠনের রূপরেখা পেশ করেন। এরনাম ছিল ‘পাকিস্তান ডিক্লরেশন’ (Now or Never; Are We to Live or Perish Forever?) এরপর লন্ডনে আয়োজিত তৃতীয় গোল টেবিল বৈঠক (১৭ নভেম্বর – ২৪ ডিসেম্বর, ১৯৩২) চলাকালীন ইকবাল বৈঠকের সদস্যেদের মধ্যে প্রস্তাবটি প্রকাশ করেন। তবে ঘরোয়াভাবে সদস্যদের মধ্যে এটি বন্টন করা হলেও তা হিন্দু ভারতীয় বা বৃটিশ কোনো পক্ষেরই অনুমোদন পায় নি। কিন্তু ভারতীয় মুসলিমদের কার্যতঃ ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে দাঁড়ায় এই বিষয়টি নিয়ে স্যার রহমত আলি নামক অপর এক বিলেতফেরত আইনজীবীর অভূতপূর্ব তৎপরতা।

ইকবালপ্রণীত সূত্র ধরে অগ্রসর হয়ে রহমত আলি ১৯৩৩ সালে পাকিস্তান আন্দোলনের সূচনা করেন।

প্রসিদ্ধ তুর্কি ঔপন্যাসিক, বুদ্ধিজীবী ও তুরস্কে নারীর অধিকার সংক্রান্ত আন্দোলনের অগ্রণি ব্যক্তিত্ব হালিদ এডিব আদিভার রচিত একটি গ্রন্থ ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হয়। ‘ইনসাইড ইন্ডিয়া’। এডিবের দৃষ্টিতে তৎকালীন ভারতবর্ষের বর্ণনা সম্বলিত এই গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থে রহমত আলির একটি সাক্ষাৎকারের উল্লেখ ছিল, যেখানে তিনি বলছেন, “Our first aim is to achieve independence for Pakistan – both from British Imperialism and from Hindu capitalism. For the moment this question eclipses all other questions. As to the form of government, one thing is certain. It will be fundamentally both democratic and socialistic. “

যদিও গুজ্জর সম্প্রদায়ের এই মানুষটির জন্ম ও বেড়ে ওঠা পাঞ্জাবের হোসিয়ারপুরে, কিন্তু তাঁকে বলতে শোনা যেত, “We are not Indians: we are Pakistanis”।রহমত আলির পরিকল্পনা ছিল অবিভক্ত বাংলা ও আসাম নিয়ে একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের। প্রস্তাবটি মহম্মদ ইকবালের মাধ্যমে ১৯৪২ সালে লাহোর অধিবেশনে পেশ হয়। প্রস্তাবিত পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের প্রতিনিধির সঙ্গে অবিভক্ত বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী (বর্তমানে মুখ্যমন্ত্রীর সমতুল্য) এ.কে.ফজলুল হক প্রস্তাবটি সমর্থনও করেন।

ইতিহাসের নানান ঘটনা পরম্পরা থেকে দেখা যায় ১৯৪২ থেকে ১৯৪৭ এই সময়কালে কমিউনিস্ট পার্টি বৃটিশ ও মুসলিম লিগ উভয়ের সঙ্গেই সমান সহযোগিতা করে চলেছিল।১৯৪০সালের মার্চ মাসে লাহোর অধিবেশনে পাকিস্তান প্রস্তাব পাশ হয়। এবং এই সময় থেকে কমিউনিস্ট পার্টি সর্বান্তকরণে এই দাবি সমর্থন ও তার বাস্তবায়নে প্রাণপন সাহায্য করতে থাকে।এই প্রসঙ্গে গৃহীত পার্টির প্রস্তাবে বলা হয়, “Pakistan is a just demand for the Muslim Homeland”।সেইসঙ্গে হিন্দু তত্ত্ব ও তার ওপরে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রবাদী ভাবধারাকে ‘ফ্যাসিস্ট’ তকমা দেওয়া হতে থাকে। যেকোনো প্রকারে ধর্ম, অধ্যাত্ম ও সনাতন সংস্কৃতির পুনরুত্থান বস্তুবাদী নাস্তিক কমিউনিস্টদের মতবাদের প্রসারের পক্ষে বিরাট প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ানোয় তাঁরা স্বদেশের এই সহস্রাব্দ প্রাচীন ভাবধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত যেকোনো বিষয়ের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকেন। এই প্রসঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি অফ গ্রেট ব্রিটেনের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক, সাংবাদিক ও গ্রন্থকার তথা ভারতে বামপন্থী ইতিহাস রচনার অগ্রদূত রজনী পাম দত্তের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ইন্ডিয়া টুডে’র একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য, “The insistence on orthodox religion as the heart of the national movement, and the proclamation of the supposed spiritual superiority of the ancient Hindu civilisation to modern ‘ Western ‘ civilisation (what modern psychologists would no doubt term a compensatory delusion), inevitably retarded and weakened the real advance of the national movement and of political consciousness, while the emphasis on Hinduism must bear a share of the responsibility for the alienation of wide sections of Moslem opinion from the national movement ”.

১৯৪২ এর ৮ই অগাস্ট কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়ার মুখপাত্র ‘পিপল্স ওয়ার’ এ লেখা হয়,””behind the demand of Pakistan is a justified desire of the people of Muslim nationalities such as Sindhis, Baluchis, Panjabis (Muslims), Pathans to build their free national life” লক্ষ্যণীয় যে এখানে ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশ, জাতি ও ভাষাগোষ্ঠীর মুসলিমদের একটি জাতি হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়েছে। অপরদিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের বহু সহস্রাব্দ প্রাচীন মাতৃভূমি সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়, “The conception of India’s unity was never a static one… it is…developing within its womb a host of individual nationalities which… are now waking to new consciousness…To begin with, it is quite clear that India was not a nation in the modern sense from times immemorial, from the days of Ashoka and Akbar.”

সম্পূর্ণ মৌলবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগের মত একটি সংগঠন সম্পর্কে তথাকথিত ‘প্রগতিশীল’ রাজনৈতিক দলের দৃষ্টিভঙ্গিতে ছিল একটি আদ্যপ্রান্ত ‘অসাম্প্রদায়িক’ দল (the secular and anti religious League)।পিপল্স ওয়ারে লেখা হয়, “the rise of Muslim League cannot be regarded as reactionary… The demand for Pakistan, if we look at its progressive essence, is in reality the demand for the self-determination and separation of the areas of Muslim nationalities”।এবং পাকিস্তানের দাবির পথে আসা যেকোনো বাধার বিরোধিতা করতে মরিয়া এই পার্টির গান্ধীজির পাকিস্তান নীতি সম্পর্কে বক্তব্য ছিল, “How does he (Gandhiji) propose to fight Pakistan? By ignoring the just demand that is behind it, by denying to the Muslim nationalities the right of autonomous state existence…the Congress cannot think in terms of compelling the people of any individual nationality inhabiting a given territorial unit to which it is attached by historical tradition, having its own language, culture, and psychological makeup and common economic life, to remain inan Indian Union against their declared and established will.” এর পরের দিন কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ও পরবর্তীকালের সাধারণ সম্পাদক বি.টি.রণদিভেও একই দাবি তুলে পিপল্স ওয়ারে লেখেন।

১৯৪২ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর পার্টির বর্ধিত পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন অর্থাৎ প্লেনামে মুসলিম লিগের পাকিস্তান সংক্রান্ত দাবির প্রতি পূর্ণ সম্মতি জানিয়ে যে প্রস্তাব পাশ হয় তাতে বলা হয়, “Such a declaration of rights in as much as it concedes to every nationality as defined above and therefore to nationalities having Muslim faith, the right of autonomous state existence and of secession… would give to the Muslims wherever they are in overwhelming majority in a contiguous territory which is their homeland, the right of autonomous states and even to separate if they so desire…such a declaration therefore concedes the just essence of the Pakistan demand”।প্লেনামে এই প্রস্তাব ১৯৪৩ সালের মে মাসে বোম্বেতে অনুষ্ঠিত পার্টির প্রথম কংগ্রেসে চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়।

