আঙিনাতর্পণে প্রণত মসীশক্তিচর্চা

মেজর ফণীন্দ্রকৃষ্ণ গুপ্ত – নিমগ্ন, তেজোদৃপ্ত শক্তিসাধক

জাতি রূপে বাঙ্গালীর বহু ব্যর্থতার মধ্যে রয়েছে সংরক্ষণের প্রতি তার তীব্র অনীহা। ফলতঃ তার অতীত গরিমার প্রায় অনেকাংশই আজ বিস্মৃত। তার আবহমানকালের শক্তিচর্চা, সেই ধারা অক্ষুন্ন রেখে নতুনের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপের ব্যর্থতাও এর মধ্যেই পড়ে।

তাই – আজ বাংলার কুস্তীগীর ও ব্যায়ামবিদদের মধ্যে মেজর পি.কে গুপ্তের নাম প্রায় মুছেই গেছে। যদি আজ এই নামটি হঠাৎ আলোচনা প্রসঙ্গেও উঠে আসে কখনো তাহলে প্রশ্নও উঠবে একইসাথে – ইনি কে? অথচ শক্তিচর্চার প্রতি এমন নিরবিচ্ছিন্ন ভক্তি ও তপস্যা কোন যুগেই দেখা যায় না প্রায়।

শ্রী ফণীন্দ্রকৃষ্ণ গুপ্ত (জন্ম:১৮৮৩ – মৃত্যু:১৯৫২) একজন সর্বজনশ্রদ্ধেয় ডাক্তার ও প্রখ্যাত কুস্তিগীর তথা ব্যায়ামবীর ছিলেন। তাঁর পুরো নাম কাপ্তেন (মেজর) ফণীন্দ্রকৃষ্ণ গুপ্ত যিনি অবিভক্ত বঙ্গ তথা ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক মতে ব্যায়ামের প্রচলন করেন এবং জটিল ব্যাধি আরোগ্য করিবার জন্য নতুন প্রনালী আবিষ্কার করেন। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতীয় সেনা রেজিমেন্টের ডাক্তার রূপে নিয়োজিত ছিলেন। সুঠাম শরীরের জন্য তাঁকে বলা হত Indian Sandow..

১৮৮৩ সালে কলিকাতা শহরে ফণীন্দ্রকৃষ্ণের জন্ম হয়। তাঁর পিতা হলেন শ্রী গোঁসাইদাস গুপ্ত; বাংলার খ্যাতনামা কবি শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত হলেন তাঁর মাতামহ। তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতা ছিলেন শ্রী মনীন্দ্রকৃষ্ণ গুপ্ত ছিলেন পরমহংসদেব শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের গৃহী শিষ্য, স্বামীজী তাঁকে ডাকতেন খোকা /মণি বলে। এটিও অবশ্যই বলার যে তিনি ছিলেন বিখ্যাত পত্রিকা ‘সংবাদ প্রভাকর’ – এর সর্বশেষ সম্পাদক। তাঁদের পৈতৃক নিবাস ছিল হাওড়া জেলার বালিতে; ফণীন্দ্রকৃষ্ণের শিক্ষাকাল আরম্ভ হয় কলকাতা শহরে। তিনি প্রথমে নিউ ইন্ডিয়ান স্কুলে ভর্তি হন। স্কুলের পড়া শেষ করে মেট্রোপলিটন কলেজে কিছুকাল পড়েন। তারপর সেখান থেকে সেন্ট্টাল কলেজে ভর্তি হন। কলেজের সাধারণ শিক্ষা শেষ করে তিনি কলিকাতা মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়তে আরম্ভ করেন। সেখানে তাঁর সতীর্থ তথা সহপাঠী ছিলেন জগদ্বিখ্যাত ডাক্তার তথা বিখ্যাত রাজনীতিবিদ, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডঃ বিধান চন্দ্র রায়। ১৯০৮ সালে ডাক্তারি পরীক্ষা পাশ করেন।

প্রশ্ন ওঠে এই সময় – ফণীন্দ্রকৃষ্ণ কি বাল্যকাল থেকেই সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন? উত্তর – কোনমতেই নয়। স্কুলে পড়াকালীন তিনি অত্যন্ত রোগা ছিলেন। এবং তাই বন্ধু মহলে তিনি পরিচিত ছিলেন ইঁদুর নামে। ১৪ বছর বয়স থেকেই ডিসপেপসিয়া রোগে ভুগতেন। অতএব ক্রমাগত উপহাস, তাচ্ছিল্যের উপযুক্ত উত্তর দিয়েই তিনি এক প্রকার প্রায় জোরে করেই ভর্তি হন তৎকালীন শহর কলকাতার বিখ্যাত অম্বুবাবুর কুস্তির আখড়ায়। বলা বাহুল্য, গুহ পরিবারের ভূমিকা বাঙ্গালীর শক্তিসাধনায় ঐতিহাসিক এবং অম্বুবাবু হলেন পরবর্তীকালের পৃথিবী বিখ্যাত মল্লযোদ্ধা শ্রী যতীন্দ্রচরণ গুহের (গোবর বাবু) ঠাকুর্দা।

