(পূর্বের অংশের পর – দ্বিতীয় পর্ব)
( ইন্দ্র বললেন ‘ তথাস্তু যাও মর্তে , সেখানে দুঃখ পাবে , দুঃখ দেবে । সেই দুঃখে ছন্দপাতন অপরাধের ক্ষয়’ —- শাপমোচন , রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )
রবিশংকর —- অন্নপূর্ণার দাম্পত্য জীবনকে আমরা মোটামুটিভাবে তিন ভাগে ভাগ করতে পারি ।
প্রথম ভাগ —- দুজনের মাইহারে পরিচয় , বিবাহ , শুভ’র জন্ম , কমলার রবির জীবনে আবির্ভাব এবং অন্নপূর্ণার মাইহারে শুভকে নিয়ে প্রত্যাবর্তন ।
দ্বিতীয় ভাগ — দুজনের অসুখী দাম্পত্য । এ সময় দুজনে থেকেছেন কলকাতা , দিল্লি , মুম্বই ।
তৃতীয় ভাগ — রবিশংকরের ভারতবর্ষ ছেড়ে যাওয়া , কমলার সঙ্গে বসবাস , অন্নপূর্ণার একাকী জীবন , এবং পরিশেষে পণ্ডিতজীর সঙ্গে আইনি বিচ্ছেদ ও রুশিকুমার পাণ্ড্যকে বিবাহ ।
রবি – অন্নপূর্ণার জীবনের প্রথম এক বছর খুবই সুখে শান্তিতে কেটেছিল । অন্নপূর্ণা নিজেই তা পরে স্বীকার করেছেন । শুভেন্দ্রশংকর বা শুভ’র জন্ম হয় ৩০ শে মার্চ , ১৯৪২ । শুভ জন্মের পর স্ট্র্যাঙ্গুলেটেড ইন্টেস্টাইনাইটিসে আক্রান্ত হয় । রাতের পর রাত এই সময়ে অন্নপূর্ণাকে জেগে কাটাতে হয়েছে । ১৯৪৪ সালের নভেম্বর মাসে রবি তীব্র ভাইরাল ফিভারে আক্রান্ত হন । রাজেন্দ্রশংকর তখন রবিকে মুম্বইয়ের মালাডে নিজের বাড়িতে এনে রাখেন । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য রাজেন্দ্র’র স্ত্রী লক্ষ্মীর সঙ্গে রাজেন্দ্র’র শ্যালিকা কমলাও তখন মালাডের ওই বাড়িতেই থাকতেন। লক্ষ্মী তখন নাচ ছেড়ে গানের সাধনা করছেন । ভাইরাল ফিভারের প্রকোপে রবির সাময়িক স্মৃতিভ্রংশ হয়েছিল । তখন অন্নপূর্ণাই সেবা – শুশ্রুষা করে , রবির সঙ্গে নিয়মিত রেওয়াজ করে রবিকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনেন । আর রবি ! সুস্থ হওয়ার পরই তিনি আবার কমলার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন । এই সময় রবির প্রণয়ঘটিত বিষয়গুলি অন্নপূর্ণা কীভাবে জেনেছিলেন তা নিয়ে নিঃসংশয়ে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছন আজ আর সম্ভব নয় । কেউ কেউ যেমন স্বপন চক্রবর্তী বলেছেন যে রবি নিজেই কমলার প্রতি নিজের দুর্বলতার কথা অন্নপূর্ণাকে বলেন । আবার অতুল মার্চেন্ট প্রমুখদের মতে আলি আকবরের স্ত্রী জুবেইদা অন্নপূর্ণাকে রবিশংকরের সঙ্গে কমলার সম্পর্কের কথা বলে দেন । কারণ আলি আকবর নিজেও রবির মত বহু নারীতে আসক্ত ছিলেন । যার ফলশ্রুতি স্বরূপ পাঁচ সন্তানের আলি আকবর পরে রামদুলারিকে বিবাহ করেন । কিন্তু আলি আকবর রবির তুলনায় অনেক সহজ সরল ছিলেন, এবং জুবেইদাও ছিলেন পুলিশ অফিসারের মেয়ে । ফলে স্ত্রীর কড়া জেরার মুখে আলি আকবর নিজের এবং রবির যাবতীয় মহিলাঘটিত অ্যাডভেঞ্চারের কথা স্বীকার করে ফেলতেন । রাগে , বিরক্তিতে জুবেইদা একদিন অন্নপূর্ণার কাছে রবির কমলাসহ অন্যান্য নারী সংসর্গের কথা বলে দেন । এর ফল হয়েছিল মারাত্মক । অন্নপূর্ণা – রবির দাম্পত্যে সেই যে ফাটল ধরে তা আর কোনদিন স্বাভাবিক হয়নি । অন্নপূর্ণা নিজের শয্যা পৃথক করলেন এবং পরে শুভকে নিয়ে মাইহারে চলে এলেন । শুভ’র তালিম শুরু হল বাবা আলাউদ্দিন খাঁয়ের তত্ত্বাবধানে , আলি আকবরের দুই পুত্র আশিস ও ধ্যানেশের সাথে ।