এই প্লেনামের উল্লেখযোগ্য নেতৃত্ব ও অন্যতম বক্তা ছিলেন পার্টির নীতিতে ভারতের মাটিতে মৌলবাদী ইসলামিক বিচ্ছিন্নতাবাদকে তাত্ত্বিকভাবে প্রতিষ্ঠা করার অন্যতম স্হপতি, পার্টির প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক ও পরবর্তীকালে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ও পলিটব্যুরোর সদস্য ডঃ গঙ্গাধর মোরেশ্বর অধিকারী, যাঁর সম্পাদিত ‘পাকিস্তান অ্যান্ড ন্যাশনাল ইউনিটি’ পুস্তিকায় প্লেনামে তাঁরই পেশ করা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। সে রিপোর্টে ডঃ অধিকারী লিখেছিলেন, “Since 1940, the party began to see that the so called communal problem in India was really a problem of growing nationalities and that it could be solved on the basis of the recognition of the right of self determination, to the point of politcal secession of the Muslim nationalities as in fact of all nationaliues which have India as their common mother land… the demand for Pakistan if we look at its progressive essence is in reality the demand for self determination and separation…”

গঙ্গাধর অধিকারী তথা পার্টির অন্যতম লক্ষ্য ছিল দেশজুড়ে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করা যে ভারতবর্ষ বলে আদৌ কোনো দেশ নেই। বরং তা আসলে ১৮ টি পৃথক জাতিসত্তার সমষ্টিমাত্র যাদের প্রত্যেকের ভারত থেকে পৃথক হওয়ার অধিকার রয়েছে। এবং অখন্ড ভারতবর্ষে ‘হিন্দু শাসনাধীনে’ মুসলিমগণ শোষিত হবেন। অপরদিকে পাকিস্তান ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারলে কমিউনিস্টদের দৃষ্টিতে তা হবে ”still greater and more glorious unity of India, the like of which India has not seen in her history”।এবং সেই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে তাঁরা দেশভাগকেই একমাত্র বাস্তবোচিত পন্থা হিসেবে ঘোষণা করেন। অধিকারীর বয়ানে, “Leftist put forward the ‘practical’ solution to the communal problem – give cultural rights to the Muslims and the problem will be solved…We saw the growth of the Muslim League not the growth of communalism but the rise of anti-imperialist nationalist consciousness among the Muslim masses. We saw this as a forward step…. We must make real to them the patriotic national consciousness that bonds each Muslim nationality to its homeland and that finds expression in its attachments to the Pakistan slogan.” তিনি মুসলিমদের এক ‘শোষিত জাতি’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেন, “The grievances and demands of the Muslims as an ‘oppressed nationalities’ are brought more into political controversies.”

ডঃ অধিকারী স্বাধীনতার পর ভারতের মাটিতে শত শত বছর নিশ্চিন্তে বাস করা মুসলিম সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেএই রিপোর্টে মন্তব্য করেছিলেন,” The Muslim masses fear that they will be oppressed and exploited by ‘Hindu India’… the uneven bourgeois development itself creates conditions wherein one dominant nationality may be in a position to stifle the growth of less developed and weaker nationalities in a free India… that is why we say that such a fear is quite an understandable fear.” আর সেইসময় ভারতের অখন্ডতা বজায় রাখার দাবিতে আন্দোলনরত স্বদেশবাসীর প্রতি তাঁর মূল্যায়ন ছিল, “Only by convincing the Congress patriot that the grant of self-determination really leads to unity can we isolate the influence of the Hindu-minded communal reactionary, who under the garb of ‘Akhand Hindustan’ fans the flames of distrust and hatred between the Hindus and Muslims and really supports national inequality and oppression. His slogan of ‘Akhand Hindustan’ leads in fact not to unity but disunity and disruption.”

অপরদিকে যে মুসলিম লিগ ও তার পাকিস্তানের দাবিকে কমিউনিস্ট পার্টি নিতান্ত মরিয়াভাবে অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিল, সেই দাবি প্রসঙ্গে ১৯৪৪ সালের ৮ই মার্চ আলিগড়ের একটি বক্তৃতায় স্বয়ং মহম্মদ আলী জিন্নাহ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন, “Pakistan started the moment the first non-Muslim was converted to Islam in India long before the Muslims established their rule….As for the Muslim, it was a duty imposed on him by Islam not to merge his identity and individuality in any alien society…. that was the basis for Pakistan.”

মার্ক্সবাদী উর্দু পত্রিকা ‘চিঙ্গারি’, সংবাদপত্র ‘কওমি জঙ্গ’, ‘নয়া জমানা’সহ বহু বামপন্থী পত্রিকার কর্ণধার, উত্তরপ্রদেশে পার্টির রাজ্য সম্পাদক ও পরবর্তীকালে পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সাজ্জাদ জাহির ১৯৪৪ সালের ১৯শে মার্চ প্রকাশিত পিপল্স ওয়ার পত্রিকায় লেখেন “the demand for Pakistan is the logical expression of the development of political consciousness among the Muslims of India. It has grown together with the development of the national movement as.a whole” (Muslim League and Freedom)।এই কট্টর মুসলিমপন্থী নীতির সমর্থনে সিপিআইয়ের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক পূরণচাঁদ যোশীলেখেন, “We held a series of discussions within our Party and came to the conclusion in 1941-42 that it (Muslim League) had become an ‘anti-imperialist organisation expressing the freedom urge of the Muslim peoples, that its demand for Pakistan was a demand of self determination and that for the freedom of India. ” (Congress and the Communist, Bombay December, 1944).

এমনকি পাকিস্তান আদায়ের দাবিকে প্রগতিশীল আখ্যা দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির তরফ থেকে সমস্ত মুসলিম কমিউনিস্ট ও জাতীয়তাবাদী মুসলিমদের মুসলিম লিগে যোগ দিতে নির্দেশ দেওয়া হয় (Mushirul Hasan, Legacy of a Divided Nation: India’s Muslims,Since Independence,1997)।পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সাজ্জাদ জাহির সুপারিশ করেন, “the Party should assist League to enroll Muslims in large numbers in order to make it a mass organization which would eventually pass out the control of its present reactionary leaders”.

এর ফলে বিরাট সংখ্যক মুসলিম লিগে যোগ দেন। এবং এই স্টালিনীয় নীতি মেনে মিঞা ইফতিকারুদ্দিন, ড্যানিয়েল লাতিফি, ও আতাউল্লাহ জাহানিয়াহ’র মত কৃষক নেতাকে মুসলিম লিগে পাঠানো হয় (Mridula Mukherjee, Peasants of India’ s Non-Violent Revolution)। কমিউনিস্টরা এবার খোলাখুলি ময়দানে নেমে পড়েন। ১৯৪৩ সালে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক ও জিন্নাহ’র বিষয়ে অগ্রণি গবেষক জামিলুদ্দিন আহমেদের বয়ানে, “Preaching communism, distributing communist literature and their organ the People’s War, and enrolling Muslim members for the League. They have established a regular centre at the house of a professor and other professors are secretly supporting them.” (Mushirul Hasan, Legacy of a Divided Nation.) লিগে যোগদানকারী অন্যান্য বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতার মধ্যে ছিলেন আতাউল্লাহ গাহানিয়া, চৌধুরি রহমতুল্লাহ, আনিস হাসমি ও গুলাম নবি ভুল্লার।

কমিউনিস্টরা মুসলিম লিগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে তাঁদের সংগঠন, প্রচার ও মুসলিম কর্মী ও কৃষক শ্রেণীর সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে তোলেন। ১৯৪৫ সালের ২৯ ও ৩০শে সেপ্টেম্বর বর্তমান লাহোরের জিয়া-বাগ্গা গ্রামে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে আয়োজিত পাঞ্জাবের প্রথম কৃষক সম্মেলনে দেড় লক্ষ চাষির জমায়েত হয় যেখানে মুসলিম লিগের নেতৃত্ব উপস্থিত থাকেন। ১৯৪৪-৪৫ নাগাদ লিগের প্রচার ও তথ্য বিভাগ শক্তিশালী হয়ে উঠলে সেখানে ইংরেজি ও উর্দু কমিউনিস্ট সংবাদপত্রের বিশেষ প্রসার ঘটানো হয়। বাম নেতৃত্বসহ বিভিন্ন লেখকের কলমে জিন্নাহর মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের নীল নকশা সংবলিত বই ও প্রচারপত্রের ব্যাপকভাবে বিলি হতে থাকে। এমনকি লিগের আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার লক্ষ্যে পাঞ্জাবের কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে ড্যানিয়েল লতিফি, আবদুল্লাহ মালিক প্রমুখ কমিউনিস্ট নেতারা পার্টি থেকে একেবারে পদত্যাগ করে মুসলিম লিগে যোগ দেন। লতিফি পাঞ্জাবের প্রাদেশিক লিগের দপ্তর সচিব হন। এই সময় প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনও পাকিস্তান প্রশ্নে লিগের কট্টর সমর্থক হয়ে ওঠে। ১৯৪৪ সালে পার্টির নির্দেশে মুফতি রাজা আনসারি লিগে যোগ দেন।

আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস্ ফেডারেশনের ছাত্ররা দলে দলে অল ইন্ডিয়া মুসলিম স্টুডেন্ট্স ফেডারেশনে যোগ দিতে থাকেন। ১৯৪৫-৪৬ সালের নির্বাচনের প্রচারে তাঁরা পালন করেনপদাতিক সৈন্যের ভূমিকা (Communist in the Muslim League, Habib Manzer)। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ভূমিকার জন্য জিন্নাহ একে ‘the arsenal of Muslim India’ বা মুসলিম ভারতের অস্ত্রাগার বলে উল্লেখ করেন। এবং পার্টির এই সুদীর্ঘ ও একনিষ্ঠ প্রয়াসের ফলে মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে চূড়ান্ত মেরুকরণে সক্ষম হয় এবং মুসলিম লিগের ১৯৪৫-৪৬ এর নির্বাচনে প্রায় সবকটি আসনে জয়লাভ করে। সেই মুসলিম লিগ, যে বিগত ১৯৩৭ এর নির্বাচনে শোচনীয় ফলাফল করেছিল। কমিউনিস্ট পার্টি অফ গ্রেট বৃটেনের সদস্য ও প্রসিদ্ধ মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড ভিক্টর গর্ডন কিয়েরম্যান, যিনি ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত সময়কাল ভারতে কাটিয়েছেন, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও মুসলিম লিগের এমন ঘনিষ্ঠতা প্রসঙ্গে মেইনস্ট্রিম পত্রিকায় (১৪ই মার্চ ২০০৯) মন্তব্য করেন, “if circumstances favoured the CPI one way or the other, it helped Jinnah and the Muslim League still more”।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পতন এবং আজাদ হিন্দ বাহিনীর মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণের পর ক্যাপ্টেন আব্দুল রশিদকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এদিকে আব্দুল রশিদের বক্তব্য ছিল, আজাদ হিন্দ বাহিনী ভারত আক্রমণ করলে দেশের মুসলিমদের স্বার্থরক্ষায় প্রস্তুত থাকাই তাঁর ওই বাহিনীতে যোগদানের আসল উদ্দেশ্য। তিনি বাহিনীর অমুসলিম সৈন্যদের যথেষ্ট নিচু দৃষ্টিতে দেখতেন। এমন ব্যক্তির এমন শাস্তি ঘোষণা দেশের মুসলিমদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এই ঘটনার প্রতিবাদে ১৯৪৬ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি মুসলিম লিগ ধর্মঘট ডাকলে কমিউনিস্ট পার্টি ও তার ছাত্র সংগঠনও তাতে অংশগ্রহণ করে ‘ক্যাপ্টেন রশিদ আলি দিবস’ পালন করে। জ্যোতি বসু এই কর্মসূচিকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মুসলিম জনসাধারণের প্রতিবাদ হিসেবে আখ্যা দেন।

একদিকে পৃথক ধর্মীয় জাতিসত্তার নামে লাগাতার মৌলবাদী উস্কানি অপরদিকে এক তথাকথিত প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের ঢালাও সমর্থন ও প্রোপাগান্ডা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে এরপর এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। মুসলিমদের দাবি মেনে দেশকে ভাগ করে পাকিস্তান গঠনের প্রশ্নে ভারতবর্ষকে বাধ্য করার কৌশলের অংশ হিসেবে ১৯৪৬ সালের ২৯শে জুলাই বম্বেতে মুসলিম লিগেপাশ হয়’ডাইরেক্ট অ্যাকশনের’ প্রস্তাব। মহম্মদ আলি জিন্না ১৬ই আগস্ট, রমজানের ১৮তম দিনে অর্থাৎ হজরত মহম্মদের বদর যুদ্ধে মক্কা দখল করার দিনেই এই’ডাইরেক্ট অ্যাকশনে’র ডাক দেন। পার্টির অধীনস্থ ট্রামওয়ে ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন এই কর্মসূচিতে সরাসরি যোগ দেয়। তাদের সদস্য মহম্মদ ইসমাইলের সভাপতিত্বে তারা কলকাতার ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে চার ঘন্টাব্যাপী সভা করে। এই মহম্মদ ইসমাইলই পরে সেন্ট্রাল প্রভিন্সের রায়পুরে লিগের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে পাকিস্তানের দাবিকে ‘natural outcome of the freedom urge of the muslims’ বলে অভিহিত করেছিলেন।

১৬ই অগাস্ট মুসলিম লিগ বন্ধ ডেকেছিল। সিপিআইও সেদিন সর্বাত্মক ধর্মঘট পালন করে। বাংলার বহু পেট্রোলিয়াম, ইস্পাত, লৌহ ও পাট প্রভৃতি কারখানা বন্ধ থাকে। অবিভক্ত বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী তথা আইন-শৃঙ্খলা মন্ত্রী, কট্টর মৌলবাদী নেতা হুসেন সুহরার্বদি লিগের সমগ্র কর্মকান্ডকে সাহায্য করার জন্য রাজ্যে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন। শহীদ মিনারে ময়দানেও কমিউনিস্ট পার্টি ও মুসলিম লিগ একসঙ্গে সভা করে। সে সময় বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি অর্থাৎ বিধানসভায় সিপিআই এর বিধায়ক সংখ্যা ছিল তিন। সইদপুর থেকে জ্যোতি বসু, দিনাজপুর থেকে রূপনারায়ন রায় ও দার্জিলিং থেকে রতনলাল ব্রাহ্মণ। জ্যোতি বসুসহ তিনজনই সভায় উপস্থিত থাকেন। সেখানে তীব্র হিন্দু-বিরোধী ও ভয়াবহ হিংস্র প্ররোচনমূলক স্লোগান শহরের আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দেয়। ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে “কান মে বিড়ি মুহ মে পান/লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান”। দুটি দল একসাথেই মিছিল করে জেলা থেকে কলকাতায় আসে।

এরপর খাস কলকাতার বুকে যে বীভৎসনরমেধ যজ্ঞ সংঘটিত হয়, তা ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছে’দ্যগ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস’ নামে।এই গণহত্যাকান্ডেমৃতের প্রকৃত সংখ্যা ১৫ হাজার পেরিয়ে গিয়েছিল (দ্য স্টেট্সম্যান, ২২ শে অগাস্ট ১৯৪৬)। খোদ জ্যোতি বসুর স্মৃতিচারণে বলেছিলেন, “By contemporary estimates, the causality in the Calcutta killings in 1946 were nothing less than 20,000 or more”(Jyoti Basu Memoirs – So Far I Can Remember, Chapter VII: The Riots of 1946)। আহতের সংখ্যা ছিল ২৯ হাজার (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লাইফ ম্যাগাজিন, ইউ.এস.এ, ৯ই সেপ্টেম্বর ১৯৪৬)। ৯০০ বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ঘটে, ২৫০০ দোকান ও বাড়িঘর ধ্বংসপ্রাপ্ত ও লুঠ হয়। গৃহহীন হয়ে পড়েন ১ লক্ষের ওপর মানুষ। এবং প্রাণহানি থেকে শুরু করে যাবতীয় ক্ষয়ক্ষতির সিংহভাগই হয় হিন্দুদের।

জ্যোতি বসু তাঁর স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেছেন কিভাবে সেদিন অর্থাৎ ১৬ই অগাস্ট পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে দেখে রেলওয়ে ইউনিয়নের নেতা জি. কৃষ্ণমূর্তি, নিখিল মিত্র প্রমুখ কমরেডের সঙ্গে তিনি গা ঢাকা দেন কলকাতার নারকেলডাঙ্গা থেকে পালিয়ে নিরাপদ স্থানে গা ঢাকা দেন। বিশিষ্ট বামপন্থী অধ্যাপক ডঃ কল্যাণ দত্তের আত্মজীবনী থেকে জানা যায় ১৭ই অগাস্ট খিদিরপুরে পার্টির হিন্দু কর্মীরা কিভাবে তাঁদেরই মুসলিম কমরেড দ্বারা আক্রান্ত হন। টেক্সটাইল ইউনিয়নের নেতা সইদ আবদুল্লা ফারুকি ও কট্টরবাদী নেতা ইলিয়ান মিস্ত্রির নেতৃত্বে এক সশস্ত্র মুসলিম বাহিনী খিদিরপুরে লিচুবাগান বস্তির কেশোরাম জুট মিলের হিন্দু কমরেডদের উপর চড়াও হয়। অসহায় ও হতবাক মানুষগুলি তাঁদের পার্টির সদস্যপদের কার্ড দেখিয়ে প্রাণভিক্ষা করেও রেহাই পাননি। অন্ততঃ ৪০০ থেকে ৬০০ হিন্দু শ্রমিক সেদিন নিজেদের পার্টির কমরেডদের হাতেই নিহত হন। তাঁদের বেশিরভাগই ছিলেন ওড়িয়া। এটাই ছিল ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংসের বৃহত্তম গণহত্যা।

