সংস্কৃতি

কাব্যে উপেক্ষিতা – অন্নপূর্ণা দেবী

(পূর্বের অংশের পর – তৃতীয় পর্ব)

( But when God sends harm , no man can sidestep it , no matter how strong he may be — Electra , Sophocles )

অন্নপূর্ণা – রবির অসুখী দাম্পত্যের প্রভাবে সবচাইতে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত যদি কেউ হয়ে থাকে সে শুভ। রবিশংকরের ঈর্ষা অন্নপূর্ণার সাঙ্গীতিক জীবনকে যেমন শেষ করে দিয়েছিলো, তেমনই নিজের আত্মজও তার থেকে রেহাই পায়নি। শুভ জন্ম থেকেই ছিলো অন্তর্মূখী এবং লাজুক। ক্রমাগত অসুখে ভুগে সে শারীরিক এবং মানসিক দুই দিক থেকেই দূর্বল হয়ে পড়েছিল। অন্নপূর্ণা মুম্বাই ছেড়ে মাইহারে চলে এলে, বাবা আলাউদ্দিনের কাছেই আশিস আর ধ্যানেশের সাথে শুভর সরোদ শিক্ষা শুরু হয় । কিন্তু বালক শুভর কাছে মাইহারের দিনগুলি ছিলো দুঃস্বপ্নের মতো । আশিস , ধ্যানেশের মতোই সেও ছিলো বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত। মা মায়ের চেয়েও বেশী শিক্ষক। তাছাড়া অন্নপূর্ণা নিজেও সেই সময় নিজের দাম্পত্য জীবনের অশান্তি নিয়ে জেরবার হয়ে যাচ্ছিলেন। এই অনিশ্চয়তা , পিতার অনুপস্থিতিজনিত এই অভাববোধ শুভকে সবসময় কুরে কুরে খেতে থাকে । তাছাড়া মুম্বাই শহরের আকর্ষক জীবনের পর মাইহারের নিন্তরঙ্গ জীবনে শুভ হাঁফিয়ে উঠেছিল । নিজের ছেলের এই অসন্তুষ্টিকে মূলধন করেই রবি বারবার অন্নপূর্ণার বিরুদ্ধে শুভকে বোড়ের ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহার করেছেন ।

একথা এখন সর্বজনবিদিত যে রবি শুভর সঙ্গে বাজানোর সময় মাইক্রোফোনে কারচুপি করতেন । আসলে শুভ এতটাই প্রতিভাবান ছিলেন যে রবি ভয় পেতেন যে কালে কালে তিনি রবিকেও ছাড়িয়ে যাবেন। দ্বিতীয়ত শুভ যদি সফল হতেন সেই সাফল্যের কৃতিত্বের সিংহভাগ পেতেন বাবা আলাউদ্দিন খাঁ এবং অন্নপূর্ণা। শুভ’র পরিচিতি হতো মাইহার – সেনিয়া ঘরানার উত্তরসূরী হিসাবে , রবিশংকরের ছেলে হিসাবে নয় । তাই রবিশংকর স্ত্রী’র পর নিজের একমাত্র ছেলের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করতে উদ্যত হলেন।

