(পূর্বের অংশের পর)
– শ্রী অলোক ভট্টাচার্য
আগের পর্বে দুই একটি বিষয় উল্লেখ করতে পারিনি বয়স জনিত স্মৃতি ভ্রান্তি বা লেখার অনভিজ্ঞতা সম্ভবত দায়ী। এই পর্বের প্রথমে সেই অনুল্লেখিত অংশটুকু বলে নিতে চাই।
১৯৬৫ এর ভারত পাক যুদ্ধের আগে পর্যন্ত নিয়মিত বাৎসরিক কিছু ভূসম্পত্তির হিসাব আমাদের বাড়িতে ডাকযোগে পৌঁছতো মুর্শিদাবাদ এর কোন এস্টেট থেকে আমাদের মৃত পূর্বপুরুষদের নামে। সেসব পূর্বপুরুষদের সব শরীকদের নাম পরিবারের সর্ব প্রাচীন জ্যাঠামশাইও বলতে পারেননি। শুধু বলেছিলেন যে আমাদের পূর্বোদের আদি নিবাস ছিল কাদাইতে।
সেখানকার কোনো সম্পত্তির হিসাব হবার সম্ভাবনা। ১৯৭৫- বহরমপুরে কর্মরত ছিলাম। কাদাই মোড়ের নিকটেই একটি সিনেমা হল ছিল। নাম সম্ভবত ‘কল্পনা’। একটি মিষ্টান্ন দোকান ছিল ‘সন্দেশ’ নামে। মালিক ছিলেন জনৈক ভট্টাচার্য। তাঁর সঙ্গে আমাদের ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে জানলাম যে তিনি বহু পুরুষের কাদাই নিবাসী। নবাবী আমলে ফরিদপুর জেলার কোথাও গিয়ে বসতি গড়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে তার দোকানের লোভনীয় সন্দেশ খেতে আর যেতে পারতাম না কারণ পরিচিত হবার পর তিনি আমাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে খুব আগ্রহ দেখালেও তিন বন্ধু সহ মিষ্টির বিল ৫০ টাকা সে সময় তিনি কিছুতেই নেননি সেই লজ্জায় আর যাওয়াও হয়নি আমাদের অতীতের ইতিহাসের একজন সাক্ষী পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল।
একটি নাম বাদ গিয়েছিল ভট্টাচার্য বংশের শেষ বিখ্যাত পন্ডিত ছিলেন তারানাথ সপ্ততীর্থ। পণ্ডিত জানকীনাথের প্রথম পুত্র। তাঁর বংশধরেরা বাস করতেন নাকতলা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু রোডের উপরেই ‘সপ্ততীর্থ কুটির’ নামক বাড়িতে।
সেই বাড়িতে আমি তাঁর বৃদ্ধা স্ত্রী (সম্পর্কে আমার জ্যাঠাইমা)কে দেখেছি। আমাকে জড়িয়ে ধরে কোড়কদীর জন্য তাঁর আকুল কান্না আজও ভুলিনি। তখনকার একান্নবর্তী পরিবারের সম্পর্কের বাঁধনটা যে খুব শক্ত ছিল।
এবার ফিরে আসি ফিরে দেখায়।
১৯০১ সালে যখন কোড়কদীতে হাই স্কুল তৈরি করলেন রাসবিহারী লাহিড়ীর পুত্র বিনোবিহারী, তখন কিন্তু জেলা শহর ফরিদপুরে কোন কলেজ ছিল না মহকুমা শহর তো পরের কথা। ফরিদপুরে প্রথম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১৮ সালে রাজেন্দ্র কলেজ নামে, একদা কংগ্রেস সভাপতি অম্বিকা চরণ মজুমদারের চেষ্টাতে। মহকুমা শহরের বাইরে কোন গ্রামাঞ্চলে এই স্কুলটিই প্রথম। তার আগে থেকেই একটি পাঠশালা চালু ছিল যেখানে বালক বালিকার একসাথে পড়ার ব্যবস্থা ছিল।
কিন্তু নতুন স্কুলে বালিকাদের ভর্তি হবার সুযোগ ছিল না। বহু দূর দুরান্ত থেকে শিক্ষার্থী পড়তে এলে তাদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে করা হতো বিনা ব্যায়ে। আমি নিজেও পাঁচ ও ছয় এর দশকে ৬, ৭ জন ছাত্রকে আমাদের বাড়িতে থাকতে দেখেছি।
কোড়কদীর ছেলেরা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করে তখন কলকাতায় যেতেন উচ্চশিক্ষার জন্য। তখনকার বিধিমত স্কুলটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃত ও অনুমোদিত ছিল।
মেয়েদের পাঠশালার পর বাড়িতেই অভিভাবকেরা পড়াতেন। আমার দুজন পিসিমার হাতে লেখা পুরনো চিঠিপত্র আমি দেখেছি। হস্তাক্ষর ও ভাষার ব্যবহার ছিল অবাক করার মতো।তখনকার সমাজের ‘মেয়েদের লেখাপড়া শেখালে বিধবা হয়ে যায়’ বলে গ্রাম সমাজে ধারণা চালু ছিল। ফলে কোড়কদীর কন্যাদের শিক্ষা ও জীবন যাপনের মান উন্নত ব’লে, জামাই জোগাড় করাও কঠিন ছিল। ফলে স্বগ্রামেই ছেলেমেয়েদের বিয়ে হতো বেশি। বিশেষ মিল বা দায় না পড়লে অন্য কোথাও পাত্র পাত্রীর খোঁজ নিতে হতো না। তার মধ্যেও হাওড়া কলকাতা ময়মনসিংহ বা নদীয়ার কন্যা গ্রামের বধু হিসাবে আমিও দেখেছি।
(ক্রমশঃ)
Comment here