তর্পণে প্রণত মসীরাজনীতি

‘রডা অস্ত্র-লুণ্ঠন’

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবের অন্যতম দুঃসাহসিক ঘটনা –

 

 

১৯১৪ সালের ২৬শে আগস্ট প্রকাশ্যে কলকাতার রাজপথ থেকে রডা কোম্পানির অস্ত্র দিন-দুপুরে লুঠের ঘটনা প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন বিপ্লবী সংগঠনগুলি পরিচালিত অন্যতম শ্ৰেষ্ঠ দুঃসাহসিক কার্য যা রক্তাক্ষরে লেখা রইবে আজীবন।

শ্রী হেমচন্দ্র ঘোষ (সর্বজনশ্রদ্ধেয় বড়দা) দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ‘মুক্তিসঙ্ঘ’ ইতিমধ্যেই ‘আত্মোন্নতি সমিতির’ সাথে যৌথভাবে মৃত্যুঞ্জয়ী প্রফুল্ল চাকীর প্রতি বিশ্বাসঘাতক নন্দলালের উপযুক্ত পুরস্কার সুনিপুণ দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করায় তা উভয় সংগঠনের মধ্যে আস্থা এবং সফল যৌথ অপারেশন পরিচালনার অন্যতম দৃষ্টান্ত বললে অত্যুক্তি করা হয় না। বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের সাথে সাথে ১৯১৩ সালের দামোদরের বন্যাজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কালে মানুষের সামাজিক সেবাতেও মুক্তিসঙ্ঘের বিপ্লবীগণ যে সমানভাবে দেশ-মাতৃকার সেবায় প্রাণ-উৎসর্গ প্রস্তুত সেই বার্তাও অন্যান্য গুপ্তসমিতির নিকট স্পষ্টতই দেখা দিয়েছিল। এই পর্যায়ে ঢাকা অনুশীলন সমিতি ব্যতীত সমস্ত বিপ্লবী সংগঠনগুলির নেতৃত্বে ছিলেন মহাক্ষত্রিয় শ্রী যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিসঙ্ঘের ভলেণ্টিয়ার্সগণ যে কাজ করেছিলেন তাতে উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা, পারস্পরিক আস্থা ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনার রূপরেখা নিয়েও আলোচনা হয়। তাঁদের মধ্যে সঠিক কি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল তা’জানা না গেলেও এটুকু বোঝা গিয়েছিল যে উভয়ই ১৯০৯-১৪ সালের মধ্যে যশোর, ঢাকাসহ অন্যান্য জেলাগুলির গ্রামাঞ্চলে গুপ্তসমিতির শাখা গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

যতীন মুখোপাধ্যায়ের ও মুক্তিসঙ্ঘের হেমচন্দ্র ঘোষ উভয়েই স্বামীজীর (an intrepid and resourceful leader with prophetic vision, an acute intellect and the will and ability to act) সান্নিধ্য এবং প্রেরণায় বিপ্লবীদের মধ্যে নির্ভীকতা, কঠোর সঙ্কল্পনিষ্ঠার ও মন্ত্রগুপ্তির প্রতিজ্ঞাবদ্ধতায় বৈপ্লবিক সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। দেশমাতৃকার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সংকল্পনিষ্ঠ, আত্মত্যাগী, শৃঙ্খলাবদ্ধ তরুণ স্বেচ্ছাসেবী গড়ে তোলাই ছিল তাঁদের অন্যতম উদ্দেশ্য। তাছাড়া, গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গোপন বৈপ্লবিক সংগঠন গড়ে তোলার প্রতি তাঁরা গুরুত্ব দিয়েছিলেন; গ্রামের কিশোর ও তরুণদের মধ্যে নানাভাবে সামাজিক সেবামূলক কাজ এবং খেলাধূলো-ব্যায়াম চর্চার সংস্কৃতির স্বদেশপ্রীতি-স্বদেশভাবনা এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের জন্য স্বামীজীর শিক্ষায় চরিত্র গঠনের মধ্য দিয়ে জাতীয়তার আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা। গ্রামের এই সংগঠনগুলির মধ্যে দিয়ে হেমচন্দ্র ঘোষ ও তাঁর সহযোগীরা যেমন যোগ্য ও আদর্শনিষ্ঠ অকুতোভয় বিপ্লবীকর্মী গড়ে তুলেছিলেন; পাশাপাশি পূর্ব-ভারতের বিস্তীর্ণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিপ্লবী সংগঠনের গোপন সাংগঠনিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা এবং গুরুত্বপূর্ণ বৈপ্লবিক অভিযান শেষে বিপ্লবীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল এর ব্যবস্থা করাও ভাবনাও এক্ষেত্রে নেতৃবৃন্দের মধ্যে কাজ করেছিল।১

