আঙিনা

দেশ – ২

(পূর্বের সংখ্যার পর)

– ডঃ গৌতম মুখোপাধ্যায়

 

এপারের রিক্সা স্টান্ড থেকে ঘাটবাঁওড় ২কিমি।

মাঝে পড়ে পাইকপাড়া। গঞ্জ টাইপ। পাটের আড়ত আছে অনেক। দুই বাংলায় বিশ্বের ৮০% পাট চাষ হয়। পাট গাছ লম্বা লম্বা আর খুব সরু সরু হয়। পাট সমতল বাংলার ক্যাশ ক্রপ। পাহাড়ে চা।

পাট গাছ সময় মত কেটে জলে ভিজিয়ে রাখতে হয় বেশ কিছু দিনের জন্য। ইছামতীর দীর্ঘ পথ জুড়ে পাট ভেজানো হয়। তারপর সাদা স্টেম থেকে পাটের আঁশ ছাড়িয়ে সুখানো হয়, তারপর বেল বানানো হয়। সাদা স্টেম কে আমরা বলি পাটকাঠি। গ্রামে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ঘর ছাইতেও ব্যবহার করা হয়। পাটের নানা কোয়ালিটি হয়। কোয়ালিটি চিনতে প্রচুর অভিজ্ঞতা লাগে। পাটোয়ারী হওয়া বেশ কঠিন কাজ।

বায়ুর ৭০-৯০% আপেক্ষিক আর্দ্রতায়, চৈত্র-বৈশাখ মাসের প্রাক বর্ষায় পাট বীজ বোনা হয়। জ্যৈষ্ঠ মাসের অপেক্ষাকৃত খরায় নিড়েন, গাছ বাছাই ও অন্যান্য অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা সম্পন্ন করা হয়। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের ভরা বর্ষায় যখন ডোবা, খাল-বিল, জলে ভরে ওঠে তখন পাট কাটা হয়। নিকটবর্তী জলাশয়ে পাট গাছ জাগ দেয়া হয়। পাট পচানোর এ পদ্ধতির নাম “রিবন রেটিং”। পরিবেশের এ সব কিছুই পাট চাষের সাথে নিবীড়ভাবে সম্পর্কিত। পাট সম্পূর্ণ বৃষ্টি নির্ভর ফসল। সাময়িক খরা অথবা জলাবদ্ধতায় পাট ফসল তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। পাট ক্ষেতে কোন রকম সেচ অথবা জল নিষ্কাশন প্রয়োজন হয় না।

বাংলাদেশের অনেক এলাকায় পাটের কচি পাতাকে শাক হিসেবে রান্না করে খাওয়া হয়। চট্টগ্রামে অঞ্চলে এটি ” নারিস শাক ” হিসেবে পরিচিত। পট্টবস্ত্র নাম সবাই শুনেছেন। রাজা বা রাজ পুরোহিতগন পট্টবস্ত্র পরিধান করতেন। পাট আগে খুব অভিজাত ছিল। পাটরানী। রাজপাট।…পট্ট থেকেই পাট এসেছে।

শিব্রামের সম্পাদক শিকার গল্প মনেআছে ? একটি কৃষি পত্রিকার সম্পাদক ছুটিতে যাচ্ছিলেন , যাওয়ার সময় এক শহুরে শখের কবি কে পত্রিকার ভার দিয়ে গেলেন। শহুরে বাবু সম্পাদক হয়ে মনের সুখে সম্পাদকীয় লিখতে শুরু করলেন। লিখলেন পাট গাছের কাঠ থেকে নৌকার পাটাতন তৈরী হয়।…বস্তা, চট তৈরী করেই পাট শিল্প কে শেষ করা হল কোন রিনোভেশন হয়নি।

রিনোভেশনের বিরুদ্ধে ৭৪ দিন জঙ্গী আন্দোলন চলেছিল। জঙ্গী বাম আন্দোলনে গঙ্গার তীরে তৈরী হওয়া কত পাটকল গঙ্গাপ্রাপ্তি লাভ করল।….পাটশিল্প এখন অন্তর্জলি যাত্রায়।

পাইকপাড়া থেকে ঘাটবাঁওড় ০.৫ কিমি। দু পাশে গাছ গাছালি, পাখি পাখালির আধিক্য চোখে পড়ে। ধানের ক্ষেত।
টাউনশিপ, গঞ্জ ছেড়ে নিপাট গ্রামের দিকে এগিয়ে চলে রিক্সা। লোক জনের চেহারা, পোষাক, পাদুকা সব জানান দিচ্ছে আমরা টাউনশিপ, তারপর গঞ্জ , তারপর গ্রামের দিকে ক্রম অগ্রসর হচ্ছি।
জীবন যাত্রার মান নানা ভাবে মাপা যায় বা হয়।
যেমন পার ক্যাপিটা আয়, শিক্ষিত লোকের সংখ্যা,
পার স্কোয়ার কিলোমিটারে কটা ব্যাঙ্ক পরিষেবা, পোস্ট অফিস, স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, কলকারখানা, কাঁচা মাল যোগান, আশপাশের উৎপাদিত কৃষিপণ্য ও তার বাজার, রাস্তাঘাট, পরিবহনের সুবিধা, ইন্ফ্রাস্ট্রাকচার।
আরো অনেক প্যারামিটার আছে, ইকনোমিস্ট দের নিত্য গবেষনার বিষয়। তবে চোখকান খোলা রাখলে আর কমনসেন্স থাকলে যে কেউ এগুলো নিয়ে রিসার্চ করতে বা প্রবন্ধ লিখতে পারেন।

