“Civilizations die from suicide, not by murder.” ― Arnold Toynbee
কথাটি প্রণিধানযোগ্য, বিশেষভাবে হিন্দুদের ক্ষেত্রে যাঁদের জীবনের অন্তত ৮০ শতাংশই তাৎক্ষণিক। নির্দিষ্ট লক্ষ্যের অভাবে কি প্রকারে সমগ্র জীবন ভেসে বেড়ানো যায়, অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিবাদ গড়ে তোলার পরিবর্তে কি প্রকারে নিকৃষ্ট অজুহাত প্রদর্শন করা যায় ও অন্যের উপর দায় চাপিয়ে দায় এড়ানো যায় তা যদি শিখতে হয় তো অবশ্যই আপনাকে ভারতবর্ষ ও বহির্ভারতে হিন্দুদের কাছেই শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে। এই ক্ষেত্রে তাঁরা অদ্বিতীয়; শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সামগ্রিক নিশ্চেষ্টতার বাতাবরণে তাঁদের নেতিবাচক গঠনের ভয়াবহ প্রভাব এ প্রজন্মের উপরেও যে পড়েছে ও সেই ছায়া যে ক্রমশই দীর্ঘ হচ্ছে তা বলা যায় নির্দ্বিধায়। অশ্বমেধ যজ্ঞদ্বারা শাসিত প্রাচীন ভারতবর্ষ তথা সনাতন সংস্কৃতির বর্তমান উত্তরাধিকারীরা যে Lebensraum অর্থাৎ living space সম্পর্কিত বক্তব্যে যে আঁতকে উঠবেন তাতে তিলমাত্র সন্দেহ থাকে না, অতিরিক্ত রক্ষণাত্মক সমাজে ফাটল ধরে প্রথমে মৃদু গতিতে, পরবর্তীকালে তা দ্রুত হয় বিস্ময়কর গতিতে। কিন্তু গার্হস্থ্য জীবনে আক্রমণ থাকবে না, অরণ্যের মোক্ষের মধ্যে তা সর্বক্ষেত্রেই শুধু ঐশ্বরিক জ্ঞানলাভে আচ্ছন্ন থাকবে – এই কপটতা বা utter hypocrisy পতনের কোন স্তরে নিয়ে যায় বোধকে তা আজ এক ব্যক্তি হিন্দু ও বৃহত্তর হিন্দু সমাজকে দেখলে বোঝা যায় সহজেই। সম্ভবত তাই ঋষি অরবিন্দকে অনুধাবন করতে ব্যর্থ প্রতিপন্ন হয়েছে বাঙ্গালী হিন্দু জাতি।
……. ১৮ই এপ্রিল, ১৯২৩ – তাদের হিন্দু–মুসলিম ঐক্যকে ছেলেখেলায় পরিণত করার জন্য আমি দুঃখিত। এই বিষয়টিকে একেবারেই উপেক্ষা করা যায় না। কোনোদিন হয়তো হিন্দুদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই–এ নামতে হবে এবং এর জন্য তাদের তৈরী থাকতে হবে। হিন্দু মুসলিম ঐক্যের অর্থ হিন্দুদের পরাধীনতা নয়। হিন্দুদের কমনীয়তা বারবার তাদের সেই পথ করে দিয়েছে। এর সবচেয়ে ভাল সমাধান হচ্ছে, হিন্দুদের নিজেদের ভালোভাবে প্রস্তুত হওয়ার অনুমতি দেওয়া এবং তারপর হিন্দু–মুসলিম ঐক্য ঠিক নিজেই নিজের ব্যবস্থা করে নেবে। ইহা স্বয়ং সমস্যার সমাধান করে নেবে। অন্যথায়, আমরা একটি জটিল সমস্যার সমাধান করে ফেলেছি ভেবে মিথ্যা সান্ত্বনা নিয়ে থাকব – যেখানে আদতে আমরা সমস্যাটিকে স্রেফ এড়িয়ে গেছি।………ঋষি অরবিন্দ দ্বারা ব্যক্ত এই জ্বলন্ত সত্য ও তার সার্থক প্রকাশ যে বাঙ্গালীকে দীক্ষিত করতে পারেনি ক্ষাত্রবীর্যে তা বোঝা যায় অক্লেশে ২০২১ সালে। অতএব?
