(আগের পর্বের লিঙ্ক)
এবার ভোরের শিশিরমাখা সাদামুক্তোর মতো শিউলিফুল গাছের নিচে ঝরে পড়ে থাকছে, আবার মাঠে-ঘাটে গেলেই কাশফুলের দেখা।মাথা তুলে যেন পেঁজা তুলোর মতো মেঘের সাথে পাল্লা দিয়ে সাদারঙা পালকে পরিণত হয়ে কে বেশি নান্দনিক তারই রেশারেশি চলছে! আর পুকুরে খালে বিলে পদ্মফুল-লালসাদা শালুক ফুল ফুটে ফুটে ফুটে সারা। পদ্মপাতার ওপর ভোরের বিন্দুবিন্দু শিশির , ছাতিমের সুগন্ধ এবার যে জানান দিচ্ছে “এসেছে শরত হিমের পরশ”। আপামর বাঙালির প্রাণের উৎসবের শুরু এবার হলো বলে। প্রকৃতিও এসবের মধ্য দিয়ে কখনো মেঘছাই কখনো তেজী রোদের সুখদৃশ্যে জানিয়ে চলেছে উমামায়ের বাপের বাড়ি আগমনের পালা। এই শারদীয়া উৎসবে গ্রামের রেওয়াজ কিন্তু একটু ভিন্ন। নাহ্ তাই বলে উৎসব উদযাপনে কোনো ভাটা পড়েনা- আমাদের পাঁচঘরাতেও না।
ক্লাবে পাড়ায়, বনেদি রাজবাড়ীর প্রাচীন পুজো কারুর কমবেশি নিজবাড়িতেও মহাসমারোহে চলে দুর্গামায়ের আরাধনা। পাড়ার সম্মিলিত লোকজন পুজোর নানান দ্বায়িত্ব বুঝে নিয়ে চলে যায় পাশের কুমোরপাড়ায় ঠাকুরের বায়না দিতে। এরপর দলেদলে এপাড়া ওপাড়ায় বাড়িতে বাড়িতে যায় দশ-কুড়িটাকা, একান্ন কিংবা ১০১/- টাকার সামর্থ্যমতো চাঁদা ফেলতে। সাথে চলে প্যান্ডেল আলো আর ভিনগাঁয়ের ঢাকির খোঁজ। আর আছে মহালয়ার ভোরের সেই আনন্দমুখর আমেজ- নাহ্ , এ সনাতনী মেজাজে কোনো কমতি আসেনি। ভোর ভোর বাড়ির গিন্নী ঘরদোর পরিস্কার করে গঙ্গাজল ছিটিয়ে শুদ্ধ বস্ত্রে গৃহদেবতাকে পুজো দেখিয়ে রেডিওতে প্রতি বাড়িতে একসাথে প্রতিধ্বনিত হয়ে ওঠে মহিষাসুরমর্দিনীর স্তবগাথা। বছরের এই একটা এমন ভোর- সমস্ত আস্তিক নাস্তিক ধর্ম বিতর্ক ভুলে প্রতি বাড়ির রেডিওতে একইসময়ে একই আগমনীর স্তবগাথা এক পবিত্র অনুভূতি সকলের মনে প্রাণে ততোধিক শ্রদ্ধা জাগিয়ে তোলে। এরপর শুরু হয় পাশের কাকুর ছোট্ট কাঠের তৈরি দোকানে গিয়ে খোকাখুকুর পুজোর ক্যাপবাজি-বন্দুক, রঙিন কুমকুম, সিল্কের লালরঙা ফিতে, নতুন জামা জুতো কেনার হুল্লোড়। সাথে চলে মা ঠাকুমা কাকিমার একে অপরকে নতুন শাড়ি, আলতা সিঁদুর দেওয়া নেওয়ার অমলিন আনন্দ।
