– শ্রী শ্রীজিৎ দত্ত
কীভাবে বঙ্কিমের রচনা বঙ্গদেশ তথা ভারতবর্ষের ইতিহাস ও সমাজের সেবায় নিয়োজিত হয়েছিল সে আলোচনা আমরা আগের পর্বে করেছি। এ-প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয়বস্তুর নিরিখে বঙ্কিমের তিনটি সাহিত্য কীর্তির উপরআমাদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত – ধর্মতত্ত্ব, কৃষ্ণচরিত্র, এবংআনন্দমঠ।এখানে এই তিনটি বঙ্কিমী গ্রন্থের ইতিহাসের কিঞ্চিৎ পরিচয় দেয়া যাক।
বঙ্কিমের ‘আনন্দমঠ’, যাকে ইতিপূর্বে আমরা অনুশীলন তত্ত্বের এক প্রায়-মহাকাব্যিক প্রয়োগ ব’লে বর্ণনা করেছি, সেই ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস প্রকাশ লাভ করে ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে। ‘প্রায়’ কথাটি ব্যবহার করছি কারণ উপন্যাসটির মধ্যে মহাকাব্যের সমস্ত মালমশলা উপস্থিত থাকলেও আদর্শ মহাকাব্যের মতো বিস্তার লাভ ঘটেনি। কিন্তু তাতে খুব একটা কিছু ক্ষতি হয়নি, বরং ভারতীয় সাহিত্য তথা শিল্পকলার ক্ষেত্রে কিংবা বৃহত্তর সমাজ ও ভারতীয় জনমানসের কল্পনায় এই উপন্যাস যে ধরণের গভীর ছাপ ফেলতে পেরেছে, তেমন উদাহরণ শুধু সাহিত্যে কেন, যে কোনো ধরণের সৃষ্টিমূলক কাজের ক্ষেত্রে বিরল।
বঙ্কিম রচনাবলী প্রথম খণ্ডের সাহিত্য সংসদ সংস্করণের ভূমিকায় শ্রী যোগেশচন্দ্র বাগল মন্তব্য করেছেনঃ “বাঙালির জাতীয় জীবন সংগঠনে ‘আনন্দমঠের’ স্থান কত উচ্চ ও গভীর তাহা নির্ণয়ের সময় হয়তো এখনও আসে নাই। এক সময়ে স্বদেশকর্মীদের [অর্থাৎ স্বদেশী আন্দোলনে যোগদানকারী তথা অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের] এক হাতে ছিল গীতা, ও অন্য হাতে ছিল ‘আনন্দমঠ’। যদিও গ্রন্থ শেষে ‘বিসর্জন’ আসিয়া ‘প্রতিষ্ঠা’কে লইয়া যায় তথাপি আনন্দমঠের ভিতরকার ভাব ব্যঞ্জনা তথা সন্ন্যাসী সন্তান-সম্প্রদায়ের নিষ্কাম স্বদেশপ্রেম বাঙালি যুবকদের প্রাণে স্বদেশভক্তির সঙ্গে সঙ্গেআশ্চর্য ত্যাগ ও সেবা-ধর্মের উদ্রেক করিয়াছিল। উপন্যাস হিসেবে ‘আনন্দমঠ’ কাহারও কাহারও নিকট উদ্দেশ্যমূলক বলিয়া নিকৃষ্ট বিবেচিত হইলেও, জাতীয় জীবনগঠনে ইহার কৃতিত্ব স্মরণ করিলে ইহাকে অতি উচ্চেই স্থান দিতে হয়। ‘আনন্দমঠ’ রচনার সার্থকতা এইখানেই। সুপ্রসিদ্ধ ‘বন্দেমাতরম্’ সংগীত আনন্দমঠেরই অন্তর্গত।”
এই বক্তব্যের ভিতর কয়েকটি কথা বিশেষ ক’রে লক্ষ্য করার মতো। প্রথমত বলতে হয় ‘বন্দেমাতরম্’ গানটির কথা। বঙ্কিম এই গানটিকে ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের অন্তর্ভুক্ত করলেও গানটি আসলে কিন্তু রচিত হয়েছিল উপন্যাস রচনার ৭ বছর পূর্বে, ১৮৭৫ সালে। বঙ্কিম সে সময় তাঁর নিজেরই চালু করা ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার সম্পাদক। এই গানের কিয়দংশ বর্তমানে আমাদের দেশের সংবিধান-স্বীকৃত জাতীয় স্তোত্র, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ন্যাশনাল সঙ’। কাজেই বন্দেমাতরম্-এর সম্পর্কে নতুন করে কিছু জানাবার নেই।
