(পূর্বের অংশের পর)
চতুর্থ পর্ব –
( জীবনের যাত্রাপথে , আঘাত পেয়ে যখনই পড়েছি হোঁচট খেয়ে — তখনই নতজানু হয়ে প্রার্থনা করেছি ! সেই প্রার্থনাই আমার সবটুকু শক্তি ,আমার সবটুকু সাধনা !’ — প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়কে প্রমথেশ বড়ুয়া ।
এই পর্বে আমরা প্রমথেশের কাজের পদ্ধতি নিয়ে এবং তাঁর সমসাময়িক ও পরবর্তী সিনেমার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন ব্যক্তিদের বক্তব্য নিয়ে আলোচনা করব ।
সত্যজিত রায় এবং মৃণাল সেন তাঁর সম্বন্ধে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না ।
‘অতীতের বাংলাছবি’ প্রবন্ধে চাঁদ সদাগরের বামহাত দিয়ে মনসাপুজো করার ভঙ্গীতে সত্যজিত লিখছেন —
“ তখনকার দিনে প্রমথেশ বড়ুয়ার খ্যাতি ছিল সংযমী অভিনেতা হিসাবে । তাঁর অভিনয় মঞ্চের প্রভাব মুক্ত ছিল এ কথা আজকের দিনেও বলা হয় । মঞ্চাভিনয়ের অভ্যাস না থাকলে সেই সঙ্গে বাংলা ভাষার উপর ষোলো আনা দখল না থাকলে অভিনয়ে মঞ্চের ছাপ না থাকাটাই স্বাভাবিক । কাজেই প্রমথেশ বড়ুয়া হয়তো চেষ্টা করেও মঞ্চসুলভ অতি – অভিনয় করতে পারতেন না । আবার এমনও হতে পারে যে বিদেশের তালিম তাঁকে বাংলা ছবির অভিনয়ের মুদ্রাদোষগুলি এড়িয়ে চলতে সাহায্য করেছিল । স্টুডিওতে আলো ও ক্যামেরার শিক্ষার ফলে প্রমথেশ বড়ুয়া বাংলা ছবিতে কোনও চমকপ্রদ বিশেষত্ব আরোপ করতে পেরেছিলেন কিনা , সেটা আজকের দিনে বলা শক্ত । এটুকু বলতে পারি যে মুক্তি , শেষ উত্তর , শাপমুক্তি ইত্যাদি ছবির যান্ত্রিক কলাকৌশলের দিকটা আজ আর চোখে পড়েনা , যেটা পড়ে সেটা হল ছবিগুলোর সামগ্রিক দো — আঁশলা ভাবটা ।’
সত্যজিত এই কথাগুলি যখন লিখছেন তখন একমাত্র কানন দেবী ছাড়া কেউই প্রতিবাদ করেননি । সত্যজিত স্বীকার করতেন না তাঁর আগে বাংলাদেশে শিল্পসম্মত ছবি হয়েছে । তাঁর যে প্রবন্ধটি উপরে উল্লেখিত হয়েছে তার ছত্রেছত্রে এই অশ্রদ্ধা প্রকাশিত হয়েছে । মুশকিল হল তাঁর এই বক্তব্যকে বাঙালি সিনেফিলরা নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছেন , তাঁর সমসাময়িক বা পরবর্তী ফিল্ম সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত অধিকাংশ লোকজন এই যুগটিকে উপেক্ষা করে গেছেন । সত্যজিতের বক্তব্যটি সামগ্রিকভাবে তাঁর অজ্ঞতাকেই প্রকাশ করে, অথচ প্রমথেশের সম্বন্ধে সত্যজিতের অন্তত এতটা অজ্ঞতার কোন কারণ নেই , উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অবজ্ঞা ছাড়া । প্রমথেশ প্রথমে হেয়ার স্কুল এবং পরে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছিলেন । সুতরাং তিনি বাংলা