হেমচন্দ্র ঘোষ স্বয়ং ‘সুভদ্য সমাজের’ ন্যায় সমাজসেবী সংগঠনের মাধ্যমে উত্তরবঙ্গে সুরেন্দ্র বর্দ্ধন এবং হরিদাস দত্তকে দায়িত্ব দেন গ্রামঞ্চলে সংগঠন বিস্তারের জন্য। শান্তিপূর্ণ সামাজিক সেবামূলক কাজকর্মের মধ্যেই চলত বৈপ্লবিক কাজের প্রস্তুতি এবং একই সাথে চলত আরও পরিণত কোন সশস্ত্র বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা। এই সময় দিনাজপুর রংপুরসহ অন্যান্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাধারণভাবে পিছিয়ে থাকা জনজাতি মানুষের মধ্যে সংগঠন গড়ে তোলাই ছিল মুক্তিসঙ্ঘের উদ্দেশ্য। সুরেন্দ্র বর্দ্ধন, নীলকণ্ঠ বৈরাগীর সহায়তায় তাদের সাংগঠনিক কার্যকলাপ আদিবাসীদের মধ্যে গড়ে তুলেছিলেন, বিশেষভাবে হুজং এবং রাভা উপজাতিদের মধ্যে। এই অঞ্চলের আদিবাসী সমাজ কলকাতা, ঢাকার ন্যায় চকমকি আধুনিকতার কৃত্রিমতা থেকে বর্জিত এবং তাঁরা তাঁদের স্থানীয় স্বাধীনতা এবং নিজেদের সংস্কৃতির মর্যাদা রক্ষায় কৃতসংকল্প। সুরেন্দ্র বর্দ্ধন পহান গ্রাম থেকে বীরেন রাভা এবং আসামের জোলাপাড়া থেকে গোবিন্দ রাভার ন্যায় দু’জন তেজদৃপ্ত যুবককে উপযুক্ত সংগঠক হিসাবে গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। সঠিক সময়ে এই বিপ্লবী যুবকদের তিনি ব্যবহার করতেন, তবে সেই সময়ের মতো তিনি তাঁদের সঙ্গে অন্যান্য সামাজিক কাজের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতেন।২

সুভদ্য সমাজের দক্ষিণবঙ্গে কার্যকলাপ মূলত রাজেন্দ্র গুহ এবং নটবর দাসের মাধ্যমেই পরিচালিত হত। দক্ষিণবঙ্গে মাঝি এবং নিম্নবর্ণের মধ্যেই সংগঠনের কাজ করতেন; আসলে সমাজের বঞ্চিত, অবহেলিতদের মধ্যেই স্বামীজী চেয়েছিলেন জাতীয় চেতনা এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্খা গড়ে তুলতে। ১৯০৯-১৯১৪ পর্যায়ে অর্থাৎ আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলা এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রারম্ভের পর্যায়ে হেমচন্দ্র ঘোষ, তাঁর চিন্তাধারা এবং কর্মপরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। ইতিমধ্যে শ্রীশ পাল, হরিদাস দত্ত এবং প্রতুল ঘোষ প্রমুখ কঠোর নিয়মনিষ্ঠা-কায়মনঃবাক্যে দেশমাতৃকার প্রতি আত্মত্যাগ এবং তীক্ষ্ণ-মেধার পরিচয় দিয়ে যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের আস্থাভাজনও হয়েছেন। বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের সাময়িক শিথিলতার অর্থ দীর্ঘ কোন সাংগঠনিক প্রস্তুতি আর আর বড় কোন দুঃসাহসিক পরিকল্পনা। এবারের পরিকল্পনাতেও ‘মুক্তিসঙ্ঘ’ ও ‘আত্মোন্নতি সমিতি’ -র যৌথ প্রযোজনায় সম্পন্ন হয়েছিল এশিয়ার মহাদেশের মাটিতে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীশক্তির বিরুদ্ধে অন্যতম সফল বৈপ্লবিক অস্ত্র লুণ্ঠনের ঘটনা। হ্যাঁ,আমি রডা কোম্পানির অস্ত্র লুন্ঠনের কথাই বলছি।৩

