আমার ইতিহাস

রোহিঙ্গারাই কি মগ জলদস্যু?

– শ্রী জ্যোতিষ্মান সরকার

 

‘মগ’ একটি অত্যন্ত পরিচিত শব্দ।ষোড়শ শতকের বঙ্গোপসাগরের ত্রাস। অতুল শক্তিশালী নৌবহর।…বীভৎস কুটিল স্বভাব নোংরা দস্যু জাতি । শ্রী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে বহু জায়গায় এই জলদস্যু গোষ্ঠীর বর্ণনা করেছেন।

তৎকালীন সাহিত্যে সমস্ত জায়গায় আমরা মগ বলতে আরাকানের মুসলিম সম্প্রদায়কেই পড়েছি। যাদেরকে আমরা রোহিঙ্গা বলে জানি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কিছু বাংলাদেশ ভিত্তিক নিউজ পোর্টালের মাধ্যমে এই তথ্য সম্প্রচার করা হচ্ছে যে মগরা সবাই বৌদ্ধ ছিল ও রোহিঙ্গারা হল তাদের victim।

“মগদস্যুরা পর্তুগীজদিগের সঙ্গে যোগ দিয়া দেশে যে অরাজকতা সৃষ্টি করিয়াছিল তাহা অতি ভয়াবহ। তাহাদের স্পর্শদোষে অনেক ব্রাহ্মণ পরিবার এখনও পতিত হইয়া আছেন। বিক্রমপুরের মগোন-ব্রাহ্মণদের সংখ্যা নিতান্ত অল্প নহে। মগ ও পর্তুগীজদের ঔরসজাত অনেক সন্তানে এখনও বঙ্গদেশ পরিপূর্ণ। ফিরিঙ্গীদের সংখ্যা চট্টগ্রাম, খুলনা ও ২৪ পরগনার উপকূলে, নোয়াখালিতে, হাতিয়া ও সন্দ্বীপে, বরিশালে, গুণসাখালি, চাপলি, নিশানবাড়ী, মউধোবি, খাপড়াভাঙ্গা, মগপাড়া প্রভৃতি স্থানে অগণিত। ঢাকায় ফিরিঙ্গিবাজারে, তাহা ছাড়া কক্সবাজারে ও সুন্দরবনের হরিণঘাটার মোহনায় অনেক দুঃস্থ ফিরিঙ্গী বাস করিতেছে।” (১)

পর্তুগীজ হার্মাদ,মগ জলদস্যুরা শৎগঙ [চাটিগাও, চিটাগাং], বাকলা [বরিশাল, বাকরগঞ্জ], সন্দীপ, নোয়াখালির নারী-শিশু-যুবক-বৃদ্ধ হিন্দু-মুসলিম লোকেদের ধরে বিক্রি করে। এই কেনা-বেচায় দেশীয় বণিকরাও অংশ নেয়। বর্ধমান, হুগলি, মেদিনীপুর-নবদ্বীপের সম্পন্ন পরিবারের লোকেরা অবিবাহিত পুরুষের জন্য চন্দননগরের বিবিরহাট থেকে অপহৃত দাসীদের কিনে আনে। এরকমই বর্দ্ধমান নিবাসী (উচ্চ/কূলবংশীয়) ভট্টাচার্য পরিবারে এক রূপবতী সংস্কৃত তরুণীকে কেনা হয়। বড়ছেলের সাথে বিয়েও দেয়। আত্মীয়-পরিজন উপহার নিয়ে বৌ-বরণ করতে আসে। পাছে বাঙ্গাল কথা টের পেয়ে যায়, নতুন বৌ বিশেষ রা- করে না। অদৃষ্টের এমন পরিহাস, নববধূ হঠাৎ শ্বাশুড়িকে ব’লে বসে–দেন মা, আমি কদুটা কুইটা দেই। (পূর্ববঙ্গের মুসলমান লাউকে কদু বলে)। (২)