জানতেন না এ অভিযোগ হাস্যকর । তাঁর জমিদারি ছিল আসাম – বাংলা সীমান্তে , তাঁর মা বাংলা ভাষার নিয়মিত চর্চা করতেন । প্রমথেশ নিজে শিশিরকুমার ভাদুড়ির একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন । কমার্শিয়াল স্টেজে অভিনয় না করলেও নিয়মিত গৌরীপুর রাজবাড়িতে অপেশাদার অভিনয় করেছেন । তিনি বিদেশ থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ শিখেছিলেন , জার্মান এক্সপ্রেশনিস্টদের প্রভাব তাঁর চলচ্চিত্রে ছিল , ফলে তিনি সচেতন ভাবেই নিজের অভিনয় কিছুটা হলেও টোনডাউন করেছিলেন এমন অনুমান করাই সংগত ।
প্রমথেশের পরিচালিত ছবি দেখলেই একথা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রে তিনি অনেক ক্ষেত্রেই পথপ্রদর্শক ।
১) স্টুডিওতে কৃত্রিম আলোর ব্যবহার( অপরাধী )
২) চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথের গানের ব্যবহার( মুক্তি)
৩) জাম্পকাট ( গৃহদাহ)
৪) ব্যাক প্রোজেকশনের ব্যবহার ( দেবদাস)
৫) গানের দৃশ্যায়ন এবং কোরিওগ্রাফিকে সম্পাদনার কাজে ব্যবহার করা( শেষ উত্তর)
৬) ক্রেডিট টাইটলসের বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহার ( রজত জয়ন্তী )
মৃণাল সেন বলেছেন যে, যে সময়ে ‘দেবদাস’ বা ‘মুক্তি’ তৈরি হচ্ছে সেই সময়ে বাংলা সাহিত্যে তিন বন্দ্যোপাধ্যায় ,কল্লোল যুগের অধিকাংশ লেখকেরা এসে গিয়েছেন । তাঁদের লেখায় যে সমাজ বাস্তবতা দেখা যায় তা তাঁদের সমসাময়িক চলচ্চিত্রে কোথায় ?
“ তাঁদের রচনায় , বক্তব্যে , আঙ্গিকে যে ধার ছিল , যে স্পষ্টতা ছিল , যে উত্তাপ ছিল অত্যন্ত সঙ্গত ও শিল্পগত কারণেই তা বাংলাদেশের পাঠক সমাজকে মাতিয়ে তুলল । কিন্তু চলচ্চিত্র শিল্পীরা হয়তো সেদিন কানে তুলো এঁটেছিলেন , মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন হয়তো , হয়তো উত্তুরে হাওয়ার ভয়ে , জটাবুড়ির ভয়ে জানালা খোলা নিষেধ ছিল তাঁদের , হয়তো বা যে বোধ , যে বিচার , যে বিশ্লেষণ , যে অনুভূতি দিয়ে সেই নব্যরীতির সাহিত্যকে অনুধাবন করা প্রয়োজন , তা তাঁদের ছিলনা ।’
এই প্রসঙ্গে তিনি বলছেন ‘উদয়ের পথে’-র কথা ।
‘ এখানেই উল্লেখ্য, চাঁদের কলঙ্কের যুগেই নতুন এক পরিচালক তাঁর প্রথম ছবি তৈরি করেছিলেন যার নাম ‘উদয়েরপথে’, মূলত রোমান্টিক হয়েও যে ছবিটির মধ্যে তৎকালীন সমাজের অশান্ত চেহারা বেশ খানিকটা স্পষ্টতা নিয়ে ফুটে উঠেছিল । তাই চাঁদের কলঙ্ক দেখে যা কখনও মনে হয়নি তাই হলো উদয়ের পথে দেখে —- মনে হল বাংলা ছবি মরতে মরতেও এগিয়ে চলছে , চলবে ।’ ( ষাটের দশকে ‘চিত্রভাষ’ পত্রিকায় প্রকাশিত)