রাজেন্দ্রশংকর নিজের শ্যালিকার সঙ্গে রবির এই সম্পর্কের কথা জেনে অত্যন্ত বিরক্ত হলেন , কারণ শংকর পরিবারের সকলেই বাবা’র প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন । তাঁরই উদ্যোগে কমলার সঙ্গে তার চেয়ে বয়সে অনেক বড় ভদ্রলোকের বিয়ে হয় । ভদ্রলোকের নাম অমিয় চক্রবর্তী । সীমা, বসন্ত, পতিতা প্রভৃতি ছবির খ্যাতনামা প্রযোজক ।
১৯৪৪ – ১৯৪৭ রবিশংকরের জীবনের এক অন্ধকার অধ্যায় । তাঁর পছন্দের দুই নারী তাঁকে ছেড়ে গেছেন । দুটি হিন্দি ছবিতে সুরকার হিসাবে কাজ করেছেন , নীচানগর ও ধরতি কে লাল , একটি ছবিও দর্শকানুকূল্য পায়নি । ১৯৪৫ এ রবি আইপিটিএ ছাড়লেন । ১৯৪৫ এ নিজের দুই ভাই রাজেন্দ্র ও দেবেন্দ্রকে নিয়ে তৈরি করলেন ইন্ডিয়া রেনেসাঁ অ্যাসোসিয়েশন । এই সংস্থার প্রথম প্রযোজনা হল নেহেরুর ডিসিকভারি অফ ইন্ডিয়া , যা চূড়ান্ত ফ্লপ হয়েছিল । রবি এই কাজটি প্রযোজনা করতে গিয়ে প্রচুর ধারও করেছিলেন , যা শোধ দেওয়ার কোন উপায় ছিল না । এই সময় রবিশংকর এতটাই মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন যে তিনি আত্মহত্যা করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন । এমনই একদিনে , যেদিন এই আত্মহত্যার প্রয়াসটি বাস্তবায়িত করবেন বলে রবি তোড়জোড় করছেন , খবর পেলেন যে জয়পুরের রাজা তাঁর বাজনা শুনতে চেয়েছেন । জয়পুরের রাজা রবির পুরনো গুণগ্রাহী , বাবার সঙ্গে তাঁর বাজনা শুনেছেন । রাজা দরাজ দিল , বাজনার পারিশ্রমিকটিও লোভনীয় । এই অপ্রত্যাশিত আমন্ত্রণ পেয়ে আত্মহত্যার পরিকল্পনা স্থগিত রইল , রবি রেওয়াজ করতে লাগলেন বিকেলে মহারাজার সামনে বাজানোর জন্য । রবির রেওয়াজের সময়ই রবির ঘরে এক মুণ্ডিতমস্তক তরুণ সাধুর প্রবেশ । সাধু রবির শৌচাগারটি ব্যবহার করতে চান । সাধুর নাম তৎবাবা । সাধুর কথাবার্তায় রবি এতটাই মুগ্ধ হলেন যে সেদিন বিকেলের মেহফিলে বাজাতে আর যাওয়া হল না । এই তৎবাবার প্রভাবেই রবি মানসিক অবসাদ কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন ।
অন্নপূর্ণা কিন্তু রবির ঐকান্তিক আগ্রহ সত্ত্বেও এই তৎবাবার প্রতি কোন আকর্ষণ বোধ করেননি । তাঁর অবসাদের উপশমের জন্য কোন বাবাজীর প্রয়োজন ছিল না , তাঁর সঙ্গীতই তাঁর আশ্রয় ছিল । দ্বিতীয়ত নিজেদের দাম্পত্যের একান্ত পরিসরে কোন তৃতীয় ব্যক্তির অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশকে তিনি প্রশ্রয় দিতে রাজী ছিলেন না । ১৯৫২ সালে রবি তৎবাবাকে নিয়ে মাইহারে হাজির হলে অন্নপূর্ণা অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলেন । তৎবাবা অন্নপূর্ণাকে অনামিকায় একটি রুবি ধারণ করতে বললে অন্নপূর্ণা সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন ।
