সংস্কৃতি

শ্রী রঘুনাথ শিরোমণি –

– শ্রী শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন

 

[রঘুনাথ শিরোমণি চৈতন্যদেবের সমসাময়িক ছিলেন – খ্রীষ্টিয় পনেরো ও ষোল শতকের ব্যক্তি ছিলেন তিনি। তাঁহার বিদ্যাবত্তা ও প্রতিভা বঙ্গদেশ তথা ভারতবর্ষের গৌরবের বস্তু। অদ্বিতীয় নৈয়ায়িক পন্ডিত রঘুনাথ বাঙ্গালা দেশে নবদ্বীপে মধ্য ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করিয়া মিথিলার প্রতিপত্তি খর্ব করেন ও বাঙ্গালার মুখ উজ্জ্বল করেন। রঘুনাথের শৈশবের ও যৌবনের বুদ্ধিমত্তার কথা বাঙ্গালার ঘরে ঘরে প্রচলিত থাকিবার যোগ্য।]

রঘুনাথ তিন বৎসর বয়সে পিতৃহীন। ইঁহার পিতা অত্যন্ত দুঃখী ছিলেন, সুতরাং মৃত্যুর পর তিনি পরিবার-প্রতিপালনের জন্য কিছুই রাখিয়া যাইতে পারেন নাই। রঘুনাথের জননী, সন্তান-প্রতিপালনের কোনও উপায় না পাইয়া, ভিক্ষা-বৃত্তি অবলম্বন করিলেন। কিন্তু তাহাতেও তাঁহার চলিয়া উঠিল না। তখন তিনি টোলের (১) ছাত্রদের “পেটেলী” (২) অর্থাৎ দাসী-বৃত্তি করিতে লাগিলেন। ইহাতে রঘুনাথ ও রঘুনাথের জননীর অতিকষ্টে দিনপাত হইতে লাগিল।

রঘুনাথের বয়স যখন পাঁচ বৎসর, তখন একদিন তাঁহার মাতা আগুন আনিতে তাঁহাকে টোলে পাঠাইয়া দেন। টোলের একটি ছাত্র রাঁধিতেছিল। রঘুনাথ আগুন চাহিলে, সে হাতায় করিয়া আগুন লইয়া রঘুনাথকে বলিল, “ধর।” রঘুনাথ আগুন লইবার পাত্র লইয়া যান নাই। সুতরাং পড়ুয়া “ধর” বোলাতে তিনি বিপদে পড়িলেন; কিন্তু তৎক্ষণাৎ এক অঞ্জলি ধূলি লইয়া হাত পাতিলেন। ছাত্র রঘুনাথের ধূলিপূর্ণ হস্তোপরি আগুন দিল। রঘুনাথ আগুন লইয়া চলিয়া গেলেন।

ঐ টোলের অধ্যাপকের নাম বাসুদেব সার্বভৌম। তিনি বঙ্গদেশে সর্বপ্রথমে ন্যায়-শাস্ত্রের প্রচার করেন। বাসুদেব দাঁড়াইয়া রঘুনাথের এইরূপ উপস্থিত-বুদ্ধি দেখিলেন; দেখিয়া তিনি চমৎকৃত হইলেন। অধ্যাপক রঘুনাথের জননীর নিকট গিয়া তাঁহার পুত্রটিকে বিদ্যাশিক্ষা দিবার অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলেন। সার্বভৌম পুত্রের ভরণ-পোষণ করিবেন এবং তাঁহাকে বিদ্যাশিক্ষা দিবেন, এই আশায় রঘুনাথের জননী পুত্রকে তাঁহার হস্তে সমর্পণ করিলেন /বাসুদেবও রঘুনাথকে অতিযত্নে বিদ্যাশিক্ষা দিতে লাগিলেন।

রঘুনাথের বুদ্ধি অতিষ্ট তীক্ষ্ণ ছিল। ব্যাকরণাদি শাস্ত্রে তাঁহার অল্পদিনেই সম্যক বুৎপত্তি লাভ হইল। তিনি “ক”, “খ” পড়িতে আরম্ভ করিয়াই জিজ্ঞাসা করিলেন, “খ” আগে না হইয়া “ক” আগে হল কেন? সুতরাং বর্ণমালা-শিক্ষা আরম্ভ করিবার আগেই তাঁহাকে কি রীতিতে বর্ণমালার অক্ষরগুলি সাজানো হইয়াছে প্রভৃতি বিষয়ে ব্যাকরণ-শাস্ত্রের কতকগুলি বিচার, অধ্যাপককে বুঝাইয়া দিতে হইল। বাঙ্গালা বর্ণমালায় দুইটী “ন”, দুইটী “ব”, দুইটী “য”, তিনটী “শ” কেন আছে, রঘুনাথের হাতে-খড়ির সময়েই বাসুদেবকে সে -সকল কথা বুঝাইয়া দিতে হইয়াছিল। যাঁহাকে “ক”, “খ” পড়াইতে গিয়েই বর্ণের উচ্চারণ-স্থান প্রভৃতি ব্যাকরণের কঠিন কঠিন বিষয় বুঝাইয়া দিতে হয়, ব্যাকরণাদি শাস্ত্রে বুৎপত্তি লাভে তাঁহার বড় বেশী বিলম্ব হইবার সম্ভাবনা নাই।