এই অভিযোগের প্রত্যুত্তরে বলা যায় যে সমাজ বাস্তবতার কথা মৃণাল বলছেন তা কোন শিল্পীর উপরে চাপিয়ে দেওয়া যায় না । রবীন্দ্রনাথ কেন প্রাগৈতিহাসিক বা ফসিলের মতো গল্প লিখলেন না এই অভিযোগ যতটা অবান্তর প্রমথেশের ছবিতে সমাজবাস্তবতার অভাবের অভিযোগটিও ততটাই অবান্তর । দ্বিতীয়ত,প্রমথেশকে কাজ করতে হয়েছে স্টুডিও ব্যবস্থায় স্টুডিও মালিকদের চূড়ান্ত ব্যবসায়িক মনোভাবের মধ্যে । সেখানে স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণ কতটা বাস্তবসম্মত ছিল । তৃতীয়ত, সাহিত্য আর চলচ্চিত্রের তুলনা চলে না । যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখন সাহিত্য শতাব্দীপ্রাচীন একটি শিল্প মাধ্যম ,সিনেমা তখনও শিল্পমাধ্যম হিসাবে নবজাতক । চলচ্চিত্রের ভাষা তখনও তৈরিই হয়নি , সেখানে প্রমথেশ নিজের ভাষা তৈরি করেছেন নিরন্তর নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে । প্রমথেশ ছিলেন বলেই তাঁর তরুণ আলোকচিত্রী বিমল রায় ১৯৪৪ সালে উদয়ের পথের মতো ছবি করতে পেরেছিলেন । মৃণালও রাতভোর থেকে শুরু করে আটটি ছবি করার পর ভুবন সোমের জায়গায় পৌঁছতে পেরেছিলেন ।
ঋত্বিক কিন্তু বরাবরই প্রমথেশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন । ঋত্বিকের আত্মধ্বংসী প্রবণতা ,সুরাসক্তি ,স্বভাবের ব্যাখ্যাহীন অস্থিরতাজনিত কারণে তিনি যে প্রমথেশের সঙ্গে আত্মীয়তা বোধ করবেন তা সহজেই অনুমেয় , কিন্তু ঋত্বিক প্রমথেশের চলচ্চিত্র নির্মাণের কৌশলগত দিকটিরও একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন ।
‘ পদ্ধতি টদ্ধতি বুঝি না মশাই , আমার কাছে প্রমথেশ বড়ুয়া আজও ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ পরিচালক । আমরা কেউই তাঁর পায়ের নখের যোগ্য নই ।
তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ ছবি ‘গৃহদাহ’ । আজও মনে পড়ে গৃহদাহ’র সেই অসম্ভব ট্রাঞ্জিশনটা । সেই যে হাইহিল পরা পা দুটো থেকে সোজা কেটে আলতা মাখা পা পালকি থেকে নামছে । এবং ব্যাপারটা ভদ্রলোক করেছিলেন ১৯৩৬ সালে ! আমার মনে আছে, চিত্রা সিনেমায় তিনদিনের মাথায় দর্শকরা স্ক্রিন ছিঁড়ে দেয় । ওখানে অচলার ট্রানজিশন ফ্রম টাউন টু ভিলেজ যে মন্তাজের দ্বারা তিনি সৃষ্টি করেছিলেন তখন তা অভাবনীয় । সাবজেকটিভ ক্যামেরার ইউজ ভারতে তিনি প্রথম প্রচলন করেন । তাঁর ‘উত্তরায়ণ’ দেখলে তা বোঝা যাবে । বড়ুয়া সাহেবের জ্বর হওয়ার পরে ক্যামেরা সোজা সিঁড়ি দিয়ে উঠে বিছানায় গিয়ে আছড়ে পড়ল !সেটাই কি ভোলা যায় । এবং কাণ্ডটি ঘটিয়েছিলেন ভদ্রলোক ডেভিড লিনের ‘অলিভার টুইস্ট’ – এর বহু আগে !’
