বসুধা

তিকাল: পুড়ে যাওয়া মায়া সভ্যতা ও পিরামিড-মন্দির

-শ্রী সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়

 

নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রায় আধ পাতা জুড়ে এমন একটা খবর সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে যা বিশ্বের অন্যান্য তাবড় সংবাদমাধ্যম এড়িয়ে যেতে পারেনি। লিডার নামে অত্যাধুনিক লেজার প্রযুক্তির মাধ্যমে গুয়াতেমালার বৃষ্টিচ্ছায় অরণ্যে আবিষ্কৃত হয়েছে কমবেশি ৬১ হাজার স্থাপত্য যা মায়া সভ্যতার সাক্ষ্য বহন করে। মুদ্রায় প্রাচীন সভ্যতার এই পর্বে সেই গুয়াতেমালায় মায়া সভ্যতার অবশেষ।

লিডার (LiDAR লাইট ডিটেকশন অ্যান্ড রেঞ্জিং) পদ্ধতি হল এরোপ্লেন বা হেলিকপ্টার থেকে পাঠানো লেজার রশ্মি দিয়ে কোনও ভূমিতলের ছবি তোলার বিশেষ পদ্ধতি। বাদুড় যেভাবে মুখ থেকে তরঙ্গ ছড়িয়ে তা কানে শুনে শিকারের অবস্থান বুঝতে পারে, অনেকটা তার অনুকরণে এই পদ্ধতি তৈরি। এর মাধ্যমে কীভাবে কোনও অংশের স্থাপত্যের মানচিত্র আঁকা যায়, তা নিয়ে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সায়েন্স পত্রিকা, যেখানে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে গুয়াতেমালার এই সাম্প্রতিক আবিষ্কারকে।

মায়া সভ্যতা বলতে আমাদের মনে প্রথমেই মেক্সিকোর ছবি ভেসে উঠলেও, এই সভ্যতার সবচেয়ে বড় শহরটি অধুনা গুয়াতেমালার উত্তরে বৃষ্টিচ্ছায় অরণ্যের একাংশে রয়েছে। ১৯৭৯ সালে এটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

গুয়াতেমালার ১৯৮৯ ও ১৯৯২ সালের ০.৫০ কোটেতজাল ব্যাঙ্কনোটে ছাপা হয়েছে তিকালের একটি পিরামিডের ছবি। মায়া সভ্যতার সবচেয়ে বড় নিদর্শন তিকাল নামে দুর্গপ্রতিম এক জনপদ, যার সবচেয়ে আকর্ষণীয় হল একটি পিরামিড যার ছবি এই নোটে ছাপা হয়েছে। এটি তৈরি করা শুরু হয়েছিল ৬৭২ খ্রিস্টাব্দে, তৈরি করতে অন্তত ২০ বছর সময় লেগেছিল। এখনও পর্যন্ত প্রি-কলম্বিয়ান যুগের যত নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় এটিই। এটি চতুর্থ মন্দির নামে পরিচিত। শাসকের সামাধির উপরে মিশরের পিরামিড তৈরি হলেও এখানের পিরামিড আসলে মন্দির অথবা মানমন্দির।

তিকাল শহরের আগের নাম সম্ভবত ইয়াক্স মিউতাল। এখানে সভ্যতার বিকাশ হয়েছিল খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে, যদিও আড়াই হাজার খ্রিস্টপূর্বেও এখানে মানুষের বসতি ছিল, রোপন করা হয়েছিল সভ্যতার বীজ। বিস্তীর্ণ মায়া সভ্যতার উপরে এই শহরের খুব বেশি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রভাব ছিল খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় থেকে নবম শতাব্দী পর্যন্ত। চতুর্থ শতকে এই শহর দখল করে তিউতিহুকানরা। এরা এসেছিল অধুনা মেক্সিকো শহরের ৪৫ কিলোমিটার দূর থেকে। নগরী জয় করে তারা সবচেয়ে বড় প্রাসাদগুলো পুড়িয়ে দেয়।

হায়রোগ্লিফ বা ছবিতে লেখা থেকে এখানকার তিউতিহুকান রাজাদের নাম জানা যায়। তবে ছবিতে লেখা বলা ঠিক হবে নাকি আইকনোগ্রাফি বলা ঠিক হবে, তা নিয়ে তর্ক চলতে পারে। শক্তিশালী তিউতিহুকান রাজা ছিলেন জাৎজ’ওম কুই, যার অর্থ বর্শানিক্ষেপকারী পেঁচা। তাঁর রাজত্বকাল শেষ হওয়ার পরবর্তীকালে লিখিত নথিতে তাঁর নাম পাওয়া গেছে। জাৎজ’ওম কুইয়ের ছেলের নাম ইয়াক্স নুআন আয়ইইন, যার অর্থ প্রথম কুমির।

এবার আসা যাক এই নোটের সামনের দিক বা অবভার্স দিকে। এই দিকে ছাপা হয়েছে কিচে মায়ানদের শেষ শাসকের একটি মূর্তি। তাঁর নাম তেকুম উমান। ১৯৬০ সালে তাঁকে গুয়াতেমালার জাতীয় নেতার সম্মান তাঁকে দেওয়া হয়।

তেকুম উমানের জন্ম সম্ভবত ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে। ১৫২৪ সালে স্প্যানিশ আক্রমণকারী পেদ্রো দে অ্যালভারাদো বিনা বাধায় দক্ষিণ আমেরিকার মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করে ক্রমেই ঢুকে পড়তে থাকেন। তবে কোয়েৎজালতেনাঙ্গো নামক জায়গায় এলে তাঁর গতি রোধ করেন দাঁড়ান তেকুম উমান। সেই লড়াই অবশ্য শেষ পর্যন্ত তিনি জিততে পারেননি। ১৫২৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়। এই সভ্যতার মানুষজন আগে ঘোড়সওয়ার দেখেননি। তীরধনুক দিয়ে প্রাথমিকভাবে স্প্যানিশদের তাঁরা আটকে দিলেও, শেষ পর্যন্ত ঘোড়সওয়ার সেনার বিরুদ্ধে স্থানীয়রা পরাজিত হন।

আড়াই হাজার খ্রিস্টপূর্বে যে সভ্যতার বিকাশ শুরু হয়, তা এক ধাক্কায় ভেঙে পড়ে ইউরোপীয় হামলার মুখে, খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে।

 

(লেখক পরিচিতি – প্রাক্তন সাংবাদিক, বর্তমানে ভাষাতত্ত্ববিদ; ইতিহাস চর্চা ও মুদ্রা সংগ্রহ তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান অঙ্গ)

Comment here