কিন্তু পার্টি তার মুসলিম তোষণের নীতি থেকে বিন্দুমাত্রও সরেনি। পরের মাসে অর্থাৎ সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে বিধানসভার অধিবেশনে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মুসলিম লিগকে ১৬ই আগস্টের জন্য দায়ী করে তীব্র আক্রমণ করেন। সেই সময় দুটি অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়। প্রথমটি এই গণহত্যার নায়ক হুসেন সুহরার্বদির বিরুদ্ধে আর দ্বিতীয়টি সমগ্র লীগ মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে। ২০শে সেপ্টেম্বর বিধানসভায় উভয় প্রস্তাবের ওপর ভোট হয়। বিধানসভায় সিপিআই এর দলনেতা জ্যোতি বসুসহ কমিউনিস্ট পার্টির তিনজন বিধায়কই প্রথম প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থাকেন আর দ্বিতীয়টিতে লিগ মন্ত্রীসভার পক্ষে ভোট দেন। জ্যোতি বসু এই গণহত্যার দায় শুধুমাত্র বৃটিশ সরকারের ঘাড়ে চাপান। এমনকি বিধায়ক রূপনারায়ন রায় উল্টে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর বিরুদ্ধেই নিন্দা প্রস্তাব আনার কথা বলেন, বিধানসভার ফ্লোরে দাঁড়িয়ে। শেষ পর্যন্ত দুটি প্রস্তাবই ভোটাভুটিতে পরাস্ত হয়। এই নারকীয় ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের প্রসঙ্গে জ্যোতি বসুর তাঁর স্মৃতিচারণে বলেছিলেন “On August 16, after the tragedy of the fratricidal riots had taken place, the prisoners were released; most of them had been initiated into communism”।

স্বাধীনতার পরেও জ্যোতি বসু, মণিকুন্তলা সেনের মত কমিউনিস্ট ব্যক্তিত্বরা মুসলিম লিগের যাবতীয় অপরাধ ধামাচাপা দিতে প্রবল চেষ্টা চালিয়ে যান। সাজ্জাদ জাহির, বি টি রণদিভে ও পি সি যোশীর মত নেতারা পাকিস্তানের দাবির ‘ন্যায্যতা’ দিয়ে প্রোপাগান্ডা বজায় রাখেন। পার্টি-সম্পাদক পি সিযোশী ২৭শে আগস্ট, ১৯৪৭ সালে তাঁর বাঙলার কমরেডদের উদ্দেশ্যে চিঠিতে লেখেন, “We can vote against the Muslim League Ministry provided it does not affect our muslim working class base…the best way possible to keep all in good humour was to stay neutral. Voting against the Muslim League will have other serious implications“।

অন্ধভাবে একটি ধর্মীয় মতাদর্শকে সমর্থন দেওয়ার এই কমিউনিস্ট নীতি তার আপাতঃ তাত্ত্বিক খোলসের বাইরেও বেরিয়ে আসত কখনও কখনও। যেমন হিন্দু কোড আইন বনাম শরিয়তি আইনের ক্ষেত্রে কমিউনিস্টদেল দুমুখো অবস্থান।স্বাধীনতা পরবর্তীকালে যখন হিন্দু ব্যক্তিগত আইন বিলুপ্ত করার জন্য হিন্দু কোড বিল আনা হয়, গণপরিষদের একমাত্র কমিউনিস্ট নেতা এবং ভারতের সংবিধান প্রণয়ন সংক্রান্ত বিতর্কের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব সোমনাথ লাহিড়ীর বক্তব্য ছিল যে হিন্দু কোড বিল অত্যন্ত সময়োপযোগী । এর ফলে কুসংস্কারচ্ছন্ন হিন্দু সমাজের অত্যাচার থেকে মহিলারা রক্ষা পাবেন। অথচ এই সোমনাথ লাহিড়ীই মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান নিয়ে বলেন যে মুসলিম সমাজ আধুনিক, উন্নত আর সংস্কৃত মনোভাবাপন্ন। সেখানে লিঙ্গবৈষম্য নেই বললেই চলে। তাই তাঁদের আইনে (শরীয়তি) হস্তক্ষেপ করার কোন প্রয়োজন নেই।

পরবর্তী পর্যায়ে ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ভারতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে রোমিলা থাপার, ইরফান হাবিব, রামশরণ শর্মা, সতীশ চন্দ্র, বিপান চন্দ ইত্যাদি বামপন্থী ঐতিহাসিকগণ সনাতন ভারতের গৌরবময় অধ্যায়কে যথাসম্ভব অবদমিত বা বিকৃত করে ইসলামিক শাসনের উৎকর্ষকে প্রাণপণ তুলে ধরার প্রচেষ্টা যে প্রতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন, তার মূল অনুপ্রেরণা ছিল ইসলামের প্রতি বামপন্থী মাত্রের সহজাত ও অন্ধ পক্ষপাত। এমনকি আধুনিক সময়ে ঘটে যাওয়া একের পর এক গণহত্যার ইতিহাসও তাঁরা সুকৌশলে গোপন অথবা বিভ্রান্তির আড়ালে ঢেকে রাখতে যথেষ্ট সফল হয়েছেন।

অবশ্যই এমন আচরণের সুনির্দিষ্ট কারণ ছিল। যেন-তেন-প্রকারেণ নিজেদের রাজনৈতিক মতাদর্শ ও ক্ষমতারপ্রসার। তার জন্য যে কোনও মূল্যে সমমনস্ক ব্যক্তি বাগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য তাঁরা মরিয়াভাবে সচেষ্ট ছিলেন। স্বভাবতই শুধুমাত্র রাজনৈতিক মতাদর্শকে সম্বল করে সেই ঈপ্সিত প্রসার সম্ভব ছিল না। বরং প্রয়োজন ছিল ইসলামের মত একটি সংঘবদ্ধ ও আগ্রাসী ধর্মের সাম্প্রদায়িক আবেগ যা গঠনগত ও চরিত্রগতভাবে তাঁদের কাছাকাছি। এবং এর সবচেয়ে বড় উদাহরণই হল খোদ পাকিস্তান দেশটি, যা জন্মলগ্ন থেকেই যার রাষ্ট্রীয় আদর্শ ছিল ইসলাম এবং সমাজতন্ত্র। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মির্জা আবুল হাসান ইস্পাহানির বই থেকে জানা যায় (Qaid-e-Azam Jinnah as I Knew Him, ১৯৬৬) ১৯৪৮ সালের ২৬শে মার্চ চট্টগ্রামের একটি সভায় জিন্নাহ ঘোষণা করেছিলেন, “you are only voicing my sentiments and the sentiments of millions of Musalmans when you say that Pakistan should be based on sure foundations of social justice and Islamic socialism which emphasizes equality and brotherhood of man”।

সেই একই সুরে সেদেশের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান পরের বছর ১৯৪৯ সালের ২৫শে অগাস্ট মন্তব্য করেছিলেন, “There are a number of ‘isms’ being talked about now-a-days, but we are convinced that for us there is only one ‘ism’, namely Islamic Socialism, …. The economic programme drawn up some 1,350 years back is still the best economic programme for us. In fact, whatever systems people may try out they all ultimately return to Islamic Socialism by whatever name they may choose to call it.” (Liakat Ali Khan: His Life and Work, Muhammad Reza Kazimi)