এই প্রসঙ্গে, প্রথমেই জেনে নিই পুলিশের অফিসিয়াল রিপোর্টের ভিত্তিতে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক মনোনীত বিচারপতি রাওলাট তাঁর ১৯১৮ সালে প্রকাশিত ‘সিডিশন কমিটি রিপোর্টে’- ১৯১৪ সালের ২৬শে আগস্ট ‘রড়া-অস্ত্র-লুণ্ঠন’ সম্পর্কে কি লিখেছেন –

65. “The theft of pistols from Rodda & Co., a firm of gun makers in Calcutta, was an event of greatest importance in the development of revolutionary crime in Bengal. On Wednesday, the 26th of August 1914, the clerk of Rodda &Co. whose duty it was to clear imports of arms and ammunition at the Custom office, had cleared 202 cases of arms and ammunition, but had brought only 192 cases to employer’s warehouse in Vansittart Row. He had then left, saying that he was going to bring the reminder. He never returned and after three days the case was reported to the police. The 10 missing cases contained 50 Mauser pistols and 46,000 rounds of Mauser ammunition for the same, the pistol bore a number of which Rodda & Co. had a record. The pistols were so constructed and packed that by attaching to the butt the box containing the shoulder in the same way as a rifle. The authorities have reliable information to show that 44 of these pistols were almost distributed to 9 different revolutionary groups in Bengal, and it is certain that the pistols so distributed were used in 54 cases of decoity or murder or attempts at decoity and murder subsequent to August 1914. It may indeed safely be said that few, if any, revolutionary outrages have taken place in Bengal since August 1914, in which Mauser pistols stolen from Rodda & Co. have not been used. Owing to the activity of the police 31 of the stolen pistols have been recovered in various parts of Bengal.” ৪

এবারে দেখি এই রডা অস্ত্র লুণ্ঠন ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যাঁরা যুক্ত ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম বিপ্লবী শ্রীহরিদাস মিত্রের সেই দুঃসাহসিক অভিযানের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখছেন –(হরিদাস মিত্র) “ …‘রডা-অস্ত্র-লুণ্ঠন’ ঘটনাটি সম্পর্কে নানারকম গল্প শোনা যায়। কোন গল্পটি ঠিক এবং কোনটি বেঠিক তাহা সাধারণ পাঠকের বোঝা মুস্কিল। পুলিশ রিপোর্ট বা ষড়যন্ত্র মামলার রিপোর্ট হইতে ঘটনার কিছু খবর পাওয়া যায়, আর বাকিটা পাওয়া যায় শোনা গল্প হইতে। সরকারী রিপোর্টে সন-তারিখ বা সরকারের জানা (তাহা ভুলও হইতে পারে) তথ্য পাওয়া যাইবে, কিন্তু শোনা গল্প নানা মুখে নানারকম হইতে বাধ্য। যাঁহারা সত্যি হাতেনাতে এই কাজটি করিয়াছিলেন, তাঁহাদের কেহ কোনো কথা আজ পর্যন্ত বলেন নাই বলিয়াই এই বিষয়ে ঐতিহাসিক-সত্য দেশবাসী জানেন নাই। রডা-ষড়যন্ত্রের যেইটুকু পুলিশ জানে তাহার চেয়ে তাহারা যাহা জানে না তাহার গুরুত্ব কম নহে।” ঘটনাটির কথা শ্রীহরিদাস মিত্র ‘সাপ্তাহিক বসুমতী’ (২২.৭.৬৫) পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর নিজস্ব লেখনী উদ্ধৃত করে ভূমেন্দ্রকিশোর রক্ষিত রায়’কে চিঠিতে জানান। ৫ (হরিদাস দত্তের লেখা চিঠি, ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত-রায় ‘সবার অলক্ষ্যে’, এক নং পত্র সংগ্রহ অংশ; পৃষ্ঠা-২২১, ১৯৬৬, কলিকাতা;)…