গৃহদাহের এমন সম্পাদনা সুবোধ মিত্রের মতো সম্পাদককেও অভিভূত করেছিল । ট্রেনের বেসিনে দেবদাস কালচে বমি করে বলে ওঠে — রক্ত । সঙ্গে সঙ্গে আমরা দেখি পার্বতীর হাত থেকে থালা পড়ে যায় । সবাক চলচ্চিত্রের আদিযুগে তিনি মন্তাজের ব্যবহার করেছেন সার্থকভাবে । দেবদাস ট্রেনে ভ্রাম্যমাণ ; প্রথমে চলন্ত ট্রেন থেকে নেওয়া স্টেশন —– সেই স্টেশনের সাইনপোস্ট । তারপর একের পর এক স্টেশনে একটার পর একটা নামের উল্লেখ । চলচ্চিত্রের ভাষায় যাকে travelling — matte effect বলে যা পরে ব্যাক প্রোজেকশন বলে বিখ্যাত হয় তারও ব্যবহার প্রথম পাই প্রমথেশের ছবিতে । মুক্তিতে প্রশান্ত’র মাথা ট্রেনের জানালায়। বাইরের দৃশ্যাবলী পরে সংযুক্ত করা হয় ।
তাঁর কাজের পদ্ধতি সম্বন্ধে বর্ষীয়াণ পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় বলছেন, … এরকম প্রগ্রেসিভ গল্প ছাড়াও আধুনিক সেট ও টেকনিক ,গানের পিকচারাইজেশন এবং কম্পোজিশন ।
হিরো হিরোইনের সম্পর্কে কিছু একটা শুনে রেগে গেছেন । রাগের সঙ্গে মেঘের গুরুগুরু ভাবটা এনেছেন । বৃষ্টি নামল । তারপরেই উনি গাড়ি চড়লেন । গাড়িতে চড়ে ব্রেক কষা , স্টিয়ারিঙের এদিক — ওদিক এইসব দিয়ে উনি হিরোর মানসিকতা ধরেছেন । অনেক পরে সিনেক্লাবের শোতে ফেলিনির ওইরকম ট্রিটমেন্ট দেখলাম , যেটা বড়ুয়াসাহেব অনেক আগেই করে গেছেন । ডিরেক্টর হিসাবে আউটস্ট্যান্ডিং ছিলেন । ওই ছবিতেই যমুনা বলছে , মেনকাকে আনবে না অশান্তি হবে । সেটা ফোয়ারায় ঢিল মেরে দেখিয়ে দিলেন কী হবে । যমুনা তখন ফোয়ারার ঝরনার জলটা খুলে দিয়ে বলল, এটাও তো হতে পারে — এই যে সিনেম্যাটিক টাচ সে সময়ে কি ভাবা যায় !… বিমলদা (বিমল রায়) ওঁর সঙ্গে ‘দেবদাস’ ( হিন্দি) , ‘গৃহদাহ’ , ‘মুক্তি’ প্রভৃতি ছবিতে ক্যামেরার কাজ করেন । ওঁর কাছে শুনেছি যে ওঁর কাজের ধারাটা খুব ডিসিপ্লিন্ড ছিল । পুরো ভেবে করা । ‘গৃহদাহ’য় একটা শট আছে যখন সুরেশ অচলাকে মোগলসরাইতে অন্য ট্রেনে নিয়ে গেল , ঠিক তারপরেই ট্রেন আসছে লাইট জ্বালিয়ে । রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে রাজি করিয়ে উনি প্রত্যেকটি কামরায় পাওয়ারফুল বাল্ব ফিট করলেন । সেই শট তিনি কোডাক থেকে স্পেশাল সেন্সিটিভ ফিল্ম আনিয়ে তুললেন । ব্রিজের ওপর দিয়ে ট্রেনটা যাবার দৃশ্য থেকে এমনভাবে তুলেছিলেন যে আলোর মালা, ভিস্যুয়াল ট্রিটমেন্ট খুব সুন্দর হয়েছিল ।’
যে যুগে অপচয়ই ছিল ছবি তৈরির প্রধান অন্তরায় সে যুগে প্রমথেশ আদ্যোপান্ত পেশাদার ছিলেন । তাঁর চিত্রনাট্য একদম তৈরি থাকত । কৃষ্ণচন্দ্র দে বলছেন —-