বিশ্বকোষে (ত্রয়োদশ খন্ডে) শ্রী নগেন্দ্রনাথ বসু মগ জাতি বলতে কার্যত বৌদ্ধদেরকেই নির্দেশ করেছেন।এদের মধ্যে মারমগরি, ভূঁইয়া মগ, বড়ুয়া মগ, রাজবংশী মগ, মারমা মগ, রোয়াং মগ, ভ্যুমিয়া মগ ইত্যাদি জাতিগুলির উল্লেখ করেছেন । কার্যত এদের মুসলিম counter partকে একরকম অগ্রাহ্য করা হয়েছে। (৩)

কিন্ত ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় এনাদের মধ্যে যারা নব্য ধর্মান্তরিত মুসলিম ছিল তারাই সবচেয়ে দস্যুবৃত্তিতে অংশ নিত। এমন কি কমিউনিস্ট নেতা মুজাফফর আহমেদ পর্যন্ত তাঁর আত্মজীবনীতে তাঁর মাতুল বংশ আরাকানের ছিল একথা স্বীকার করেছেন।

মগ আসলে কারা এই প্রশ্নের উত্তর জানতে আমাদের যেতে হবে প্রাক ইসলামী দক্ষিণ পূর্ব বাঙলার ইতিহাসে। বার্মিজ ক্যালেন্ডার অনুসারে আরাকান বা রাখাইনের প্রথম রাজা হলেন খিত্তাথিন। 380 ME বা ১০১৮/১৯ তে তাঁর শাসন শুরু। ১২৭৯তে মিন হতি (မင်းထက်) সিংহাসন আরোহন করেন প্রথম দিকে তিনি বর্মার Ava রাজবংশের অধীনে থাকলেও পরবর্তীতে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং একটি বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি মোট ৯৫ বছর শাসন করেন পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয় এমন কোন রাজার উল্লেখ রয়েছে কিনা সন্দেহ রয়েছে।

১২৮৩ নাগাদ বিক্রমপুরের সেন শাসনের আর অস্তিত্ব অবলুপ্ত হয়ে যায়। সোনারগাঁ বন্দর মুসলিম অধিকারে চলে যায়। শিলালিপি ও তাম্রশাসনাদি প্রসঙ্গে দীনেশ চন্দ্র সরকার দশরথ দেবের পাকামোঢ়া তাম্রশাসনের উল্লেখ করেছেন। এখানে তিনি প্রমাণ করেছেন যে দলুজ রায় ও দশরথ দেব অভিন্ন । (৪)

১২৯৩-৯৪ তে লখ্নৌতীতে শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ ও রুকুদ্দিন কায়াউসের মধ্যে ক্ষমতার দন্দ্ব চলছিল ।

রাজা দনুজ রায় এই দ্বন্দ্বের সুযোগে সোনারগাঁও উদ্ধারের পরিকল্পনা করেন। দিল্লি সালতানাতের অধীনতা থেকে সুবর্ণগ্রামকে মুক্ত করার জন্য, মহারাজা দনুজ রায় একটি শক্তিশালী সুলতান বিরোধী রাজনৈতিক জোট গঠনের উদ্যোগ নেন। দিল্লীর সাথে যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে তিনি প্রতিবেশী রাজ্য আরাকানের সাথে মিত্রতার সিদ্ধান্ত নেন। অবশেষে তিনি আরাকানের তৎকালীন শাসক মিন হ্তির (မင်းထက်) সাথে একটি মৈত্রী স্থাপন করেন এবং দিল্লি সালতানাতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। শ্রী রজনীকান্ত চক্রবর্তীর ‘গৌড়ের ইতিহাস’ অনুসারে ১৩১৭-১৮ পর্যন্ত সোনারগাঁ দনুজ রায়ের অধিকারেই ছিল। ফিরোজ শাহর পুত্র বাহাদুর শাহ সমস্ত শক্তি একত্রিত করে সোনারগাঁ দখল করেন। এরপর দনুজ রায় সোনারগাঁ থেকে সরে গিয়ে চন্দ্রদ্বীপে তার নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। (৫)