পাকিস্তানের প্রথম শাসক দল মুসলিম লিগে একাধিক ইসলামি সমাজতন্ত্রী ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি ছিল। ছিলেন গুলাম আলি পারভেজের মত ইসলামি পন্ডিত যিনি আধুনিক বিজ্ঞানের চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কোরানবাদের প্রচার করতেন। ১৯৬০ সালে মহম্মদ আয়ুব খান রাষ্ট্রপতি থাকার সময়ে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ও পরবর্তীকালের রাজ্যপাল হানিফ রামে লাহোরে বেশ কিছু বুদ্ধিজীবীর সমন্বয়ে এই গুলাম আলি পারভেজ, ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক খলিফা আব্দুল হাকিম, সিরিয়ার বাথ পার্টির শীর্ষনেতা মাইকেল আফাক প্রমুখের মতবাদের ভিত্তিতে সেদেশে ইসলামিক সমাজতন্ত্রকে গড়ে তোলেন। এবং হানিফ রামের অনুপ্রেরণায় পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রতিষ্ঠা হয় জুলফিকার আলি ভুট্টোর হাতে। এই দলের গঠনতন্ত্রের ভিত্তি ছিল হজরত মহম্মদের অধীনে মক্কা ও মদিনায় কোরান বর্ণিত সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা।

১৯৪৭ এর আগে কাশ্মীর পাকিস্তানে যোগ করার জন্য মুসলিম লিগের দাবি আগে পূরণ হয়নি। কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষা থেকে ১৯৪৭ এর ২২শে অক্টোবর স্বাধীনতার পাক সেনার মদতে পাকিস্তানের নর্থ-ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্স থেকে উপত্যকায় ব্যাপক হারে মুসলিম উপজাতির জঙ্গি ঢুকতে থাকে এবং স্হানীয় মুসলিমদের পৃষ্ঠপোষকতায় কাশ্মীর দখলের পরিকল্পনা করে। ডোগরা রাজবংশের শেষ রাজা হরি সিং যিনি স্বাধীনতার সময় স্বাধীন কাশ্মীর চেয়েছিলেন, বিপদ বুঝে ২৬ শে অক্টোবর ভারতের সঙ্গে কাশ্মীর যুক্ত করেন। ভারতীয় সেনা বেশিরভাগ জায়গা থেকে পাকিস্তানিদের হঠিয়ে দিলেও নিয়ন্ত্রণরেখা অবধি কাশ্মীরের এক তৃতীয়াংশ দখল করে নেয়।

ডোগরা শাসনকালে কাশ্মীর উপত্যকার জমির বেশিরভাগ অংশ ছিল হিন্দুদের। অপরদিকে জনসংখ্যার ৯৫% ছিলেন মুসলিম। ১৯৪৪ সালে সোপোরে কাশ্মীরের রাজনৈতিক নেতা শেখ আবদুল্লাহর দল ন্যাশনাল কনফারেন্সের এক কনভেনশনে দলের যে ম্যানিফেস্টো বা গঠনতন্ত্র গৃহীত হয় তার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ভূমি সংস্কার। এই ম্যানিফেস্টো তৈরি হয় লাহোরের ফ্রিডা ও বাবা প্যায়ারেলাল বেদি দম্পতি, ড্যানিয়েল লাতিফি, কুরবান আলি ও কে. এন বিমজ়ানি প্রমুখ কমিউনিস্ট তাত্ত্বিকদের হাতে। ‘নয়া কাশ্মীর’ নামক এই গঠনতন্ত্র ছিল আসলে সোভিয়েতের একটি সংবিধান থেকে নেওয়া। ১৯৪৮ সালের পাকিস্তান আক্রমণের পর ১৯৪৯ সালেই আবদুল্লাহ কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ওই ম্যানিফেস্টো রূপায়ণ শুরু করেন। ১৮৬ ক্যানাল বা ২২ একরের বেশি সমস্ত ব্যক্তিগত জমি তাঁরযসরকার মালিকের কাছ থেকে সরাসরি অধিগ্রহণ করে নেয়, কোনো ক্ষতিপূরণ ছাড়াই। কারণ কাশ্মীরের মাটিতে ভারতীয় সংবিধান তখন কাজ করত না। ১৯৭৫ সালে এই ২২একরের ঊর্ধসীমা আরও কমিয়ে আনা হয়।

পরবর্তী দশক গুলিতে বিপদ ক্রমশঃবাড়তে থাকে। শেখ আবদুল্লা কাশ্মীরি পন্ডিতদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেন, “রালিভ, শালিভ ইয়া গালিভ” অর্থাৎ, “হয় আমাদের একজন হও, অথবা পালাও, নয়ত মর”। ধীরে ধীরে জিহাদী তৎপরতা এবং নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে গিয়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নেওয়া বাড়তে থাকে। ১৯৮৯’র মার্চে একটি বোমা বিস্ফোরণে প্রথম একজন কাশ্মীরি পন্ডিত প্রাণ হারান। সেপ্টেম্বর নাগাদ বিক্ষিপ্ত হিংসা ছড়াতে শুরু করে, ভিতরে ভিতরে চলে ভয়াল ষড়যন্ত্রের ছক।

প্রসিদ্ধ লেখক ও সাংবাদিক রাহুল পন্ডিতা তাঁর best selling এবং প্রামাণ্য গ্রন্থ ‘আউর মুন হ্যাভ ব্লাড ক্লট’ বইটিতে উল্লেখ করেছেন,১৯৮৯ সালের ১৪ অক্টোবর ঈদ-এ-মিলাদ-উন-নবি অর্থাৎ হজরত মুহাম্মদের জন্মদিনের দিন উপলক্ষে শ্রীনগরের বাদশা চকে এক বিরাট জমায়েত হয়। মিছিল করে আসা কট্টরবাদীরা চিৎকার করে স্লোগান দিতে থাকেন “‘Yahan kya chalega? Nizam-e-Mustafa, La sharqiya la garbiya, Islamia, Islamia”। [What will work here? The rule of Mustafa. No eastern, no western : only Islamic, only Islamic’] সেইদিন থেকেই শুরু হয়ে যায় হামলা। একটানা বিস্ফোরণে কেঁপে উঠতে থাকে উপত্যকা। ডিসেম্বর কংগ্রেসের মুফতি মহম্মদ সঈদ দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর শুরু হয় ভয়াবহ হিন্দুবিরোধী দাঙ্গা। মুফতির কন্যা রুবিয়াকে ‘অপহরণ’ করে হামিদ শেখ সহ পাঁচ কুখ্যাত জঙ্গিকে ছাড়িয়ে নেয় পরের বছর থেকে পন্ডিতদের ধরে ধরে হত্যা করা শুরু হয়। সমস্ত সরকারি সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়। ১৯৯০ এর ১৯শে জানুয়ারি উপত্যকার আকাশ বাতাস ধ্বনিত হয়ে ওঠে, “নারা এ-তকবির, আল্লা হো আকবর”। ইসলামে কাফেরদের বিরুদ্ধে চরম জিহাদের ডাক। তাঁরা চিৎকার করে বলতে থাকেন।

‘কাশ্মীরি পন্ডিত নেটওয়ার্ক’ নামক কাশ্মীরি পন্ডিতদের নির্মিত একটি ওয়েবসাইটে (ikashmir.net) এবিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানে প্রশিক্ষিত মুসলিম জঙ্গিরা সন্ত্রাস, হত্যা, ধর্ষণ, লুন্ঠন ও অগ্নিসংযোগ শুরু করে। লোহার তার দিয়ে শ্বাসরোধ করে, গরম লোহার ছেঁকা দিয়ে, ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে, জীবন্ত পুড়িয়ে, জলে ডুবিয়ে, জীবন্ত শরীরের অঙ্গ উপড়ে ফেলে হত্যালীলা চলে। সঙ্গে উৎসব পালন। বহু মৃতদেহ টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়, সৎকার পর্যন্ত করতে দেওয়া হয়নি। উপত্যকা থেকে বিতাড়িত হন ৩ লক্ষ ৫০ হাজার কাশ্মীরি পন্ডিত, ওই এলাকায় হিন্দুদের ৯৯%। নিজের দেশের মাটিতেই তাঁরা শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেন দিল্লি, জম্মু প্রভৃতি স্থানে। সে শরণার্থী শিবিরেও অবর্ণনীয় কষ্টে মারা যান ৫ হাজার মানুষ। ১ হাজার মানুষ মারা যান হিট-স্ট্রোকে। সাপের কামড়ে, হার্ট অ্যাটাকে, মানসিক আঘাতে, টাইফয়েড, গ্যাসট্রোএন্টেরাইটিসের মহামারিতে প্রাণ হারান আরও বহু মানুষ। ধ্বংস করা হয় ২০ হাজার ঘরবাড়ি, ১৪,৪৩০ টি ব্যবসাকেন্দ্র, ১০৩ টি মন্দির ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ১৯৫ টী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেখানে গড়ে দখল হয়ে যায় জমি-বাড়ি-সম্পত্তি। কৃষি উদ্যানের ওপর নির্ভরশীল ১২,৫০০ মানুষের সর্বস্ব দখল করে নেওয়া হয়।