‘ বড়ুয়াসাহেব নিয়মশৃঙ্খলার অত্যন্ত পক্ষপাতী ছিলেন । তিনি নিজে সেটে হাজির হতেন ঠিক সময়ে । সুটিং আরম্ভ হতো সকাল সাড়ে নটায় , বড়ুয়াসাহেব ফ্লোরে আসতেন ঠিক নটা বেজে পঁচিশ মিনিটে। আগের দিন সহকারীদের বলে রাখতেন কোন কোন সিন টেক করবেন ; তাঁরা সব ঠিক করে রাখতেন । তিনি ফ্লোরে এসে ঠিক সাড়ে নটায় কাজ আরম্ভ করতেন । শুটিংও শেষ করতেন ঠিক ছ’টায় । লাঞ্চের সময়ের অথবা ছ’টা বাজতে যদি দু’পাঁচ মিনিট বাকি থাকত তবুও তিনি ছুটি দিয়ে দিতেন । কারণ তখন তিনি যদি কোন সিন টেক করা আরম্ভ করেন তবে লাঞ্চের অথবা ছুটির দেরী হবে । তাতে যে শিল্পীদের কষ্ট হবে , অসুবিধা হবে ! এর ব্যতিক্রম হ’তে কোনদিন আমি দেখিনি ।’
সহ – অভিনেতাদের প্রতি কেমন ছিল তাঁর ব্যবহার ! পাহাড়ি সান্যাল লিখছেন —
“ কয়েকবার চেষ্টার পর তাঁকে বললাম —- ‘ আপনি একটু দেখিয়ে দিন , সিচুয়েশনটা ঠিক বুঝতে পারছি , কিন্তু মনের দিক থেকে সে আবেগ ফুটিয়ে তুলতে পারছি না ।’ পিসিবি বহাল তবিয়তে বললেন —- ‘ আমিই যদি তোমায় দেখিয়ে দেবো তবে তো স্টুডিওর দারোয়ানকেই ডাকতাম।’ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হলেন পাহাড়ী সান্যাল , তখন ভাগ্যচক্রের মতো ছবি করে খ্যাতির মধ্যগগনে তিনি । জিদ চেপে গেল তাঁর, রিহার্সাল করতে লাগলেন বারবার । এরমধ্যেই বড়ুয়াসাহেব এক ফাঁকে টেক করে নিয়েছেন । পরে পাহাড়ি যখন তাঁকে অনুযোগের সুরে বললেন যে ‘ অতটা শক্ত কথা না বললেও পারতেন ‘, প্রমথেশ হেসে বলেছিলেন — ‘ দেখো পাহাড়ী , সিচুয়েশন বুঝতে চাওয়া বল , চরিত্র বুঝিয়ে দেওয়া বল , সবই আমি উচিত মনে করি , কিন্তু অ্যাকশন দেখিয়ে দেওয়া খুব খারাপ জিনিস । আমি অবশ্য অভিনয় করে তোমাকে এই বিশেষ মানসিক অবস্থার রূপটি দেখিয়ে দিতে পারতাম , কিন্তু তাতে লোকসান হত এই যে তোমার অভিনয়ের মধ্যে শুধু আমাকে পেতুম, তোমাকে পেতাম না । বিশেষ – বিশেষ অভিনয় ধারা হল শিল্পীর নিজস্ব জিনিস ।’
এই অভিনয় করে দেখিয়ে দিতে অসম্মত হওয়ার জন্যই কানন দেবীর সঙ্গেও তাঁরও প্রাথমিকভাবে একটা মনান্তর হয় । কিন্তু কানন দেবী পরে অনুভব করেন —
‘ যাইহোক এর ফলে মস্ত একটা লাভ হয়েছিল এর আগে সম্পূর্ণভাবে ডিরেক্টরের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম । এই প্রথম আপন শক্তির ওপর একটা আস্থা এল । এ আত্মবিশ্বাস পরোক্ষে মিঃ বড়ুয়ারই দান ।’
ক্ষুব্ধ কানন নিজের আত্মজীবনী ‘সবারে আমি নমি’ তে এক জায়গায় লিখছেন —-
‘কিন্তু মিঃ বড়ুয়ার প্রবণতা ছিল ক্যামেরার প্রধান অংশটা নিজেই অধিকার করার । যে দৃশ্যে উনি আছেন ,সেই দৃশ্যে উনি একক এবং অদ্বিতীয় । ওঁকে ছাপিয়ে কেউ যেন বড় হয়ে না ওঠে ।… শেষ উত্তরে আমার অনেক ছবি এমন অ্যাঙ্গেলে এসেছে যা না আসাই বাঞ্ছনীয় ছিল । ওঁকে আমি বলেওছিলাম । কিন্তু সে ত্রুটি শোধরানো হয়নি ।’