এই ধরণের গুরুদের প্রতি অন্নপূর্ণা কোনদিনই আস্থাশীল ছিলেন না । অনেক পরে ১৯৮৫ সাল নাগাদ সাঁইবাবা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে , সে প্রস্তাবের প্রত্যুত্তরে তিনি পত্রপাঠ না করে দেন ।
যাই হোক , ১৯৫৫’র আগস্ট মাসে শুভ’র মুখ চেয়ে অন্নপূর্ণা রবির সংসারে ফিরলেন । রবির অবস্থা তখন অনেকটাই ফিরেছে । অল ইন্ডিয়া রেডিওর এক্সটার্নাল সার্ভিসের ডাইরেক্টর পদে যোগ দিয়েছেন । দিল্লীতে কাপড়ের মিলের মালিক ধনকুবের ভরতরামজীর বাড়িতে দুজনে সংসার পাতলেন । কিন্তু একসাথে থাকলেও দুজনের মধ্যে দূরত্ব বাড়তেই লাগল । কারণ সংগীতসাধনা সম্বন্ধে দু’জনের দৃষ্টিভঙ্গীর ফারাক । একদিন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে বাবা সুরশৃঙ্গার ( বাবারই আবিষ্কৃত যন্ত্র ) বাজাচ্ছেন , রবি ঘনিষ্ঠ বৃত্তে মন্তব্য করলেন বাবার বাজনা নবীন শ্রোতাদের আকর্ষণ করতে পারছে না । ধ্রুপদ যেমন ভারতীয় সঙ্গীত থেকে জনপ্রিয়তা হারিয়েছে , তেমনই বাবার ঢংএর বাজনাও শীঘ্রই অবলুপ্ত হবে , তাই তার আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন । অন্নপূর্ণা অত্যন্ত আহত হয়েছিলেন রবির এই মন্তব্যে , কিন্তু রবির ঘনিষ্ঠ বৃত্তে রবির এই মনোভাবকে তোল্লাই দেওয়ার লোকের অভাব ছিল না । ভারতীয় মার্গসংগীতে দুই ধরণের সাধনার কথা বলা আছে । মার্গী —- নির্দিষ্ট সমঝদার শ্রোতার জন্য , আত্ম – উত্তরণে রজন্য । আর দেশী — সাধারণ মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য । রবি এবং অন্নপূর্ণা দুই ভিন্ন ধারার পথিক ছিলেন ; তাই দুটি সমান্তরাল রেললাইনের মতো দুজনের মিলন কার্যত অসম্ভব ছিল ।
অন্নপূর্ণার প্রতিভা নিয়ে রবি হীনমন্যতায় ভুগেছেন সারাজীবন । তিনি নিজে জানতেন সঙ্গীতজ্ঞ হিসাবে অন্নপূর্ণা তাঁর চেয়ে অনেক বেশি প্রতিভাবান । সমঝদারেরা বলেন বাবা আলাউদ্দিন খাঁয়ের তালিমের আশিভাগ যদি অন্নপূর্ণা রপ্ত করে থাকেন , আলি আকবর পেরেছেন ষাট । সেখানে রবি চল্লিশের আশেপাশে । দুজনের যুগলবন্দী সম্বন্ধে এক প্রত্যক্ষদর্শীর মতামত দেখে নেওয়া যাক । তারিখ – ৩১ শে ডিসেম্বর । স্থান — কনস্টিটিউশন ক্লাব , দিল্লি ।
“ What I remember very clearly six decades later ; is that during the recital Ravi Shankar would play a phase and pause for Annapurna to do her bit and each time she outdid him to the delight of the audience . Especially during the jhala and fast improvisations , he threw her several challenges but each time she went on better and outperformed him in terms