সমগ্র ঘটনায় রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকার – উভয়েরই ভূমিকা ছিল হয় নীরব দর্শক না হয় প্রচ্ছন্ন মদতদাতার। এবং প্রায় কোনোক্ষেত্রেই অপরাধীদের কোনো শাস্তি হযনি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলি বিষয়টি ছিল উদাসীন। রাহুল পন্ডিতার বইটিতে কাশ্মীরের ‘এথনিক ক্লিন্সিং’ সংক্রান্ত বেশ কিছু তথ্য রয়েছে। যেমন ১৯৪১ এর জনগণনায় ১৫% জুড়ে থাকা কাশ্মীরি পন্ডিতদের সংখ্যা ১৯৮১ তে ৫% এ নেমে আসে। ২০১১ এ উপত্যকায় মাত্র ২৭০০ থেকে ৩৪০০ পন্ডিত অবশিষ্ট ছিলেন, যা জনসংখ্যার ০.০২% মাত্র । অপরদিকে সংখ্যালঘু তকমা পাওয়া মুসলিমরা ১৯৮১ তে ৬৪.২% থেকে ২০১১ তে উঠে আসেন ৬৮.৩% এ। কাশ্মীরের ঘটনা সাম্প্রতিক ভারতের বৃহত্তম ‘এথনিক ক্লিন্সিং’ বা জাতিগত নির্মূলকরণের দৃষ্টান্ত।অথচ সুশীল সমাজের বামপন্থী অংশ, জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের মত সোভিয়েত ভাবধারা তথা তহবিলে গড়ে ওঠা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বুদ্ধিজীবীগণ ও বামপন্থী গণমাধ্যম সমস্বরে এমন ধারণা প্রচার করতে থাকে যে কাশ্মীর কোনোকালেই ভারতের অংশ ছিল না। বরং ১৯৪৭ সালে সর্দার বল্লভভাই পটেল বলপূর্বক একে দখল করেন। যুক্তি হিসেবে তাঁরা মূলতঃ কাশ্মীরে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিষয়টি বারে বারে তুলে ধরতেন। দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর এই ধারাবাহিক আক্রমণ আবার নতুন করে আরেকটি দ্বিজাতিতত্বের বিতর্ক সৃষ্টি করে।

কূটনীতি বা সামরিক শক্তির সাহায্যে কাশ্মীরকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব না হওয়ার পর বিকল্প উপায় হিসেবে বেছে নেওয়া হল সন্ত্রাসের পথ। একটা সময়ে এই সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছিল জম্মু-কাশ্মীর। ভারতের বর্তমান নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল একবার হিন্দুস্থান টাইমস পত্রিকায় দেশকে সতর্ক করে দিয়ে লিখেছিলেন “ইসলামী জিহাদের ফলে ভারতের ৭০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন, হত্যা করা হয়েছে ১১ হাজার সেনাকে। ৫ লক্ষ কাশ্মীরী হিন্দু স্বদেশে উদ্বাস্তু ত্রাণশিবিরে বাস করছে। ২৪,৫০০ ভাড়াটে জেহাদী এসেছে দেশের রক্ত চুষে নিতে।” (১১/০৯/২০০৭)।সাউথ এশিয়া টেররিজম পোর্টালের তথ্য অনুযায়ী ২০০০ থেকে ২০২২ এর জুলাই অবধি ইসলামিক জিহাদী হানার ফলে জম্মু ও কাশ্মীরের মোট ১১,৮৪১ টি প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।অথচ কাশ্মীরি পন্ডিতদের ওপর অকথ্য অত্যাচার বামেদের প্রচারযন্ত্রের হয়ে ওঠে ‘ভূমি সংস্কার’, আতঙ্কবাদ হয়ে ওঠে ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’।

ভারতের স্বাধীনতা পরবর্তী বেশ কয়েকটি দশক জুড়ে বাম ও ইসলামের আঁতাত বেশ কয়েকটি দেশের শাসনক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার সীমা মানচিত্র থেকে বেরিয়ে আমরা চোখ রাখতে পারি সোমালিয়া, লিবিয়া, প্যালেস্টাইনে। তারপর সময়ের ক্রমপঞ্জী অনুসরণ করে ইরান ও আফগানিস্তান।সোমালিয়ার কথা বলতে গেলে উল্লেখ করতেই হয় সিয়াদ বারে’র নাম, যিনিজেন্ডারমেরির একজন মেজর জেনারেল থেকে ১৯৬৯ সালে সেনা অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে সোমালিয়ার তৃতীয় রাষ্ট্রপতি হন ও ১৯৯১ অবধি সে পদে বহাল থাকেন। বারের অধীনে সুপ্রিম রেভল্যুশনারি কাউন্সিল সামরিক জান্তা সোমালিয়াকে একটি একদলীয় মার্কসবাদী-লেনিনবাদী কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হিসাবে পুনর্গঠন করে। তাঁর সামরিক শাসনকালে ১৯৭৬ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার ছত্রছায়ায় গঠিত সোমালি রেভেলিউশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টি রাষ্ট্রের সরকারি রাজনৈতিক মতাদর্শের সাথে সরকারি ধর্ম ইসলামের সমন্বয়ের চেষ্টা হয়। সোমালিয়ায় ওঠে সম্পূর্ণ সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত পুতুল রাষ্ট্র।

এরপরের নামটি লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মর গদ্দাফি। এমন এক নাম, যা দীর্ঘ চার-চারটি দশক ওই দেশটির সাথে সমার্থক ছিল বলা চলে। কারণ এইবিপ্লবী নেতা ১৯৬৯ সালে সেনা অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে ২০১১ তে বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হওয়া পর্যন্ত ছিলেনলিবিয়ার একচ্ছত্র অধিপতি। সেদেশে আরব জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র, আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ ইত্যাদির মিশেলে তৈরি নিজস্ব ‘থার্ড ইন্টারন্যাশনাল’ তত্ত্বের ভিত্তিতে তিনি ‘গ্রেট সোশ্যালিস্ট পিপলস লিবিয়ান আরব জামাহিরিয়া’ নামক সরকার গঠন করেন। প্যান আরবিজ়ম দ্বারা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত এই তত্ত্বের বিবরণ লিখিত হয় তাঁর রচিত’ গ্রিন বুকে’যার বিষয়বস্তু শিশুশ্রেণী থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর অবধি সমস্ত ছাত্রছাত্রী তথা দেশের সব নাগরিকের অবশ্যপাঠ্য ছিল। আইন ব্যবস্থা হিসেবে দেশে কায়েম করেন শরীয়া। উল্লেখ্য এই ‘জামাহিরিয়া’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ জন্যগণের সরকার হলেও তিনিই ছিলেন সে সরকারের সর্বাধিনায়ক। গ্রিন বুকে তিনি ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের ‘প্রিন্সিপল্স অফ কমিউনিজ়মে’র অনুকরণে অর্থ ও মুনাফার বিলোপেরও উল্লেখ করেন।

এরপর চলে আসা যাক ইয়াসের আরাফতের নেতৃত্বাধীন প্যালেস্টাইনে।১৯৬৯-২০০৪ অবধি প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (PLO) চেয়ারম্যান আরাফত জীবনের শেষ দশ বছর প্যালেস্টাইন ন্যাশনাল অথরিটির প্রেসিডেন্টের পদে ছিলেন এবং আমৃত্যু নেতৃত্ব দেন ফাতাহ দলের। এই নোবেল শান্তি পুরষ্কার বিজয়ী মতাদর্শের দিক থেকে ছিলেন আরব জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী।

এর পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহের জন্য আমাদের যেতে হবে সত্তরের দশকের ইরানে। সেখানে দুজন ব্যক্তির ভূমিকা এক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। প্রথমজন আলি আহমেদ এবং দ্বিতীয়জন মহম্মদ নখশব। ইরানি গ্রন্থকার, দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানী ও নৃতাত্ত্বিক আলি আহমেদ ছিলেন পশ্চিমী সভ্যতার কঠোর সমালোচক। তিনি ফরাসি দার্শনিক ফ্রান্জ় ওমর ফ্যানন ও কার্ল মার্ক্সের মতাদর্শের সমন্বয়ে এক বিশেষ ধারণাকে জনপ্রিয় করে তোলেন, যার নাম গর্বজ়াদেগি (gharbzadegi) অর্থাৎ পাশ্চাত্য সভ্যতার সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর প্রভাব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অল্পকাল পরেই তিনি তাঁর রাজনৈতিক গুরু খলিল মালেকির সঙ্গে কমিউনিস্ট টুড়ে পার্টিতে যোগ দেন। পরবর্তীকালে পৃথক সমাজতন্ত্রী দল গড়েন। আবার ১৯৬৩ সালে কট্টরপন্থী ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লা খোমেইনির সময়ে তিনি জাতীয় নীতির পরিবর্তনে সে ধর্মীয় নেতৃত্বকে সমর্থন করেন।

