শাশ্বত সনাতন

কিন্নৌর কৈলাশ॥ এক অধুরী কাহানী – ভ্রমণ কাহিনী – ৭

(পূর্বের অংশের পর)

 

– শ্রী সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

 

০৯/০৭/২০১৫

কোনোক্রমে ছবিলালের পিঠে চেপে নদী পার হয়ে এপারে এলাম, মোজা জুতো পরলাম এবারে তো ওপরে উঠতে হবে, খুব তাড়াতাড়ি অন্ধকার নেমে আসছে। ঐ ডেঞ্জারাস স্লাইডিংএর জায়গাটা পেরোতে হবে, কিছুটা এগোবার পর প্রথম ডেঞ্জার জোন। সিধু কোনোক্রমে পার হয়ে শ্বাস ছাড়ছে,তারপর আমি। হঠাৎ কেন জানিনা মনে একটা জোর পেয়ে গেলাম। সিধু জিজ্ঞেস করলো “ধরবো নাকি?” আমি বললাম না, বলে এক..দুই.. তিনটে স্টেপেতেই সিধু আমাকে হাত টেনে নিল। এখনও ২টো জায়গা আছে উৎরাইতে। পৌনে ৭টা বাজে আমার কষ্ট হচ্ছে দেখে একবার আবার পিঠে চেপে নামলাম কিছুটা রাস্তা। আমাকে নামিয়ে সিধু আর ছবিলাল এগিয়ে গেল। অনেকটা রাস্তা একলা হাঁটছি আর গুরুকে স্মরণ করছি, ওদের কাউকেই দেখতে পাচ্ছিনা। হঠাৎই পায়ে যেন ব্যালান্স চলে এল আর অদ্ভুতভাবে ঐ ওয়ান স্টেপ জায়গাদুটো আমি কিভাবে পার হয়ে এলাম আমি বুঝতে পারলামনা। আরও ১০০ফিট নিচে ঐ হোটেল। খাড়া উৎরাই একা আমি দাঁতে দাঁত চেপে নামছি, অন্ধকার হয়ে গেছে হঠাৎ ছবিলাল এল আর বাকি রাস্তাটুকু হোটেল পর্যন্ত আমাকে পিঠে করে বয়েই নিয়ে গেল। কঙ্গরন গ্রামে এটা পুরন সিংএর হোটেল পুরোটাই চীর গাছের মোটা মোটা কাঠ দিয়ে করা, শান বাঁধানো ডিশ অ্যান্টেনা আছে দোকান আছে, আপেল খেত,(কিন্নরের আপেল সারা ভারতে যায় আর আমরা শুধু কাশ্মীরী আপেলকেই চিনি!!)গরু-বাছুর সবেতেই শ্রী ছাপ। পৌঁছে দেখি সিধু চেয়ারে বসে। দেখে রাগও হ’লো আর একটা বিরক্তিও হ’লো। ওকে বললাম “একটু দাঁড়াতে পারলিনা?” ও বলল “আমি এখানে বসে শুধু শিবকে ডাকছি যাতে তোমরা ঠিকমত ফিরে আস”। আসলে ও জানে ঐ মারাত্মক জায়গাটা ছবিলাল আমাকে পিঠে করে পার করেছে, ওর দোষ নেই ব্যপারটা সত্যিই কঠিন ছিল লেখা যত সহজ ঐ মূহুর্তটা ততটাই কঠিন ছিল।

আসার পরে দেখলাম পুরন সিংএর বৌ আছে যে প্রায় সবটাই দেখভাল করে। আমরা আসতে বলল থাকার ঘর তো হয়ে যাবে কিন্তু রাত প্রায় সাড়ে৮টা (যেটা ওদের ঘুমিয়ে পরার সময়, পাহাড়ে এটাই দস্তুর) খাবার কে বানাবে? এ কথা শুনে সিধু ছবিলাল চুপ। ছবিলাল এ ব্যাপারে ওয়াকিবহাল কারণ ও প্রায় অনেক বছর ধরেই গাইড কাম পোর্টার পেশার জন্য পরিচিত ফলে সে জানে যে এরা এখন শুয়ে পড়বে, এদিকে আমার পায়ে মারাত্মক যন্ত্রনা পেটে খিদের জ্বালা। চা খাবার আশায় আমি একটু সেন্টু দিয়ে বললাম “দিদি,আপ মাতৃজাতি হ্যায় হামলোগ আপ কে সন্তান জেইসা, আপকো তো খানা বানানাহি পড়েগা, বহোত ভুখ লাগে হে..কুছ ভি বানায়ে রোটি সবজি লেকিন পহলে চা পিলাইয়ে” দিদি চা বানিয়ে খাওয়ালো আর তারপর খাবার বানাতে লাগলো।

ইতিমধ্যে আমরা হাত-পা ধুয়ে নিলাম আমি ওপরে বিছানায় চলে গেলাম আপডেট করতে গায়ে কম্বল চাপা দিয়ে।শরীরটাও ম্যাজম্যাজ করছে, নিচে ছবিলাল ওর পাহাড়ী এক্সপিরিয়েন্স সিধুর সাথে শেয়ার করছিল, আমি আপডেটে ব্যস্ত কিছুক্ষণ পরে দিদির ৭-৮ বছরের ছোট মেয়ে ববিতা, সামনের ৩টে দাঁত পড়ে গেছে ছোট করে কাটা চুল একমুখ ফোকলা হাসি নিয়ে চারটে রুটি আর গরম বাটি চচ্চড়ি ওপরে মাখন দেওয়া নিয়ে এল। আমি দুটো রুটি ফেরত দিলাম আর বাকি খেয়ে এত তৃপ্তি পেলাম যে ভাষায় বলা যায়না যেন খাবারে মাতৃ স্নেহ-মমতা মেশানো এত আন্তরিকতা দিয়ে খাবার বানিয়েছেন ঐ কিন্নরী ভদ্রমহিলা।
আমি খেয়ে একটা ট্যাবলেট খেয়ে আপডেট করতে লাগলাম সিধু আর ছবিলাল শুতে এল। সিধু আমার পাশে শুয়ে নাক ডাকাচ্ছে ছবি নিচে শুয়ে আছে কম্বল চাপা দিয়ে, আমি আর ঘুমাতে পারছিনা, প্রচণ্ড গরম লাগছে। আমি খালি গায়ে শুয়েছি কম্বল খুলছি তো ঠাণ্ডা লাগছে দিচ্ছি তো গরম। জানিনা ওষুধের গুণে কিনা? পা নাড়াতে পারছিনা পাশ ফিরতে গেলে হাত দিয়ে পা টাকে টেনে ফেরাতে হচ্ছে। এইভাবে যন্ত্রনা সহ আধোঘুম আধো জাগরনে রাত কেটে গেল।

 

(ক্রমশঃ)

(লেখক পরিচিতি – বিশিষ্ট জ্যোতিষী; একাগ্র পান্থ)

Comment here