রঘুনাথ ব্যাকরণ, সাহিত্য ও স্মৃতির (৩) কিয়দংশ পড়িয়াই ন্যায়-শাস্ত্র পড়িতে আরম্ভ করিলেন, এবং অল্পদিনের মধ্যে প্রচলিত অনেক গ্রন্থের দোষ দেখাইয়া দিতে লাগিলেন। সার্বভৌম, ছাত্রটি তাঁহার অপেক্ষা বড় পন্ডিত হইয়াছেন বুঝিয়া, পাঠ-সমাপ্তির জন্য তাঁহাকে মিথিলায় (৪) পাঠাইয়া দিলেন। তৎকালে মিথিলাই বিদ্যাচর্চার প্রধান স্থান ছিল, এজন্য মিথিলার পন্ডিতেরাই ছাত্রদিগকে উপাধি-দান (৫) করিতে পারিতেন। এই কেহ উপাধি দিলে তাহা গ্রাহ্য হইত না।

রঘুনাথ মিথিলা যাইবার সময় মনে-মনে সঙ্কল্প করিলেন যে, তিনি প্রত্যাগমন করিয়া বঙ্গদেশেই ছাত্রদিগকে উপাধি দিতে আরম্ভ করিবেন। তৎকালে মিথিলার পক্ষধর মিশ্র প্রধান পন্ডিত ছিলেন। তিনি সহস্রাধিক ছাত্রকে পাঠ দিতেন। রঘুনাথ পক্ষধর মিশ্রের টোলে পড়িতে আরম্ভ করিলেন। রঘুনাথের এক চোখ কাণা ছিল। এজন্য অন্যান্য ছাত্রেরা সর্বদা তাঁহাকে ব্যঙ্গ করিত। যাহা হউক, তিনি অল্পদিনের মধ্যেই পক্ষধর মিশ্রের প্রধান প্রধান অধ্যাপকদিগকে বিচারে পরাস্ত করিলেন; এবং তদনন্তর স্বীয় অধ্যাপকের সহিত-ই তাঁহার বিচার চলিতে লাগিল। পক্ষধর ছাত্রের বুদ্ধির প্রাখর্য দর্শনে মুগ্ধ হইয়া বলিয়াছিলেন যে, যদি পূর্ণচন্দ্রের কিরণ হইতে কিছু নির্মল বস্তু জগতে থাকে, তবে সে রঘুনাথের বুদ্ধি। তিনি বিচারে আপনার পরাজয় স্বীকার করিয়া, রঘুনাথকে ‘তার্কিক-শিরোমণি’ উপাধিতে ভূষিত করিয়াছিলেন। রঘুনাথের নিকট মিথিলার সর্বপ্রধান পন্ডিত পরাজয় স্বীকার করায়, তদবধি নবদ্বীপ হইতেই উপাধি-দানের সূত্রপাত হইল। বঙ্গদেশের ছাত্রেরা অন্য অন্য স্থানে অধ্যয়ন করিয়া পাঠ-সমাপন ও উপাধি-গ্রহণার্থে নবদ্বীপে আসিতে লাগিলেন। অদ্যাপি নবদ্বীপের এই সম্মান বজায় আছে। কিন্তু এই সমস্ত মহাসম্মানের মূল সেই ভিখারিণীর পুত্র রঘুনাথ।

রঘুনাথ মিথিলা হইতে নবদ্বীপে প্রত্যাগমন করিয়া টোল খুলিয়া দিলেন। তাঁহার এক কাঠা জমিও ছিল না, এবং ঘর করিবার একটি পয়সাও ছিল না। সুতরাং হরিঘোষ নামক এক গোয়ালার গোয়াল-ঘরে তাঁহাকে প্রথমে অধ্যাপনা আরম্ভ করিতে হইয়াছিল। অল্পদিনের মধ্যেই তথায় এত ছাত্র আসিয়া উপস্থিত হইল যে, তাহাদের কলরবে হাট বসিয়াছে বলিয়া বোধ হইত। এই জন্যই, যে বাড়ীতে অনেক লোক বাস করে, আজিও লোকে তাহাকে ‘হরিঘোষের গোহাল’ বলে।