পাঁচঘরা গ্রামের আদি পুজো হলো পাঁচঘরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিগত নব্বই বছরের দুর্গোৎসব। আমরা যেটা “পাঠশালার পুজো” বলে একবাক্যে চিনি। সাধারণত আমরা দেখি বিদ্যালয়ে সরস্বতী দেবীর আরাধনাই হয়ে থাকে, কিন্তু পাঁচঘরার আদি দূর্গাপুজো হলো বিগত নব্বই বছরধরে ছোট একটি চালাঘরে পুরো গ্রামের সমবেত উপস্থিতিতে উদযাপিত উৎসব 🙏 সেই খড়ের ছাউনি দেওয়া টিনেরপাতের দেওয়াল তোলা স্বল্প পরিসরের প্রাথমিক বিদ্যালয় আজ পাকা বাড়ি হলেও পুজোর দিনগুলি তেমনি রয়েছে। টোলে শিক্ষা নেওয়া পুরুত মশাই এর পুজোপাঠ, বোধন-অধিবাস-বিসর্জনের নানান মন্ত্রে সাক্ষী থাকে জাগপ্রদীপ থেকে জগন্মাতা। দশমীর সিঁদুরখেলা ও বাড়ির তৈরি কাঠের ছাপায় নারকেল নাড়ুর মিষ্টিমুখ- চোখের পাতাটা বড্ড ভারি করে দেয়, ঊমামাকে যে যেতে দিতেই হবে এবার 😢 । এই দশমীর বিষাদভরা দিনেও সকলে সুখ খুঁজে নেন একে অপরকে কোলাকুলি করে, প্রণাম করে এবং মিষ্টিমুখ করিয়ে।
এই মিষ্টি তবে দোকানের নাহে, বাড়ি বাড়ি নিয়ম করে দিনকয়েক আগের করে রাখা গুড়ের-চিনির নাড়কেল নাড়ু আর মাখা সন্দেশ, কাঠমিস্ত্রিকে দিয়ে তৈরী করানো কাঠের নকশাদার শাঁখ বা গোলগোল চাকার ছোট আকারের ছাপা মায় একই নকশার পাথরের ছাপায় সেই সন্দেশ,নারকেলনাড়ু চেপে বসিয়ে সেই আকারের হাতেগড়া ছাপামিষ্টি । সাথে মা’য়ের বিদায়ী বরণে কলাপাতা বা বেলপাতায় আলতা, সিঁদুরগোলা দিয়ে পাটকাঠি বা গাছের সরু ডাঁটার সাহায্যে লেখা খোলাচিঠি “শ্রী শ্রী দূর্গা সহায়”- পুকুরে ভাসিয়ে মনে মনে বলে দেওয়া- আসছে বছর আবার এসো মা গো। ঠাকুরের এই পঞ্জিকামতে দোলায় গমন হোক মায় গজে গমন এতদিনের পুজো আসছে আসছে রেশে আট থেকে আশির অনাবিল আনন্দ যেন একনিমেষে মানুষের-মন্ডপের-প্রকৃতির রঙীন শারদসাজ উধাও করে দেয়। আবার ফেরো কাজের মাঝে। আবারও অপেক্ষা “বচ্ছরকার” পুজোর।
কিন্তু না, থেমে তো থাকেই না পালাপাব্বণ- এবার যে “হ্যাংলা লক্ষ্মী আসবে একলা” 😊 তাই কোজাগরী পূর্ণিমার চাঁদকে সাক্ষী রেখে বাড়ি বাড়ি সাধ্যমতো চলে শ্রী ও সমৃদ্ধির দেবী মা লক্ষ্মীর আরাধনা । প্রতি বাড়ি-মন্ডপ আবারও সেজে ওঠে চালগুঁড়োগোলা আল্পনা আর মালক্ষ্মীর শ্রীচরণ আঁকা চৌকাঠ মঙ্গল চিহ্নরুপে। শুধুই যে এখানে বিগ্রহের পুজো হয় তা নয়, কেউ করেন ঠাকুরের ঘটে আবার কেউ কেউ দেবীর ছবি আঁকা পটে। লোকবিশ্বাস তো তাই বলে -“ঠাকুরের বাস ঘটে আর পটে”! ভরাজ্যোৎস্নায় মহীতল যেন রুপোলি আলোয় মোড়া থাকে কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমার রাত। পাড়ায় পাড়ায় ঠাকুর পুজো তো আছেই তবে লক্ষ্মীপুজো সর্বাধিক বাড়িতে বা বলা যায় প্রতি বাড়িতেই পূজিতা হন। বাড়িভেদে নিয়মরীতি অনেকটা আলাদাও হয়। কেউ বায়না দিয়ে মৃন্ময়ী বিগ্রহ ঘরে তোলেন তো কেউ লক্ষ্মীর ঘটে আবার সুনিপুণ পটুয়াশিল্পীর আঁকা পটেও পুজো