বিপ্লবীর ধর্ম হলো শূন্যের মধ্যেও বস্তুকে খুঁজে বার করা, ‘না’র মধ্যেও ‘হা’কে সৃষ্টি করা। আর ১৯১৪ সালে বিশ্ব পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে বাংলার এবং অবশ্যই বাংলার বাইরের বিপ্লবীদলগুলির সক্রিয়তা ছড়িয়ে ছিল। এই সময় ‘যুগান্তর দল’, ছাড়াও সবচেয়ে বড় গুপ্ত সমিতি হিসাবে ‘অনুশীলন সমিতি’র প্রভাব-প্রতিপত্তি বাঙ্গালার সর্বত্র সগৌরবে বর্তমান ছিল। আগেই উল্লেখ করেছি ‘মুক্তিসংঘ’–এর সংগঠক হেমচন্দ্র ঘোষ, হরিশ শিকদার এবং বিপিন গাঙ্গুলির ‘আত্মন্নোতি দল’ এবং অবশ্যই ‘যুগান্তর দল’ ও ‘অনুশীলন সমিতি’র সাথে সদ্ভাব বজায় রেখে ও আলোচনা করেই বৈপ্লবিক কাজকর্ম সংগঠিত হয়েছিল।৬ (ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত-রায় ‘সবার অলক্ষ্যে’, ১৯৬৬; কলিকাতা, পৃষ্ঠা ৪-৫।)

১৯১৪ সালের এরকমই এক নিশীথে বউবাজারস্থ ছাতাওয়ালা গলির এক আড্ডায় যুগান্তর, আত্মন্নোতি, মুক্তিসংঘের নেতৃবৃন্দের (যতীন মুখার্জী, হেমচন্দ্র ঘোষ, বিপিন গাঙ্গুলি, হরিশ শিকদার) সমর্থনেই মিলিত হয়েছিলেন কয়েকজন, ‘মুক্তিসঙ্ঘ’-এর মহাশয়ের কলকাতাস্থ প্রতিনিধি শ্রীশ্চন্দ্র পাল প্রদত্ত একটি প্রস্তাব আলোচনার জন্য। উপস্থিত ছিলেন বিপিন গাঙ্গুলির বন্ধু অনুকূল মুখার্জী, আত্মোন্নতি সমিতির শ্রীশ মিত্র (হাবু ভাই), সতীর্থ হরিদাস দত্ত ছাড়াও উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য (বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায়), নরেন ঘোষচৌধুরী, আশুতোষ রায় (পাবনা), খগেন দাস (চারগাছা গ্রাম কুমিল্লা), সুরেশ চক্রবর্তী (বরিশাল), জগৎবাবু ও মেডিক্যাল্ করেজের সিনিয়র ছাত্র বিমানচন্দ্র (কলিকাতা) এবং শ্রীশ পাল স্বয়ং।৭

আজ থেকে ১০৬ বছর আগে ১৯১৪ সালের ২৬শে আগস্ট দিনটিকে ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবীর ইতিহাসকে যাঁরা উজ্জ্বল করে গেছেন, তাঁদের আজ ক’জনই বা মনে রেখেছে!!

সমবেত সেই গোপন বৈঠকে বিপ্লবী নেতৃবৃন্দকে শ্রীশ পাল যে প্রস্তাব শুনিয়েছিলেন তার সারমর্ম বিবরণসহ ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত রায় লিখছেন– “রডা কোম্পানীর কেরানি মধ্য কলকাতার ‘হাবুভাইয়ের (শ্রীশ মিত্র) কাছে সংবাদ পাওয়া গেছে যে, ঐ রডা কোম্পানির জন্য বহু অস্ত্রশস্ত্র কাস্টমস হাউজে আসছে। এ অস্ত্রগুলোর মধ্যে তিব্বতের দালাই লামার চাহিদা মত এসে যাচ্ছে পঞ্চাশটি মাউজার পিস্তল, পঞ্চাশটি অতিরিক্ত স্প্রিং এবং পিস্তলের এমন ধারা পঞ্চাশটি খাপ যাদের সাহায্যে পিস্তলগুলিকে রাইফেল্-এর মত বড় করে ব্যবহার করা চলে। ওই খাপগুলোই একাধারে বন্দুকের কুঁদার মত মাউজার পিস্তলের কুঁদা এবং উহার খাপের কাজ করে থাকে। এ ছাড়া সঙ্গে রয়েছে পঞ্চাশ হাজার রাউণ্ড কার্তুজ। মালমত্র সবই জাহাজে থেকে নেবে গেছে, কাস্টমস ছাড়পত্র নিয়ে উহা ‘রডা’র ঘরে তুলবার অপেক্ষা। ……… শ্রীশবাবুর মতে একেই বলা হয় সুবর্ণ সুযোগ। এ সুযোগ গ্রহণ করতে হবে। পথ থেকে মাউজার পিস্তল্গুলো এবং বুলেট অপসারিত করার প্ল্যান নিতে হবে।” ৮