of speed and breath taking bit of fancy . He tried playing faster , and unfazed she responded in equal measure . I remember the moment when he almost in desperation , played a superfast phase and she took up the challenge and outdid him . He then threw up his hands , as if saying ‘ I give up’ , and the audience burst into ecstatic applause . Ravi Shankar clearly meant to led , though it was a duet concert , but again and again she outshone him , without fanfare , flamboyance or theatrics …. Whether it was an alap , gat or tihai to arrive at sam , it was she who carried the day .” ( শকুন্তলা নরসিংহ)
ঐ বছরের ৩০ শে মার্চ ওই একই জায়গায় আর একটি জলসা হয় । অংশগ্রহণকারীরা সকলেই দিকপাল । কুমার গন্ধর্ব , বিসমিল্লা খান , আলি আকবর , হীরা বাইবরোদকর , গাঙ্গুবাই হাঙ্গল , নজাকত সালামত খান । তবলা সঙ্গতে আহমদজান থিরাকুয়া আর প্রেমবল্লভ । মাঝরাতে দুজনের যুগলবন্দী । অন্নপূর্ণা শুরু করলেন রাগেশ্রী । মন্দ্রসপ্তকে শুরু করে মীর খন্দিচালে বিস্তারের পর যখন অতি কোমল ঋষভ ছুঁয়ে যাচ্ছেন , তখন মনে হয়েছে প্রেক্ষাগৃহে অতিপ্রাকৃত কিছু ঘটতে চলেছে । রবি সেদিন অন্নপূর্ণার ধারেকাছেও পৌঁছতে পারেননি । এরপরে রবিশংকর আর কোনদিন অন্নপূর্ণার সাথে বাজাননি । যে কয়েকটা হাতে গোনা অনুষ্ঠান দুজনে একসাথে করেছেন , তাতে এমনও হয়েছে যে রবি অন্নপূর্ণার মাইক্রোফোন নিয়ে নিয়েছেন । অন্নপূর্ণা কিন্তু নিরুত্তাপভাবে বাজিয়ে গেছেন , দর্শকরা রবিকে ধিক্কার দিয়েছেন ।
রবি অন্নপূর্ণাকে নিয়ে যে হীনমন্যতায় ভুগতেন তার আর একটি নিদর্শন দেখি । এই কাহিনীর বক্তা অন্নপূর্ণা স্বয়ং । রবি তখন সদ্যবিবাহিত । মাইহারে গেছেন দুজনে । মাইহারের রাজা ব্রিজনাথ অন্নপূর্ণার বাজনা শুনতে চেয়েছেন । রবি আমন্ত্রিত না হয়েও তাঁদে রসঙ্গে চললেন । অন্নপূর্ণার বাজনা শুনে রাজা যখন উঠবেন , রবি রাজাকে ধরে বসলেন যে তাঁর বাজনাও শুনতে হবে । রাজা বিরক্ত হলেও বাবা’র জামাতাকে নিরাশ করার কোন ইচ্ছাই তাঁর ছিল না । তাই সৌজন্যের খাতিরে কিছুক্ষণ রবির বাজনা শুনে তাঁর রাতের খাওয়ার সময় হয়ে গেছে বলে উঠে চলে গেলেন । এরজন্য অন্নপূর্ণাকে রবির কাছ থেকে বহু কটুকথা শুনতে হয় ।
১৯৫৬ তে রবি অল ইন্ডিয়া রেডিও ছাড়লেন এবং অমিয় চক্রবর্তীর মৃত্যুর পর তাঁর সদ্যবিধবা স্ত্রী কমলার সঙ্গে নিজের সম্পর্কটি আবার শুরু করলেন । শুধু তাই নয় নিজের বন্ধু , এইচএমভি’র বিমান ঘোষে রসঙ্গে অন্নপূর্ণার অবৈধ সম্পর্ক আছে এমন কথা বাজারে রটিয়ে দিলেন । এমনকি আলাউদ্দিন খাঁয়ের কাছেও এ ব্যাপারে অভিযোগ করতে ছাড়লেন না । এর ফলশ্রুতিস্বরূপ অন্নপূর্ণা দ্বিতীয়বার স্বামীর ঘর ছাড়লেন ।