আরাকানের যুদ্ধ: 

আরাকানের রাজা Min saw Mon গৌড়ে সামরিক সাহায্য চাইতে রান ১৪০৪ সালে । কিন্তু গণেশের ও দেব বংশের শাসনকাল কেবলমাত্র যুদ্ধে নিয়োজিত থাকায় তাঁদের থেকে সহায়তা পাননি।

একটি সমসাময়িক আরাকানীয় নথি লিপিবদ্ধ করেছে যে রাজা গণেশের সেনাবাহিনী, তৎকালীনভাবে পান্ডুয়ার নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং যুদ্ধে ইব্রাহিমকে পরাজিত করেছিল। এই নথি অনুসারে, আরাকানের একজন শাসক Min Sow Mon নামের, যিনি ১৪০৬ সালে একজন বার্মিজ রাজা মিনখাউং (আভা রাজবংশ) দ্বারা পরাজিত হয়ে পান্ডুয়ায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, তিনি রাজা গণেশকে সামরিক সাহায্য দিয়েছিলেন যা তার সেনাবাহিনীকে ইব্রাহিমকে পরাস্ত করতে সক্ষম করেছিল। (৬) (৭) (৮) (১০)

জালালুদ্দিন ক্ষমতায় এলে তিনি তাঁর কাছেও সহায়তা চান । গণেশের ও দেব বংশের সৈন্য বাহিনীতে Min Sow বহুদিন ধরেই ছিলেন।

জালালুদ্দিন তাঁর সামরিক কুশলতার সম্বন্ধে জউনপুরের সাথে ( মুঙ্গেরের যুদ্ধে ) যুদ্ধের সময় থেকেই পরিচিত ছিলেন। তিনি সুলতানের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন এবং সুলতানকে আরাকানি সিংহাসন পুনরুদ্ধারে সাহায্য করতে রাজি করান। সুলতান রাজি হন কিন্তু এক শর্তে যে Min Sow Mon কে ইসলাম গ্রহণ করতে হবে এবং তাকে তার রাজ্যে মুসলিম সুফিদের প্রবেশের ধর্মপ্রচারের অনুমতি দিতে হবে। Min Sow Mon র রাজি হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল। জালালুদ্দিন তাকে একটি নতুন নাম দেন সুলেমান শাহ। যদিও তিনি কখনো বৌদ্ধ ধর্ম ত্যাগ করেননি তিনি তাঁর বংশের পরবর্তী রাজারা বহু বৌদ্ধ মঠ মন্দির পরে নির্মাণ করে। আরাকান রাজপরিবার দুটি নাম ব্যবহার করত, প্রথম বৌদ্ধ হিসেবে দ্বিতীয় মুসলিম হিসেবে।

১৪২৯ সালে, তিনি সুলতানের সহায়তায় আরাকানি সিংহাসন পুনরুদ্ধার করেন এবং রাজ্য শাসন করেন। ফেব্রুয়ারি/মার্চ ১৪২৯ সালে স মোন আফগান সৈন্যদের সহায়তায় আরাকান আক্রমণ করে। আক্রমণের প্রথম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল কারণ Saw Mon র সাথে সেনাপতির বাদানুবাদ হয়েছিল (Tabaung 790 ME), জেনারেল ওয়ালী খান বন্দী হয় Saw Mon কোন ক্রমে পালিয়ে যান। (৯) (১০)

সুলতান আরেকটি প্রচেষ্টায় রাজি হলেন। দ্বিতীয় আক্রমণটি সফল হয়। ১৮ই এপ্রিল ১৪২৯ সালে Launggyet তে Saw Mon কে রাজা ঘোষণা করা হয়।

(Thursday, 1st waning of Kason 791 ME). (According to some Arakanese chronicles, such as Inzauk Razawin, the second invasion took place in 1430, a year later.)