শুধু এই প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের নামের আগে ‘ঋষি’ উপাধিটি কেন শোভা পায়, সে সম্পর্কে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বক্তব্য এখানে তুলে ধরতে চাইঃ “বঙ্কিমবাবু যাহা কিছু করিয়াছেন…সব গিয়া একপথে দাঁড়াইয়াছে। সে পথ জন্মভূমির উপাসনা, জন্মভূমিকে মা বলা – জন্মভূমিকে ভালবাসা – জন্মভূমিকে ভক্তি করা। তিনি এই যে কার্য করিয়াছেন, ইহা ভারতবর্ষের আর কেহ করে নাই। সুতরাং তিনি আমাদের পূজ্য, তিনি আমাদের নমস্য, তিনি আমাদের আচার্য, তিনি আমাদের ঋষি, তিনি আমাদের মন্ত্রকৃৎ, তিনি আমাদের মন্ত্রদ্রষ্টা। সে মন্ত্র – বন্দেমাতরম্।”
এ গেল ‘আনন্দমঠ’-এর ঐতিহাসিক পরিচয়। এবারে আসি বঙ্কিমের ‘কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থটির প্রসঙ্গে। এই গ্রন্থটি সম্বন্ধে অনেকের অনেক ভুল ধারণা আছে। যেমন, অনেকে মনে করেন যে শ্রীকৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব প্রমাণ করবার জন্যই বঙ্কিমচন্দ্র এ গ্রন্থটি লিখেছিলেন। আবার অনেকে ভাবেন যে “সত্যিই কি শ্রীকৃষ্ণ নামের কোনো ঐতিহাসিক চরিত্র কখনো ভারতবর্ষে ছিলেন?” – এই প্রশ্নের মীমাংসা করতেই বঙ্কিম কৃষ্ণচরিত্রের অবতারণা করেন। বলা বাহুল্য, যাঁরা এইসব ধারণা মনে পোষণ করেন, তাঁরা কেউ বঙ্কিমের ‘কৃষ্ণচরিত্র’ বইটি পড়ে দেখেননি অথবা বইটি সম্পর্কে বঙ্কিম নিজে কী ব’লে গেছেন তার খোঁজ রাখেননি। অনুশীলন তত্ত্ব বোঝবার পক্ষে কেন বঙ্কিমের ‘কৃষ্ণচরিত্র’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সে প্রশ্নেরও উত্তর এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ‘কৃষ্ণচরিত্র’-এর প্রথম সংস্করণের প্রকাশ কালে বঙ্কিম তাঁর এই গ্রন্থের জন্য যে বিজ্ঞাপন লিখেছিলেন, তাতে তিনি বলছেনঃ ““অনুশীলন ধর্মে” যাহা তত্ত্ব মাত্র, কৃষ্ণ চরিত্রে তাহা দেহবিশিষ্ট। অনুশীলনে যে আদর্শে উপস্থিত হইতে হয়, কৃষ্ণচরিত্র কর্মক্ষেত্রস্থ সেই আদর্শ। আগে তত্ত্ব বুঝাইয়া, তার পর উদাহরণের দ্বারা তাহা স্পষ্টীকৃত করিতে হয়। কৃষ্ণচরিত্র সেই উদাহরণ…”
আবার কৃষ্ণচরিত্রেরই দ্বিতীয় সংস্করণের বিজ্ঞাপনে নিজের বক্তব্যের উপসংহার টানতে গিয়ে বঙ্কিম বলছেন: “পরিশেষে বক্তব্য কৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব প্রতিপন্ন করা এ গ্রন্থের উদ্দেশ্য নহে। তাঁহার মানব চরিত্র সমালোচন করাই আমার উদ্দেশ্য। আমি নিজে তাঁহার ঈশ্বরত্বে বিশ্বাস করি; – সে বিশ্বাসও আমি লুকাই নাই। কিন্তু পাঠককে সেই মতাবলম্বী করিবার জন্য কোন যত্ন পাই নাই।”
অর্থাৎ বঙ্কিমের নিজের জবানি থেকে এটা পরিষ্কার যে ঐতিহাসিকভাবে সত্যই হোক আর কাল্পনিকই হোক, মহাভারত, হরিবংশ, বিষ্ণুপুরাণ-শ্রীমদ্ভাগবতপুরাণ-ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ-গীতগোবিন্দ ইত্যাদি কৃষ্ণ বিষয়ক গ্রন্থের পরিপ্রেক্ষিতে একজন রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে শ্রীকৃষ্ণের যে চরিত্রটি সমগ্র প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে ফুটে ওঠে তার পর্যালোচনা ক’রে বঙ্কিম শুধু এটুকুই দেখাতে চেয়েছেন যে অনুশীলন তত্ত্বের নিরিখে বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণে রচরিত্র একটি আদর্শ মনুষ্য চরিত্র। সত্যি বলতে, তাঁর‘কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থে বঙ্কিম এমনটা দাবীও করেছেন যে, সমগ্র আর্যসাহিত্যের কোথাও খুঁজলেও এমন একটি চরিত্রও পাওয়া যাবে না, যিনি সনাতন ধর্মতত্ত্বে নিহিত অনুশীলন তত্ত্বের কষ্টিপাথরের বিচারে প্রতিপন্ন শ্রেষ্ঠ আদর্শ মানুষ শ্রীকৃষ্ণের সমকক্ষ হতে পেরেছেন।
