(পূর্বের সংখ্যার পর)
– ডঃ গৌতম মুখোপাধ্যায়
জিটি স্কুল থেকে দেশের বাড়ি যাওয়ার কাঁচা রাস্তার দুধারে নানা গাছ গাছালি। পাখি পাখালি। দুধারে বাঁশঝাড়, কুলগাছ, বেলগাছ, কয়েতবেল গাছ, গাম্ভিলগাছ। গাম্ভিল গাছের আধিক্য ছিল চোখে পড়ার মত। মাঝারি উচ্চতা। ছোট ছোট গোল গোল সবুজ রং এর ফল ধরত। মানুষ খায়না। পাখিতেও খায়না। গাম্ভিলের কাঠ, ডাল গ্রামের ঘরে ঘরে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হত। অন্যান্য গাছ ও জ্বালানী হয়ে জ্বলত। মনে রাখতে হবে সেই সময় গ্যাস তো বহুদূরের কথা, গ্রাম বাংলায় কয়লার প্রচলন ছিলনা। কয়লা খনি অঞ্চলে হয়ত ছিল। বনগা টাউনে কয়লা ব্যবহৃত হত।
দোতলাবাড়িতে ওপর নীচ মিলে দশটা ঘর ছিল। বাড়ির ভেতরে নিকোনো উঠোনে শীতকালে ধান ঝাড়াই হত। উঠোনের একপাশে ছিল গোয়ালঘর। সেখানে থাকত চাষের বলদ ও দুধের গাই। উঠোনের অন্যদিকে রান্নাঘর। রান্নাঘরের দুটি ভাগ। একভাগে মেঝেতে মাটির উনুন বা আখাতে চেরা কাঠ/ ডাল জ্বালিয়ে রান্না হত। আগুন নিভু নিভু হলে কাঠের চোঙা/ নলে ফুঁ দিয়ে আগুন উস্কে দেওয়া হত। মা/কাকিমা কে শীত গ্রীষ্ম বর্ষায় এইভাবে রান্না করতে দেখতাম। রান্নাঘরের পাশেই ছিল টিউবওয়েল। পানীয় জল , রান্নার জল ওটা থেকে তোলা হত। স্নান সবাই করতাম ইছামতীতে। আমাদের নিজস্ব ঘাট।
ফড়েরা আসত। ক্ষেতের সব বেগুন কিনে নিয়ে যেত। আমরা ছোটরা কাকা দের সাথে ওজন দেখতাম, ঝাঁকাবন্দি হওয়া সুপারভাইজ করতাম। সেইসাথে একটা আস্ত গোলপানা বেগুন হাতে করে সিধে রান্নাঘরে। আখায় হয়ত কিছু রান্না চাপানো হয়েছে, নীচে জ্বলন্ত কাঠের পাশে বেগুন রেখে দিতাম। পরে বের করে ঠান্ডা করে ছাল ছাড়িয়ে নুন দিয়ে খেতাম। কোথায় লাগে অমৃত! গ্রামে বিশুদ্ধ খোলা বাতাস, টিউবওয়েলের জল সব হজম হয়ে যেত। নদীর ধারের জমি বা চড়ার জমি খুব উর্বর। বেগুন, মটরশুটি, মূলো ইত্যাদির বীজ ছড়ানো হত। এছাড়া ছিল কলাবাগান, পেঁপে বাগান। একটু ভেতরে কলমের আমবাগান।
পাখি পাখালির অন্ত নেই। চড়াই শালিখ তো ছিলই। আমি অত পাখির ডাকের পার্থক্য বুঝতাম না। কিন্তু কাকাদের কান ছিল খুব শার্প। বসে আছি বাড়ির সিঁড়িতে, ছোটকাকা কোনখান থেকে ফিরছিল, হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বলল সাহেব বুলবুলি ডাকছে। আমগাছ গুলোর দিকে তাকিয়ে থাক, লম্বা লেজওলা নীলসাদা ছোট পাখি দেখতে পাবি। অনেকক্ষণ তাকানোর পর চোখে পড়ত ১.৫ -২ মিটার লম্ব লেজওলা সাহেব বুলবুলি। প্রচুর ঘুঘু পাখি ছিল। সারাদিন ডাকত ঘুঘুর ঘু করে।
ছিল কুবো পাখি। বেশ বড় বড় লালচে আর কালো রং মেশানো। কুচকুচে কালো রঙের ফিঙে পাখি খুব চোখে পড়ত। শুনেছি সবচেয়ে বুদ্ধিমান পাখি হল ফিঙে। নদীর ধারে ধ্যানরত মাছরাঙা কোন ডাল বা বাঁশের ওপর বসে থাকত। জলের দিকে একাগ্রচিত্তে একদৃস্টিতে তাকিয়ে থাকত মাছের নড়াচড়ার অপেক্ষায়। বাড়ির সামনে একটা ঘাসে ঢাকা উঠোন, সেটা ঢালু হয়ে
সামনের কাঁচা রাস্তায় গিয়ে মিশেছে। আগে গ্রামে কাঁচা রাস্তাও ছিলনা।
রাস্তার দুধারে কিছুদূর অন্তর অন্তর ৩মিX৩মিX২মি খোঁড়া গর্ত জানান দেয় যে মাটি কেটে নির্ধারিত পায়ে চলার পথের ওপর ফেলে সেই যুগে স্বাধীনতার পর গ্রামের রাস্তা বানিয়ে সরকার বাহাদুর আমাদের ধন্য করেছিলেন। ৫০ বছর পর এখন সেসব রাস্তা পাকা হয়েছে। এখন তার ওপর দিয়ে অটো , টোটো, মোটরসাইকেল হৈ হৈ করে ছুটছে, টোটো করে বেড়াচ্ছে। ১৯৮৫ তে আমোদাবাদে ওনজিসি তে চাকরি করতে গিয়ে সারা গুজরাট চষে বেড়াতে হয়েছে অয়েল এক্সপ্লোরেশন এর কাজে। প্রত্যন্ত গ্রামেও রাস্তা সব পাকা। সব জায়গায় অটো চলছে। সাইকেল রিক্সা কোথাও নেই।
