আঙিনা

দেশ – ৭

(পূর্বের সংখ্যার পর)

 

– ডঃ গৌতম মুখোপাধ্যায়

 

ইছামতি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ একটি সুন্দর কবিতা লিখেছিলেন। চৈতালি কাব্যগ্রন্থে আছে। বিজয়া দশমীতে ইছামতিতে প্রতিমা বিসর্জনের অনুষ্ঠান ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের একটি অনন্য প্রদর্শনী। ইছামতি নদীটি যা দুই দেশের মাঝে নিরপেক্ষ সীমানা হিসেবে কাজ করে, তা উভয় দেশের নৌকা থেকে বিসর্জনের সময় উচ্ছসিত কিন্তু বিষন্নতায় ভরে ওঠে। এসময় বিভিন্ন আকৃতির নৌকা দৃষ্টিগোচর হয় এবং প্রতিটি নৌকাগুলোতে সংশ্লিষ্ট দেশের পতাকা লাগানো থাকে। জোড়া নৌকার ওপর প্রতিমা বসিয়ে মাঝ নদীতে নৌকো দুটো দুদিকে সরিয়ে নিয়ে প্রতিমা নিরঞ্জন এক বিশেষ দ্রষ্টব্য প্রদর্শনী। এটিই বছরের একমাত্র দিন যখন সীমান্ত টহল শীথিল করা হত, নদীর উভয় পাড়ের মানুষ স্বতঃস্ফুর্তভাবে নদীর অপর পাড়ে যেতে পারত। এখন আবার কড়াকড়ি বাড়ানো হয়েছে।

নৌকো করে বনগা থেকে সুখপুকুর বা দেশ থেকে বনগাঁ অনেক বার যাতায়াত করেছি। তাছাড়া কয়েকবার ব্যারাকপুরেও নৌকো করে গেছি। লক্ষ্য করেছিলাম নদীর দু ধারে ( দুই পাড়ে নয়) ছোট ছোট ঝোপ ঝাড়। যাদের সরু সরু কান্ড। কান্ডের মাথায় পত্রাবলি। নাম বন্যেবুড়ো। এরা বন্যার সময়েও বেঁচে থাকে। এদের কান্ড আসলে শিকড়। তাই দিয়ে শ্বাস নেয়।এরা নদীর পাড়ের ভাঙ্গন রোধে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ওনজিসি তে জিওলজি পড়ার সময় জেনেছি এদের বলে ম্যানগ্রোভ। এগুলো নদীবাহিত হয়ে মোহনার কাছে জমা হয়। তারপর আস্তে আস্তে মাটির নীচে চলে যায়।

লক্ষ লক্ষ বছর মাটির নীচে উচ্চ তাপমাত্রা ও চাপে হাইড্রোকার্বনে পরিণত হয়। খুড়তোতো ভাইদের সাথে নদীতে মাছ ধরতে যেতাম ছিপ নিয়ে। আমি পারদর্শী ছিলাম না। মাছ চারা খেয়ে পালিয়ে যেত। ভাইরা ভাল ধরতে পারতো। বেশীর ভাগ সরম পুঁটি। অনেকদিন আগের একটা সিনেমা “পাড়ি” তে একটা গান ছিল ‘ইছামতি নদী তোমার ইচ্ছা বোঝা দায়’। ইছামতির রূপালী জলে আমাদের শৈশব পড়ে আছে, হেসে খেলে বেড়ায়। প্রথম দিকে লিখেছিলাম ৬০ এর দশকে আমাদের দেশ সুখপুকুরে ইলেকট্রিসিটি ছিলনা। মিলেনিয়মের পর হয়ত এসেছে। ঠিক জানিনা। এটা জানি বহুকাল ছিল না।

যাঁরা শহরে বা টাউনে বড় হয়েছেন তেনারা জ্যোতিবাবুর লোডশেডিং দেখে থাকলেও বিদ্যুৎহীনতা যে কি জিনিস কল্পনা করতে পারবেন না। সন্ধ্যার আগে আগে বৌ মেয়েরা নদীতে গা ধুয়ে, হাঁস গুলোকে চৈ চৈ করতে করতে ফেরে। পাখিকুল নিজ নিজ কুলায়ে ফেরে। কেউ নিজস্ব বসত বাড়িতে ( ছোট গাছে)। অন্যরা দল বেঁধে মাল্টিপ্লেক্স আবাসনে ( বট বা অশ্বত্থ গাছে)। ওখানে নিজের নিজের চয়েস আছে। কেউ নীচে, কেউ মাঝে, কেউ উঁচু তলায়।

লোকে গরু বাছুর বা গরুর পাল নিয়ে ফেরে। গরুর ক্ষুরে ক্ষুরে কাঁচা রাস্তায় বা মাঠে ধূলো ওড়ে, তার ওপর অস্তগামী সূর্য্যের লাল রশ্মি আবিরময় এক মায়া সৃস্টি করে। তাই একে গোধূলিবেলা বলে। বেশ খানিকক্ষণ থাকে এই সুন্দর স্বর্ণালী মায়া।  একে কনে দেখা আলোও বলে। এই সময় পাত্রপক্ষের জন্য হবু কনে কে সাজিয়ে বসানো হয়। দুরন্ত লালাভ আলো কন্যার রূপ লাবন্য বাড়িয়ে দেয়। পাত্রের পিতা বলেন সামনের মাসে দিন দেখুন, লক্ষ্মী ঘরে তুলব। 