বনগা থেকে পাকা রাস্তা ইছামতীর সমান্তরালে এসেছে ঘাটবাঁওড় পর্যন্ত। তারপর রাস্তাটা ৯০ডিগ্রী বাঁক নিয়ে ডান দিকে চলে গেছে, হেলেঞ্চা, বাগদা, বয়রা সীমান্তের দিকে।
বাগদার আগে আসে দত্তফুলিয়া। ওখান থেকে বাঁ দিকে একটা পাকা রাস্তা চলে গেছে সিধে রানাঘাট এর দিকে।
বনগা স্টেশন থেকে দিনে দুটি ট্রেন যেত রানাঘাটে।
একটা দুপুর ১.৩০ , অপরটি বিকেল ৫.৩০ এ।
রানাঘাটে আছে চূর্ণী নদী আর বিখ্যাত পান্তুয়া।
কবি জয় গোস্বামী , সাহিত্যিক সমীর মুখোপাধ্যায়।
রাণাঘাট মহাবিদ্যালয় খুবই বিখ্যাত।
রিক্সা থেকে নেমে ঘাটবাঁওড় থেকে যে কাঁচা রাস্তা ইছামতীর সমান্তরালে চলেছে, সেটাই আমাদের দেশের বাড়ীর পথ। ২৫০ মিটার দূরত্ব, ঘাটবাঁওড় থেকে।
ঘাটবাঁওড়ে একটা প্রাইমারী স্কুল ছিল।
জিটি স্কুল। ক্লাস ফোর পর্যন্ত।

জিটি স্কুলের সাথে লাগোয়া একটা খেলার মাঠ আছে। কতদিন আমরা মুখার্জি বাড়ির ছেলেরা খেলতে আসতাম স্থানীয় ছেলেদের সাথে। গরমকালে ফুটবল, শীতকালে ক্রিকেট। কয়েকজনের নাম মনে আছে গোবিন্দ, মানিক, গৌতম, জয়ন্ত। আমাদের খুড়তুতো জাঠতুতো ভাইদের সাথে ছোটকাকাও আসতেন।

জিটি স্কুল থেকে দুটো সাঁকো পার করে ২৫০ মিটার দূরে দেশের দোতলা পাকা বাড়ি। মাঝে একটা প্রাইমারী স্কুল। দ্বিতীয় শ্রেনী অবধি ছিল। মাটির বাড়ি। কাছাড়িবাড়ি স্কুল। এককালে জমিদারদের কাছাড়িবাড়ি ছিল। মোটা মোটা খাতায় প্রজাদের খাজনার ইতিহাস লেখা থাকত। মিথ্যা হিসাবে টিপসই নেওয়ার দলিল। দেশের বাড়ি অবধি ধুলায় ধুসরিত কাঁচারাস্তা। বর্ষায় কর্দমাক্ত।

কাঁচারাস্তা তারপর অশ্বথ্থতলা কে ডানহাতে ফেলে ঘোষপাড়া ছাড়িয়ে মাধবপুরের দিকে এগিয়েছে।
রাস্তা থেকে বাঁহাতে ৪০-৫০ মিটার দূরত্ব বজায় রেখে
ইছামতী কলকল শব্দে নাচতে নাচতে চলেছে।
মাধবপুরের আগে শিবপুর পড়ে। শিবপুর থেকে বাঁদিকে একটা সরু কাঁচা রাস্তা গিয়ে পড়েছে ইছামতী তে, একটি ঘাটে। নাম বিভূতি বাঁড়ুজ্জের ঘাট।
ওইখানে নদী পার হলে ব্যারাকপুর।
(এটা রাণাঘাট লাইনের ব্যারাকপুর নয়। )
ব্যারাকপুরে আমার ঠাকুমার বাপের বাড়ী।
বাবার মামার বাড়ী। খুব ছোটবেলায় গেছি দু একবার।
একই পাড়ায় প্রকৃতিপ্রেমিক সাহিত্যিক বিভূতি ভূষন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ী।
বিভূতিবাবুর আবির্ভাব অনেকটা শরৎচন্দ্রের মত।
উনি তখন ভাগলপুরে এক সেরেস্তায় কাজ করছেন।

শরৎচন্দ্রের মামা উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে সন্ধ্যায় সাহিত্য আলোচনা হত। বিভূতিবাবু আড্ডায় চুপ করে সবার কথা শুনতেন। একদিন উপেন বাবু ওনাকে জিজ্ঞেস করলেন আপনি লেখেন টেখেন? পরের দিন বিভূতিবাবু ওনার একটা পান্ডুলিপি উপেনবাবু কে দিলেন পড়তে। উপেনবাবু ওটা কলকাতা নিয়ে গেলেন ও পরে বিচিত্রা পত্রিকায় বিভূতিবাবুর প্রথম পান্ডুলিপি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করলেন। বইয়ের নাম পথের পাঁচালি। আর ফিরে তাকাতে হয়নি।

 

(ক্রমশঃ) – পরের সংখ্যা

 

(লেখক পরিচিতি – অবসরপ্রাপ্ত পেট্রফিসসিস্ট: ব্যাঙ্গালোরের প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেট্রোলিয়াম বিভাগের প্রাক্তন ফ্যাকাল্টি)

Comment here