বঙ্কিমের কৃতিত্ব এইখানেই, যে তিনি সনাতন হিন্দুধর্মের মূল প্রতিপাদ্যগুলিকে আমাদের এই নবযুগের উপযোগী ক’রে উদ্ধার করেই শুধু ক্ষান্ত হননি, বরং আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে দেখাতে পেরেছেন যে ভারতীয় চিন্তা ও কল্পনা অন্ততঃ একসময় এমন দার্শনিক উচ্চতায় পৌঁছেছিল যে, যদি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ঐতিহাসিকভাবে সত্যি নাও হয়ে থাকেন, তবু ভারতীয়রা শ্রীকৃষ্ণের মতো আদর্শ মানুষের চরিত্র কল্পনা করবার কৃতিত্বটি অর্জন করেছিল। আর যে সমাজ, যে ধর্মের পক্ষেএমন সর্বাঙ্গসুন্দ রচরিত্রের কল্পনা করা সম্ভব, তদুপরি যে সমাজ ও ধর্ম এই চরিত্রকে আপন আরাধ্য আদর্শের সর্বোচ্চ স্থান দিতে পারে, সেই সমাজে এই আদর্শের একেবারে সমান-সমান না হলেও তার উচ্চতার কাছাকাছি অন্তত পৌঁছতে পেরেছেন – এমনঐতিহাসিকভাবে সত্য মানবচরিত্রের উদ্ভব হওয়াটাই স্বাভাবিক – তেমনটা না হ’লেই বরং বিস্ময়ের ব্যাপার ঘটত। এবং তেমন প্রায়-আদর্শ চরিত্রের উদ্ভব যে এই বঙ্গীয় হিন্দু সমাজে হয়েছিল, তারও ইঙ্গিত বঙ্কিম রেখে গেছেন নিজের রচনায়, ‘আনন্দমঠ’-এ।
সেখানে সন্ন্যাসী সন্তান সম্প্রদায়ের নেতা সত্যানন্দের মুখ দিয়ে তিনি শ্রীচৈতন্যদেবের কথা উল্লেখ করিয়ে বলিয়েছেনঃ “চৈতন্যদেবের বৈষ্ণবধর্ম…অর্ধেক ধর্মমাত্র। চৈতন্যদেবের বিষ্ণু শুধু প্রেমময় – সন্তানের বিষ্ণু শুধু শক্তিময়। আমরা উভয়েই বৈষ্ণব – কিন্তু উভয়েই অর্ধেক বৈষ্ণব।” এই তাৎপর্যপূর্ণ উক্তিটিকে অনুশীলন তত্ত্বের নিরিখে বিচার করলে আমরা সে তত্ত্বকে আরও সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পারি।
অনুশীলন তত্ত্বের পরিভাষায় প্রেম অথবা ভক্তি হ’ল মানসিক বৃত্তি, সেটির অনুশীলনের অনুচিত অর্থাৎ বাড়াবাড়ি রকমের সম্প্রসারণের ফলে শক্তি নামক শারীরিক বৃত্তির সমুচিত স্ফূর্তিতে বিঘ্ন ঘটে; আবার এর উল্টোটাও সত্যি। সব ধরণের বৃত্তির সমুচিত অর্থাৎ একে অপরের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে যে সম্প্রসারণ বা স্ফূর্তিতাকেই অনুশীলনের চরম অবস্থা বলা হয়েছে।
আগেই বলেছি যে অনুশীলন তত্ত্ব হচ্ছে বঙ্কিমচন্দ্র কর্তৃক হিন্দুধর্ম তথা সনাতন বৈদিকধর্মের মূলসূত্রগুলির একটি নূতন যুগোপযোগী বিবৃতি।প্রধানতঃ‘ধর্মতত্ত্ব’, ‘কৃষ্ণচরিত্র’ এবং জনপ্রিয় উপন্যাস ‘আনন্দমঠ’-এর মাধ্যমে বঙ্কিম তাঁর সমকালীন বাঙালীর সামনে হিন্দুধর্মের সারমর্ম বা সারতত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন। নির্দিষ্ট হিন্দু দেবতা এবং মাতৃভূমির সাথে যুক্ত আবেগপ্রবণ এবং ভক্তিমূলক দিকগুলির সাথে আপস না করে যুক্তিযুক্ত, পদ্ধতিগত, এমনকি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে দর্শকরা। এই উপস্থাপনায় বঙ্কিম বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের মাধ্যমে হিন্দুধর্মের যা চিরকালীন সত্যতাকে বিবৃত ক’রে আধুনিক সমাজের বোধগম্য ভাষায় ও কায়দায় হিন্দুধর্মের মূল্য নির্ধারণ করেছেন।