এখানে অন্য একটা কথা বলি। সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের সময় আলোর সাতটা রঙের মধ্যে লাল রঙ টা পৃথিবী তে এসে পৌঁছয়। একে বলে Raleigh’s Scattering. একই কারনে আমরা আকাশের রং নীল দেখি। এটা আবার এক্সপেরিমেন্ট করে ভারতীয় বিজ্ঞানী সি ভি রমন দেখান ও নোবেল প্রাইজ পান Raman Effect এর জন্য। উনি কলকাতার বৌবাজারে এই পরীক্ষা করেন। তখন ইন্ডিয়ান এ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স বৌবাজারে ছিল। পরে যাদবপুরে স্থানান্তরিত হয়। রামকৃষ্ণ দেবের শিষ্য ও বিখ্যাত ডাক্তার ও বৈজ্ঞানিক মহেন্দ্রলাল সরকার IACS এর প্রতিস্ঠাতা।  আমি ফিজিক্সে পিএইচডি এখান থেকেই করি।

সন্ধ্যের পর চারিদিক নিঃঝুম অন্ধকার। যাঁরা খাঁচায় পাখি পুষেছেন . তাঁরা জানেন রাতে কালো কাপড় দিয়ে খাঁচা ঢেকে দেওয়া হয়, ঠিক সেই রকম, মনে হয় চতুর্দিক কালো কাপড় দিয়ে কে যেন ঢেকে দিল। সবাই দালানে বসি, ঠাকুরদা গড়গড়ায় টান দিতে দিতে পরের দিন কোন ক্ষেতে কি কাজ হবে নির্দেশ দেন। অন্যান্য আলোচনাও চলে। তার পর ওনার দোতালার ঘরে চলে যেতেন। রাতের খাওয়ার সময় নামতেন।

জোনাকিরা জানান দিত সন্ধ্যা নামছে পাখির পালকের মত ভাসতে ভাসতে। কখনো শেয়ালের দ্রুত চলাফেরা চোখে পড়ত। শেয়ালের লেজ খুব মোটা হয়। লেজ পার্থক্য করে দেয় শেয়াল আর কুকুরের। ‌অনেক গুলো হ্যারিকেন জ্বালানো হত। একটা হ্যাজাক ও ছিল। সেটা জ্বালিয়ে বড়রা ব্রীজ খেলতেন। আগেই বলেছি অনেক আত্মীয় আসতেন সেই সব দিনে , তাঁদের কেউ গল্প বলতে শুরু করতেন সন্ধ্যেবেলায়। বেশীরভাগ ভূতের বা শিকারের গল্প। কখনো ছাতে সতরঞ্চি পেতে সবাই বসতাম, কেউ কেউ গান করতেন। ছাতে শুয়ে শুয়ে মেঘহীন আকাশে সপ্তর্ষি মন্ডল বা কালপুরুষ দেখতাম। কালপুরুষের বেল্ট, কুকুর লুব্ধক এখনো মনে আছে। কেউ গাইড করার ছিলনা বা ভাল বই পাইনি স্টার গেজিং এর ওপর। স্টার গেজিং খুব ভাল অভ্যাস। কাকাদের সবার কাছে নিজস্ব টর্চ থাকত। ৪ ব্যাটারির টর্চ দুটো ছিল। ওগুলো শিকারের সময় লাগত।

হারিকেনের আলোয় পড়তে বসতাম অনেকে মিলে। পড়া কিরকম হত বোঝাই যায়। আমরা যারা মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছি, তারা ক্যারিয়ার কনশাস ছিলাম না। অতদূর ভাবার ক্ষমতা ছিল না। আমরা তো তাও সারা বছর গ্রামে থাকতাম না। যাদের সারা বছর গ্রামে থেকে সাইকেল করে ঝড় জলে ৫ কিমি বা ১০ কিমি কাঁচা পাকা রাস্তা ঠেঙিয়ে স্কুলে আসতে হত, তারা কতটা পড়ার সুযোগ পেত? তাও বাড়ির সব কাজ করে। এখন ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। এখন অবস্থার যে বিরাট পরিবর্তন হয়েছে, তা কিন্তু নয়। তবে এখন প্রায় সব গ্রামে ইলেকট্রিসিটি এসে গেছে এবং তার সাথে গ্রামের ভেতরের রাস্তাগুলো পাকা হয়েছে। মোটর সাইকেল, টোটো ছুটে বেড়াচ্ছে।

(ক্রমশঃ)

(লেখক পরিচিতি – অবসরপ্রাপ্ত পেট্রফিসসিস্ট: ব্যাঙ্গালোরের প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেট্রোলিয়াম বিভাগের প্রাক্তন ফ্যাকাল্টি)

Comment here