জালালউদ্দিন কোন স্বাধীন শাসক ছিলেন না তিনি বহুবার চীনের মীং বংশকে উৎকোচ প্রদান করেন।চৈনিক নৌবাহিনীর সরাসরি সোনারগাঁও বন্দরের ওপর ইন্টারেস্ট ছিল কিন্তু দেব সাম্রাজ্যের শক্তিশালী নৌবাহিনীর বিরুদ্ধে তারা টিকতে পারত না। ১৪১৫ তে Zheng He সোনারগাঁও বন্দর ভ্রমণ করেন।

Zheng He সমস্ত রকম কূটনৈতিক সাহায্য প্রদান করে জালালুদ্দিনকে। পরবর্তীতে জালালুদ্দিন যথার্থই Ming সাম্রাজ্যের অধীনতা স্বীকার করেন। Admiral Ming Shi একবার ও Zheng He দুবার পান্ডুয়া ভ্রমণ করেন। জালালুদ্দিন চীনা নৌ সেনাপতিদের যথাসাধ্য উৎকোচ প্রদান করেন। যে রাজারা তাঁর অধীনতা স্বীকার করেনি সেরকম ৩০ টি রাজ্যের রাজাকে বন্দি করে Zheng He চিনে নিয়ে যায়।

তারা ১) চৈনাদের কর প্রদান ২) চিনা নৌ বণিকদের অবাধ ব্যবসার জন্য বন্দর উন্মুক্তকরণের শর্তে ছাড়া পান।

১৪২৭- ১৪৩৪ পর্যন্ত সোনারগাঁ কার্যত চৈনিক নৌঘাঁটি হিসেবেই ব্যবহৃত হতো। দঃ পূর্ব বঙ্গ দখলের পর কার্যত সেখানের হিন্দু বৌদ্ধদের নাভিশ্বাস উঠে যায় জালালুদ্দিন ও নব্য ধর্মান্তরিত আরাকানের রাজাদের অত্যাচারে।বহু হিন্দু মন্দির বৌদ্ধ মঠ ধ্বংস হয়। বহু মানুষ প্রবল অত্যাচারের মধ্য দিয়ে ধর্মান্তরিত হন। (১১) (১২) (১৩)

আরাকান নৌবহর ও ত্রিপুরা ও পান্ডুয়ার শাসকের সাথে যুদ্ধ:

তিনি ১৪৩০ সালে একটি নতুন রাজধানী হিসেবে আরও ভালো কৌশলগত অবস্থান রূপে Mrauk-U(မြောက်ဦးမြို့)শহর, প্রতিষ্ঠা করেন । রাজা ১৪৩৩ সালে মারা যান এবং তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা Khayi/Ali Khan (အလီခင်) স্থলাভিষিক্ত হন। আলি খাঁর শাসনে যথার্থই আরাকান একটি প্রাথমিক ঐসলামিক রাজ্যে পরিণত হয় এমনকি এইসময় মুদ্রায় ফার্সিতে কালেমা লেখার চল শুরু হয়। এই সময়েতেই পীর বদরুদ্দিনের আগমন হয় চট্টগ্রামে। তাঁর সম্পর্কে বলা হয় যে, তিনি চট্টগ্রামে সকল ভূত দূর করে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেন। পীর বদরুদ্দীন সম্ভবত চট্টগ্রামে বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। ভূত সম্ভবত ‘ব্যূতপরস্তি’ অর্থাৎ প্রতিমা পূজাকে বোঝায়। বট পরস্তি/بت پرسی মানে প্রতিমা পূজা। অনেকের মতে ব্যুত বুদ্ধ মূর্তিকেও বোঝায়। (৭) (১৪)