দুবছর ধরে ক্রমাগত ব্যায়ামাভ্যাসের ফলে ফণীন্দ্রকৃষ্ণ নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন মহাভারতের ভীমের ন্যায়; আখড়ার পুরোনো ও অভিজ্ঞ কুস্তিগীররাও হার মানে শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রতাপ ও কৌশলের কাছে। এবং এর মূলে ছিল ধনঞ্জয়ের মতো ক্রমাগত অভ্যেস ও অপরিসীম ধৈর্য্য। এবং এর জন্যেই তাঁর ৭০ বছরের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ফণীন্দ্রকৃষ্ণ তাঁর সুঠাম শরীর ধরে রেখেছিলেন। ব্যায়াম ছিল তাঁর নিত্য অভ্যাস। কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করবার পর তিনি প্রাইভেট প্রাকটিস শুরু করেন। তাঁর patient দের মধ্যে ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, শ্রী যতীন্দ্রমোহন সুনগুপ্ত প্রমুখ শ্রদ্ধেয় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ। পূর্বেই বলা হয়েছে তিনি ডঃ বিধানচন্দ্র রায়ের সহপাঠী ছিলেন।

১৯১৫ সালে তিনি ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিসের লেফট্যানেন্ট হিসেবে যোগ দেন; ইন্ডিয়ান আর্মির ডাক্তার হিসেবে নিযুক্ত হন ১৯২৩ সালে।সৈন্যবাহিনীর ডাক্তার হিসেবে বিশ্বের বহু দেশ যথা ইজিপ্ট,প্যালেস্তাইন,তুর্কি,বার্মা,অস্ট্রিয়া,নিউজিল্যান্ড প্রভৃতি ভ্রমণ করেছেন। কিন্তু নিত্য ব্যায়ামাভ্যাস থেকে বিরত থাকেন নি একটি দিনের জন্যেও। বিদেশে থাকাকালীন তার দৈনিক রুটিনের অন্তর্ভুক্ত ছিল কুস্তি ও বডিবিল্ডিং।একবার তাঁর সেনা ক্যাম্পে দুই ব্রিটিশ অফিসার আসেন আর এসেই দুম করে চ্যালেঞ্জ করে বসেন কুস্তি লড়বার।তিনি রাজি হন, উপরন্তু বলেন যে দু-জনে সাথে একসাথে লড়বেন। কিন্তু শর্ত একটাই ক্যাম্পে থাকা তাঁর ব্যায়ামের বিরাট মুগুর দুটি ঘুরিয়ে দেখাতে হবে।। মুগুর ভাঁজা ছিল তার দৈনিক রুটিন। ব্রিটিশ অফিসার বীর বিক্রমে গেল বটে কিন্তু একখানাও তুলতে পারল না। রাগে অপমানে ব্রিটিশ অফিসার দুটি বললেন ঠিক আছে আমরা আপনার জেনারেল নলেজের টেস্ট নেবো। উনি সাগ্রহে রাজি। যদিও ব্যায়ামচর্চা তাঁর কাছে ছিল মন্ত্রজপের মতো, বিদ্যাভ্যাসেও তিনি ছিলেন সমান আগ্রহী। তাঁর অতীব পছন্দের বিষয়ের মধ্যে ছিল ইতিহাস, ভুগোল, দর্শন ও সাহিত্য। ব্রিটিশ অফিসারদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিলেন প্রায় তাচ্ছিল্যের সাথে। ৪১ বছর বয়সে আর্মি থেকে অবসর নিয়ে তিনি তাঁর আপন মসজিদবাড়ী স্ট্রীটের বাড়ীতে প্রারম্ভ করেন আখড়ার। পরবর্তীকালের বহু বিখ্যাত ব্যায়ামবিদরা ছিলেন তাঁর শিষ্য। তাঁদের অন্যতম ছিলেন আয়রন মনে শ্রী নীলমণি দাস, আচার্য বিষ্ণুচরণ ঘোষ, শ্রী বিজয়কৃষ্ণ পাঠক, শ্রী কানাইলাল মুখোপাধ্যায়, শ্রী উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।

তাঁর দৈনন্দিন রুটিনের উপরে মনোনিবেশ করা যাক: –

ভোর ৫টায় তিনি ঘুম থেকে উঠতেন, ঘুমোতে যেতেন রাত ১০টায় ;
কোন প্রকার যথা তামাক, মদ্যপানের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন।