রবি বাদক হিসাবে সাফল্য পাওয়ার জন্য কতটা নির্মম , কতটা অপেশাদার হতে পারেন তার একটি নিদর্শন দিই । তখন রবির শিকার হয়েছিলেন আলি আকবর স্বয়ং। কেমনভাবে এবার বলছি। যখন আলি আকবর বা রবি ছাত্র ছিলেন তখন বাবা আলাউদ্দিন খাঁ সরোদ বাঁধতেন বি টনিক এ। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বাহাদুর খাঁ বা আলি আকবর খাঁ সাহেব সারোদকে বাঁধতে সক্ষম হলেন সি টনিকে । যদিও আন্তর্জাতিক হিসাবে C এর যা মান অর্থাৎ 261.63 Hz তার থেকে তাঁদের C কিছুটা নীচেই ছিল । রবি মাইহারে থাকাকালীন এই ভাবেই তাঁদের সঙ্গে সামজস্য রেখে সেতার বাঁধতেন । কিন্তু পরে কলকাতার কানাইলালের দোকান থেকে একটু ছোট সেতার আনাতে লাগলেন ও বাঁধলেন C# এ যার মান 277.18 Hz । এর ফলে যুগলবন্দীর সময় আলি আকবরের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠত । যেকোন পেশাদারী শিল্পীর মতো সহশিল্পীর সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখে রবিশংকরের সেতার বাঁধা উচিত ছিলো 269.4 Hz এ যা C এবং C# এর গড়। কিন্তু রবি তা না করে 274 Hz পর্যন্ত বাজানোর সময় তুলতে লাগালেন। এর ফলে যুগলবন্দীর সময় খাঁ সাহেবের সরোদের তার ছিঁড়ে যেতে থাকলো। ১৯৫০ এ দিল্লীতে এমনই এক যুগলবন্দীর সময় আলি আকবর প্রায় বাজাতেই পারেননি। এ ঘটনা শুনে বাবা পরে বলেছিলেন —

‘আমি আলি আকবরকে এমনই তালিম দিয়েছি যে সে যেকোন শিল্পীকে থামিয়ে দিতে পারে , কিন্তু এখানে সে কেন রবির এভাবে বাজানো মেনে নিল জানি না ।’ রবিশংকরের এই অপেশাদারী মনোভাবের জন্যই আলি আকবর পরে রবিশংকরের সঙ্গে আর বাজাননি , নিজের যুগলবন্দীর সাথী হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন নিখিল ব্যানার্জীকে ।

যাক, ফিরে আসি শুভ’র কথায়। রবি — অন্নপূর্ণা তখন মুম্বইতে স্থিতু হয়েছেন । এর আগেই রবি শুভকে সরোদ ছেড়ে সেতার শিখতে বাধ্য করেছেন। কারণ বাবা এবং অন্নপূর্ণা এতদিন শুভকে সরোদ শেখাচ্ছিলেন । রবি শুভকে নিজের মায়ের প্রতি বিরূপ করে তোলার জন্য তাকে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যেতেন, টাকা দিতেন। মুম্বাইতে এসে রবির প্ররোচনায় শুভ জে জে স্কুল অফ আর্টসে ছবি আঁকা শিখতে ভর্তি হলেন। যুক্তি হিসাবে রবি বললেন উদয়শংকরও বিদেশে ফাইন আর্টস শিখতে গিয়ে নাচ শিখেছিলেন। কিন্তু একথা রবি ভুলে গেলেন যে উদয়শংকরের জীবনে যা হয়েছে তা শুভ’র ক্ষেত্রে কার্যকরী নাও হতে পারে। দ্বিতীয়ত, উদয়শংকর মাইহার — সেনিয়া ঘরানার মতো কোন শতাব্দী প্রাচীন ঘরানার উত্তরাধিকারী ছিলেন না । শুভ’র তাঁর চেয়ে ভালো শিল্পী হওয়ার সম্ভবনাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে চেয়েছিলেন তিনি। ছেলের মতিগতি দেখে অন্ত্রপূর্ণাও শুভকে সিনেমা দেখার অবাধ ছাড় দেওয়া ইত্যাদি ঘুষ দিয়ে রেওয়াজ করতে বাধ্য করতে লাগলেন। কিন্তু অন্নপূর্ণা যতই এসব করলেন শুভ ততই তাঁর উপর বিরূপ হয়ে উঠতে লাগলো ।