পরে অবশ্য নিজের সিদ্ধান্তের পুনর্মূল্যায়ণ করে তিনি বলেছেন —
‘ ইদানিং আমাকে ছবি তোলার নেশায় পেয়েছিল…ক্যামেরা সম্বন্ধে একটু জ্ঞান হবার দরুনই বোধহয় বুঝতে পেরেছিলাম আমার ধারণাটা কত ভ্রান্ত । কেন ? মিঃ বড়ুয়া ছিলেন ছোট্টখাট্টো এতটুকু মানুষ । উনি যখন হাফপ্যান্ট আর স্পোর্টিং গেঞ্জি পরে স্টুডিও লনে ব্যাডমিন্টন খেলতেন, দূর থেকে দেখে মনে হত যেন স্কুলবয় । সেই মানুষটাই যমুনা , কমলেশকুমারী , চন্দ্রা ( চন্দ্রাবতী দেবী ) এদের মতো দীর্ঘাঙ্গী … মেয়েদের বিপরীতে হিরোর পার্ট করতেন । কিন্তু এতটুকু বেমানান তো লাগেইনি , উপরন্তু ব্যক্তিত্বে অভিব্যক্তির অনন্যতায় এবং স্বাভাবিকতায় তিনি সে যুগের সকলকে ছাপিয়ে উঠেছিলেন …
…মিঃ বড়ুয়ার ওই উদাসী বিষণ্ণতা, ওই অভিনব এক্সপ্রেশনের অনেকটাই পর্দার বুকে ফুটে উঠতে পারত না যদি না ক্যামেরার সংস্থাপন খুব কাছাকাছি হত ,কারণ ছোট জিনিস দূর থেকে এত ছোট দেখায় যে তার অস্তিত্বই অনেক সময় না মঞ্জুর হয়ে যায় …ছবির সামগ্রিক সাফল্যের দিকে লক্ষ্য রাখতেন বলেই হিরো বড়ুয়ার চেহারার চরিত্রকে সুপরিস্ফুট করার জন্য ক্যামেরাম্যান বড়ুয়া এত ব্যস্ত এত সজাগ ছিলেন ।’
চিত্রপরিচালক হিসাবে তাঁর দক্ষতার লক্ষণগুলিকে পর্যায়ক্রমে সাজালে আমরা যা দেখি তা হল —-
১) ছবির সংলাপ তিনি নিজে লিখতেন । চরিত্রপো্যোগী ,বুদ্ধিদীপ্ত , আবেগবর্জিত , বাস্তবানুগ সংলাপ লেখায় তাঁর দক্ষতা ছিল ।
২) চিত্রনাট্যে যতটা সম্ভব অ্যাকশনের সাহায্য বেশী নিয়ে সংলাপ কম রাখতেন ।
৩) অভিনয়ে শিল্পীর নিজস্ব অভিনয়শৈলীকে বিকাশের সুযোগ দিতেন । রিহার্সালের উপর বেশী জোর দিতেন না । তিনি মনে করতেন রিহার্সাল করালে অভিনয়ের স্বতঃস্ফূর্ত তা নষ্ট হয়ে যায় । পরিচালকের ব্যক্তিত্বের প্রভাবে অভিনেতার স্বকীয়তা নষ্ট হয়ে যায় ।
৪) গানের প্রয়োগের সময় সিচুয়েশনের কথা মাথায় রাখতেন । তাঁর ছবিতে গানের ব্যবহারতাই সুপ্রযুক্ত এবং সুমিত ।
৫) তাঁর ছবির কম্পোজিশন জ্ঞান ছিল অদ্ভুত । অভিনেতারা কোথায় কেমন ভাবে দাঁড়ালে ভালো লাগবে তা চমৎকার বুঝতেন ।
৬) নিজে সম্পাদনার কাজ ভালো জানতেন বলে কোন শট কতটা নিতে হবে তা খুব ভালো বুঝতেন । এতে রিটেকও কম হত । চল্লিশ হাজার ফুটের মধ্যেই তাঁর ছবি শেষ হয়ে যেত । তাঁর সম্পাদনা’র দক্ষতা নিয়ে সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় লিখছেন —