এবার আবারও গন্তব্য মাইহার । আলি আকবর ততদিনে কলকাতায় আলি আকবর স্কুল অফ মিউজিক স্থাপন করেছেন । সেখানে শিক্ষক হিসাবে যোগ দিয়েছেন দিকপাল শিল্পীরা — বাহাদুর খাঁ , নিখিল ব্যানার্জী , মহাপুরুষ মিশ্র । অন্নপূর্ণা হলেন প্রতিষ্ঠানের ভাইস প্রিন্সিপল । এই সময়েই নেতাজী ইন্ডোরে অন্নপূর্ণা ( ১৯৫৬ সালের ১৪ ই এপ্রিল ) নিজের শেষ অনুষ্ঠানটি করলেন । এই সময় শুভ দিল্লি থেকে কলকাতায় এসে মডার্ন স্কুলে ভর্তি হলে রবিশংকর বালিগঞ্জের প্রেসিডেন্সি কোর্টে দুটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন । একটি অন্নপূর্ণা ও শুভ’র জন্য । অপরটিতে এসে উঠলেন সেই বিমান ঘোষ , যাঁর সঙ্গে রবি অন্নপূর্ণার নাম জড়িয়ে কুৎসিত ইঙ্গিত করেছিলেন । বিমানবাবু অন্নপূর্ণার গতিবিধি সম্বন্ধে রবিকে অবহিত করতেন ।
অন্নপূর্ণা নিজের বাজনার রেকর্ডিং পছন্দ করতেন না । তিনি একে তাঁর নিভৃত সাধনায় অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ বলে মনে করতেন । প্রেসিডেন্সি কোর্টে তখন বিধু গাঙ্গুলির দোকান ছিল । এই বিধুবাবুই আলি আকবরের পরামর্শক্রমে অন্নপূর্ণার রেওয়াজের রেকর্ডিংকরেন । পরে অন্নপূর্ণা একথা জানতে পেরে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন ও বিধুবাবুকে বাধ্যকরেন অধিকাংশ রেকর্ডিং নষ্ট করে দিতে ।
১৯৬০ সালে দিল্লির বাস পাকাপাকিভাবে উঠিয়ে রবি চলে আসেন মুম্বইয়ের মালাবার হিলসের পাভলোভা অ্যাপার্টমেন্টে । ১৯৬১ তে শুভকে নিয়ে অন্নপূর্ণা কলকাতার পাট চুকিয়ে এই বাড়িতে চলে আসেন । কলকাতায় থাকাকালীনই মা শারদা আর বাবা আলাউদ্দিনের ছবি ছুঁইয়ে অন্নপূর্ণাকে রবি বাধ্য করেছিলেন শপথ করতে যে তিনি আর জনসমক্ষে বাজাবেন না । কিন্তু অন্নপূর্ণা কেন এমন অপমানজনক শর্তে রাজী হলেন ! এর প্রথম এবং প্রধান কারণ হল শুভ । শুভ’র কথা ভেবেই পণ্ডিতজীর এমন বেয়াড়া শর্ত অন্নপূর্ণা মেনে নিয়েছিলেন । দ্বিতীয় কথা অন্নপূর্ণা সত্যিই খ্যাতির জন্য বাজাতেন না । সঙ্গীত তাঁর কাছে সাধনাই ছিল । আজকের বাজার সর্বস্ব পৃথিবীতে এমন কথা ভাবা সত্যিই অসম্ভব , কিন্তু অন্নপূর্ণা অন্য মূল্যবোধের মানুষ ছিলেন । ঈর্ষায় অন্ধ হয়ে রবিশংকর অন্নপূর্ণার হাতের সবকটা আঙ্গুল ভেঙ্গে দিতে চেয়েছিলেন , অথচ অন্নপূর্ণা কোনদিন কোন কটু কথা বলেননি । রবির যাবতীয় ঈর্ষা , রাগ অন্নপূর্ণার নির্লিপ্তির দেওয়ালে মাথা কুটে মরেছে , রবি আরও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠেছেন । অন্নপূর্ণার একমাত্র দুবর্ল জায়গা ছিল শুভ , রবি সেখানেই আঘাত করবেন বলে মনস্থ করলেন —- সে কথায় পরে আসছি ।
