শ্রীজিৎ দত্ত
:
অগ্নিচয়ন – বিপ্লবের অনুশীলন
নিজের স্মৃতিকথায় যাদুগোপাল সরাসরি উপনিষদের যুগে ফিরে গিয়েছেন –বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় ভারতবর্ষে জ্বলে ওঠা বিপ্লবী জাতীয়তাবাদের মূল উপাদানগুলি খুঁজে বের করবার জন্য। ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসের সেই ঊষাকাল থেকে আরম্ভ ক’রে তাঁর রচনায় তিনি পরবর্তী সময়কালগুলির কথাও সংক্ষেপে বিবৃত করেছেন। বলেছেন বুদ্ধ যুগের কথা, বুদ্ধের সঙ্ঘগঠন ও সমাজ জীবনে সঙ্ঘের প্রভাবের কথা, বিভিন্ন জনপদগুলির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত রাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা; বলেছেন মৌর্যদের বিরাট সাম্রাজ্য স্থাপনের কথা, সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের অধীনে ভারতের রাজনৈতিক ঐক্যস্থাপন এবং আচার্য চাণক্য কর্তৃক‘এক জাতি, এক পতাকা’-র জাতীয়তাবাদী ধারণা প্রবর্তনের কথা, চার্বাক ও লোকায়তদের বস্তুবাদের কথা, এবং মধ্যযুগীয় ও প্রাক-আধুনিক ভারতবর্ষের বীর রাজপুত, মারাঠা এবং শিখদের কথা। ভারতবর্ষের চলমান সভ্যতার ইতিহাসের একটি সংক্ষিপ্ত অথচ সামগ্রিক চিত্র তুলে ধ’রে বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী লেখক যাদুগোপাল এই ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন করেছেন,যাতে পাঠক বুঝতে পারেন যে ভারতীয় ইতিহাসের আধ্যাত্মিকতা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং সাংস্কৃতিক গৌরব আধুনিক ভারতের জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীদের চিন্তায় এবং কর্মে কতখানি সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল।
অতএব, ইতিহাস রচনার যে পদ্ধতিটি আমি এখানে অবলম্বন করেছি তাতে নতুনত্ব কিছু নেই। কিন্তু এ কথাও মাথায় রাখা দরকার যে খুব কম সংখ্যক ইতিহাস-রচয়িতাই তাঁদের রচনায় এই পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। ইতিহাসবিদ দম্পতি শ্রী হরিদাস ও শ্রীমতী উমা মুখোপাধ্যায়ের নাম এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে স্মর্তব্য। তাঁদের পূর্বসূরি আচার্য রমেশচন্দ্র মজুমদারের বেশ কয়েকটি রচনাতেও এই পদ্ধতির আভাস লক্ষ্য করা যায়। যাদুগোপাল নিজে ইতিহাসবিদ না হয়েও বিপ্লবী জাতীয়তাবাদের ইতিহাস রচনায় ব্রতী হয়ে এই বিশেষ পদ্ধতিটির শরণাপন্ন হয়েছেন।আমি মনে করি, এই পদ্ধতি অবলম্বনে রচিত ইতিহাস অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের জাতীয়তাবাদী রাজনীতি তথা সমগ্র ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের উপরেই নতুন এবং গভীর আলোকপাত করবার সম্ভাবনা রাখে। তবে যাদুগোপাল যেমনটা করেছেন, সেইমতো অগ্নিযুগের বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক উপাদানগুলির সুলুক সন্ধান করতে ব’সে আমি কিন্তু ভারতবর্ষের প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাসের সুদূর অধ্যায়গুলির আলোচনায় যাবো না। আমি বরং নিজের ইতিহাস-বিশ্লেষণকে আধুনিক যুগ, অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়া থেকে আরম্ভ ক’রে তৎপরবর্তীকালের উপাদানগুলির বিশ্লেষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখব। কীভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গীয় নবজাগরণ অগ্নিযুগের পথ প্রস্তুত করেছিল,কীভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর কয়েকজন চিন্তাবীর ও কর্মবীর আধুনিক ভারতবর্ষে ধর্মীয়-আধ্যাত্মিক, রাজনৈতিক-সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন, এবং কীভাবে এর ফলে ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্তিম ভাগ থেকে আরম্ভ ক’রে মধ্য-বিংশ শতাব্দীর ভারতীয় রাজনীতির প্রায় সব কটি ভিন্ন-ভিন্ন ধারার জন্ম হয়েছিল, তা এই ইতিহাসে ধরা পড়বে।