ঐতিহাসিক বিচারে সময়টা তখন সনাতনী রাজন্যবর্গের শাসনামল। ভারতের দিকে তখনও মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামিক দস্যুদের শ্যেনদৃষ্টি পড়েনি। কিন্তু ভারতবর্ষের আত্মা, সনাতন আর্য ধর্মরূপ নদী তখন একদিকে যেমন জটিল বাহ্যানুষ্ঠানের পঙ্কে যুগের বহমানতা হারাচ্ছে, অপরদিকে সেই নদীর উপর আকাশচুম্বী বাঁধ গড়ে সাধারণের কাছে তাকে অত্যাচারের শৈবালাকীর্ণ বদ্ধ জলাশয়রূপে জনসাধারণের সামনে তুলে ধরছে নব্য ধর্মপ্রচারকগণ। তুলবে না’ই বা কেন? যে ধর্মে বিপ্রের অন্তর্দৃষ্টি নাই, রাজার পালকবুদ্ধি নাই, বণিকের বাণিজ্যে স্বাধীনতা নাই, শুদ্রের তো বাঁচার অধিকারই নাই, সেই ধর্মের অনুসরণের চেয়ে মরে যাওয়া ভাল। এমত বিশৃঙ্খল অবস্থায় সনাতন আর্য সিদ্ধান্ত যখন গুহাকন্দরে গুপ্ত, তেমনই বিন্ধ্যাঞ্চলের এক গুহাকন্দরে যুগ যুগ ধরে সমাধিতে মগ্ন মহর্ষি বেদব্যাসের পরম্পরাভুক্ত গুরু গোবিন্দপাদকে উদ্বোধিত করার কঠিন প্রয়াস করে চলেছেন সুদূর কেরলদেশ থেকে আগত মাত্র নয় বৎসরের প্রবজ্যাব্রতী শিশু। কে এই শিশু? ইনিই এই কলিকালের সর্বপ্রথম জগদ্গুরু শিবাবতার আচার্য শঙ্কর, যিনি ভারতের বুক থেকে অবলুপ্ত হতে বসা সনাতন বৈদিক আর্য সিদ্ধান্তকে পৃথিবীতে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করেন। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবেনা যে মহর্ষি ব্যাসের পর বেদাদি শাস্ত্রকে যুগের নিরিখে বিচার করতে তিনিই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এবং বহু সম্প্রদায় ও শাখায় বিভক্ত হিন্দু সমাজকে অদ্বৈতবাদের ঐক্যমন্ত্রে গ্রথিত করার চেষ্টা করেন।
আচার্য শঙ্করের পূর্বে এমন কোনো আচার্যের মুখে হয়তো ত্যাগের মন্ত্র শোনা যায়নি। আচার্য হয়তো ধ্যানযোগে উপলব্ধি করেছিলেন যে সত্য ত্রেতা দ্বাপরে ধর্মের জয়ধ্বজা যে গৃহস্থ ঋষিগণের মাধ্যমে বাহিত হয়েছিল, তার দিন ফুরিয়েছে এবং ভাবীকালে মানুষের স্বার্থের সংঘাতে সংকীর্ণ হয়ে যাওয়া দৃষ্টিকোণ হয়তো সনাতন ধর্মকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অগ্রসর হবেনা। তাই তখন দরকার হল কিছু নিঃস্বার্থ জ্ঞানতাপসের, যাঁরা তত্ত্বোপলব্ধি এবং ধর্মরক্ষাকেই জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য করবে। নানা শাস্ত্র অধ্যয়ন করে শঙ্কর উপলব্ধি করেন যে, হিন্দু ধর্ম ও তার অনুসারী সমাজকে ভিত দিতে গেলে দরকার বেদের ভিত্তি, জীবন দর্শনের জন্য চাই বেদান্ত অর্থাৎ উপনিষদীয় চেতনা, ঐশ্বরিক কৃপাপ্রাপ্তির জন্য চাই সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব বিস্মৃত পঞ্চদেবোপাসনা, সার্বিক সম্বৃদ্ধির জন্য দরকার তন্ত্র-অনুমোদিত শ্রীবিদ্যা সাধনা এবং সমগ্র সমাজের রক্ষার দায়িত্ব নেবে মোক্ষমার্গী স্বার্থশূণ্য সন্ন্যাসী। আচার্য সন্ন্যাসের অর্থই দিলেন পাল্টে। সন্ন্যাস যে বৃদ্ধাবস্থার কর্ম নয় বা জপতপ ছাড়া সমাজরক্ষাও যে সাধন-অঙ্গ, আচার্য সমাজকে সেই বার্তা দেন। গুরু গোবিন্দপাদের থেকে ব্রহ্মবিদ্যা লাভের পর অদ্বৈত মতকে প্রতিষ্ঠা করতে সর্বপ্রথম তিনি বেছে নেন কাশীধামকে। সেখান থেকে ঐশী নির্দেশে ভগবদ্পাদ হিমালয়ের কোলে পৌঁছে গিয়ে নিভৃতে রচনা করলেন বেদান্তভাষ্য, যা সনাতন ধর্মাবলম্বীকে প্রদান করে নূতন জীবনদর্শন এবং তারপর সেই দর্শন সারা ভারতব্যাপী প্রচার করে করেন দিগ্বিজয়।