১৯৬৭ সালে রবি পাকাপাকিভাবে দেশ ছাড়লেন । সঙ্গী কমলা । ১৯৬৮ সালে অন্নপূর্ণা আকাশগঙ্গা অ্যাপার্টমেন্টের ছয়তলার ফ্ল্যাটে চলে এলেন , যেখানে তিনি আমৃত্যু ছিলেন । পণ্ডিতজী তখন মাসে মাসে ৩০০০ টাকা অন্নপূর্ণাকে দিতেন ভরনপোষণের জন্য । সে টাকাও সময় মতো আসতো না । অন্নপূর্ণাকে টাকার জন্য রবিশংকরের সলিসিটর সোলি বাটলিওয়ালার দরজায় ঘুরতে হত । ভাগ্যিস হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার মধ্যস্থতায় রবি ফ্ল্যাট দুটি অন্নপূর্ণা আর শুভ’র নামে করে দিয়েছিলেন তাই জীবদ্দশায় অন্নপূর্ণাকে ঘরছাড়া হতে হয়নি । কিন্তু ১৯৭০ সালে শুভ চলে গেলে রবি ফ্ল্যাটের শুভ’ রঅংশ বিক্রি করে দেন অন্নপূর্ণাকে বিপদে ফেলার জন্য । ভাগ্যের পরিহাস এমনই যে ফ্ল্যাট বিক্রির পুরো টাকাটাই সোলি বাটলিওয়ালা পকেটস্থ করেন , রবিশংকর এক পয়সাও পাননি । ১৯৭৩ সালে হৃষিকেশ মুখার্জি রবি – অন্নপূর্ণার জীবন নিয়ে ‘অভিমান’ ছবি করতে চান । ছবিটি অমিয় প্রোডাকশনের ব্যানারে ( অমিতাভের অমি জয়ার য়া ) তৈরি হয় । অন্নপূর্ণা ছবিটি তৈরির ব্যাপারে সম্মতি দেন একটা শর্তে যে তাঁর বা রবির নাম ব্যবহার করা যাবে না । অন্নপূর্ণার রাজি হওয়ার আরও একটা কারণ ছিলেন শচীন দেববর্মন , যিনি এই ছবিতে সুরারোপ করেছিলেন । অনেকেই জেনে অবাক হবেন যে শচীন দেববর্মন বাবা আলাউদ্দিন খাঁয়ের ছাত্র ছিলেন ।
এই সময় অন্নপূর্ণা অনাহারে থেকেছেন । ধ্যানেশ খাঁ পরে বলেছেন যে তিনি এসে দেখেছেন অন্নপূর্ণার ভাঁড়ার সম্পূর্ণ শূন্য । তিনি বাজার করে এনে দিয়েছেন , অন্নপূর্ণা ধ্যানেশের হাত ধরে কেঁদে ফেলে বলেছেন ‘ আমি তোমার পিসীমা আমার তোমাকে খাওয়ান উচিত ।’ অথচ অন্নপূর্ণা কাউকে শেখানোর জন্য পয়সা নেননি , উপরন্তু ছাত্রছাত্রীদের প্রতিদিন রান্না করে খাইয়েছেন ।
এই সময় এনসিপিএর ( ন্যাশানাল স্কুল অফ পার্ফর্মিং আর্টস ) ডিরেক্টর নারায়ণ মেননের প্রস্তাব অনুযায়ী অন্নপূর্ণা সপ্তাহে দুদিন এনসিপিএতে গিয়ে শেখাতে রাজী হন । গাড়ি করে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হত এবং আবার ক্লাস শেষ হলে ফিরিয়ে আনা হত । বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে এটুকুই তাঁর যোগাযোগ ছিল । ডক্টর ললিতা রাও , যিনি পরে মহারাষ্ট্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন ( ১৯৮০ – ১৯৮৫) তিনি বলেছেন এই সময় অন্নপূর্ণা চরম অপুষ্টিতে ভুগছিলেন । নিরূপায় হয়ে অন্নপূর্ণা এই সময়ে ফ্ল্যাটের একটি ঘরে পেয়িং গেস্ট রাখতে শুরু করেন । এই ঘরেই পেয়িং গেস্ট ছিলেন গৌতম মুখোপাধ্যায়, যিনি পরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্যা রাণুকে বিবাহ করেন । রাণু – গৌতমের বিবাহ হেমন্ত প্রথমে মেনে নেননি। তখন আকাশগঙ্গার এই ঘরেই রাণু – গৌতম থাকতেন । নিজের পুত্র – পুত্রবধূর মতোই গৌতম – রাণুকে স্নেহ করতেন অন্নপূর্ণা । পরে তাঁরই মধ্যস্থতায় হেমন্ত এই বিয়ে মেনে নেন । দুজনে অন্নপূর্ণার ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে গেলে অন্নপূর্ণা আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন ।