অপরদিকে ইরানি অধ্যাপক ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক ইতিহাসের গবেষক এরভান্দ আব্রাহামিয়ানের ‘ইরান বিটউইন টু রেভেলিউশানস’ থেকে জানা যায়, মহম্মদ নখশব ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি শিয়া ইসলাম ও ইউরোপীয় সমাজতন্ত্রের মিলন প্রথম ঘটান। ইরানি পন্ডিত নকশবের আন্দোলন এই যুক্তির উপরে ভিত্তি করে ছিল যে ইসলাম এবং সমাজতন্ত্র উভয়ই সামাজিক সমতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার অর্জন করতে চায়। ন্যায়শাস্ত্রের তাঁর অর্জিত স্নাতক ডিগ্রির গবেষণাপত্রে তিনি এই বিষয়ে উল্লেখ করেন। ১৯৪৩ সালে নখশব ‘মুভমেন্ট অফ গড-ওয়ারশিপিং সোশ্যালিস্ট’ নামে এক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। যে ছয়টি সংগঠন মিলে ইরানের ন্যাশনাল ফ্রন্ট গঠন করেছিল, তাদের মধ্যে এটি ছিল অন্যতম। এর আদর্শ ছিল ধর্মীয় আনুগত্য, ইসলামিক জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা।

১৯৫৩ সালে মোহাম্মদ মোসাদ্দেঘের ন্যাশনাল ফ্রন্ট-নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের পর ইরানে ইসলামী সমাজতন্ত্র আরো নাটকীয় মোড় নেয়। গড়ে ওঠে ‘অর্গানাইজেশন অফ স্ট্রাগল ফর দ্য ইম্যানসিপেশন অফ দ্য ওয়ার্কিং ক্লাস’ বা ‘পেকার’ নামক এক কট্টর কমিউনিস্ট সংগঠন যা মার্ক্সিস্ট মোজাহেদিন নামেও পরিচিত ছিল। এটি ছিল ইরানের ‘পিপলস মোজাহেদিন অফ ইরানে’র (PMOI/MEK) থেকে বিচ্ছিন্ন একটি দল ছিল। এমনকি এর সদস্যরা এমন কথা ঘোষণা করে দেন যে তাঁরা শুধুমাত্র মার্কসবাদ-লেনিনবাদেই বিশ্বাস করেন, আর কিছুতে নয়। একসময়ে এই পেকারকে ইরানি কমিউনিস্টদের মধ্যে সবচেয়ে চরমপন্থী মনে করা হত। এর সাথে যুক্ত হয়, ইরানি সমাজবিজ্ঞানী আলি শরিয়তির নেতৃত্বে দেশের জনমানসে ‘ইসলামি মার্কসবাদে’র প্রয়োগ। এই শরিয়তিকে বলা হয় ইসলামিক বিপ্লবের পথিকৃত। পেকারের সক্রিয়তা, শরিয়তির প্রভাব ইরানের শাহ সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ইরানের বিপ্লব সূচিত হয়। এরই ফলশ্রুতিতে বেশ কিছু ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৭৯ সালে পাহলভি সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। মোহাম্মদ রেজা পাহলভির রাজতন্ত্র প্রতিস্থাপিত হয় ধর্মীয় নেতা রুহুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ধর্মতান্ত্রিক সরকার দ্বারা।

সময়ের সারণী বেয়ে ইরান থেকে আমাদের আবার ফিরে আসতে হবে দক্ষিণ এশিয়ার আফগানিস্তান। সেখানে ১৯৭৮ সালের ২৭-২৮ শে এপ্রিল নূর মহম্মদ তারাকি, হাফিজুল্লা আমিন ও বাবরাক কার্মালের নেতৃত্বে ‘সাওর বিপ্লবে’র মাধ্যমে ২০০০ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে ক্ষমতায় আসে মার্ক্সবাদী ‘ পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান’। সোভিয়েতের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় ক্ষমতাসীন হওয়ার পরেই পিডিপিএ সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি চালু করে। ঐতিহ্যবাহী সবুজ ইসলামি পতাকার বদলে সোভিয়েত ইউনিয়নের আদলে লাল রঙের পতাকার ব্যবহার শুরু হয়। দেশে শুরু হয় কঠোর নির্যাতন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্নেট রুবিন তাঁর’ দ্য ফ্র্যাগমেন্টেশন অফ আফগানিস্তান’ গ্রন্থে লেখেন, “Khalq used mass arrests, torture, and secret executions on a scale Afghanistan had not seen since the time of Abdul Rahman Khan, and probably not even then”। উল্লেখ্য খালাক ছিল পিডিপিএ’র প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদক তারাকির নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী গোষ্ঠী।

বিরুদ্ধ মতকে দমন করতে কমিউনিস্টরা দেশে ব্যাপক হারে গণহত্যা শুরু করে। রবার্ট ডি কাপলানের’ সোলজার্স অফ গড: উইথ ইসলামিক ওয়ারিয়র্স ইন আফগানিস্তান অ্যান্ড পাকিস্তান গ্রন্থে এই প্রসঙ্গে বলেছেন, “The soldiers’ knock on the door in the middle of the night, so common in many Arab and African countries, was little known in Afghanistan, where a central government simply lacked the power to enforce its will outside of Kabul. Taraki’s coup changed all that. Between April 1978 and the Soviet invasion of December 1979, Afghan communists executed 27,000 political prisoners at the sprawling Pul-i-Charki prison six miles east of Kabul.” এই বিপ্লবের পর থেকে দেশে যে দীর্ঘমেয়াদী অশান্তি ও অস্থিরতা সৃষ্টি হয় তা আজও অব্যাহত।এবং ওপরোক্ত দেশগুলির প্রায় প্রতিটির ক্ষেত্রেই এক সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যর্থতা। বামপন্থা ও ইসলামের এই মিশ্রণ প্রায় কোনোখানেই স্হায়ী শান্তি ও সম্প্রীতি, সুস্হিত বিকাশ বা আর্থ-সামাজিক সম্বৃদ্ধির দিশাদেখাতে সফল হয় নি।

পরিশেষে আবার আমরা সেই ভারতবর্ষেই ফিরে আসি যেখানে থেকে এই আলোচনা শুরু। কারণ এই বিষয়টি এদেশে কখনই প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি।১৯৪৬-৫১ এই সময়কালে তেলেঙ্গানায় কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে সংঘটিত সশস্ত্র সংগ্রাম কৃষক অভ্যুত্থানের সঙ্গে অনেক ২০০৯ সালে পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্যের জন্য আন্দোলনের তুলনা করে থাকেন। ১৯৪৮ সালে মজলিস-এ-ইত্তেহাদুল-মুসলিমিনেল প্রতিষ্ঠাতা (বর্তমানে AIMIM) কাশিম রাজভি’র রাজাকার নামক সশস্ত্র মুসলিম মিলিশিয়ার দ্বারা হায়দরাবাদকে পাকিস্তানে যুক্ত করার মরিয়া চেষ্টাও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য এক দৃষ্টান্ত। তেলেঙ্গানা ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত তৎকালীন হায়দরাবাদ প্রদেশের অংশ ছিল।২০১৭ সালের হিসেবে ১ কোটি সদস্য বিশিষ্ট হায়দরাবাদ-ভিত্তিক এই এ.আই.এম.আই.এম দলটির তেলেঙ্গানা ও মহারাষ্ট্রেও উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি আছে। হাতে আছে দুটি লোকসভা ও ১২ টি বিধানসভা আসন। এই দলটি ভারতের মুসলিমদের জন্য বারংবার সার্ভভৌম অধিকারের দাবী তুলছে। তাঁদের মতে ভারতবর্ষ যে এখনও হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ – এটাই নাকি মুসলিমদের প্রতি একপ্রকার অন্যায়। তাঁর মতে আসামের অনুপ্রবেশকারী পাকিস্তানীরা নাকি আদতে ভারতীয়। এবং বিহার ও পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করা বেআইনি বাংলাদেশী মুসলিমদের নাগরিকত্ব দেওয়ারও দাবি তুলেছেন তাঁরা।