১৯৭০ সাল ।তখন রবিশংকর অধিকাংশ সময়ই বিদেশে থাকেন। একবার মুম্বইতে এসে শুভর জন্য ঘরোয়া জলসার আয়োজন করলেন তিনি । এবং সেদিনই শুভকে প্রস্তাব দিলেন আমেরিকায় তাঁর সঙ্গে চলে যাওয়ার জন্য। শুভ’র চোখে তখন অনন্ত স্বপ্ন । অন্নপূর্ণা শুধু বলেছিলেন আর দেড় বছর থেকে যেতে। তাহলে শুভর তালিম একটা জায়গায় পৌঁছতো । কিন্তু শুভ তার সিদ্ধান্তে অনড় । এরপর হঠাৎ একদিন শোনা গেল শুভ নাকি ঘুমের বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করতে গেছেন। অন্নপূর্ণা পরে বারবার বলেছেন যে এমনকিছুই সেদিন ঘটেনি। তিনি শুভ’র ‘ আত্মহত্যার চেষ্টা’ র খবর পেয়ে ডাক্তার ডেকেছিলেন, ডাক্তারি পরীক্ষায় কোন ঘুমের ওষুধের চিহ্নমাত্রও পাওয়া যায়নি শুভর শরীরে । কোনো ঘুমের বড়ির পাতাও ছিলনা অকুস্থলে। আসলে রবিশংকরের প্ররোচনায় আত্মহত্যার নাটক করেছিল শুভ যাতে অন্নপূর্ণা শুভকে আর আটকাতে না পারেন।

মার্কিন দেশে শুভর জীবন মোটেও সুখী হয়নি। রবিশংকর মাঝেমধ্যে তাঁর সঙ্গে যুগলবন্দী করেছেন, কিন্তু সেখানেও শুভকে তার প্রাপ্য জায়গা দেননি, মাইক্রোফোনে কারচুপি করে শুভ’র বাজনাকে দর্শকের কাছে পৌঁছতে দেননি। ঠিক যেমনটা তিনি করেছিলেন আলি আকবরের সঙ্গে। অতুল মার্চেন্টের কাছে আলি আকবর বলেছিলেন, ‘পন্ডিতজি ইচ্ছা করে আমার মাইক্রোফোনের ভল্যুম কমিয়ে রাখতেন, সেখানে শুভ কে ! ’

শুভ শেষ পর্যন্ত গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য বেল টেলিফোন কোম্পানিতে তাঁদের ইয়েলো পেজ ডিজাইনের কাজ নেন । শুভ’র চূড়ান্ত দুঃসময়ে রবিশংকর কোনদিন শুভকে কোন আর্থিক সাহায্য করেননি , অথচ অনুষ্কা সবদিক দিয়েই রবিশংকরের প্রশ্রয় পেয়েছেন । এর কারণ হয়তো অনুষ্কাকে নিয়ে তাঁর কোন নিরাপত্তাহীনতা ছিল না । শুভ’র বিয়ে হয়েছিলো লিন্ডা নামে এক মার্কিনি মেয়ের সঙ্গে। রবিশংকরের এই বিয়েতে স্পষ্ট অমত ছিলো। শুভ চেয়েছিলেন ভারতীয় রীতি রেওয়াজ মেনে তাঁর বিয়ে হবে। কিন্তু তাঁর বিয়ের সময় রবিশংকর বিদেশে অনুষ্ঠান করছিলেন। আর কমলা ! যিনি নিজেকে সর্বত্র শুভ’র মা বলে পরিচয় দিয়ে বেড়াতেন তিনিও শুভ’র বিয়েতে উপস্থিত থাকার জন্য সময় দিতে পারেননি । মা-বাবার অনুপস্থিতিতে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে লস এঞ্জেলেসের সেল্ফ রিয়েলাইজেশন সেন্টারে শুভ’র বিবাহ হয়।

রবিশংকর অনুষ্ঠানে কেমনভাবে শুভ’র বাজনাকে দর্শকের কাছে পৌঁছতে দিতেন না তাঁর তিনটি উদাহরণ দেবো ——–