প্রতিদিন সকালে দুহাজার ডন, আড়াই হাজার বৈঠক দেওয়া তাঁর অবশ্য কর্তব্য ছিল। ডাম্বেল কষতেন এবং প্রৌঢ় বয়সেও তাঁর বুকের ছাতি ছিল ৫২ ইঞ্চি, বাইসেপ ১৮ ইঞ্চি। দুবান্ডিল তাস একসাথে ছিড়ে ফেলতে পারতেন।

তাঁর সুযোগ্য পুত্র শ্রী রবীন্দ্রনাথ গুপ্ত পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আজীবন ব্যায়ামচর্চায় মগ্ন থেকেছেন ও লৌহকঠিন স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। পিতার সম্পর্কে তিনি লিখছেন, ‘Even though he exercised hard, his meals were plain and simple. Being a Bengali, he had to have fish – which he ate for lunch. At dinner, there was chicken or mutton, but in reasonable quantities. These he ate with rice or chapattis, dal, fresh green vegetables, milk or dahi (yogurt). During the time when he increased his workouts, he increased the amount of fish and meat in his daily diet and sometimes supplemented it with some half boiled eggs. The cooking was always light, with little oil, very small amounts of spices, and no chillies.

1. He also ate almonds (ground and stirred in water with sugar), mostly on winter mornings. The very first thing he regularly used to have every morning was some quantity of ripe frতিনিuit like bael (wood apple), banana, papaya or mango, which he believed kept his bowels regulated and healthy. He used to have a cup of tea only in the afternoon everyday…

তৎকালীন দিনে ব্যায়াম প্রতিযোগিতায় বিচারক রূপে তিনি নিয়মিত ছিলেন। ১৯২৩-২৪ সালে শহর কলকাতায় প্রচণ্ড উদ্দীপনার সাথে যে নিখিল-ভারত কুস্তির প্রতিযোগিতা ( All India Championship Wrestling Tournament ) অনুষ্ঠিত হয় তাতে তিনি অন্যতম বিচারক ছিলেন। ব্যায়ামের পরেই তাঁর শখ ছিল বই পড়া ও বাগানের। সেই যুগে তিনি তাঁর আপন গৃহে রঙিন মাছের চৌবাচ্চা করেছিলেন। কথিত আছে, এস্রাজ ও হারমোনিয়াম বাজানোয় তাঁর বিস্ময়কর দক্ষতা ছিল।

তাঁর কোমল হৃদয়ের প্রকাশের বহু নিদর্শন আছে। একবার একটি বিয়ের বাড়িতে তিনি দেখতে পান যে একজন রুগ্ন মানুষকে একদল লোক চোর অপবাদ দিয়ে মারছে। তিনি যে শুধু সবাইকে নিরস্ত করেন তা নয়; অনুসন্ধান করে জানতে পারেন যে লোকটি অভুক্ত, দুদিন ধরে খাবার পায়নি। তাই বিয়েবাড়ি তে দুমুঠো খাওয়ারের আশায় এসছেন।তিনি তাকে পেট ভরে খাইয়ে তার পরিবারের জন্যঅর্থ সাহায্য করেন, এবং লোকটিকে পরে একটি গ্যারেজে কাজ দেন। অতুলনীয় শারীরিক শক্তির অপব্যবহার তাঁর কাছে অকল্পনীয় ছিল।

ফণীন্দ্রকৃষ্ণের জীবনের মন্ত্র ছিল – দেহকে লৌহসম করার সাথে মানসিক ঔদার্যের সহাবস্থান অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

হয়তো তিনি যে মূল্যবোধ মেনে চলতেন তা আজকের ক্ষয়িষ্ণু সমাজকে এক নতুন পথের সন্ধান দিতে পারে –

মিথ্যা বলবে না
বড়োদের সম্মান করবে
আর্তদের সাহায্য করবে
ইশ্বরে বিশ্বাস রাখবে
সব দিক দিয়ে শিক্ষিত হবে,নইলে মনের সর্বোতো বিকাশ লাভ ঘটবে না
শরীর কে সবল, শক্তিশালী ও সুস্থ রাখবে
শারিরিক শক্তির অপচয় করবে না
মদ তামাক সম্পুর্ন ভাবে বর্জন করবে।.

পরিশেষে, এ কথা অবশ্য স্বীকার্য মেজর ফণীন্দ্রকৃষ্ণ গুপ্তের মতো সুসংস্কৃত ব্যায়ামবীর ও মল্লযোদ্ধা প্রতি যুগেই অত্যন্ত বিরল।

তথ্যঋণ: ‘My System on Physical Culture’ by Major PK Gupta
‘ব্যায়ামে বাঙ্গালী’ – শ্রী অনিলচন্দ্র ঘোষ
প্রবাসী পত্রিকা – সন ১৩৩০
My Father – A Doctor and A Cultured Strongman by Sri Rabindra Nath Gupta – 2008

Comment here