মৌদুদির প্রতিষ্ঠিত জামাত-এ-ইসলাম ১৯৭১ এর বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত হিন্দু গণহত্যায় সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল। ২০১৩ সালে সেদেশে ৭১’র যুদ্ধাপরাধীদের সাজা ঘোষণা হলে এই সংগঠনের ভারতীয় শাখা ওই অপরাধীদের কার্যকলাপকে নেহাতই রাজনৈতিক মতানৈক্যজনিত বলে অভিহিত করে সংশ্লিষ্ট বন্দীদের মুক্তির দাবি তোলেন। কেরলে এই সংগঠনের তরফে’ মধ্যমম’ নামক একটি গণমাধ্যম সংস্থা গঠিত হলে সেরাজ্যের বামপন্থীদের মধ্যে তাঁদের পত্রিকায় লেখার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। কেরলের রাজ্য বোর্ডের প্রাক্তন ভাইস-চেয়ারম্যান ও প্রসিদ্ধ তাত্ত্বিক বাম নেতা প্রভাত পট্টনায়েক এই সমকালীন ইসলামিক মৌলবাদকে ‘সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী’ ও ‘ভোগবাদ বিরোধী’ ইত্যাদি বলে অভিহিত করেন। এই সংগঠনটি থেকেই পরবর্তীকালে স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট্স অফ ইন্ডিয়া বা সিমি নামক সংগঠন তৈরি হয়। পরে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের জন্য সেটি নিষিদ্ধ হয়। ২০০০ সালে ‘ওবেইদুল্লাহ প্ল্যান’ ফের নতুন রূপে সক্রিয় হতে শুরু করে। ভারতের প্রতি রাজ্যে তাঁদের শাখা গড়ে ওঠে যারা একদিকে কট্টর দেশবিরোধী মনোভাব ও অপর দিকে ইসলামিক মৌলবাদের ব্যাপক প্রসার ঘটাতে থাকে। পরে এই সব সংগঠন মিলিত হয়ে গঠিত হয় পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া নামক আরেক মৌলবাদী জঙ্গি সংগঠন।

দেশের একমাত্র কমিউনিস্ট সরকারের শাসনাধীন রাজ্য কেরলে ভীষণভাবে সক্রিয় জামাত ই-ইসলামী হিন্দ, পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া (পি.এফ.আই), মুজাহিদ প্রভৃতি সংগঠনগুলি। তারা আই.আই.টি, বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ, কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ন্যাশনাল ল স্কুল ইত্যাদি ভারতের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিস প্রভৃতি উচ্চ সরকারি পদে নিজেদের সম্প্রদায়ের লোক ঢোকানোর জন্য ক্যারিয়ার গাইডেন্স প্রোগ্রাম ও প্রি-অ্যাডমিশন সাপোর্টের ব্যবস্থা করছে। মুসলিম শিক্ষক ও ছাত্র নেতারা এই কাজের জন্য সারা দেশ চষে ফেলছেন। বিভিন্ন আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করছেন। নিজস্ব হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে দ্রুত যোগাযোগ বজায় রাখছেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে পি.এফ.আই এর মত সংগঠনের সদস্যসংখ্যা ৫ লক্ষের বেশি।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স দুজন মুসলিম পি.এফ.আই জঙ্গিকে শক্তিশালী বিস্ফোরক সমেত গ্রেফতার করেছিল। তারা ১৭ই ফেব্রুয়ারি এই সংগঠনটির প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে সিরিয়াল ব্লাস্টের পরিকল্পনা করেছিল। এবং ২০২২ সালের ১৪ ই জুলাই বিহার পুলিশের হাতে পাটনা থেকে গ্রেফতার হওয়া এই সংগঠনের দুই মুসলিম সদস্যের কাছ থেকে একটি গোপন নথি উদ্ধার হয়েছে, যেখানে ভারতবর্ষকে ২০৪৭ সালের মধ্যে ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করার পরিকল্পনা আছে। দেশের বিভিন্ন এক্সিকিউটিভ, জুডিশিয়ারি, পুলিশ ও আর্মি প্রভৃতি ক্ষেত্রে নিজেদের অনুগত লোক ঢুকিয়ে, আর.এস.এসের মত সংগঠনের সাথে জনজাতিভুক্ত মানুষের বিভেদ সৃষ্টি করে ও তুরস্কের মত বিদেশি শক্তির সাহায্যে দেশের মাত্র ১০% মুসলিমের সাহায্যেই তারা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে সফল হবে বলে সেখানে ঘোষণা করা হয়েছে। ধৃতদের একজন মুসলিমদের মার্শাল আর্ট শেখানোর আড়ালে তলোয়ার ও ছুরি চালানো শেখাত। কিছুদিন আগে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম ছাত্রদের নাগরিকত্ব আইন বা সি.এ.এ বিরোধী আন্দোলন যথেষ্ট অশান্তি সৃষ্টি করেছিল। এরপর ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেটিভ এজেন্সির তরফে ২০২২ সালের ২২ এবং ২৭শে সেপ্টেম্বর এই দুটি দিনে দেশের ১৫টি রাজ্যের ৯৩ টি স্হানে ব্যাপক হারে তল্লাশি অভিযান চলে, যার নাম ছিল অপারেশন অক্টোপাস। পি.এফ.আই এর রাজনৈতিক সংগঠন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অফ ইন্ডিয়ার ৮০ জন সদস্যসহ ৩৫০ এর বেশি ব্যক্তি গ্রেফতার হন।ভারত সরকারের নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের (CAA) বিরোধিতায় দেশের ইসলামিক ও বামপন্থী শক্তিগুলির একত্রিত আন্দোলনের নামে দাঙ্গা, অগ্নিসংযোগ ও বিভিন্ন হিংসার ঘটনা সাক্ষী থেকেছে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়। খোদ রাজধানীর বুকে শাহীনবাগে ধ্বনি উঠেছে ‘জিন্নাওয়ালি আজ়াদির’।

ভারতবর্ষের ইতিহাসে যেমন বহিঃশত্রুর আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে তেমনই রয়েছে দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে দেশেরই কিছুসংখ্যক মানুষের মাতৃভূমির বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার প্রচুর উদাহরণ। এবং জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের পথ ধরে স্বাধীনতা অর্জন ও তার পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের গঠন ও বিকাশে এবং দেশের সহস্রাব্দ প্রাচীন সংস্কৃতি তথা ভারতবাসীর যথার্থ আত্মপরিচয় রক্ষার ক্ষেত্রে এই আভ্যন্তরীণ শক্তিগুলি প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেখা দেয়। বিগত শতকের প্রথমার্ধে গড়ে ওঠা বাম ও ইসলামিক শক্তির রাজনৈতিক রসায়ন ও মতাদর্শগত সমন্বয় এর প্রকৃষ্টতম উদাহরণ বলা যেতে পারে। সেই সময় থেকে শুরু করে একেবারে আজকের দিনে দাঁড়িয়েও এই দুই শক্তি একে অপরের পরিপূরক, কিম্বা বলা যেতে পারে একই মুদ্রার দুই পিঠ হিসেবে কাজ করে চলেছে।তাই আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যখন ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লিঘ বা জম্মু কাশ্মীর ন্যাশনাল কনফারেন্সের মত ইসলামিক দলের সঙ্গে সিপিআইএলএল, সিপিএম, সিপিআই, সমাজবাদী পার্টি সহ তাবৎ বামপন্থী দল একজোট হয়ে রাষ্ট্রবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেয় তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।

চিত্র ঋণ – Citti Media

(সমাপ্ত)

 

লেখক পরিচিতি – পদার্থবিদ্যায় স্নাতক আর বিজনেস ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। তৎসহ ইলেকট্রনিক্স ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক স্তরের ডিগ্রিও। আর তথ্য প্রযুক্তি নিয়ে নানা পড়াশোনা। স্কুল ও কলেজের শিক্ষকতাসহ সরকারি-বেসরকারি নানা চাকরি করার সুযোগ হয়েছে। তবে কাজের বিষয় প্রায় সবক্ষেত্রেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক কিংবা নিরস প্রশাসনিক বিষয় সংক্রান্ত। ছোটোবেলা থেকেই লেখার অভ্যেস। বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতি। লিখেছেন ফিকশন ও নন-ফিকশন দুধরণের লেখাই। ইতিমধ্যে আরও দুটি বই প্রকাশিত, সর্বশেষটি ইংরেজিতে। কলকাতার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন শহরে বাংলা পত্রিকা ও লিটল ম্যাগাজিনেও নিয়মিত লেখেন।