হিন্দুধর্মের মূলসূত্রগুলিকে খুঁটিয়ে বিশ্লিষ্ট করবার পর একজন শিল্পীর সহজাত প্রবৃত্তির মাধ্যমে বঙ্কিম সেগুলিকে আমার সুন্দরভাবে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্তায় সংশ্লেষিতও করেছেন এবং হৃদয়গ্রাহী ভঙ্গিমায় ১৮৫৭-পরবর্তী ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা এবং বৃহত্তরভাবে ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক-বৌদ্ধিক-রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যে, বিশেষ প্রতিকূলতার সত্ত্বেও, সেই সত্তাকে সগর্বে তুলে ধরেছেন। এই সত্তাকে তিনি নাম দিয়েছেন অনুশীলন তত্ত্ব। এই কীর্তি তৎকালীন সমাজ-রাজনীতিতে একজন হিন্দু চিন্তাবিদ তথা সরকারী চাকুরের পক্ষে নিছক সহজ ছিল না।বঙ্কিমের মতো চিন্তাবীর ও সাহিত্যিক-শৈল্পিক-নান্দনিক প্রতিভার একত্রে সমাবেশ না হ’লে এমন কীর্তি স্থাপন করা অসম্ভব ছিল ব’লেই মনে করি।
অনুশীলন তত্ত্ব উপস্থাপিত করবার খাতিরে বঙ্কিম ‘ধর্মতত্ত্ব’তে বাদ-বিসম্বাদমূলক কথোপকথনের শৈলী গ্রহণ করেছেন; ‘কৃষ্ণচরিত্র’ তে বিশ্লেষণাত্মক প্রবন্ধের শৈলী, এবং ‘আনন্দমঠ’-এ গল্প বলবার অত্যন্ত কার্যকর ভঙ্গী অবলম্বন করেছেন তিনি। ‘ধর্মতত্ত্ব’তে একজন গুরু ও তাঁর শিষ্যের মধ্যে একটি দীর্ঘ কথোপকথনের মাধ্যমে বঙ্কিম হিন্দুধর্মের মৌলিক নীতিগুলিকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যাতে সহজেই সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদী পাশ্চাত্য যুক্তিবাদী মননের কাছে তার আবেদন অনেকখানি।
উনিশ শতকের চতুর্থ ভাগের বাংলার প্রেক্ষিতে এটি ছিল বঙ্কিমের পক্ষ থেকে হিন্দুধর্মের তত্ত্বতালাশ ক’রে তাকে পুনরুজ্জীবিত করবার একটি সাহসী প্রচেষ্টা।‘ ধর্মতত্ত্ব’তে হিন্দুধর্মকে একটি বিশ্লেষণাত্মক এবং যৌক্তিক ছকের আকার দেওয়া হয়েছিল,যুক্তিবাদের চোখ দিয়ে দেখা হয়েছিল। এই পরীক্ষাটি একশোভাগ সফল হয়,এবং সেটাও হয় বাংলায়, যে ভাষাকে তখনকার অ্যাংলো-স্যাক্সন শাসকশ্রেণী ও তাদের আলোকপ্রাপ্ত আত্মবিস্মৃত শিক্ষিত শ্রেণী হেয় করত। ঐ সময়ের নিরিখে এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছিল অবশ্যই অভিনব;এবং প্রকৃতপক্ষে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের যুগের পর থেকে বাংলায় কয়েক শতাব্দীর মধ্যে এই ধরণের প্রচেষ্টা ছিল প্রথম, কারণ এই ধরণের একমাত্র অন্য প্রচেষ্টাটি (অর্থাৎ, ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলন) শুধুমাত্র হিন্দুধর্মের বৈদান্তিক দিকটির একটি বিশেষ ব্যাখ্যার উপর দৃষ্টিনিবদ্ধ ক’রেই এগিয়েছিল।ঈশ্বরের সাথে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপনের প্রাচীন-নবীন যাবতীয় পথগুলির মধ্যে সমন্বয়সাধন এবং সেই সাথে হিন্দুধর্মের প্রশস্ত পরিধির মধ্যে উপাসনার অগণিত পদ্ধতিগুলিকে সুস্থ কৌতূহলের মাধ্যমে সসম্মানে উপস্থাপিত করেছেন।
