(পূর্বের অংশের পর)
কিন্তু এই গ্রামটির চেহারা বদলে যেত বর্ষাকালে যখন অন্তত দুটি মাস বাড়িগুলি ছারা মাঠ-ঘাট-পুকুর তলিয়ে যেত অনন্ত জলরাশির নীচে। তখন বৃষ্টি বোধয় বেশি হত, আর সাগর পানে ধেয়ে আসা উত্তরের প্লাবন। প্রথম দিকে ঘোলা (পলিমাটি বয়ে আনত বলে) ও পরে পরিষ্কার। তাই এইকে জমি সিল খুব উর্বরা। এই মাসদুয়েক কোরকদী বেশ কয়েকটি খন্ড দ্বীপে পরিণত হয়ে যেত। ভট্টাচার্য পাড়া তিন খন্ড ও লাহিড়ি – সান্যাল পাড়া একলপ্তে থাকায় আরেক খন্ড দ্বীপ। একটি থেকে আরেকটিতে যেতে ডিঙ্গি বা ভেলাই ভরসা। ছেলেবেলায় আমরাও কলাগাছ কেটে ভেলা বানিয়ে নিতাম। এই খন্ড দ্বীপের তখন অন্য রূপ। প্রথম দিকে উঁচু ভিটে ও পরে পাকা বাড়ি তৈরী করতে মাটি নিতে নিতেই অনেকগুলি জলাশয় সৃষ্টি হয়েছিল। তবে সেগুলি স্নানাদি কর্মে ব্যৱহৃত হত না। পানাপুকুর হয়েই থাকতো। লাহিড়ি পাড়ার সামনে (দক্ষিণ দিকে) এমনই একটি বিশাল পুকুর তৈরি হয়েছিল যেটি কিন্তু পানাপুকুর হয়নি। সারা বছর জল থাকত কিন্তু আমরা তেমন পাইনি। অগ্রহায়ণ মাস থেকেই আমরা সেখানে ফুটবল, দাঁড়িবান্ধা ইত্যাদি খেলেছি। এই পুকুরটি বর্ষাকালে ভরে যেত পদ্মফুলে। শাপলা নয়, শুধু পদ্মফুলে। অনেকগুলি পারিবারিক দুর্গাপুজো হত। প্রচুর পদ্ম লাগত। সারা গ্রামের প্রয়োজন এখন থেকেই মিটে যেত। পদ্মপাতায় প্রসাদ খাবার চল থাকায় পাতায় কাজে লাগত। সেটি একটি অপরূপ দৃশ্য। দশ বিঘার পদ্মে ভরা পুকুর। জ্যোৎস্না রাতে নৌকোতে হতো গানের জলসা। শুধু ছেলেদের অনুমতি ছিল সেই নৌকোয় ওঠার। এটির নাম ছিল পদ্মপুকুর। আমরা তাকে পদ্মহীনাই দেখেছি। লাহিড়ি বাড়ির সৌখিন কেউ হয়ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বা প্রয়োজন বুঝে চাষ করেছিলেন। পরের দিকে হয়ত প্রাকৃতিক পদ্মপুকুর হয়ে যায়। বছরের দু-আড়াই মাস এটি কোরকদীর রত্নাভরণ হয়ে থাকতো।
শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে আরেক ইংরেজ জেলাশাসক বজরা ও লোকজন নিয়ে এসেছিলেন কোরকদীর দুর্গোৎসব দেখতে। চারিদিকে জলে থৈ থৈ। পদ্মপুকুর ও দ্বীপের মত গ্রামটির শোভায় মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন এটি ‘বাংলার ভেনিস’। কিন্তু দু’মাসের রূপ সারা বছর থাকবে না। ভেনিস নয় ‘ছোট কলকাতা’ নামটিই তিলক হয়ে গেল।
(ক্রমশঃ)