যদিও আলি খান বা তাঁর পুত্র Ba Saw Phyu ဘစောဖြူ কলিমা শাহ (ကလမသျှာ) জালালুদ্দিনের বংশের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন না। এঁরা চট্টগ্রামে অভিযান চালায় রুকুদ্দিন বারবাক শাহের বিরুদ্ধে ।এনারা মুসলিম হলেও বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি খুব বেশি অত্যাচার করেননি এবং মহাবোধি শ্বে-গু মন্দির, এনাদের সময়েই তৈরি হয়। ত্রিপুরার রাজাদের সাথে এনাদের যুদ্ধ নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা ছিল। একমাত্র গজপতি ဂဇာပတိ ছাড়া এই বংশের বাকি সবার মুসলিম নাম ছিল। মাত্থু শাহ ১৪৯১ তে ফেনী নদীর তীরে ত্রিপুরার রাজাদের সাথে এক যুদ্ধে মারা যান। ইলিয়াস শাহের (ဣလိသျှာ)র বিরুদ্ধে যুদ্ধে ত্রিপুরার রাজাদের পক্ষে এক বাঙ্গালী সেনানায়ক বীরত্ব দেখান।

“রাধাকৃষ্ণ স্থাপিবারে মঠ আরম্ভিল।/ চট্টেরী দেবী আসি স্বপ্ন দেখাইল।।”
“চট্টগ্রামে সদরঘাটে এক বৃক্ষমূলে।/ পুজয়ে আমাকে সদা মগধ সকলে।।/ সেই স্থান হৈতে শীঘ্র আনহ আমায়।”
“এই মঠে যদি আমা স্থাপন না কর।/ তবে জান রাজা তোমার নাহিক নিস্তার।।”
“রসাঙ্গমর্দন নারায়ণ পাঠায় চট্টলে।/ স্বপ্নে যেই স্থানে দেখে মিলিকে ভালে।।”

সদরঘাটের যুদ্ধ(1501 AD):

গভীর জঙ্গল ও হিংস্র বন্যপ্রাণী উপেক্ষা করে রাজকীয় নির্দেশ পাওয়া মাত্রই রসঙ্গমর্দন চট্টগ্রামে পৌঁছে যান। চট্টগ্রামের সদরঘাটে চট্টেশ্বরী দেবী মূর্তি উদ্ধার করতে গেলে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ত্রিপুরা সেনাবাহিনীর যুদ্ধ শুরু হয়। সেনানায়ক রাসাঙ্গমর্দনের নেতৃত্বে ত্রিপুরা সেনাবাহিনী অবশেষে রোহিঙ্গা দস্যুদের পরাজিত করে এবং তাদের অধিকাংশই মা চট্টেশ্বরীর সামনে বলিদান করে। তারপর বিজয়ী রাসঙ্গমর্দন দেবী মূর্তি নিয়ে ত্রিপুরা রাজধানীতে ফিরে আসেন এবং রাজ্যে দেবী ত্রিপুরেশ্বরী রূপে স্থাপিত হন। চট্টগ্রাম ত্রিপুরা রাজ্যের হিন্দু শাসনের অধীনে আসে এবং রসাঙ্গ-মর্দন চট্টগ্রামের সামন্ত প্রধান নিযুক্ত হন। (১৬) (১৭)

বহিরাগত আফগান সৈন্যরা আরাকানে বসতি স্থাপন করে স্থানীয় বৌদ্ধদের বিবাহ করতে থাকে এবং তার ফলে আরাকানে বৌদ্ধ নিপীড়ন বৃদ্ধি পায় বাইরে থেকে অনেক। আরব বণিকরাও এই অঞ্চলে বসবাস স্থাপন করতে থাকে। সুফিদের বাড়বাড়ন্তের কারণে বহু স্থানীয় বৌদ্ধ নিপীড়িত হয়ে সমতল ভূমি ছেড়ে আরাকান ও চট্টগ্রাম পর্বতমালা অঞ্চলে সরে যায়। এভাবেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্ম হয়। এরা পেশায় জলদস্যু ও ধর্মে মুসলিম।

অতএব নিঃসন্দেহে বলা যায়, “মগ জলদস্যু সম্প্রদায়’ ও রোহিঙ্গারা অভিন্ন। দঃপূর্ব বাংলা ও সুন্দর বন অঞ্চলে স্থানীয় মানুষদের লুটপাট ও ধর্মনাশ করত।

আরাকান নৌ অভিযাণের দ্বিতীয় পর্ব:

বহুকাল নিস্ক্রিয় থাকার পর পুনরায় মিন বিন Min Bin (မင်းပင်), যাবুক শাহ (ဇာပေါက်သျှာ)ও মিন দীক্ষা (မင်းတိက္ခ) বাহাদুর শাহের শাসনকালে আরাকানের নৌবাহিনীর পুনর্গঠন শুরু হয় এবং সুন্দরবন ও পূর্ব বঙ্গে নৌ অভিযান প্রেরণ আরম্ভ হয়। ত্রিপুরার রাজাদের সাথে সেই সময় বিরোধ চরমে ছিল।তবে চট্টগ্রাম অঞ্চলে লুটপাট সেই সময় খুব বেশি মাত্রায় ছিল না। চট্রগ্রাম যদিও চট্টগ্রামের অধিকার নিয়ে আরাকান সুলতানি সৈন্য ও ত্রিপুরার ত্রি শক্তি সংগ্রাম চলতেই থাকত।

শেলিম শাহ বা মিং রাজগির শাসনে পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হয় । বিক্রমপুরে নতুন হিন্দু রাজশক্তির সাথে তাদের বিরোধ চরমে পৌঁছে যায়। (১)

দে বারো নামে পর্তুগিজ ঐতিহাসিকের বইতে দেখা যায়, গোয়ার পর্তুগিজ শাসক নুনো দা কুনহা চট্টগ্রামে উপনিবেশ স্থাপনের জন্য পাঁচটি জাহাজ ও দুইশত লোক নিয়ে আলকনসো ডি মেলোকে পাঠান। সপ্তগ্রাম ও চট্টগ্রাম ছিল তাদের প্রধান ব্যবসার স্থান। তারা চট্টগ্রামকে পোর্টো-দে-গ্রান্ডি এবং সপ্তগ্রামকে পোর্টো দে পেকিনো নামে ডাকত। সন্দ্বীপের আশেপাশে বাঙালি-মগ-পর্তুগিজ-মুঘলদের মধ্যে অনেক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, এটি লবণের খনির জন্য বিখ্যাত।

সমুদ্রগামী পর্তুগিজরা সবাই দস্যু ছিল না, তবে তাদের মধ্যে অবশ্যই অনেক অত্যাচারী হার্মাদ ছিল। ফিরিঙ্গিদের পরাজিত করার পর, কেদার রায় সূক্ষ্মভাবে তাদের রাজ্য দখল করেন এবং শ্রদ্ধার বিনিময়ে ডমিঙ্গো কারভালিয়াস/কারভালিয়াস বা কারভালহোকে সন্দীপের রাজ্য দেন। কারভালহো কেদার রায়ের নৌপ্রধান হন। এই সময়ে, মুঘল সেনাবাহিনী সন্দ্বীপকে ঘিরে ফেললে, কেদার কার্ভালহোকে সাহায্য করার জন্য সৈন্য পাঠান এবং একটি যুদ্ধে মুঘলদের পরাজিত করেন।

অন্যদিকে আরাকানরাজ মেং রাজাগি বা সেলিমশা সর্বদা সন্দ্বীপের উপর নজর রেখেছিলেন। তিনি সন্দ্বীপ দখল করার জন্য ১৫০টি যুদ্ধজাহাজ পাঠান। তিনি কেদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করেন এবং মগরা পরাজিত হয়, ১৪০টি যুদ্ধজাহাজ কেদার রায়কে দখল করে। ক্রুদ্ধ আরাকানি সম্রাট পরবর্তীতে ১, ০০০ টি যুদ্ধজাহাজ পাঠান। একটি বৃহৎ সৈন্যবাহিনী, এবং একটি ভয়ানক যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং মগরা পরাজিত হয়, যার ফলে প্রায় ২, ০০০ মগ নিহত হয়। অবিভক্ত বাংলার ইতিহাস অনুসারে, বাংলায় এমন ভয়ানক নৌ-যুদ্ধ আর কখনও দেখা যায়নি। পরবর্তীতে ক্যাভার্লো ক্ষতিগ্রস্ত রজ্জুগুলি মেরামত করতে শ্রীপুরে গিয়েছিলেন সেই সময়, কেদার রায় মুঘল আক্রমণ প্রতিরোধে ব্যস্ত ছিলেন এবং আরাকানিরা সন্দ্বীপ দখল করে। (১) (১৫)