১৯৮১ সালে কমলা — রবির চৌদ্দ বছরের সহবাসের ইতি ঘটে । কমলা চেন্নাইতে চলে আসেন এবং নিজের মৃত্যু পর্যন্ত চূড়ান্ত নিঃসঙ্গতার মধ্যে জীবন কাটান । ১৯৮২ সালে বাবা আলাউদ্দিন মিউজিক সার্কলের আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে রবি মুম্বইতে আসেন । অন্নপূর্ণার সঙ্গে ভাঙ্গা সম্পর্ক জোড়া লাগিয়ে আবার একসাথে থাকার প্রস্তাব দেন । বলাই বাহুল্যঅন্নপূর্ণা সে প্রস্তাব পত্রপাঠ নাকচ করে দেন ।
রবি অন্নপূর্ণার রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে বলেন — “ আজকাল দু’হাজার টাকায় তোমার চলছেনা শুনছি ।’ অন্নপূর্ণা নিরুত্তর । “ প্রত্যেকদিন কিলো কিলো চাল , গম কাক পায়রার পিছনে খরচ করলে টাকা থাকবে কী করে ?” অন্নপূর্ণা চাপা গলায় বলেন “ ওরা অন্তত বেইমান নয় ।” নিষ্ঠুর হেসে রবি বলেন “ দুদিন খাবার দেওয়া বন্ধ করে দাও ওরা আর আসবে না ।”
এরপরই রবি অন্নপূর্ণাকে বলেন তাঁর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদে সম্মতি দিতে । একলক্ষ টাকা অন্নপূর্ণা তখনই পাবেন বাকি একলাখ পাবেন বিচ্ছেদের পর । পুরো কথোপকথনের সময় হেমন্ত কন্যা রাণুসহ রবিশংকরের বন্ধুবান্ধবেরা রয়েছেন বসার ঘরে । অপমানিত অন্নপূর্ণা আর দ্বিরুক্তি না করে বিচ্ছেদের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে দেন ।
পরে পণ্ডিত যতীন ভট্টাচার্য্য , বাবা আলাউদ্দিন খাঁয়ের ছাত্র, অন্নপূর্ণার পরম সুহৃদ অন্নপূর্ণাকে যখন জিজ্ঞাসা করেন যে অন্নপূর্ণা খোরপোষের কথা কী বলেছেন । বিস্মিত অন্নপূর্ণা বলেছিলেন “ খোরপোষ কী ?”
এমনই ছিলেন অন্নপূর্ণা । জাগতিক বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন । রবি – অন্নপূর্ণা যখন দিল্লিবাসী , তখন থেকেই তাঁদের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর পরিচয় । ইয়েহুদি মেনুহিন যখন ভারতে আসেন তখন অন্নপূর্ণার বাজনা শোনার ইচ্ছাপ্রকাশ করেন । আলি আকবর এবং রবিশংকর দুজনেই ভেবেছিলেন তাঁরা অনুরোধ করলে অন্নপূর্ণা শুনবেন না । তাঁরা তখন ইন্দিরা গান্ধীকে ধরলেন অন্নপূর্ণাকে রাজী করানোর জন্য । যথা সময়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে চিঠি এল অন্নপূর্ণার কাছে মেনুহিনের সামনে বাজানোর জন্য । অন্নপূর্ণা বললেন মা শারদার মূর্তির সামনে প্রত্যেকদিন রেওয়াজের সময় মেনুহিন তাঁর বাজনা শুনতে পারেন । যদিও শেষ মুহূর্তে মেনুহিনের বাড়িতে একটি দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ায় মেনুহিনের সে যাত্রা অন্নপূর্ণার বাজনা শোনা হয়নি । তাঁর পরিবর্তে সেই অতীন্দ্রীয় অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন ।