সারা ভারতের পণ্ডিতবর্গ, রাজন্যবর্গকে এক অদ্বৈত মন্ত্রে দীক্ষিত করে গড়ে তোলেন নতুন সনাতন আর্য সমাজ, সৃষ্ট হল নতুন ধর্মীয় শাসনতন্ত্র। সাধুসমাজকে দশনামী সম্প্রদায়ে সুসজ্জিত করে ভগবদ্পাদ দায়িত্ব প্রদান করলেন ধর্মের এক এক দিক সংরক্ষণের। ভারত তথা সমগ্র জম্বুদ্বীপে এই শাসনকে রক্ষা তথা চতুর্বেদের সংরক্ষণের জন্য ভগবদ্পাদ তাঁর চার সন্ন্যাসী শিষ্যের নেতৃত্বে তথা আচার্যত্বে স্থাপন করে দিলেন ভারতের চারপ্রান্তে চতুরাম্নায় মঠ। এই মঠগুলি আজও করে চলেছে ধর্মরক্ষা এবং শাস্ত্র সংরক্ষণের কাজ। ইতিহাস বলে, সুলতান যুগের অবসানে মোঘল আমলে, হিন্দুধর্মের রক্ষণে তাঁর প্রবর্তিত এই দশনামী সম্প্রদায়ের আচার্যগণ সর্বপ্রথম সাধুসমাজের সশস্ত্রীকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং গড়ে ওঠে নাগা বাহিনী। এই বিষয়ে এই বাংলায়, কলকাতার অদূরে জন্মগ্রহণ করা শঙ্কর পরম্পরার বিশিষ্ট আচার্য দণ্ডীস্বামী শ্রী মধুসূদন সরস্বতী ভগবদ্পাদের ভূমিকা অপরিসীম। কেবল ধর্মীয় নয়, ভারতের একাধিক সঙ্কটে শঙ্কর সম্প্রদায়ের মঠ আশ্রমগুলি মানবসেবার্থে অন্ন, বস্ত্র বা চিকিৎসার মত কাজে এগিয়ে আসে। বর্তমান পীঠাধীশগণের আনুকূল্যে আজও যেমন একদিকে বেদান্ত পঞ্চদশী, ব্রহ্মসূত্রটীকা, গীতার মত শাস্ত্র সংরক্ষিত হয়, বৈদিক গণিতের মত লুপ্ত হয়ে যাওয়া বিজ্ঞান কে পুনরায় তুলে ধরা হয়, আবার ভারতের মত আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া দেশে মানুষের স্বার্থে গড়ে ওঠে হাসপাতাল, বিদ্যালয়। চেন্নাইতে গড়ে ওঠা শঙ্কর নেত্রালয়, কাঞ্চীতে গড়ে ওঠা হাসপাতাল বা মধ্যপ্রদেশের নরসিংহপুর জেলায় গড়ে ওঠা নিঃশুল্ক বিদ্যালয়, বৃদ্ধাবাস, চিকিৎসালয়ের মত বহু উদ্যোগ ছড়িয়ে আছে সারা ভারতে। এছাড়াও ক্ষেত্রোন্নয়নের স্বার্থে বারবার খবর পৌঁছে যায় সরকারের কাছে, যার ফলে গড়ে ওঠে রাস্তাঘাট, পৌছোয় বিদ্যুৎ বা গড়ে ওঠে আর্থিক যোজনা। দুঃস্থ পরিবারের শিশুদের বিদ্যাদান, ক্ষুধার্তকে অন্নদান, কর্মহীনকে সমর্থ ভক্তদের আনুকূল্যে কর্মদানের মত বহু উন্নয়নমূলক কাজ হয় পীঠাধীশ, মহামণ্ডলেশ্বর বা মহন্তদের আনুগত্যে। বিদেশ থেকে আগত অনুসন্ধিৎসু বা স্বধর্মের জিজ্ঞাসুদের সনাতন সিদ্ধান্তকে বা দেবভাষাকে সঠিকভাবে পৌঁছে দেয় এই শঙ্কর মঠ। বর্তমানে ভারত সরকার যে যোগ তথা আয়ুর্বেদের প্রচার-প্রসারে উদ্যোগী, তা এই সন্ত-সমাজের অনলস প্রচেষ্টার ফল। কেবল তাইই নয়, ভারতীয় রাজনীতিতে আসা এক এক গুরুত্বপূর্ণ সময়কালে শঙ্কর মঠের আচার্যগণ গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশ করেছেন। আজও তীর্থসমুহের সংরক্ষণ বা সেখানকার দেবসেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে শঙ্কর মঠ। তাই সর্বশেষে বলাই যায়, ভারত রাষ্ট্রের বর্তমান গুরুপদের কর্ম করে চলেছে এই শঙ্কর মঠ।
— শ্রী নিত্যানন্দ তীর্থনাথ(ঋত্বিক হাজরা)
সম্পাদক, কামেশ্বরাঙ্কনিলয়া
( জ্যোতিষ্পীঠাধীশ্বর ও দ্বারকা শারদাপীঠাধীশ্বর জগদ্গুরু শঙ্করাচার্য স্বামী শ্রী স্বরূপানন্দ সরস্বতী মহারাজের আদেশানুসার জনগণের আধ্যাত্মিক উত্থানকল্পে প্রবর্তিত বাংলা মাসিক পত্রিকা )
এম. এ. (ইতিহাস), রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।
মাতৃসাধক, লেখক ও হিন্দুধর্মশাস্ত্র গবেষক।
অপূর্ব লেখনী। এই রকম আরো লেখায় সমৃদ্ধ হোক আপনার পত্রিকা। ধন্যবাদ।