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা এবং পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশগুলিতে মনন, অনুশীলন এবং দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে যে বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটেছিল, তা একাধিক কারণের সমাহার ও তাদের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফল। এই ইতিহাস-আলেখ্যতে প্রাথমিকভাবে আমার মনোযোগ আধ্যাত্মিক/ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক কারণগুলির উপর ন্যস্ত থাকবে। বলা বাহুল্য, এগুলির সবকটিই পুরোদস্তুর ঐতিহাসিক কারণ, অর্থাৎ ঐতিহাসিক পদ্ধতি এবং ঐতিহাসিক উপাদান ব্যবহার ক’রে এগুলিকে শনাক্ত করা সম্ভব। আর সেইজন্যে এদের ঐতিহাসিকতা বা ইতিহাসগত মূল্য কোনোভাবেই অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক কারণগুলির তুলনায় কম কিংবা বেশী নয়। একইসঙ্গে এ-ও ব’লে রাখা প্রয়োজন যে আমি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অর্থাৎ বস্তুগত কারণগুলিকে অবহেলা করি না – কেবল এক্ষেত্রে আমার মনোযোগ বিশেষভাবে অন্যত্র নিয়োজিত। এই যাবতীয় ঐতিহাসিক কারণগুলিকে আমি একত্রে রূপকার্থে অগ্নিযুগের বিপ্লবী জাতীয়তাবাদের আগুন প্রজ্বলিত করবার কাজে ব্যবহৃত ‘সমিধ’হিসাবে বর্ণনা করছি। এইসব সমিধদেশের মুক্তিযজ্ঞের আগুন জ্বালিয়েছিল।
প্রথমেই ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ার বছরগুলিতে ভারতবর্ষের চিন্তাজগতে যে ধরণের পরিবর্তন ঘটতে আরম্ভ করেছিল, সে-সম্পর্কেএকটা ধারণা অর্জন করা দরকার। ঐ বছরগুলিতে ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক-রাজনৈতিক ধারণা এবং আদর্শের ক্ষেত্রে প্রবল কর্মকাণ্ড চলেছিল, যার প্রভাবে ভারতীয়দের মধ্যে স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা কয়েক দশকের মধ্যেই বিরাট আকার ধারণ করে। এই কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা থাকলে বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদের আগুন কীভাবে জ্বলে উঠেছিল, কীভাবে তা মূলধারার জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মধ্যে জায়গা ক’রে নিয়েছিল, এবং ক্রমশ দেশ-বিদেশব্যাপী এক ঘোর দাবানলে পরিণত হয়েছিল সেসব বুঝতে আমাদের সুবিধে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যে ভারতবর্ষের বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদ স্রেফ এদেশের গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, সময়ের ও সংগ্রামের চাহিদা মেনে তাদেশ ছাড়িয়ে বাইরের বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়েছিল, বিভিন্ন মহাদেশে তার কার্যকলাপ প্রবল গতিতে চলেছে, এবংঅবশেষে তা ভারতের রাজনৈতিক স্বাধীনতা আনতে সরাসরি সাহায্য করেছিল। সত্যি বলতে, এর প্রভাব এখনো ফুরোয়নি। ভারতের বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদের প্রেরণা স্রোত আজও এদেশের আত্মক্ষয়কারী মননের ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্তির লড়াইয়ে রসদ জুগিয়ে চলেছে। দেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি অর্জনের জন্য ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তার পদধ্বনি আজকেও শোনা যায় – শুধু শুনতে পারার মতো কান থাকা চাই।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার যে, বিপ্লবী তথা লেখক শ্রীযুক্ত ক্ষীরোদকুমার দত্ত – যিনি নিজে বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদের আদি সংগঠন অনুশীলন সমিতির সদস্য ছিলেন, তিনি ১৮৭০ থেকে ১৯০০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে অবিভক্ত বাংলা এবং মহারাষ্ট্রে বিপ্লবের আগুন জ্বালানোর লক্ষ্যে ‘সমিধ সংগ্রহের যুগ’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। এই ধারাবাহিক রচনার পরবর্তী অংশগুলিতে আমরা উনিশ শতকের সেই তিনটি ঘটনাবহুল দশকে ঠিক কী কী ঘটেছিল তার একটি বিস্তৃত আলোচনার মধ্যে যাবো।