তবে বঙ্কিম হিন্দুধর্মের এই যৌক্তিক-বিশ্লেষণমূলক উপস্থাপনা ক’রেই ক্ষান্ত হননি।তিনি এমনকী হিন্দুর জীবনের আবেগপ্রবণ ও ভক্তিমূলক দিক এবংদেবদেবী, পবিত্র জ্ঞানগ্রন্থাবলী এবং ভারতবর্ষের পবিত্রভূমির প্রতি হিন্দুসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ‘কৃষ্ণচরিত্র’এবং‘আনন্দমঠ’-এ তিনি যে রক্তমাংসের জীবন ও চরিত্রের আদর্শ চিত্রায়ন করেছেন, সেই জীবনাদর্শ ও চরিত্রাদর্শকে তিনি ‘ধর্মতত্ত্ব’তে প্রতিপাদিত অনুশীলনের তত্ত্বেরই ঐতিহাসিক (এবং একই সঙ্গে নান্দনিক) সংবেদনের মাধ্যম করেছেন।
বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসে ইতিহাস-সচেতন বাঙালী বঙ্কিমচন্দ্রের নামের অগ্রে প্রায়শই ‘ঋষি’এবং ‘সাহিত্যসম্রাট’-এর মতো সম্মানসূচক উপাধিগুলি প্রয়োগ ক’রে থাকে। এর মধ্যে প্রথম উপাধিটি মূলত তাঁর‘বন্দেমাতরম’-এর ধারণা এবং সঙ্গীত প্রণয়নের কারণে,ভারতবর্ষের আত্মাকে জাগ্রতভাবে নান্দনিকভাবে সুচারুভাষায়-সুরে সঙ্গীত হিসেবে আপন ক’রে পাবার কারণে। এই মন্ত্র ‘আনন্দমঠ’ রচনার বেশ কিছুকাল আগে ঋষি বঙ্কিমের দৃষ্টিতে ধরা দিলেও তা ‘আনন্দমঠ’-এর মাধ্যমেই দিগ্বিদিকে স্বদেশবৎসল বাঙালী তথা ভারতীয়দের স্বাধীনতার সংগ্রামে লিপ্ত হবার মন্ত্রণা-প্রেরণা দিয়েছিল, এবং শতশত এমনতর ভারতীয় যুবক-যুবতীকে প্রণোদিত করেছিল বিদেশী রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক নাগপাশ হ’তে ভারতবর্ষকে মুক্ত করবার জন্য বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদের পন্থা অবলম্বন করতে। ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে‘ বন্দেমাতরম’ প্রকাশের পরেই বাঙালী তথা ভারতবর্ষীয় জনতা দেশমাতা বা ভারতমাতার মধ্যে স্বদেশপ্রেমের একটি সুনির্দিষ্ট ভিত্তি খুঁজে পেয়েছিল। এই মন্ত্রের ভাবে জারিত হয়ে তাঁরা তাঁদের মাতৃভূমি এবং তাঁদের নিত্য-উপাস্য দেবীর মধ্যে কোনও পার্থক্য করেননি।
বঙ্কিমচন্দ্র সুবিন্যস্ত আকারে এই অনুশীলনতত্ত্বকে তাঁর ‘ধর্মতত্ত্ব’তে গুরু-শিষ্যের সংলাপের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন, যা ১৮৮৮ খৃষ্টাব্দে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। এই রচনার অনেকাংশ ইতিমধ্যেই অক্ষয়চন্দ্র সরকার কর্তৃক সম্পাদিত বাংলা পত্রিকা ‘নবজীবন’-এ পৃথক প্রবন্ধ আকারে প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৮৪ এবং ১৮৮৫ সালের মধ্যে। বঙ্কিম এই প্রবন্ধগুলিতে বেশ কিছু পরিবর্তন আনেন এবং এটিকে একটি সম্পূর্ণ গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশ করবার জন্য সেগুলিতে আরও কিছু উপাদান যুক্ত করেন, এবং এর শিরোনাম দেন ‘ধর্মতত্ত্ব (অনুশীলন – প্রথমভাগ)’।শিরোনামটি এই গ্রন্থের পরবর্তীভাগ প্রকাশের পরিকল্পনার ইঙ্গিত দেয়। এই পরিকল্পনা অবশ্য বাস্তবায়িত হয়নি,এবং বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৯৪ খৃষ্টাব্দে পঞ্চান্ন বছর বয়সে পরলোকগত হন।
অনুশীলন তত্ত্ব কি?