‘ … এই যে আখ্যানের ক্রমউন্মোচন — দরজার পর দরজা খুলে যাওয়া — এইটা ছবির প্রথম সম্পাদক সুবোধ মিত্র বুঝতেই পারেননি । তিনি প্রথাগত সম্পাদনের নিয়ম মেনে অতগুলো দরজা খোলা কেটে দিয়ে একবারেই মিডশট থেকেই দরজায় টোকা দেওয়া দেখাতে ইচ্ছুক ছিলেন । কিন্তু প্রমথেশ বড়ুয়া যেহেতু চলচ্চিত্রে auteurship-এর বশবর্তী ছিলেন তিনি সম্পাদক বদল করতে অনুরোধ করলেন, বিরক্তিবশতই , নিউ থিয়েটার্সের সর্বাধিনায়ক বি এন সরকারকে । নতুন সম্পাদক কালী রাহা পরিচালকের নির্দেশ অনুযায়ী দরজার শটের ক্রমবিন্যস্ত করলেন । বাকিটা ইতিহাস । সুবোধবাবু সবিস্ময়ে সরকার সাহেবের কাছে জানতে চান যে ওই দরজা খোলায় কী এমন রহস্য আছে । বিএন সরকারের সহাস্য জবাব ছিল — ‘ তা বুঝতে পারলে তো তুমি বড়ুয়ার মতো ডিরেক্টর হয়ে যেতে ।’
৭) দর্শক মনস্তত্ত্ব খুব ভালো বুঝতেন বলেই কোথায় কতটুকু কী রস দিলে দর্শকরা খুশী হবেন আগে থেকেই তার চার্ট করে কাজে নামতেন ।
৮ ) চূড়ান্ত পেশাদার ছিলেন , অভিনেতাদের কোনরকম অভিনেতা সুলভ খামখেয়ালিপনা বরদাস্ত করতেন না । গৃহদাহ ছবিতে সেই সময়ের খ্যাতনামা অভিনেত্রী উমাশশীর অচলার ভূমিকায় অভিনয় করার কথা ছিল । চার পাঁচদিন শুটিং হওয়ার পর উমাশশী একদিন শুটিং এ এলেন না । অমর মল্লিক ছিলেন প্রোডাকশন কন্ট্রোলার এবং কেদারবাবুর ভূমিকাতেও তিনি অভিনয় করছিলেন । অবিচলিত বড়ুয়াসাহেব অমর মল্লিককে বলেন ‘ মল্লিক মশাই আমি শুটিং বন্ধ করতে ইচ্ছুক নই । আপনি যত শীঘ্র পারেন যমুনাকে গাড়ি পাঠিয়ে যমুনাকে আনাবার ব্যবস্থা করুন…’ পরে যমুনা বড়ুয়াকে দিয়ে চার-পাঁচদিনের কাজ রিটেক করে ছবির কাজ শেষ করা হয় । অনুরূপ ঘটনা ‘রূপলেখা’ ছবির ক্ষেত্রেও হয় । ছবির নায়িকা রতনবাঈ ছবির শেষ দৃশ্যটি অপছন্দ হয়েছে বলে অভিনয় করতে অস্বীকৃত হলে তিনি নায়িকাকে বাদ দিয়ে শেষ অংশটি চিত্রায়িত করেন ।
৯ )অভিনেতা হিসাবে নিজেকে নিয়ে নিয়ত নিরীক্ষা করতে কখনও পিছপা হননি । কালিপ্রসাদ ঘোষের ছবি ভাগ্যলক্ষীতে ভিলেনের চরিত্রে নির্বাচিত হওয়ার সময় কালিপ্রসাদবাবু তাঁকে বলেছিলেন ‘ ভিলেনের চরিত্র যেভাবে রূপদান করা হয় আমার মতে তা ভুল , অসংগত । কারণ যার চেহারা দেখেই মনে হবে লোকটি বদমাশ , তার ফাঁদে নায়িকা পা দেবে কেন ? নায়িকাকে মজাতে পারে সেই ,যাকে দেখে মনে হবে ‘বাঃ কি সুন্দর ।’প্রমথেশ দ্বিরুক্তি না করে অভিনয় করতে রাজি হয়ে যান ।
১০ )বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে টেকনিশিয়ানদের জন্য প্রথম ফ্যাক্টরি অ্যাক্ট তাঁর উদ্যোগেই চালু হয় ।
তপন সিংহ স্বল্পকথায় বড়ুয়াসাহেবের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করতে গিয়ে তাঁর টেকনিকাল বিষয়ের উপর দখল ,তাঁর বাস্তবধর্মী সংলাপ এবং থিয়েটারের অতিরেকবিযুক্ত বাস্তবানুগ অভিনয়ের কথা সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করেছেন ।