প্রথমেই লক্ষ্যণীয়, ১৮৭০ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে তিন দশকের মধ্যেইআমাদের ইতিহাস-আখ্যানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিন চরিত্র– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ এবং শ্রী অরবিন্দ – বেড়ে ওঠেন এবং কর্মী তথা চিন্তাবীর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার বছরগুলি থেকেইএই তিন ব্যক্তিত্ব নিজ নিজ প্রতিভা ও সাধনার জোরে বাঙ্গালী সমাজ তথাভারতীয় সমাজের উপর, বিশেষ ক’রে ভারতের যুবসমাজের মানসিকতার উপর, গভীর প্রভাব ফেলতে শুরু করেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের সেই তিন দশকে (১৮৭০-১৯০০) হিন্দুধর্মের ভেতরে সংস্কারপন্থী এবং পুনরুত্থানপন্থী এই দু’ধারার আন্দোলনই তীব্র হয়ে উঠেছিল। নিম্নলিখিত ঘটনাগুলি লক্ষ্য করলে এ-ব্যাপারটি স্পষ্ট বোঝা যায়। আদি ব্রাহ্মসমাজ ১৮৭৮ সালে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের মতো নতুন সম্প্রদায়ের জন্ম দেয়, এবং ১৮৮১ সালে শক্তিশালী ব্রাহ্ম প্রচারক শ্রী কেশবচন্দ্র সেন নববিধান ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী কর্তৃক আর্যসমাজের গোড়াপত্তনও মোটামুটি ঐ একই সময়ে (সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ১৮৭৫ সালে) ঘটে। এইভাবে একঝাঁক উল্লেখযোগ্য ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নেতা উদ্যোগে জোরদার সংগঠন-গঠনমূলক কার্যকলাপ এবং দেশব্যাপী প্রচারের পাশাপাশি এই একই সময়ে ভারতবর্ষে প্রথম জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক সংগঠনও গ’ড়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে, উপরোক্ত ধর্মীয় সংগঠনগুলির প্রচার-প্রসারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব রাজনৈতিক সংগঠন গ’ড়ে তোলার পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে সংগঠন তৈরির এই তৎপরতা হিন্দুসমাজে এক নতুন প্রাণের জোয়ার এনেছিল, যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হল আধুনিক রাজনৈতিক পদ্ধতিতে নিজেদের সংগঠিত করবার নতুন তাগিদ অনুভব। মাথায় রাখতে হবে, ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (১৮৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত) এবং ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস (১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত)-এর মতো ভারতবর্ষের প্রথম দু’টি সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক সংগঠনও এই তিন দশকের মধ্যেই আবির্ভূত হয়েছিল।
এই সময়কালেরই অন্তর্গত অতি-গুরুত্বপূর্ণ একটি সাংস্কৃতিক তথা আধা-রাজনৈতিক উদ্যোগ ছিল কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাৎসরিক হিন্দুমেলা। আক্ষরিক অর্থেই একটি মেলা বা কার্নিভাল হ’লেও আদতে হিন্দুমেলা ছিল ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন এবং ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের মতো সংগঠনগুলির অগ্রদূত। হিন্দুমেলার প্রকাশভঙ্গি এবং কার্যকলাপে স্পষ্টতই রাজনৈতিক ছাপ ছিল। আদি ব্রাহ্মসমাজের সাথে সরাসরি যুক্ত অথবা ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ব্রাহ্ম ধর্মনেতা এবং বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগে এইহিন্দুমেলা ১৮৬৭ থেকে ১৮৮০ সাল পর্যন্ত মোট চৌদ্দবার অনুষ্ঠিত হয়েছিল। হিন্দুমেলা