১৯৮৯ সাল। লণ্ডনের বার্বিকন সেন্টারে পন্ডিতজীর সংগীত জীবনের পঞ্চাশতম বছর উদযাপনের অনুষ্ঠান। রবির জীবন থেকে তখন কমলা অন্তর্হিতা, এসে গেছেন সুকন্যা । রবিশংকর পাখোয়াজের সঙ্গে বাজালেন রাগ ঝিঁঝোটি আর খাম্বাজ । শুভ মঞ্চে বসে বাজাতেই পারলেন না। এর কয়েকবছর পর কলকাতার ডোভার লেনে শুভ’র মাইক্রোফোনের আওয়াজ কম দেখে ধ্যানেশ খাঁ সেই মাইক্রোফোন ঠিক করতে গেলে রবির এক শিষ্য রূঢ়ভাবে তাঁকে বলেন ‘ভারতীয় পরম্পরায় শিষ্যর বাজনার আওয়াজ গুরুর চেয়ে বেশি হওয়া উচিত নয় ।’ একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে দেখেছেন আশিস খাঁ । একবার ফিলাডেলফিয়া্য , একবার নিউ ইয়র্কের লিঙ্কন সেন্টারে । রবিশংকর নিজে ব্যবহার করেছেন অত্যাধুনিক মাইক্রোফোন আর শুভ’র জন্য বরাদ্দ থেকেছে খারাপ মাইক্রোফোন। আশিস সেকথা রবিশংকরকে বললে বিরক্ত রবিশংকর আশিসকে বলেছেন এ বিষয়ে মন্তব্য করা তাঁর অনধিকার চর্চা। তিনি যেন সাধারণ শ্রোতার মতো অনুষ্ঠান শুনে চলে যান।

শুভ বরাবরই অন্তর্মূখী, চাপা স্বভাবের । এর উপর বিখ্যাত বাবার এমন ব্যবহার, মায়ের সঙ্গে দূরত্ব। শুভ অবসাদগ্রস্ত হয়ে সিগারেট আর মাদকের আশ্রয় নেন । জীবনের শেষ দুবছর নিজের বাবার সঙ্গে তাঁর কোন যোগাযোগ ছিল না। রবিশংকর ফোন করলেও শুভ ফোন তুলতেন না । মাত্র একান্ন বছর বয়সে স্বজনহীন প্রবাসে শুভ ফুসফুসের সংক্রমণ নিয়ে মারা যান । পুত্র সোমশংকরের বয়স তখন পনেরো । কন্যা কাবেরী দশ। শুভ মারা যাওয়ার পর লিন্ডা জানিয়াছিলেন একবারে শেষদিকে শুভ বাবা-মা নয় তাঁর বাল্যকালের দুই সুহৃদ, ভাই আশিস আর ধ্যানেশের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। শুভ যখন অসুস্থ রবি তখন দেশ বিদেশে বাজিয়ে বেড়াচ্ছেন। শুভ’র অসুখের খবর পেয়ে রবি অন্নপূর্ণাকে বলেন আমেরিকা চলে আসতে । অন্নপূর্ণা জানান তাঁর পক্ষে মার্কিন দেশে যাওয়া সম্ভব নয় , কারণ তিনি দীর্ঘদিন নিজের ফ্ল্যাটের বাইরে পা রাখেননি । দ্বিতীয়ত তাঁর কোন পাসপোর্ট ছিল না । রবিশংকর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে ফোন নামিয়ে রাখেন । এভাবেই ভারতবর্ষের অন্যতম প্রতিভাবান সঙ্গীতজ্ঞ দম্পতির একমাত্র সন্তান অমিত প্রতিভাবান শুভেন্দ্র শংকরের ভাগ্যহত জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে ।