আমরা আগেই বলেছি যে অনুশীলনতত্ত্ব হল নব আঙ্গিকে উপস্থাপিত হিন্দুধর্ম। এই বক্তব্যটি বোঝার জন্য, আমরা অনুশীলনতত্ত্বের মৌলিক কাঠামোটি দেখব, যা সাতটি প্রস্তাবের সমন্বয়ে গঠিত।এইগুলি হ’ল:
“১। মনুষ্যের কতকগুলি শক্তি আছে। আপনি তাহার বৃত্তি নাম দিয়াছিলেন। সেইগুলির অনুশীলন, প্রস্ফুরণ ও চরিতার্থতায় মনুষ্যত্ব।
২। তাহাই মনুষ্যের ধর্ম্ম।
৩। সেই অনুশীলনের সীমা, পরস্পরের সহিত বৃত্তগুলির সামঞ্জস্য।
৪। তাহাই সুখ।
৫। এই সমস্ত বৃত্তির উপযুক্ত অনুশীলন হইলে ইহারা সকলই ঈশ্বরমুখী হয়। ঈশ্বরমুখতাই উপযুক্ত অনুশীলন। সেই অবস্থাই ভক্তি।
৬। ঈশ্বর সর্ব্বভূতে আছেন; এই জন্য সর্ব্বভূতে প্রীতি, ভক্তির অন্তর্গত, এবং নিতান্ত প্রয়োজনীয় অংশ। সর্ব্বভূতে প্রীতি ব্যতীত ঈশ্বরে ভক্তি নাই, মনুষ্যত্ব নাই, ধর্ম্ম নাই।
৭। আত্মপ্রীতি, স্বজনপ্রীতি, স্বদেশপ্রীতি, পশুপ্রীতি, দয়া, এই প্রীতির অন্তর্গত। ইহার মধ্যে মনুষ্যের অবস্থা বিবেচনা করিয়া, স্বদেশপ্রীতিকেই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম্ম বলা উচিত।” (ধর্মতত্ত্ব – অনুশীলন)
আনন্দমঠ উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই যে কাহিনী একটি সংক্ষিপ্ত অথচ রহস্যময় উপক্রমণিকা দিয়ে শুরু হয়েছে।
এক অন্ধকার অরণ্যের কাব্যিক বর্ণনা দিয়ে শুরু ক’রে, দুটি নামহীন অজ্ঞাত মানবকণ্ঠের মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর ব্যঞ্জনাময় বাক্য বিনিময়ের মাধ্যমে উপক্রমণিকাটি শেষ হয়। বাক্য বিনিময়টি নিম্নরূপ:
সেই অন্তশূন্য অরণ্যমধ্যে, সেই সূচীভেদ্য অন্ধকারময় নিশীথে, সেই অননুভবনীয় নিস্তব্ধ মধ্যে শব্দ হইল, “আমার মনস্কাম কি সিদ্ধ হইবে না?”
শব্দ হইয়া আবার সে অরণ্যানী নিস্তব্ধে ডুবিয়া গেল ; তখন কে বলিবে যে, এ অরণ্য মধ্যে মনুষ্য শব্দ শুনা গিয়াছিল? কিছুকাল পরে আবার শব্দ হইল, আবার সেই নিস্তব্ধ মথিত করিয়া মনুষ্যকণ্ঠ ধ্বনিত হইল, “আমার মনস্কাম কি সিদ্ধ হইবে না?”
এইরূপ তিন বার সেই অন্ধকারসমুদ্র আলোড়িত হইল। তখন উত্তর হইল, “তোমার পণ কি?”
প্রত্যুত্তরে বলিল, “পণ আমার জীবনসর্বস্ব।”
প্রতিশব্দ হইল, “জীবন তুচ্ছ ; সকলেই ত্যাগ করিতে পারে।”
“আর কি আছে? আর কি দিব?”