করেন, চাল-ডাল-ফলমূলসমেত সাধ্য অনুযায়ী ষোড়শোপচারেও নৈবেদ্য সাজান। বাঙালি নিয়মে পুজো মাত্রই তো আমরা বুঝি জন্মসূত্রে ব্রাক্ষ্মণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু লক্ষ্মীপুজো অধিকাংশ ক্ষেত্রে গৃহস্বামী বা গৃহকর্ত্রী মায় বাড়ির যেকেউ নিষ্ঠা সহকারে উপবাস করে লক্ষ্মী আরাধনা করেন। যেহেতু সমৃদ্ধির দেবীর পুজো তাই উপাসনা শেষে নারকেলের জলপান করে উপাসক সেরাত্রি পূর্ণিমার চাঁদকে সাক্ষী রেখে মাটির প্রদীপ বাড়ির সমস্ত জায়গায় প্রজ্জ্বলন করে জেগে থাকেন যাতে লোকবিশ্বাস মতে প্রদীপের আলোয় ভরা জ্যোৎস্নায় দেবী ধরাধামে তাদের বাড়ি বাড়ি উপস্থিত হয়ে বরপ্রদান করেন গৃহের সুখ সমৃদ্ধি যাতে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়।
পুজোর নৈবেদ্য হিসেবে কিছু বাড়িতে খিচুড়ি ভোগের আয়োজন করেন আবার কেউ পায়েস ভোগেও অর্ঘ্য দেন তো কেউ কেউ গাওয়া ঘিয়ে ভাজা লুচি আর আলুভাজা সমেত পূজার্চনা করেন। তবে সমস্ত পুজোমন্ডপ, বাড়ির পুজোয় স্নান সেরে শুদ্ধবস্ত্রে তৈরী করা বিশেষত গুড়ের নারকেল নাড়ু অবশ্যই থাকে। কিছু বাড়িতে সেই সমেত তিলের নাড়ুও হয়ে ওঠে পূজার্ঘ্য। এরসাথে থাকে সিন্নিভোগ, সে এক অমৃতসমান স্বাদ- পরিমাণমতো আটা বা ময়দায় কাঁচাদুধ-গুড়-কলা চটকে খুব ভালো করে মিশিয়ে দেওয়া হয়, সাথে কিছু কুচোনো ফল, বাতাসা, নারকেলনাড়ু, অল্প আতপচাল ভেজানো, পঞ্চগব্যের পাক- কাজু,কিশমিশ, বাদাম – ব্যস অমৃত তৈরী। এই সিন্নি, খিচুড়ি ভোগ, পায়েস, লুচি আর নাড়ুর অমলিন স্বাদের লোভে ছোট শিশু থেকে বড়জনও মেতে ওঠেন পুজোর প্রসাদ পেতে। আর সাথে থাকে সবপুজোর অপরিহার্য অর্ঘ্য- কাঁচাদুধ- গঙ্গাজল-গোচনা-ঘি-মধুসমেত পঞ্চগব্যের তরল চরণামৃত। চঞ্চলা লক্ষ্মীদেবীর কিন্তু অহংকারের সাথে সাথে অতিমাত্রায় শব্দও অপছন্দের। তাই পঞ্চপ্রদীপের আলোয়, জলপদ্মের শোভায়, সাদা-হলুদ রামকড়ির সমাহারে, সাধ্যমতো নৈবেদ্য, শুধুমাত্র মঙ্গলশঙ্খ আর উলুধ্বনির মূর্চ্ছনায় দূর্বাহাতে সুরে সুরে পড়া লক্ষ্মীর পাঁচালী আর সত্যনারায়ণের ব্রতকথা এবং উপাসকের ভক্তিভাব ও গোবরজলে নিকানো মাটির সাজানো বাড়িতেই দেবীর বাস। উৎসবে-ভক্তিতে মুখর হয়ে ওঠে ভূ-তলের আবেগী মানুষ। সুতোকাটা হলেই যে ভূমন্ডলের আসলেই “অর্থমন্ত্রী” ধনলক্ষ্মী বাহনসমেত পাড়ি দেবেন স্বর্গরাজ্যে।
(ক্রমশ)
রবীন্দ্রসংগীত ও কত্থক নৃত্যশিল্পী, কথাসাহিত্যে স্নাতকোত্তর ও আকাশবাণীর ঘোষিকা। .দেশজ জীবনশৈলীর একনিষ্ঠ ধারক।
Comment here