দ্বিতীয় বিবাহ ও শেষ জীবন
————————————-

রবিশংকরের কাছ থেকে বিচ্ছেদের সময় প্রায় কিছুই পাননি অন্নপূর্ণা । তার আগেই রবিশংকর অন্নপূর্ণার মাসিক বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছিলেন । সাংসারিক বিষয়ে অনভিজ্ঞ অন্নপূর্ণার সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে । এমন সময়ে আশিস – ধ্যানেশ মারফত অন্নপূর্ণার দুরবস্থার খবর পেয়ে আলি আকবর অন্নপূর্ণাকে তাঁর প্রতিষ্ঠানে শিক্ষয়িত্রীর কাজ নিতে বলেন । কিন্তু অন্নপূর্ণা ওই বয়সে নিজের শিকড় ছেড়ে বিদেশে যেতে চাননি । সেই সময় রুশীকুমার পাণ্ড্য নামে এক মেধাবী সাইকলজিস্ট মানসিক অবসাদ , স্ট্রেস ইত্যাদি কাটানোর জন্য ভারতীয় মার্গসংগীতের ভূমিকা নিয়ে কাজ করার জন্য মার্কিন দেশে আলি আকবরের কাছে ছিলেন । আলি আকবর তাঁকে অন্নপূর্ণার কাছে তালিম নিতে পাঠান । এই রুশীকুমার পাণ্ড্যকেই রবিশংকরের সঙ্গে বিচ্ছেদের অব্যবহিত পরেই ১৯৮২ সালের ৯ই ডিসেম্বর অন্নপূর্ণা বিবাহ করেন । রুশীকুমার পাণ্ড্য অন্নপূর্ণাকে সুখী করতে পেরেছিলেন কিনা বলা শক্ত , কিন্তু রুশীর সান্নিধ্যে অন্নপূর্ণা শান্তি পেয়েছিলেন । এর সাত বছর পর ১৯৮৯ সালের ২৩ শে জানুয়ারি রবিশংকর — সুকন্যা পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন । রুশী শেয়ার বাজারে টাকা খাটাতেন । ২০১৩ সালে রুশী যখন মারা যান তখন অন্নপূর্ণা যথেষ্ট ধনী । যদিও অন্নপূর্ণার অনভিজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে রুশীর বন্ধুরা অন্নপূর্ণাকে ঠকান । তবে শেষ জীবনে অন্নপূর্ণার ছাত্ররা , যেমন সুরেশ ব্যাস , নিখিল হলদিপুর , অতুল মার্চেন্ট প্রমুখেরা তাঁকে আগলে রেখেছিলেন । ১২ ই অক্টোবর অন্নপূর্ণাকে প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় । ডাক্তাররা বলেন তিনি হাইপোস্ট্যাটিক নিউমোনিয়ায় ভুগছেন । পরের দিনই ১৩ ই অক্টোবর অন্নপূর্ণা মারা যান । বিভূতিভূষণ ইন্দির ঠাকরুনের মৃত্যু প্রসঙ্গে লিখেছিলেন যে তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিন্দিপুরে একটি যুগ শেষ হয়ে গেল । অন্নপূর্ণার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীতের জগতে একটি যুগ শেষ হয়ে গেল । এমন একটা যুগ যে যুগ জনরুচির সঙ্গে আপোষ করার চাইতে ঐতিহ্যকে অবিকৃত রাখাকে প্রাধান্য দিয়েছে , যে যুগ আপোষহীন ভাবে শিল্পের বিশুদ্ধতম রূপের সাধনা করে গেছে , যে যুগে শিল্পীদের এতটাই চারিত্রিক দার্ঢ্য ছিল যে তাঁরা খ্যাতি , অর্থের প্রলোভনকে উপেক্ষা করেও নিরলসভাবে সঙ্গীতের সাধনা করে গেছেন ।

বিবিধ প্রসঙ্গ — অন্নপূর্ণা সারাজীবন রবির কাছ থেকে অপমান ছাড়া কিছু না পেলেও রবি সম্বন্ধে একটাও কটু কথা কখনও বলেননি । শুভ’র প্রসঙ্গ ছাড়া রবির প্রতি কোন অভিযোগ আনেননি । বারবার বলেছেন পণ্ডিতজীর গুরুভক্তির কথা , রাগরূপকে অবিকৃত রেখে তাকে জনপ্রিয় করে তোলার কথা । যদিও তাঁর আপত্তির জায়গাটিও বলেছেন —-