তখন উত্তর হইল, “ভক্তি।”
এই উপন্যাস অরবিন্দ ঘোষ (পরবর্তীকালে শ্রী অরবিন্দ) ও তাঁর ভাই বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। মূল বাংলায় এবং ইংরেজি অনুবাদে এই উপন্যাস যে তৎকালীন ভারতীয় যুবসমাজে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল তা জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী সংগঠন ‘অনুশীলন সমিতি’র নামকরণে তথা কর্মকাণ্ড হ’তে অনুধাবন করা যায়। অরবিন্দ ও বারীন্দ্র উভয়েই যুগান্তর এবং অনুশীলন সমিতির সাথে সম্পৃক্ত বিপ্লবী দেশপ্রেমিকদের সেই প্রজন্মের প্রতিনিধি যাঁরা ব্যক্তিগত সুখ দুঃখ সুবিধা-অসুবিধার চিন্তা ত্যাগ ক’রে ভারতবর্ষকে বিদেশী শাসন হতে মুক্ত করতে সমস্ত ধরণের প্রচেষ্টার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে লেগেছিলেন। রাওলাট কমিটির রিপোর্টে বলা হয়: “এটা মনে রাখতে হবে যে ১৯০৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ‘ভবানী মন্দির’ (অরবিন্দ রচিত), যার লক্ষ্য ছিল বিপ্লবীদের আদর্শ নিরূপণ করা এবং একাধিক উপায়ে তা বাস্তবায়িত করা। এই রচনাটি বেশ কিছু কারণে উল্লেখযোগ্য ছিল….এর কেন্দ্রীয় ধারণাটি বঙ্কিমচন্দ্রের সুপরিচিত উপন্যাস ‘আনন্দমঠ’ থেকে নেওয়া হয়েছে। এটি একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস, যা ১৭৭৪ খৃষ্টাব্দের সন্ন্যাসী বিদ্রোহের কথা তুলে ধরে, যে সময় সন্ন্যাসীদের সশস্ত্র দল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ স্থায়ী সাফল্যের পর সেই বিদ্রোহকে দমন করা হয়…”
‘আনন্দমঠ’-এর উপক্রমণিকার বিষয়বস্তুতে ফিরে যাই। এখানে আমাদের লক্ষ্য করতে হবে, ভক্তির উপর কেন জোর দেওয়া হচ্ছে। আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি যে অনুশীলনতত্ত্বে সাতটি প্রস্তাব রয়েছে। এর মধ্যে প্রথমটিই বলে যে মানুষের কিছু সহজাত ক্ষমতা রয়েছে, যাকে বঙ্কিম বৃত্তি বলেছেন। লক্ষ্যণীয়: এটিকে পতঞ্জলির যোগসূত্র বা অন্যান্য যোগ-সম্পর্কিত গ্রন্থে পাওয়া বৃত্তি শব্দটির সাথে গুলিয়ে ফেলা উচিত হবে না।এটি এই সংস্কৃত শব্দের এক অভিনব বাংলা প্রয়োগ, যা বঙ্কিম নিজেই তাঁর ধর্মতত্ত্বে ‘অনুশীলন’ হিসেবে আখ্যাত করেছেন। যাই হোক, অনুশীলন তত্ত্বের মৌলিক কাঠামোর সাতটি প্রস্তাবনার মধ্যে প্রথমটিতে বলা হচ্ছে যে, মানুষ যে বৃত্তিগুলি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, সেগুলির সঠিক অনুশীলনের মাধ্যমে এই বৃত্তিগুলির বিকাশ ঘটবে। একইসঙ্গে অন্য একটি প্রস্তাবনায় বলা হচ্ছে যে প্রত্যেক বৃত্তির অনুশীলনের সীমা রয়েছে এবং অন্য সবগুলিকে অবহেলা ক’রে কোনো একটি বা দু’টি বৃত্তিকে অব্যাহতভাবে বিকশিত হতে দেয়া কাম্য নয়, কারণ তাতে বৃত্তিগুলির মধ্যে সামঞ্জস্যের অভাবঘ টবে। এমনতর অভাব ঘটলে অনুশীলন ত্রুটিপূর্ণ থেকে যাবে।প্রতিটি বৃত্তির এই ধরনের ক্রমান্বয়ে বিকাশ এবং শেষ পর্যন্ত তাদের পরিপূর্ণতা একটিই শর্ত দ্বারা নির্ধারিত হয়: এই সমস্ত বৃত্তিগুলি একে অপরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা।
অনুশীলন তত্ত্ব বলে যে, বৃত্তিগুলির পরস্পর সামঞ্জস্য বজায় রেখে সেগুলির অনুশীলনের মাধ্যমে ব্যক্তি মনুষ্যত্বের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছতে পারে, এবংতা-ই মানুষের ধর্ম।