ইমার্জেন্সির সময় অন্নপূর্ণার আকাশগঙ্গার ফ্ল্যাটে একদিন হাজির হলেন ইন্দিরা গান্ধী । অন্নপূর্ণাকে জানালেন তিনি পদ্মভূষণের জন্য মনোনীত হয়েছেন । ইন্দিরা প্রস্তাব দেন দিল্লি গিয়ে তাঁর সুরবাহারের কিছু রেকর্ডিং করে আসার জন্য যা ভবিষ্যৎ শিক্ষার্থীদের কাজে আসবে । অন্নপূর্ণা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন । এরপর ইন্দিরা ইমার্জেন্সি সম্বন্ধে তাঁর মতামত জানতে চাইলে অন্নপূর্ণা সপাটে উত্তর দেন ‘ আমি রাজনীতি বুঝি না কিন্তু আপনি যা করেছেন তা খুব খারাপ ।’
ম্লান হেসে ইন্দিরা সেদিন বিদায় নিয়েছিলেন । নির্দিষ্ট সময়ে ডাকযোগে পদ্মভূষণ প্রাপ্তির সার্টিফিকেট অন্নপূর্ণার কাছে পৌঁছে যায় ।
আর একবার হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া অন্নপূর্ণাকে একটি দামী ঘড়ি উপহার দেন । অন্নপূর্ণা ঘড়িটি নিয়ে সটান ছয়তলার উপর থেকে নীচে ফেলে দেন । পরে আর একবার অন্নপূর্ণার চূড়ান্ত অর্থকষ্টের সময় হরিপ্রসাদ এক শুভানুধ্যায়ীর কাছ থেকে এক সুটকেস টাকা নিয়ে এলে অন্নপূর্ণা সুটকেসটি ছুঁড়ে ফেলতে উদ্যত হন । হরিপ্রসাদ আগেরবারের অভিজ্ঞতা থেকে ঠেকে শিখে অন্নপূর্ণাকে নিরস্ত করতে সক্ষম হন , কিন্তু অন্নপূর্ণা একটি টাকাও ছুঁয়ে দেখেননি । সুরজিত সিংএ রলেখা হরিপ্রসাদেরআত্মজীবনী ‘ বাঁশুরিস ম্রাট হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার’ উদ্বোধন করেন অমিতাভ বচ্চন । সেই অনুষ্ঠানে হরিপ্রসাদ অন্নপূর্ণাকে নিয়ে যেতে চাইলে অন্নপূর্ণা বাড়ির দরজা খোলেননি । পরে এহেন রূঢ় আচরণের কারণ জিজ্ঞাসা করলে অন্নপূর্ণা বলেছেন যে গুরুর কাজ হল শিষ্যের পা যাতে মাটিতে থাকে তা নিশ্চিত করা । এবং সেই অপ্রিয় কাজটিই তিনি করেছেন ।
এই নির্লোভ , নিরহংকারী , খ্যাতির প্রতি উদাসীন শিল্পী সারা জীবন স্বামীর কাছ থেকে অপরিসীম লাঞ্ছনা আর অপমান ছাড়া কিছুই পাননি । অন্নপূর্ণার কাছে যে কোন পুরুষ শিক্ষার্থী এলেই , তাঁর বয়স যাই হোক না কেন , রবিশংকর তাঁর সঙ্গে অন্নপূর্ণাকে জড়িয়ে কুৎসিততম কথা প্রচার করতেন । সর্বত্র প্রচার করতেন অন্নপূর্ণা পাগল , দুশ্চরিত্রা , সবার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন । একবার সিদ্ধেশ্বরী দেবী এসেছেন কিষাণ মহারাজকে নিয়ে অন্নপূর্ণার সঙ্গে দেখা করতে । প্রাথমিক পরিচয়ের পর স্বভাব – সরল সিদ্ধেশ্বরী বলে উঠলেন ‘ দেখ কিষাণ ইসনে মুঝে গালি নেহি দি ।’ কিষাণ মহারাজ যত সিদ্ধেশ্বরীকে ইঙ্গিতে চুপ করতে বলেন , সিদ্ধেশ্বরী তত ইবলে চলেন “ রবিজীনে বোলাথা ও সবকো গালি দেতি হ্যায় , পর উসনে মুঝে গালি নেহি দি ।
যাইহোক রবি— অন্নপূর্ণার জীবন থেকে আমরা অনেক দূরে এসেছি । এবার আলোচনা করবো এই কাহিনীর সবচাইতে ভাগ্যহত মানুষটিকে নিয়ে । সে শুভ ।
রবিশংকর ও অন্নপূর্ণা —- তখন সদ্যবিবাহিত
(ক্রমশঃ)
অনিন্দ্য গৌতম পেশায় পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসনিক কৃত্যকের একজন আধিকারিক। বর্তমানে পুরুলিয়া জেলায় উপশাসক এবং উপসমাহর্তা পদে কর্মরত। মূলত অন্তর্জালে লেখালেখি করেন।
Comment here