উন্নত রাস্তাঘাট ও পরিবহন ব্যবস্থা যে শিল্প বানিজ্য এমনকি কৃষিপন্য বিপননের জন্য ইনফ্রাস্ট্রাক্চারের মেরুদন্ড তা ব্যবসাবিমুখ বাঙালি ও বাঙালি রাজনীতিকরা কখনো ভাবেননি বা বোঝেননি বা বোঝার মত বাবসায়িকবুদ্ধি ছিলনা। পড়াশুনো করে MIT বা Harvard এ যাওয়া যায়। তারপর কোথাও ভাল চাকরি করা যায়। এটা বাঙালিরা পারে। কিন্তু নন-ম্যাট্রিক ধিরুভাই অম্বানী র মত entrepreneur হওয়া যায়না। এটা গুজরাটী রা পারে। অম্বানীর পর আদানী বিশ্বের বাণিজ্য মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে। জেফ বেজোস ( আমাজন), এলান মাস্ক ( টেসলা) র সাথে টক্কর নিচ্ছে। আর আমরা বাঙালীরা? পরিযায়ী শ্রমিকের সাপ্লাই বাড়িয়ে চলেছি।
আগে লিখেছিলাম বনগায় ইছামতীর ওপর রায় ব্রীজ পার হয়ে বাঁ দিকে গেলে পাইকপাড়া, ঘাটবাঁওড় আসে। রায় ব্রীজ পার হয়ে সোজা চলে গেলে আসে ছঘোড়ে। ছঘোড়েতে ব্রীজ থেকে ১.৫ কিমি দূরে আছে একটা স্কুল। রাখালদাস স্কুল। তার পরে দা্ঁড়িয়ে আছে রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি। বংশধরদের কেউ কেউ থাকেন এখন। রাখালদাস বাবুর নাম অনেকেই হয়ত শেনেননি। উনি ১৮৮৫ সালে মুর্শিদাবাদের বহরামপুরে জন্ম গ্রহন করেন। পরে বনগাঁয় এসে বসবাস করেন।
ভারতের আর্কিওলজিক্যাল স্যোসাইটিতে দায়িত্বপূর্ণ পদে কাজ করতেন। ওনার নেতৃত্বে মাটি খুঁড়ে মহেঞ্জোদরো ও হরপ্পার প্রাচীন উন্নত নগরভিত্তিক সভ্যতার নিদর্শন আবিস্কার করা হয়। ১৯১৮-১৯২৩ সাল পর্যন্ত উনি এক্সাভেশন কার্য পরিচালনা করেন। প্রতি বছর সরকারী নিয়মানুসারে হেড অফিসে রিপোর্ট পাঠান তদানীন্তন আর্কিওলজিকাল স্যোসাইটির ডাইরেক্টর জেনারাল জন মার্শাল রিপোর্ট গুলো চেপে দেন। পরে নিজের নামে বই বের করেন। পশ্চিমী দুনিয়া মার্শাল সাহেবকেই জানে মহেঞ্জোদরো র আবিস্কর্তা হিসেবে।
It’s a blatant lie. যমজ শহর মহেঞজোদরো হরপ্পা র আর এক নাম সিন্ধু সভ্যতা। পরে আরো অনেক জায়গায় সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে। যেমন গুজরাটের লোথাল। আমি আর নোটন গাড়ী চালিয়ে লোথাল গেছিলাম আমেদাবাদে থাকাকালীন। সিন্ধু সভ্যতার আর এক নাম সরস্বতী সভ্যতা। সরস্বতী নদীর তীরে এই ৫০০০ বছরের প্রাচীন নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। আমিশ ত্রিপাঠি তাঁর “Immortals of Meluha” (পরে আরো দুটো বই নিয়ে Trilogy লেখেন)। বই দুটো হল “Secret of Nagas” and “Oath of Vayuputras”. বইতে লেখেন মোহন জো দরো। ও হরি আপ্পা থেকে মহেঞজোদরো ও হরপ্পা নাম আসে। মোহন ও হরি কৃষ্ণ র নাম। আমেরিকায় একজন ভারতীয় প্রফেসর আছেন নীলস ওক। উনি জোতির্বিজ্ঞানের ওপর কম্পিউটার সিমুলেশন চালিয়ে প্রাচীন কালে বর্নিত গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান দেখে সিন্ধু সভ্যতার বয়স ৭০০০ বছর নির্ণয় করেছেন। ভারত ও অন্যত্র উনি লেকচার দিয়ে বেড়ান।…নেট দ্রষ্টব্য।
(ক্রমশঃ) – পরের সংখ্যা
(লেখক পরিচিতি – অবসরপ্রাপ্ত পেট্রফিসসিস্ট: ব্যাঙ্গালোরের প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেট্রোলিয়াম বিভাগের প্রাক্তন ফ্যাকাল্টি)
Comment here