মহামতি কৌটিল্যের মতানুযায়ী একটি রাষ্ট্র ততক্ষণ পর্যন্ত পরাস্ত হয় না যতক্ষণ তার মন পরাজিত না হয় এবং মন ততক্ষণ পরাজিত হয় না যতক্ষণ তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবোধ ও জাতীয়তাবাদ অক্ষুণ্ণ থাকে। তাই সাবলীল রাখতে হয় চর্চা ও শিক্ষাদান, সাধারণ কথায় indoctrination..একই বিতর্কিত বিষয়কে কেন্দ্র করে চর্চা এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় সামগ্রিক উৎকর্ষের লক্ষ্যে। বহু বিষয়ে মনোযোগী, বিশেষত উদ্দেশ্যহীন দিনাতিপাতে সদা ব্যস্ত হিন্দুদের কি আদৌ মনে আছে গত বছর এই একই পবিত্র শিবরাত্রির সময়ে সিক্স প্যাক ও বাঙ্গালীর ভুঁড়িওয়ালা শিবের মধ্যে একটি আগুনে গনগনে বিতর্কে মুখরিত হয়েছিল জগৎ? ফিরে দেখি বিষয়টিকে এই শিবরাত্রির আলোকে।
মূল বিতর্ক এটি নিয়েই এবং তাকে কেন্দ্র করে একটি প্রসঙ্গের অবতারণা হয়েছে – শিব অর্থাৎ মহেশ্বর অথবা মহাদেব অথবা পিনাকপাণি অথবা ঝড়েশ্বর অথবা বিশ্বরূপায় অথবা বামদেব অথবা নীললোহিত অথবা শশীশেখর অথবা শংকর অথবা শূলপাণিকে নিয়ে – প্রশ্ন উঠছে সেই বামমহল থেকেই যে ক্রমশ বঙ্গে নাকি শিবের আকার পরিবর্তিত হচ্ছে – বাঙ্গালীর নিজস্ব চিরকালীন স্থূল/ভুঁড়িওয়ালা শিবের স্থানে six-pack শিব আসছে এবং তা উত্তর ভারতের সংস্কৃতির প্রভাবে। এবং এটিকে বহিরাগত মস্তানিও বলা হচ্ছে। অর্থাৎ নিজস্ব রাজনৈতিক বিশ্বাস অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বামপন্থীরা ভারতবর্ষের এক রাজ্যে অন্য রাজ্যের (একই ধর্মের অন্তর্গত) সাংস্কৃতিক প্রভাবকে বহিরাগত রূপে চিন্তা করছে। আবার কোন বামপন্থী মুক্তমনা তাতে হিন্দুধর্মের বিপন্নতা বোধ করছেন। কারণ!? ভুঁড়িওয়ালা শিব না থাকলে হিন্দু ধর্মের ঔদার্য থাকে না সম্ভবত।
কিন্তু প্রশ্ন ওঠে – বঙ্গের শিবের এই হাল কেন। দক্ষিণ ও উত্তর ভারতের মতো একই শিবমহিম্ন স্তোত্রম্, আদি শঙ্করাচার্যের “নয়নত্রয় ভূষিত চারুমুখং মুখপদ্মবিরাজিত কোটিবিধুম্ বিধুখন্ডবিমন্ডিতভালতটং প্রণমামি শিবং শিবকল্পতরুম্” পাঠ করা বাঙ্গালী কি যুগের পর যুগ ধরে পথভ্রষ্ট? নাকি মাতৃশক্তির উপাসক শক্তিচর্চার বঙ্গভূমিতে শিব গুরুত্ব পাননি কালী, তারা, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ষোড়শী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, মাতঙ্গী, কমলার দাপটে। নাকি জ্যোতির্লিঙ্গের ভূমি থেকে দূরে অবস্থানের জন্য শিবের প্রয়োজনীয়তা ততটা অনুভব করেনি বাঙ্গালী!? তাহলে বাঁকুড়া-বীরভূম জুড়ে শিবের উপাসনার এতো ঘনঘটা!! বর্ধমানের কালনা শহরের নব কৈলাশ মন্দির বা একত্রে ১০৮ শিব মন্দিরের প্রয়োজনীয়তাই বা কেন!? মুর্শিদাবাদের ভৈরব পুজোর উন্মাদনা!?