“…পণ্ডিতজী বাজানোর সময় তবলাকে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছেন যা সাধারণ শ্রোতার রুচিকে বিকৃত করে দিয়েছে । আজকের শ্রোতার সুরের ব্যাপারে ধৈর্য্য বড়ো কম তাঁরা তাল আর দ্রুতলয়ের ভক্ত ।”

নিজের সঙ্গীতের সম্বন্ধে তাঁর মূল্যায়ন নির্মোহ —–

“ আজকে যে বাজনা তোমরা শোন তা তার বিশুদ্ধ রূপের চেয়ে যোজন দূরবর্তী । যাঁরা বাজাচ্ছেন তাঁরাই শ্রোতাদের রুচিকে বিকৃত করে দিয়েছেন । আজ যদি আমি বাজাতাম শ্রোতাদের হয়তো মনে হতো আমি খুব ধীরলয়ে বাজাচ্ছি যা হয়তো তাঁদের বিরক্তির উদ্রেক করতো ।”

অথচ ৫ই এপ্রিল, ১৯৯৯ সালে প্রনঞ্জয় গুহ ঠাকুরতাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রবিশংকরকে যখন প্রশ্ন করা হয় যে অন্নপূর্ণা কেন বাজানো ছেড়ে দিয়েছিলেন , রবিশংকর বললেন —

“আমি যতটুকু বুঝেছি আমাদের বিয়ের পর আমি তাঁকে বাজাতে জোর করতাম । কিন্তু তিনি একা অনুষ্ঠান করতে চাইতেন না , আমার সঙ্গে বাজাতে তাইতেন , তাই আমাদের বিচ্ছেদের পর তিনি আর বাজাননি …তিনি দর্শকদের মুখোমুখি হতে ভয় পেতেন হয়তো , কিন্তু ঘটনা হল তিনি সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায় জনসমক্ষে বাজানো বন্ধ করে দেন ।”

এই নির্লজ্জ মিথ্যাচারের প্রতিবাদ করে অতুল মার্চেন্ট এনিগমা অফ অ্যান রেক্লুজ বলে একটি নিবন্ধ লেখেন অন্নপূর্ণার সম্মতিক্রমে যাতে সত্যিটা তুলে ধরা হয় । অতুলবাবু ফোনে হুমকি পর্যন্ত পেয়েছিলেন লেখাটি লেখার পর ।

সলিল চৌধুরী একবার তাঁর বন্ধু অমিতাভ গুপ্তকে নিয়ে অন্নপূর্ণার সঙ্গে দেখা করতে যান । একান্ত আলাপচারীতায় অন্নপূর্ণা যা বলেছিলেন অমিতাভবাবু তা পরে বিকৃত করে যুগান্তর পত্রিকায় ছেপে দেন । অন্নপূর্ণা সলিল চৌধুরীর উপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন । যদিও সলিল চৌধুরী বলেছিলেন যে তিনিও জানতেন না যে অমিতাভবাবুর অন্নপূর্ণার সঙ্গে কথোপকথন ছেপে দেওয়ার অভিপ্রায় আছে । ১৯৯৭ সালে রবিশংকর তাঁর রাগমালা বইটি লেখেন বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয় । বইটিতে রবির সেই অনৃতকথনের পুনরাবৃত্তি দেখে অন্নপূর্ণা তাঁর শিষ্য অতুল মার্চেন্টকে একটি সাক্ষাৎকার দেন , যা অন্নপূর্ণার দীর্ঘতম সাক্ষাৎকার । পরের পর্বে সাক্ষাৎকারটির বাংলা তর্জমা দেবো ।

 

মূল ছবি: শ্রী শুভেন্দ্রশংকর ( শুভ )

 

(ক্রমশঃ)

Comment here