সেলিম শাহের স্থানীয় নাম মেং রাজগি ছিল। অনুমান করা যায় এখান থেকেই মগ জাতির নামকরণ হয়(মেং>ভেংগে> মগ)। এই অঞ্চলে ত্রিপুরা আরাকান ও স্থানীয় হিন্দুরা শক্তির মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলত।

এই কারণেই মানসিংহ কেদার রায় কে লেখা পত্রে ‘ত্রিপুর মগ বাঙালি’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেন। (১) কেদার রায়ের পরবর্তীতে প্রায় আধ দশক মগরা দক্ষিণ পূর্ব বাংলায় লুঠপাট চালায় সম্ভবত এই সময় কালেই নোয়াখালী অঞ্চল সম্পূর্ণরূপে মুসলিম প্রধান হয়ে যায়।

আরাকান-রাজের সৈন্যদলের মধ্যে অনেক মগ ও অবৈতনিক পর্তুগিজ সৈন্য ছিল। এরা বছরে বারোমাস লুণ্ঠন, অপহরণ ও অত্যাচার চালাত। ১৬৬৩ খ্রিষ্টাব্দে নবাব শায়েস্তা খাঁ সেনাপতি হুসেনবেগের সহায়তায় আরাকান-রাজকে সম্পূর্ণ পরাজিত করে মোগলদের হৃত-ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেন। ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর সেনাপতি ওমেদ খাঁ ও হুসেনবেগ চট্টগ্রাম ও সন্দ্বীপ দখল করে। শায়েস্তা খাঁর এই দুর্ধর্ষ অভিযানে চট্টগ্রাম থেকে পর্তুগিজ ও মগেরা অতি ক্ষিপ্রকারিতায় পালানোর (স্থানীয়ভাবে এই ঘটনা ‘মগ-ধাওনি’ নামে খ্যাত ছিল) সময় ১,২২৩টি কামান ফেলে যায়। (১)

সূত্র –

(১) “বৃহৎ বঙ্গ” – শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন
(২) “‘ বাংলার দাস-বাণিজ্যের ক্রীতদাসী” – শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকার
(৩) শ্রী নগেন্দ্রনাথ বসু – “বিশ্বকোষ” ত্রয়োদশ খন্ড, পৃ – ৬৭৮
(৪) শ্রী দীনেশ চন্দ্র সরকার – “শিলালিপি ও তাম্রশাসনাদি প্রসঙ্গ”
(৫) শ্রী রজনীকান্ত চক্রবর্তী – “গৌঢ়ের ইতিহাস”, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ – ১৯২
(৬) Richard Maxwell Eaton (1993). “The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204-1760”.pp-53ff, 54ff.
(৭) Harvey 1925: 137–140
(৮) Sandamala Linkara Vol. 2 1999:
(৯) Myint-U 2006: 73
(১০) Sandamala Linkara Vol. 1 1997:
(১১) East Africa and its Invaders p. 37
(১২) Paranavitana, History of Ceylon, p.299
((১৩) Sri Haraprasad Ray, (1997). Sino – Indian Commercial and Diplomatic Relations. The Quarterly Review of Historical Studies. Vol. 37. Calcutta: Institute of Historical Studies. p. 114
(১৪) Phayre 1967: 78
(১৫) Portugese in Bengal Campos
(১৬) Tripura Rajamala [Dhanyamanikya kanda]
(১৭) Sri DC Sen – “Regional History of Bengal – Tripura kingdom”

Picture Courtesy: TFIPost

লেখক পরিচিতি: শ্রী জ্যোতিষ্মান সরকার B.Tech Ceramic Technology তে পাঠরত।

Comment here