এই ক্ষেত্রে মূল বিষয় হল বঙ্গে হিন্দু ধর্মের চর্চা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলেছে অপরিমেয় অত্যাচারের মধ্য দিয়ে। মন্দির ধ্বংস, প্রাচীন মন্দিরের অভাব প্রতি মুহুর্তে বুঝিয়ে দেয় অবস্থা কি ছিল। প্রাতিষ্ঠানিক রীতিনীতির উপর ঐসলামিক রাজশক্তির আক্রমণ হলেও মানুষের প্রাণের আকুতি তাতে থেমে থাকেনি। তাহলে এই ভুঁড়িওয়ালা শিবের উত্থান হয় কি করে!?
ভুঁড়িওয়ালা শিব বঙ্গের সহজাত চিন্তনের প্রতিফলন অর্থাৎ যখন বৈদিক সংস্কৃতির ওপর ঈমানী আক্রমণ চলছে তা থেকে বাঁচার এক পথ। মন্দির ধ্বংস, তাই শিব ঘোরে মাঠে, গ্রামে – লোকে গড় করে শান্তি পায়, ক্রমে তার অবয়ব ভুঁড়িওয়ালা শিব স্থান পায় পটচিত্রে। কিন্তু এটি প্রত্যেক অর্থেই একটি escapism/পলায়নবাদ যার সাথে বাঙ্গালী হিন্দুকে compromise/আপোষ করতে হয়েছে ঘোর অনিচ্ছায়। এবং এতে আশ্চর্যের বিশেষ কিছুই নেই। পরাজিত জাতির দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় মিশে থাকে গ্লানি যা ক্রমশ পরিণত হয় এক ঐতিহ্যে এবং যা ছিন্ন করা কয়েক শতাব্দীর পর হয় দুঃসাধ্য। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতা অনুকূলে হলে তা সম্ভবপর হয়, ধর্মদ্রোহী কিন্তু দেশাচারে স্বীকৃত হিন্দু নারীর সতীদাহ, বিধবার ক্লেশও এইপ্রকারেই শেষ করা হয়েছিল। শিব প্রতিষ্ঠিত হোন বঙ্গে স্বমহিমায়। পঞ্চম বেদ ধনুর্বেদের মূল তিনি, সনাতন হিন্দু ধর্মের শস্ত্রচর্চার আধার তিনি, তাঁর আশীর্বাদ লাভ করেই তৃতীয় পান্ডব অর্জুন কুরুক্ষেত্রের পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য প্রত্যয়ী হয়েছিলেন।
প্রসঙ্গত, আজ থেকে ২৫০ বছর আগে পবিত্র বৈদ্যনাথ ধামের মৃত্তিকা সহযোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একটি গ্রাম – বৈদ্যনাথতলা। ১৯৭১-এ সেই স্থানের নাম পরিবর্তন করে নাম রাখা হয়েছিল মুজিবনগর। না – হিন্দুদের অনুমতি নেওয়ার কোন প্রয়োজন বোধ হয়নি কারও, এবং কারণটিও অতীব সহজ – thanks to their inherent honesty and indistinctness Hindus are always taken for granted……. সেই একই স্থানে একটি প্রায় ২৫০ বছরের পরিত্যক্ত, জরাজীর্ণ শিব মন্দির রয়েছে। কোন মুক্তমনা বামপন্থী ধর্মনিরপেক্ষ প্রয়োজন বোধ করেননি ওটি পুনঃস্থাপনের জন্য, কারণ হিন্দুরা পা ও পথের – দু ক্ষেত্রেই শুধু ধুলো।
পরিশেষে, সময় যখন অনুকূল হয়, রাষ্ট্রক্ষমতা যখন নিজ স্বার্থরক্ষার পক্ষে সক্ষম হয় তখন hereditary demerits কে শেষ করাই শ্রেয়। ভুঁড়িওয়ালা শিব থাক পটচিত্রে, মন্দিরে ও অন্তরে স্থান পাক – শিবের ভয়ংকর মূর্তি। সনাতন হিন্দু ধর্মের শস্ত্রগুরু হলেন পিনাকপাণি and so a warrior can’t be obese.
