বসুধাসাদাকালো রঙমাখা

হাতির দাঁতের অনন্য পুরাকীর্তি, ডানাওয়ালা স্ফিংস আধুনিক মুদ্রায়

– শ্রী সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়

 

উচ্চতা ১৫ সেন্টিমিটার। হাতির দাঁতে তৈরি এক ব্যক্তির মুখ। তিনি একাধারে প্রশাসক, আইননজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদ। তাও আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগের কথা। সিরিয়ার দামাস্কাসের জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত মূর্তিটি জায়গা করে নিয়েছে তাদের আধুনিক ব্যাঙ্কনোটে। প্রিন্স অর প্রিন্সেস অফ ওগারিট/ উগারিট নামে পরিচিত মূর্তিটি ১৩০০ খ্রিস্টপূর্ব সময়ের। ১৯৭৬ থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে ছাপা ৫০০ পাউন্ড নোটটিই আজকের প্রতিবেদনের ভিত্তি। অনেকের কাছে এই মূর্তিটিকে লেডি অফ উগারিট নামেও পরিচিত। অর্থাৎ এখনও এই ব্যক্তির সঠিক পরিচয় উদ্ধার করতে পারেননি পুরাতত্ত্ববিদরা। কোনও আইকনোগ্রাফি এখনও পর্যন্ত এব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারেনি।

মূর্তিটি থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট। গত দশ হাজার বছরে শতাধিক যেসব সভ্যতার সাক্ষী থেকেছে আধুনিক সিরিয়া, সেই বিস্তৃত সময়কালের মধ্যে এই মূর্তিটি অবশ্যই অনন্য। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে হাতির দাঁতের এত সুন্দর কাজ সেই সময়ের শিল্পসত্তার পরিচয় বহন করে। সিরিয়ার একসময় যে নারীদের যথেষ্ট সম্মান ছিল এবং সামাজিকভাবে তাঁরা পুরুষদের চেয়ে পিছিয়ে ছিলেন না, তার আরও একটি প্রমাণ পরের প্রতিবেদনেও পাবেন।

নোটের একেবারে নিচে, মাঝামাঝি অংশে এক দেবীর ছবি রয়েছে যাঁর শিং ও ডানা আছে। ইনি দেবী ইস্তার। রজনীর রানি বলেও পরিচিতা। আটকোণা তারা দিয়েও তাঁকে চিহ্নিত করা হয়। তিনি একাধারে সব ধরনের ভালবাসা ও তৃপ্তি, উর্বরতা, দ্বন্দ্ব, যুদ্ধ, বিচার ও ক্ষমতার দেবী। মোটামুটিভাবে সুমেরের উরুক যুগে অর্থাৎ ৪০০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ৩১০০ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত তিনি পূজিতা হয়েছেন। আরাত্তা সভ্যতায় ইনি আনাহিতা এবং সুমেরীয় ও ব্যাবিলনীয়দের কাছে ইনিই ইনান্না নামে পরিচিতা ছিলেন। তাঁর যুদ্ধরাত মূর্তি যেমন পাওয়া যায় তেমনই পুরোহিত থেকে মনুষ্য-ইতর বহু প্রাণীর সঙ্গে তাঁর নানাভাবে লিপ্ত মূর্তিও পাওয়া গেছে। তিনি সৌন্দর্য ও স্বর্গেরও দেবী রূপে পূজিতা হয়েছেন। একসময় তাঁর বহু মন্দিরও ছিল। সৌন্দর্যের প্রতিপূর্তি হিসেবে তাঁর বহু মূর্তি পাওয়া গেছে।

আমাদের গণেশ, সংকটমোচন, বরাহ, নৃসিংহের মতো নররূপ ও অন্য প্রাণীর মাথাওয়ালা দেবতা আছেন, মিশরে পশুপাখির মাথা ও মানুষের শরীর বিশিষ্ট দেবতা রয়েছেন। প্রাচীন মেসোপোটেমিয়াও এর ব্যতিক্রম নয়।

এই দেবী এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে সমসাময়িক ফুলদানিতে পর্যন্ত তাঁর অবয়ব দেখা যায়। অনেকটা আমাদের দেশে বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন মাধ্যমে এখনও যেভাবে গণপতির দেখা মেলে, দেবত্বের পাশাপাশি তিনি যেমন সজ্জার সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে, দেবী ইস্তারও সেই যুগে তেমনই ছিলেন।

মুদ্রাটির পিছনের দিকে, একেবারে নিচে বাঁদিকের কোণে রয়েছে প্রাচীন মৃৎপাত্র। সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতা থেকে প্রাপ্ত মৃৎপাত্রের মতো এটিও চিত্রিত। রয়েছে একটি চক্রের ছবি ও উগারিট বর্ণমালা লেখা একটি মাটির ট্যাবলেট। আরেকটি পাত্রের ছবি রয়েছে যেখানে চক্রাকারে সাজানো রয়েছে নানা কাল্পনিক ছবি। সেগুলি ডানা-বিশিষ্ট নানা প্রাণীর ছবি যাদের মুখ মানুষের। এগুলো রাশিচক্রের মতো করে সাজানো। প্রাচীন সিরিয়ার (আদতে মেসোপোটেমিয়া) দেবদেবীও এমনই ছিলেন। ষাঁড়ের দাঁড়ানো শরীর, বিশাল ডানা, শ্মশ্রুগুম্ফবিশিষ্ট মূর্তিটি শেডুর। শেডু নামের চেয়ে অবশ্য লামাসু নামেই তিনি বেশি পরিচিত। ডানা দেখা যায় একই রকম বসা মূর্তি, শরীর সিংহের হলে সেই দেবতার নাম সোলারিসেস। শেড নামে যে দেবী রয়েছেন (শেডুর স্ত্রীলিঙ্গ) তাঁর সব মূর্তিতে অবশ্য ডানা দেখা যায় না। মানে এককথায় মিশরের স্ফিংসের আদল, তাতে বাড়তি রয়েছে ডানা।

প্রাচীন সিরিয়ার আরও নানা পুরাকীর্তি ধরা রয়েছে তাদের মুদ্রায়। আধুনিক নোটে ছাপা হয়েছে রানির ছবিও। সিরিয়ায় রানি? ঠিকই পড়ছেন। এই রানির কথা আগামী পর্বে।

 

(লেখক পরিচিতি – প্রাক্তন সাংবাদিক, বর্তমানে ভাষাতত্ত্ববিদ; ইতিহাস চর্চা ও মুদ্রা সংগ্রহ তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান অঙ্গ)

Comment here