উক্ত গোপন সভায় উপস্থিত বিপ্লবী নেতাদের অন্যতম নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ও নরেন ঘোষচৌধুরী দিনে দুপুরে কলকাতার রাজপথে কি ভাবে এই দুঃসাহসিক কাজ হাসিল করা সম্ভব তা’ এঁদের অনেকের কাছেই এ প্রচেষ্টার চিন্তাকে পাগলামী মনে করে সভাস্থল ছেড়ে চলে গেলেন। কিন্তু আর সকলে সেদিন শ্রীশ পাল মহাশয়ের বাঙ্ময় মূর্তির মধ্যে যেন দুর্ধর্ষ যৌবনের এক সার্থক রূপলিখা দেখতে পেলেন! তাই তাঁরা সকল কর্ম নেতৃত্ব শ্রীশ্চন্দ্রের হস্তে ন্যস্ত করে খুশি হলেন। এযাবৎ বাংলার বিপ্লব-ইতিহাসে এত বড় দুঃসাহসিক এ্যাকশনের (বিপ্লবী-কার্যের) সফল কল্পনা কেউ করেন নি। “………ঊনিশ শত চোদ্দ সাল—এ বৎসর-ই বুঝি পৃথিবীর নির্যাতিত দেশগুলোর বিপ্লবের জয়ধ্বজা উড়িয়ে দেবার শুভকাল!” হেমচন্দ্র ঘোষের ‘মুক্তিসংঘ’র কলকাতাস্থ প্রতিনিধি রূপে বিপ্লবী শ্রীশ পাল ও আত্মোন্নতি দলের যৌথ প্রযোজনায় ১৯১৪ সালে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে ‘রডা অস্ত্র-সংগ্রহ’ প্ল্যানিং করা হয়েছিল। শ্রীশ্চন্দ্র পালের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন, দুঃসাহসিক সতীর্থ হরিদাস দত্ত ও হাবু মিত্র। নিঃসন্দেহে যাঁরা ‘রডা অস্ত্র-সংগ্রহ’ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরাসরি যারা যুক্ত ছিলেন জীবন-মৃত্যু ছিল তাঁদের পায়ের-ভৃত্য, শ্রীশ্চন্দ্র পাল সেদিনের সমস্ত ভালমন্দের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। ৯

ঘটনার পূর্ব দিন (২৫.৮.১৯১৪)শ্রীশ পাল আর অনুকুল মুখার্জিতে মিলে স্থির হলো যে মাল সরাবার জন্য অনুকুল মুখার্জি গরুর গাড়ি জোগাড় করবেন, আর সেই গাড়ির গাড়োয়ান জোগাড় করবেন শ্রীশ পাল। এছাড়া এও স্থির ঠিক হলো যে, ‘রডা কোম্পানির মালগুলো কাস্টমস্ হাউস-এর আওতা থেকে রডা আফিসে আনবার কালে গরুর গাড়িগুলোতে মাল নামানো-ওঠানোর ফাঁকেই ঐ কাজে ভারপ্রাপ্ত ‘রডা কোম্পানি’র কর্মচারী শ্রীশ মিত্র (হাবু মিত্র) মাউজার পিস্তল ও কার্তুজের বাক্সগুলো বিপ্লবীদের গাড়িতে তুলে দিয়ে যথাসময়ে সরে পড়বেন। হরিদাস দত্ত গাড়ি বোঝাই মাল নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যাবার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।১০