শিব অথবা ত্র্যম্বক অথবা ঈশান অথবা চন্দ্রশেখর অথবা নীলকন্ঠ অথবা পার্বতীহৃদয়বল্লভ অথবা প্রমথেশ অথবা মৃত্যুঞ্জয়ের মধ্যে নিহিত আছে এক অব্যক্ত শব্দ বা ব্রহ্ম – প্রচন্ডতা। কিন্তু প্রচন্ডরূপী শিবের উপাসনা করতে হবে প্রচন্ডতার সাথে, শস্ত্রধারী তিনি – তাঁর পূজাও হবে শস্ত্র সহকারে। বামপন্থীরা বিপন্ন বোধ করছেন বাঙ্গালী হিন্দুদের ক্রমশ পরিবর্তনশীল চিন্তায়।
‘ওঁম ত্রম্ব্যকম যজামহে সুগন্ধিংপুষ্টি বর্ধনাম
ঊর্বারু কমিব বন্ধনাৎ মৃত্যুমক্ষীয় মামৃতাৎ’।।
শ্রী অনিমিত্র চক্রবর্তী হলেন একজন সাংবাদিক ও বিভাগীয় লেখক (columnist) এবং বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের এক সক্রিয় কর্মী।
খুব সুন্দর বক্তব্য তুলে ধরেছেন অনিমিত্রদা !
শিবদর্শন কত জন্মের পর সম্ভব এটা তো স্বয়ং মহেশ্বর ছাড়া কেউ বলতে পারবে না আর শিবদর্শনের আগে শিবরূপ বিবরণ কল্পনামাত্র ! কিন্তু বিবরণের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায় যে বিবরণ দিচ্ছে তার শিবের প্রতি ভক্তি আদৌ আছে কি না সেটা জানা যায় , তার উদ্দেশ্য জানা যায় !
ভারতে অধিকাংশ মানুষ হিন্দু হওয়ার পরও হিন্দু ধর্ম নিয়ে যতটা খিল্লি করা হয় ততটা আর কোনো দেশে কেনো হয় না ? কার ইচ্ছানুসারে এইসব হয় এটা খুব বড় গবেষণার ব্যাপার কিন্তু সেই গবেষণা করবে কে , সেই গবেষণা করতে গেলে তার হুক্কাপানি বন্ধ হয়ে যাবে …তাই সেই পথে ভয়তে কেউ এগোয় না !
একই অদ্ভুত রহস্যময় ব্যবস্থার মাধ্যমে হিন্দু বাঙালি বহুদিন ধরে হয়ে আছে সফট টার্গেট , এখন হিন্দু বাঙালি লুপ্তপ্রায় জাতিতে পরিণত , অধিকাংশকে অন্য ধর্মে নিয়ে যাওয়া হয়েছে , বাকিদের অবস্থা মৃতপ্রায়-জাতিগতভাবে !
হিন্দু বাঙালীদর এতটাই বিভ্রান্ত করা হয়েছে যে আজ তারা ভাবে পুজো মানে মস্তি , আরো হাজার ব্যাপার আছে যেগুলো অন্য কোথাও দেখা যায় না !
হিন্দু বাঙালিরা প্রায় সবাই তাদের অজান্তে জাতিগতভাবে প্রায় শেষ হয়ে এসেছে সেটা উপলব্ধি করার ক্ষমতাও তারা হারিয়ে ফেলেছে !
মহাদেবই জানেন ভবিষ্যতের ব্যাপারে !
হর হর মহাদেব !
অসাধারণ! রাষ্ট্রক্ষমতা হতে বহু দূরে থাকতে বাধ্য হওয়াতেই বাঙ্গালীর চর্চায় সহজিয়া বাড়বাড়ন্ত এবং চারিত্রিক অধঃপতন। তাই, সকল চিন্তাই হোক রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রশক্তি কেন্দ্রিক।