মূলত শ্রী নবগোপাল মিত্র নামে জনৈক স্বদেশপ্রেমী ভদ্রলোকের উদ্যোগের ফল, যিনি প্রায় এককভাবে মেলা আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন এবং বহু গণ্যমান্য ব্যক্তিকে সক্রিয়ভাবে এতে অংশগ্রহণ করতে রাজি করিয়েছিলেন। নবগোপাল এই উদ্যোগে আদি ব্রাহ্মসমাজের শীর্ষনেতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের কাছ থেকে অকুণ্ঠ সাহায্যও সমর্থন পেয়েছিলেন। কলকাতার জোড়াসাঁকোর এই ঠাকুর পরিবার হিন্দুমেলার আয়োজন সফল কবার লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক ও আর্থিক এই দু’ভাবেই সহায়তা করেছিল। এক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল মহর্ষির অসাধারণ প্রতিভাবান পুত্রদের – বিশেষ ক’রে দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথের, হিন্দুমেলায় যাঁদের অংশগ্রহণ ছিল সর্বাত্মক। এই চার প্রতিভাবান তরুণ কবিদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ রবীন্দ্রনাথ হিন্দুমেলার জনসমাবেশে কবিতা পাঠ করবার বিশেষ উদ্দেশ্যে কয়েকটি স্বদেশপ্রেম-উদ্বোধক কবিতা রচনা করেছিলেন। স্বদেশী আন্দোলনের ভবিষ্যৎ মুখপাত্র এবং অন্যতম নেতা রবীন্দ্রনাথ হিন্দুমেলা অনুষ্ঠিত হবারকালে কিশোরবয়স্ক বালক ছিলেন মাত্র। কিন্তু ঐ অল্প বয়সেও রবীন্দ্রনাথ এই অভিনব এবং উত্তেজনাপূর্ণ উদ্যোগে অগ্রজ সহোদরদের সঙ্গে নিজের মনপ্রাণ সঁপে দিয়েছিলেন।যে নব-উদীয়মান জাতীয়তাবাদী অনুভূতির জোয়ার সেসময় হিন্দুমেলা কলকাতা শহরে বইয়ে দিয়েছিল, তা নবযৌবনের তরঙ্গ-উচ্ছ্বাসের মতো রবীন্দ্রনাথের কিশোর মনে গভীর রেখাপাত করে।
ব্যক্তিমনের উপর প্রভাবের বাইরেও সাধারণভাবে দেখতে গেলে হিন্দুমেলায় রবীন্দ্রনাথও তাঁর অগ্রজদের অংশগ্রহণ ১৮৭০-এর দশকের নবজাগরণশীল বাংলার শিক্ষিত বাঙালি যুবকদের জাতীয়তাবাদী হাওয়ার প্রতি ইতিবাচক মনোভাবেরই লক্ষণ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতি-তে সেসময়ের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। সেখানে তিনি তাঁর মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জনপ্রিয় জাতীয়তাবাদী সঙ্গীত “মিলে সবে ভারতসন্তান” রচনার কথা স্মরণ করেছেন, যা হিন্দুমেলার যুগেই রচিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্মৃতিকথায় আরও উল্লেখ করেছেন যে হিন্দুমেলাই প্রথমবার আধুনিক ভারতীয়দেরকে তাদের নিজের মাতৃভূমি বা স্বদেশহিসেবে ভারতবর্ষকে প্রেম ও ভক্তির দ্বারা অনুভব করবার সুযোগ ক’রে দিয়েছিল। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে হিন্দুমেলায় জাতির প্রশংসামূলক স্তোত্র ও গান পরিবেশিত হ’ত, দেশাত্মবোধক কবিতা আবৃত্তি করা হ’ত, স্বদেশী বা জাতীয় শিল্প ও কারুশিল্প, জিমন্যাস্টিক্স এবং মার্শাল আর্টের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হ’ত, এবং মেলা উপলক্ষে বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রতিভাবান ভারতীয়দেরকে পুরস্কৃত করা হ’ত।
ইতিহাসবিদ আচার্য রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর মহাগ্রন্থ ‘দ্য হিস্ট্রি অ্যান্ড কালচার অফ দ্য ইন্ডিয়ান পিপল’-এর দশম খণ্ডে উনিশ শতকের শেষ দশকে হিন্দু মেলা কীভাবে বিশেষ ক’রে বাঙ্গালীদের মধ্যে আরও জোরালো রাজনৈতিক সংগঠন তৈরির অনুশীলনের সূত্রপাত করেছিল তা উল্লেখ করেছেন। আচার্য রমেশচন্দ্র জানাচ্ছেন : “বাংলায় রাজনৈতিক ও জাতীয় আন্দোলনের সাথে আরও সরাসরিভাবে নিয়োজিত অন্য কয়েকটি সংগঠন প্রতিষ্ঠার কারণে [হিন্দু মেলার] গুরুত্ব ধীরে ধীরে হ্রাস পায়। তবে বাংলায় জাতীয়তাবাদী মনোভাবের বিকাশে এর অবদানের গুরুত্ব অসীম। এই মেলায় গাওয়া এবং আবৃত্তি করা দেশাত্মবোধক গান এবং কবিতা –যার মধ্যে আঠারো-বছর বয়সী বালক রবীন্দ্রনাথের দু-একটি অধুনা-বিখ্যাত রচনাও ছিল, আজওবাংলাসাহিত্যের সম্পদ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে।”
আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হ’ল, হিন্দু মেলার চতুর্থ অধিবেশনের পরপরই ন্যাশনাল সোসাইটি বা “জাতীয় সমাজ” নামে একটি সংগঠনের স্থাপনা, যা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ব্রাহ্মসমাজের ঐ একই ধর্মনেতা এবং বুদ্ধিজীবীরা,যাঁরা কিনা হিন্দুমেলারও মূল চালিকাশক্তি ছিলেন। আচার্য রমেশচন্দ্র জানাচ্ছেন যে এই সোসাইটির ঘোষিত লক্ষ্য ছিল “হিন্দুজাতির মধ্যে ঐক্যের ভাব তথা জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শের প্রচার”। এই লক্ষ্যে বক্তৃতা প্রদানের জন্য সোসাইটির মাসিক অধিবেশন বসতো, যেখানে সোসাইটির সবচেয়ে বাগ্মী এবং প্রতিভাবান বক্তারাই বক্তৃতা দিতেন। এই সমিতিরই এক বক্তৃতায় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং “ঋষি”রাজনারায়ণ বসু উপস্থিত ছিলেন। সে সময় মহর্ষি ব্রাহ্মসমাজের নেতাদের মধ্যে এবং সাধারণভাবে হিন্দুসমাজের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে মান্য হতেন, এবং সে কারণে তিনি হিন্দুসমাজের অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ন্যাশনাল সোসাইটির এই বিশেষ অধিবেশনটিতে সভাপতিত্ব করেন এবং রাজনারায়ণ বসু ঐ সভায় বক্তৃতা প্রদান করেন।
সেবার ঋষি রাজনারায়ণের ভাষণের বিষয়বস্তু ছিল “হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব”। বসু তাঁর প্রদত্ত ভাষণে জোরের সঙ্গে ঘোষণা করেন যে ইউরোপীয় সভ্যতা-সংস্কৃতি ও খৃষ্টীয় ধর্মতত্ত্বের তুলনায় হিন্দুধর্ম এবং হিন্দুসংস্কৃতি শ্রেষ্ঠতর। একইসঙ্গে তিনি আপামর হিন্দুজাতির মধ্যে জাতীয়বাদী মনোভাব প্রসারের প্রয়োজনীয়তার পক্ষে জোরালো সওয়াল করেন। এই প্রসঙ্গে ১৮৬৬ খৃষ্টাব্দে ঋষি রাজনারায়ণ কর্তৃক প্রকাশিত একটি রচনার কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, যার শিরোনাম ছিল “বাংলার শিক্ষিত স্বদেশবাসীর মধ্যে জাতীয়তাবাদীভাব প্রচারের জন্য গঠিত সমাজ”। এই রচনাটি আসলেই ছিল ভারতবর্ষের সদ্যোজাত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক ইশ্তেহার। এতে ঋষি রাজনারায়ণ ভবিষ্যত ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও সংগঠনের মূল আদর্শগুলিকে তুলে ধরেন, যার একমাত্র উদ্দেশ্য হবে শারীরিক, বৌদ্ধিক, নান্দনিক এবং আধ্যাত্মিক – এই যাবতীয় মানবীয় ক্ষমতার বিকাশের মাধ্যমে হিন্দুজাতির পুনর্জন্ম ঘটানো।
একাধিক কারণে ঋষি রাজনারায়ণের এই জাতীয়তাবাদী ইশতেহারটিকে বঙ্কিমচন্দ্রের অনুশীলন তত্ত্বের পূর্বসূরি বলা চলে, যে অনুশীলন তত্ত্বে বঙ্কিম হিন্দুজাতির সামাজিক-ধর্মীয় পুনর্জাগরণের ধারণাগত বা তাত্ত্বিক কাঠামোটিকে দাঁড় করিয়েছিলেন। এই অনুশীলন তত্ত্ব বঙ্কিম তাঁর বিখ্যাত রচনা ধর্মতত্ত্বে (১৮৮৮ খৃষ্টাব্দ) ব্যাখ্যা করেন। এই অনুশীলন তত্ত্বের নাম ধার করেই বাংলায় প্রতিষ্ঠিত প্রথম এবং প্রধান বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদী সংগঠন‘অনুশীলন সমিতি’র নামকরণ করা হয়েছিল। সুতরাং, ঋষি রাজনারায়ণের ১৮৬৬ সালে রচিত এই ইশতেহারটিকে হিন্দুসমাজের রাজনৈতিক মুক্তি-আন্দোলনের একটি ‘ব্লুপ্রিন্ট’ বললে খুব ভুল বলা হবে না। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, হিন্দুমেলার সাংস্কৃতিক মন্থন হ’তেই ভারতবর্ষের রাজনৈতিক মুক্তি আন্দোলনের এবং বিশেষ ক’রে বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের আদর্শ, ভাবধারা ও গতিপ্রকৃতি নির্ধারিত হ’তে আরম্ভ করে।
(ক্রমশঃ)
(লেখক পরিচিতি – শ্রী শ্রীজিৎ দত্ত একজন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক, কবি, নাট্যকার, অনুবাদক ও সঙ্গীতজ্ঞ)