রডা-কোম্পানীর মাল কি ভাবে সরান হবে তার execution-এর পরিকল্পনাটি হাবু মিত্রের বাড়িতে বসেই স্থির করা হয়েছিল। সেখানে উপস্থিত ছিলেন শুধু অনুকূলবাবু ও তাঁর সহকর্মী হাবু মিত্র; শ্রীশ পাল ও তাঁর সহকর্মী হরিদাস দত্ত এবং খগেন দাস। এসম্পর্কে পরবর্তীকালে বহু বিভ্রান্তিমূলক লেখাপত্র হয়েছিল—তাতে ‘ষড়যন্ত্র-সভা’ নাকি বসেছিল গিরীনবাবুর বাড়িতে ৪/৩, মঙ্গলা লেনে। এই বিতর্কের অবসান ঘটে যখন এই পরিকল্পনার অন্যতম অংশীদার শ্রীহরিদাস দত্ত কলম ধরেন। তিনি আমাদের জানাচ্ছেন “ …… বিপিনবাবু, অনুকূলবাবু, হরিশবাবু প্রমূখ ‘আত্মোন্নতি’-র নেতাদের বাড়িগুলি পুলিশ সার্চ করে এবং তাহার পর হইতে ঐ বাড়িগুলির উপর অল্পবিস্তর নজর রাখে। …… যাঁহারা কোনো ‘ষড়যন্ত্র’ হাতেনাতে করিতে চান। ………… পরিকল্পনাটিকে কিভাবে রূপ দেওয়া হইবে তাহা স্থির করার জন্য ঐদিন রাত্রেই হাবু মিত্রের গৃহে দ্বিতীয় বৈঠক বসে। এই বৈঠকে ছিলেন অনুকূলবাবু, হাবু মিত্র, শ্রীশ পাল, খগেন দাস ও লেখক (হরিদাস দত্ত)। এখানে আবার বলি যে, পুলিশের জানিত গৃহে (৪-৩, মঙ্গলা লেনে) অত বড় একটা ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আলোচনার জন্য শ্রীশ পালের মত একজন পলাতক বিপ্লবীসহ আমরা উপস্থিত হইব ইহা সম্ভবপর নয়। অধিকন্তু আমি এবং খগেন দাসও “ওব্রাইন-ষড়যন্ত্র’ ব্যাপারের পর পলাতক ছিলাম। কাজেই আমরাও সে-বাড়িতে যাইতে পারি না। তাই পার্ক-এর সভা ভাঙিবার অব্যবহিত পর আমরা হাবু মিত্রের বাড়িতেই দ্বিতীয় বৈঠক বসাইয়াছিলাম। ‘রডা-অস্ত্র-লুণ্ঠন’-এর পরিকল্পনায় কারা কারা ছিলেন সে নিয়েও বিতর্ক এবং ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছিল।

তার নিরসন ঘটিয়ে শ্রী হরিদাস দত্ত লেখেন – “কালিদাসবাবু উল্লেখিত কোনো সভাতেই উপস্থিত ছিলেন না। সভায় উপস্থিত ছিলেন তিনটি দলের প্রতিনিধিগণ এবং direct action-এ যাঁহারা শরিক হইবেন তাঁহারা। ‘আত্মোন্নতি’র প্রতিনিধি ছিলেন অনুকূলবাবু এবং ‘আত্মোন্নতি’র হাবুবাবু হবেন direct action-এর direct শরিক। কাজেই উক্ত সভায় কালিদাসবাবুর আসার প্রয়োজন হয় নি। ঠিক এই কারণেই বিপিনবাবু, গিরীনবাবু প্রমূখ কোনো নেতারই এ-বৈঠকে উপস্থিত হবার প্রয়োজন হয় নি। নরেন্দ্র ব্যানার্জির কথা তো আসেই না। কারণ, তখন তাঁর বয়স শুধু খুব অল্প নয়, তিনি দলেও ঢুকিয়াছেন সবেমাত্র। তাঁহার কিছু জানিবার কথা নয়।” ১১