রঘুনাথ ন্যায়-শাস্ত্রের যে-সকল টীকা ও গ্রন্থ রচনা করিয়া গিয়াছেন তাহা পূর্ববর্তী সমস্ত ন্যায়-গ্রন্থের টীকা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট হওয়ায়, এখন তাহাই প্রচলিত আছে। তিনি সব-শুদ্ধ ত্রিশখানি বৃহৎ বৃহৎ গ্রন্থ রচনা করেন। তৎপরবর্তী গ্রন্থকারেরা রঘুনাথের গ্রন্থের টীকা লিখিয়া আপনাদিগকে কৃতার্থ মনে করিয়া গিয়াছেন।

নবদ্বীপ একসময় বঙ্গদেশের রাজধানী ছিল, কিন্তু এখন সে রাজধানীর চিহ্ন-ও নাই; এখন সর্বদেশীয় পন্ডিতবর্গের মধ্যে নবদ্বীপ কেবল ন্যায়-চর্চার প্রধান স্থান বলিয়া প্রসিদ্ধ। সেই ন্যায়-চর্চার প্রধান প্রবর্তক রঘুনাথ।

যখন মনে হয়, এই রঘুনাথের মাতা, ভিক্ষা করিয়া পুত্রকে খাওয়াইতেন এবং দাস-বৃত্তি করিতেন, তখন বিদ্যাশিক্ষার যে কত গুণ, থা অনায়াসে বুঝিতে পারা যায়। দেখ, বিদ্যাশিক্ষা করাতেই, একজন ভিখারিণীর পুত্র, বঙ্গদেশের সর্বপ্রধান পন্ডিত বলিয়া জগতে চির-স্মরণীয় হইয়াছেন। যতদিন ন্যায়-শাস্ত্রের চর্চা থাকিবে, ততদিন কেহই তাঁহার নাম বিস্মৃত হইতে পারিবে না।

(১) টোল – প্রাচীন রীতিতে পরিচালিত সংস্কৃত বিদ্যালয়। ছাত্ররা টোলে বিনা বেতনে পাঠ করে ও বিনা ব্যয়ে বাসস্থান ও আহার পায়। ধনী লোকেরা বৃত্তি ও দান দিয়া অধ্যাপকদিগকে এই বিদ্যা-দান ও অন্নদান-কার্যে সাহায্য করেন। ‘টোল’ শব্দের অর্থ ‘টোলা’, টুলী বা পল্লী – ‘যেখানে বহুলোক সমবেত হয়’; বিশেষ অর্থে ‘ছাত্র-বহুল বিদ্যালয়’। অন্য নাম – ‘চতুস্পাঠী’ বা ‘চৌবাড়ী’।

(২) পেটেলী – ‘পাটিয়ালী’ শব্দ হইতে। যে ‘পাট’ করে অর্থাৎ গৃহ-মার্জন, জল-আহরণ প্রভৃতি নির্দিষ্ট কার্য সমাধা করে; ‘পাটিয়াল’ বা ‘পেটেল’ অর্থাৎ কৃতকর্মা ব্যক্তি, ভৃত্য; স্ত্রীলিঙ্গে, ‘পাটিয়ালী – পেটেলী’।

(৩) স্মৃতি – হিন্দু জাতির সাংসারিক, সামাজিক ও ধার্মিক জীবন পরিচালিত করিবার জন্য রচিত শাস্ত্রগুলিকে ‘স্মৃতি’ বলে।

(৪) মিথিলা – গঙ্গার উত্তরে বিহার প্রদেশের যে অংশ অবস্থিত তাহার নাম ‘মিথিলা’। এই অঞ্চলের ভাষার নাম ‘মৈথিলী’। বিদ্যাপতি কবি মিথিলার লোক ছিলেন। সংস্কৃতচর্চ্চার জন্য প্রাচীনকাল হইতে মিথিলার পন্ডিতদের খ্যাতি আছে।

(৫) উপাধি – এখনকার বি-এ, এম-এ ডিগ্রির মত, প্রাচীনকালে পাঠ সাঙ্গ হইলে অধ্যাপকেরা কৃতী ছাত্রদের ‘বিদ্যারত্ন, বিদ্যাসাগর, তর্করত্ন, সার্বভৌম’ প্রভৃতি উপাধি দিতেন। এ উপাধি পণ্ডিতদিগকে সমাজে প্রতিস্থাপন্ন করিত।

Comment here