সংস্কৃতি

‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী’ – রাজেশ্বরী দত্ত

” মানুষেরই গান শুনে প্রাণ ভরে মনে হয়
সকলই সম্ভব আহা সকলই সম্ভব
পরকে আপন জরে জীবনমরণ বেঁধে
জীবনেরই গান সেধে সুরে সুরে দীর্ঘস্বর
বলা- না – বলায় শব্দ হয়ে ওঠে বাস্তব তন্ময়
স্বাধীন গৌরবে।
গান করো পরকে আপন করো তবে”।

কবি বিষ্ণু দে ‘পরকে আপন করে ‘ কবিতায় এই পংক্তির অবতারণা করেছেন।এই কবিতাটি তাঁর বন্ধুপ্রতীম সুধীন্দ্রনাথ দত্তের স্ত্রী রাজেশ্বরী দত্তকে উদ্দেশ্য করে লেখা রবীন্দ্রসঙ্গীতের জগতে সম্ভ্রান্ত শিল্পী হিসেবে যেকটি নাম উচ্চারিত হয় তাঁদের মধ্যে অন্যতমা হলেন রাজেশ্বরী দত্ত।জন্মসূত্রে দক্ষিণ ভারতীয় হলেও শান্তিনিকেতনে পড়াশুনা ও রবীন্দ্রনাথের ভাবধারার সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে নিয়ে তিনি অনায়াসেই এই বাঙালীর অতি আপন শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন।

যাঁরা রবীন্দ্রসঙ্গীতের রসিক শ্রোতা তাঁদের কাছে শ্রীমতী রাজেশ্বরী দত্তর নাম আজও অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। ১৯১৮ সালের ১৭ এপ্রিল লাহোরে রাজেশ্বরীর জন্ম।পিতার নাম অর্জুনদাস বাসুদেব যিনি ছিলেন লাহোর হাইকোর্টের বিচারক লাহোরেই রাজেশ্বরীর পড়াশুনার সূত্রপাত।সেখানকার বিখ্যাত স্কুল সেক্রেড হার্ট কনভেন্ট থেকে ম্যাট্রিকুলেশান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর গভর্নমেন্ট কলেজ অফ উইমেন থেকে সংস্কৃততে অনার্স সহ স্নাতক হন রাজেশ্বরী।

১৯৩৮ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে এলেন।স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ ধন্যা রাজেশ্বরী ১৯৩৮ থেকে ১৯৪২ সাল অবধি সেখানে কন্ঠসঙ্গীতের ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের তালিম নেন।সেসময় শান্তিনিকেতনে তাঁর শিক্ষক শিক্ষিকাদের মধ্যে ছিলেন রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তিদেব ঘোষ,শৈলজারঞ্জন মজুমদার,ইন্দুলেখা ঘোষ,অমিতা সেন,প্রমুখ।১৯৪৩ সালে রাজেশ্বরীর প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হলো।দুপিঠে দুখানি রবীন্দ্রসঙ্গীত।একপিঠে ‘ আজি তোমায় আবার চাই শুনাবারে এবং অন্যপিঠে বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল।ঐ বছরই নিউ থিয়েটার্সের ব্যানারে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি প্রিয় বান্ধবীতে ‘ তোমার আমার এই বিরহের অন্তরালে’ গানটিও গেয়েছিলেন রাজেশ্বরী।

১৯৩৯ সালে রাজেশ্বরীর সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়েছিলো সুধীন্দ্রনাথ দত্তর।সেই পরিচয় থেকে প্রেম এবং ১৯৪৩ সালে দুজনে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন।এরপর রাজেশ্বরী ও সুধীন্দ্রনাথ কলকাতায় চলে আসেন এবং রাসেল স্ট্রিটে সংসার পাতেন।পাশাপাশি চলতে থাকে তাঁর সঙ্গীতচর্চা।

মোটামুটিভাবে ১৯৪৫ থেকে ১৯৫৪ সাল অবধি কলকাতায় রাজেশ্বরী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চা অব্যাহত রেখেছিলেন।টপ্পা ও ঠুংরি এই সময় তিনি শিখতে শুরু করেন।এই পর্যায়ে রাজেশ্বরীর গুরুদের মধ্যে ছিলেন গিরিজাশংকর চক্রবর্তী, যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়,প্রমুখ।শুধু গান নয় ফরাসী,জার্মান ও ল্যাটিন ইত্যাদি ভাষাও তিনি শিখেছিলেন।

রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষে রাজেশ্বরী সর্বপ্রথম বিদেশযাত্রা করেন।তখন স্বামী সুধীন্দ্রনাথ প্রয়াত হয়েছেন।১৯৬৩ সালে শিকাগোতে লাইব্রেরি সায়েন্স নিয়ে তিনি এম. এ পাশ করেন এবং চাকরি নেন।১৯৬৫ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবলিওগ্রাফার হিসেবে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৭৫ এ দেশে ফিরে পঞ্চম সংহিতা নিয়ে গবেষণা করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন রাজেশ্বরী কিন্তু সে আশা তাঁর পূর্ণ হয় নি। ১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে বারাণসীতে গবেষণার কাজে গিয়েছিলেন তিনি।সেখানেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন রাজেশ্বরী।সেরিব্রাল থ্রম্বোসিসে আক্রান্ত হন।চিকিৎসার জন্য কলকাতায় আনা হয়।সেখানে মাত্র ৫৮ বছর বয়সে ১৯৭৬ সালের ১০ এপ্রিল প্রয়াত হন রাজেশ্বরী দত্ত।

সংখ্যার বিচারে খুব বেশী রবীন্দ্রসঙ্গীত রাজেশ্বরী দত্ত রেকর্ড করেন নি।কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট এমন কিছু গান তিনি রেকর্ড করে গিয়েছেন যেগুলি পরবর্তীতে খুব বেশী শিল্পী রেকর্ড করেন নি।যাঁরা রবীন্দ্রনাথের গানের প্রকৃত বোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত তাঁরা রাজেশ্বরীর গানের বিভিন্ন বিশ্লেষণ করেছেন।সাধারণ শ্রোতারাও প্রশংসা করেছেন তাঁর।স্বল্প যন্ত্রাণুষঙ্গে শুধুমাত্র গলার কারুকার্যে এক একটি গানে রাজেশ্বরী প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতেন।

তাঁর রেকর্ড করা গানগুলির মধ্যে ‘ ওগো আমার চির অচেনা পরদেশী’,’ যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’,’ এরা পরকে আপন করে’,’ আজি যে রজনী যায়’,’ এ কি করুণা করুণাময়’,’ বন্ধু রহো রহো সাথে’,’ বড়ো বেদনার মতো’,’ নীলাঞ্জনছায়া’,ইত্যাদি।রেকর্ড করেছেন ব্রহ্মসঙ্গীতও।

জীবদ্দশায় রাজেশ্বরী তাঁর সৌন্দর্য ও আভিজাত্যে ছিলেন অতুলনীয়া।চলাফেরায় ছিলো ব্যক্তিত্বের ছাপ।শান্তিনিকেতনে আসার আগে যে মার্গসঙ্গীতের তালিম তিনি পেয়েছিলেন তার পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিলো রবীন্দ্রনাথের ‘ এ পরবাসে রবে কে’,বা ‘ কে বসিলে হৃদয়াসনে’,ইত্যাদি গান পরিবেশনে।যখন রাজেশ্বরী ‘ এ মোহ আবরণ’ পরিবেশন করেছিলেন তখন সেই গানে এক অনন্য মুগ্ধতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিলো।

প্রাথমিক সঙ্গীত শিক্ষা,আপন প্রতিভা এবং অত্যন্ত গুণী শিক্ষকদের সান্নিধ্য তাঁকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের জগতে পাকাপাকি স্থান গ্রহণ কর‍তে সাহায্য করেছিলো। বিশিষ্ট সমালোচক শ্রী অমিতাভ ঘোষের উক্তি এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য, ” ‘ শেষ গানেরই রেশ নিয়ে যাও চলে’ গানটিতে ‘ গোধূলিতে আলো- আঁধারে ‘ যখন রাজেশ্বরী গাইছেন তখন অনুভবে – উপলব্ধিতে মনে হবে যেন সত্যিই অন্ধকার নেমে আসছে। ওখানে কোমল ধা – র যে চড়া সংস্করণ সেটা ছুঁয়ে মীড় টেনে নেমে আসাটা একমাত্র রাজেশ্বরীই পেরেছেন।অন্য কোন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী পারেন নি।”

তাঁর গান চিরদিন আমাদের মনে থাকবে।বর্তমান সময়ের রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীরা যদি রাজেশ্বরী দত্তর গান শোনেন বা তাঁর রবীন্দ্রগানের কথার উচ্চারণ আত্মস্থ করেন তাহলে সেটাই হবে তাঁর প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন।

Comment here