বঙ্কিম ‘কৃষ্ণচরিত্র’-তে স্বীকার করেছেন যে,অনুশীলনের চরমোৎকর্ষ অর্থাৎ মানবিক বৃত্তিগুলির ভার সাম্যপূর্ণ বিকাশের মাধ্যমে তাদের পরিপূর্ণতার উদাহরণ মানুষের ইতিহাসে বিরল।উপরন্তু, তিনি এই ধরনের অনেক বৃত্তির উল্লেখ করলেও এদের মধ্যে প্রধান চারটি বৃত্তির কথা বিশেষ জোর দিয়ে বলেছেন: শারীরিকী, জ্ঞানার্জনী, কার্যকারিণী এবং চিত্তরঞ্জিনী। এখানেই প্রশ্ন উঠতে পারে: এই ধরণের একটি আদর্শ আদৌ অর্জনযোগ্য কিনা। বঙ্কিম এ প্রশ্নের মীমাংসা করেছেন এভাবে: ঈশ্বরই এ ধরণের আদর্শের একমাত্র উদাহরণ।এখন ঈশ্বরের অসীম প্রকৃতি ও গুণাবলী বোঝা মানুষের পক্ষে কঠিন, তাই ব্যক্তির কর্তব্য হ’ল সেই সব মানুষের জীবনকে অনুশীলনের উদাহরণ ও মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ করা, যাঁরা এই আদর্শকে অনেকখানি নিজেদের জীবনে বাস্তবায়িত করতে পেরেছেন, অর্থাৎ কিনা সেই সব মানবসন্তান যাঁদেরকে মানুষের আধারে ঈশ্বরের অবতার হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। বঙ্কিম উদাহরণ দিয়েছেন: বুদ্ধ, খৃষ্ট, (বড় বড় সম্প্রদায় প্রবর্তকেদের শ্রেণী);তারপর জনক, নারদ, বশিষ্ঠ, (ঋষিদের শ্রেণী) তারপর শ্রীরামচন্দ্র, যুধিষ্ঠির, অর্জুন, লক্ষ্মণ, দেবব্রত ভীষ্ম (সর্বশ্রেষ্ঠ ক্ষত্রিয়,যাঁরা একইসঙ্গে সম্রাট এবং দার্শনিক, যাঁরা রাজনৈতিক ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছেও বৈরাগ্যবান, যাঁরা একইসঙ্গে রাজদণ্ডধারণ করেন আবার সর্বোচ্চ ধর্মীয় আদর্শ ও শিক্ষা দেন) এবং শেষ পর্যন্ত বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ।
তাঁর ‘কৃষ্ণচরিত্রে’র মাধ্যমে বঙ্কিম মহাভারতের একজন প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসেবে শ্রীকৃষ্ণের ঐতিহাসিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, এবং দেখিয়েছেন যে শ্রীকৃষ্ণ সমস্ত মানবিক বৃত্তি তথা গুণাবলীর সর্বশ্রেষ্ঠ সামঞ্জস্য বজায় রেখে সেগুলির পরিপূর্ণ বিকাশ অর্জন করেছিলেন।এবং এই ব্যাখ্যার মাধ্যমেই বঙ্কিম বুঝিয়েছেন যে, কেন হিন্দুরা শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বরাবতার বা স্বয়ং ঈশ্বর হিসেবে পূজা ক’রে থাকে।অনুশীলন তত্ত্বের পঞ্চম এবং ষষ্ঠ প্রস্তাবে ঈশ্বরানুগ বা ঈশ্বরমুখী মনুষ্যবৃত্তির বিকাশ ও পরিপূর্ণতাকে বঙ্কিম যথার্থ অনুশীলন ব’লে বর্ণনা করেছেন, যে বৃত্তির অপর নাম ভক্তি।
এইভাবে, ঈশ্বরে ভক্তি, যা সমস্ত প্রাণীর মধ্যে বর্তমান প্রেম নামক বৃত্তির অন্তর্ভুক্ত, তাকে বঙ্কিম অনুশীলনের চূড়ান্ত ব’লে প্রতিষ্ঠা করেছেন।ঠিক এই কারণেই আমরা আনন্দমঠের উপক্রমণিকায় ভক্তির উপর জোর দেখতে পাই। আর সেই কারণেই বিপ্লবের কাণ্ডারীরা ভবানী মন্দির অর্থাৎ মাতৃমন্দিরের রূপক তুলে ধরেন। শুধু রূপক কেন, এই দেশমাতারূপিণী জগন্মাতাকে হৃদয়ের ভক্তি দিয়ে পূজা করবার জন্য তাঁর রূপরেখায় ও রঙে চিত্রিত করেন (অবনীন্দ্রনাথের ‘ভারতমাতা’ চিত্র স্মর্তব্য), এবং সর্বোপরি বাহুবল দিয়ে তাঁরা এই মাতৃমূর্তিকে স্বাধীন দেশরূপী মন্দিরে চিরতরে প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হন (অরবিন্দের ‘দুর্গাস্তোত্র’ স্মর্তব্য)। এভাবেই বঙ্কিম সাহিত্য ও সাহিত্যের ইতিহাসের গণ্ডি ছাড়িয়ে ভারতের প্রাক-ঔপনিবেশিক সভ্যতা, ঔপনিবেশিক তথা উপনিবেশ-উত্তর দুর্দশা, এবং সেই দুর্দশা কাটিয়ে ওঠবার প্রকল্পে বড় বেশি ক’রে প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েন। বঙ্কিম হয়ে ওঠেন প্রবহমান ভারতেতিহাসের কবি তথা ঋষি – যে দুই শ্রেণীর মধ্যে বৈদিক বাঙ্ময় কোনও প্রভেদ করেনি।
(সমাপ্ত)
(লেখক পরিচিতি – শ্রী শ্রীজিৎ দত্ত একজন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক, কবি, নাট্যকার, অনুবাদক ও সঙ্গীতজ্ঞ)