তিনিই বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম স্টার যিনি নিজস্ব স্টাইল স্টেটমেন্ট তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন । বড়ুয়া কলারের পাঞ্জাবি ,গলাবন্ধ কোট তখন আপামর জনসাধারণের মধ্যে প্রবল জনপ্রিয় হয় ।
বাংলা চলচ্চিত্র সমালোচনার ক্ষেত্রটি বড়োই একদেশদর্শী ,বিপজ্জনকভাবে খণ্ডিত । পথের পাঁচালি যে বছর মুক্তি পায় সেই বছরই ‘শাপমোচন’ মুক্তি পায় । অপূর্ব কুমার রায়ের মতো শাপমোচনের উত্তমকুমারও গ্রামের অপাপবিদ্ধ যুবকের শহরে এসে পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার ইতিকথা —- একথা ভুলে গেলে বাংলা ছবির এক অমোঘ ঐতিহাসিকতাকে বিস্মৃত হওয়া হয় । শেষ করব সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের সুলিখিত প্রবন্ধটি উদ্ধৃত করে —–
‘ সত্য এই যে , রাজকুমার বড়ুয়ার চরিত্র , আখ্যান , সংলাপ সবই অতিশয়োক্তিপরায়ণ । কিন্তু এই প্রাচুর্য, এই উচ্ছ্বাস , এই অতিরেক তো বাঙালি চরিত্রের পাগলামির কারুশিল্প । আমাদের আত্মপরিচয়েই বাকবাহুল্য থাকে , তা বাঙালির মুদ্রাদোষ , প্রমথেশের একার নয় । আমাদের সুরাপাত্র উপচে পড়ে বীরবাহুর স্বর্গারোহণ । এরকমভাবেই মধুসূদন দত্ত , মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বা ঋত্বিক ঘটক । এঁরা শিল্পী , এঁরা বাঙালির নিজস্ব চতুর্থ সর্গ নিজস্ব ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যে । আর প্রমথেশ চন্দ্র বড়ুয়া সেই পাঠক্রমের মুদ্রণ প্রমাদ । তিনি হয়ত শিল্পের মহত্ত্বকে ছুঁতে পারেন না , কিন্তু আমাদের ব্যর্থতায় , আমাদের দিনাবসানে , আমাদের প্রত্যাখ্যাত প্রেমপত্রে দেবদাসের গৌরবর্ণচ্ছটা । ভুলি কেমন করে যে বাংলা সিনেমা তাঁর মতো রাজপুত্রকে সম্বল করেই একদা এসে দাঁড়িয়েছিল রাস্তায় , সেলুনে , যুবকের পরিধেয়তে । ‘মুক্তি’ , বা ‘গৃহদাহ’ , ‘অপরাধী’ ও ‘উত্তরায়ণ’ অদ্বিতীয় ‘দেবদাস’ যদি উৎকৃষ্ট শিল্পের মহিমা নাও দেখায় তা হলেও তারা বাঙালি চরিত মানস নানাদিক থেকেই ।’
( তথ্যসূত্র — ‘রাজার’ কুমার —- প্রমথেশ বড়ুয়ার জীবন কথা’ – রবি বসু , ‘দ্য লিজেন্ড অফ ইন্ডিয়ান সিনেমা সিরিজ’ – সম্পাদনা অরুণা বাসুদেব —- ‘প্রমথেশ বড়ুয়া’ – সোমা এ চ্যাটার্জী , ‘রূপমঞ্চ — প্রমথেশ বড়ুয়া সংখ্যা’ , ‘সবারে আমি নমি’ — কানন দেবী, ‘রূপালী পর্দার রাজকুমার’ — মনোতোষ দাশগুপ্ত , ‘সোমেনি সিনেমাজ’ , বিডি গর্গ)|
(সমাপ্ত)
অনিন্দ্য গৌতম পেশায় পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসনিক কৃত্যকের একজন আধিকারিক। বর্তমানে পুরুলিয়া জেলায় উপশাসক এবং উপসমাহর্তা পদে কর্মরত। মূলত অন্তর্জালে লেখালেখি করেন।
Comment here