২৬শে আগস্টের পরিকল্পনা গৃহীত হতেই শ্রীশ পাল হরিদাস দত্তকে নিয়ে ২৫ আগস্ট, রাতের অন্ধকারে যান মার্কাস স্কোয়ারের পশ্চিম দিকের মারোয়াড়ী হোস্টেলে। কলেজ পড়ুয়া প্রভুদয়াল হিম্মৎসিংকা মারোয়াড়ী ছাত্রনিবাসের বোর্ডার, এবং বিপ্লবী দলের কর্মীও। তাঁর ওপরই ভার পড়ল হরিদাস দত্তকে রাতে রেখে দেবার জন্য এবং একই সাথে তাকে পর দিন সকালের মধ্যে খাঁটি হিন্দুস্থানী গাড়য়ানের সাজে সাজিয়ে পূর্বনির্ধারিত স্থানে পৌঁছে দেবার। পর দিন ২৬ আগস্ট হিম্মৎসিংকাজির বিশ্বস্ত এক ক্ষৌরকারের সাহায্যে হরিদাস দত্তের চুল হিন্দুস্থানী গাড়োয়ানের মতো ছোট ছোট করে ছেঁটে দেওয়া হল, যাতে হিন্দুস্থানী গাড়োয়ানের সাথে তাঁর কোন প্রভেদ না থাকে। এরপর তাঁকে পরনের জন্য দেওয়া হয় কালো রঙের ফতুয়া, গলায় কালো তারের সাথে আঁট করে লাগানো হলো একটি পেতলের ধুকধুকি, আর আট হাতি কোরা ধুতি পরানো হল। অর্থাৎ নিখুঁত সাজ-সজ্জা সাথে হরিদাস দত্ত যখন রাস্তায় নামতেই বোঝা গেল তিনি কোন আবেগপ্রবণ কেতাবি বিপ্লবী নন, দস্তুর মতো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিক বিপ্লবী; তাঁর বিপ্লবী আদর্শের শিক্ষা ও দীক্ষা যে অত্যন্ত উচ্চস্তরের হাতেই গড়া তাতে কোন সন্দেহ থাকে না। মঙ্গলা লেনে অনুকূল মুখার্জির থেকে গরুর গাড়িতে যখন গরুর লেজ মুচরে বসলেন তখন তাঁকে বোঝার উপায় নেই যে তিনি … সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে এশিয় মহাদেশের মাটিতে এক দুঃসাহসিক ঘটনা জন্য ছদ্মবেশ নিয়েছেন। জনাকীর্ণ কলকাতার রাস্তায় যখন ওই গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি যেন পার্থসারথি।১২

পরিকল্পনামাফিক নেতৃত্বে থাকা শ্রীশ পাল সশস্ত্র অবস্থায় সেই গরুর গাড়ি সম্মুখে হেঁটে চললেন এবং খগেন দাসের ওপর নির্দেশ ছিল গোপনে একটু দুরত্বে ওই গাড়িকে অনুসরণ করার। সময়মতই ডালহৌসি স্কোয়ারে শ্রীশ পাল, খগেন দাস এবং গাড়িসহ হরিদাস দত্ত উপস্থিত হলেন। গরুর গাড়িতে শুধু একটি শাবল রাখা হয়েছিল। অবশ্য তিনজনের গোপনে নিজেদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্রও রেখেছিলেন, যদি ধরা পড়েন তা’হলে যুদ্ধ করতে করতে মরবেন। তাছাড়া মাল উদ্ধার করে পালাবার সময়ও যদি পুলিশ আক্রমণ করে, তবে হরিদাস দত্ত কোনভাবেই প্রথমে গুলি চালাবেন না। পরিকল্পনা অনুযায়ী শ্রীশ পাল ও খগেন দাস গুলি চালাবেন এবং সেই ফাঁকে গাড়ির চালক লুণ্ঠিত মালের বাক্স ভেঙে দুটি মাউজার পিস্তলের গুলি ভরে শ্রীশবাবুদের হাতে তুলে দেবেন—এবং এইভাবে ডালহৌসি স্কোয়ারকে রক্ত হোলিতে স্নান করিয়ে মরণকে বলবেন তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান। বলাবাহুল্য সেদিনের পথ চলায় বিদ্রোহীদের কাছে মৃত্যুকে তুচ্ছ করাতেই ছিল তাঁদের চরম তৃপ্তি, জীবনের সার্থকতা।১৩

‘রডা’ কোম্পানির সিংহদ্বার ছিল ‘ভ্যান্সিটার্ট রো’ দিকে যেতে–ডালহৌসি স্কোয়ারের দক্ষিণ দিকে। কাস্টমস্ এর অবস্থান ডালহৌসি স্কোয়ারের উত্তর-পশ্চিম কোণে, উভয়ের মধ্যে দুরত্ব অল্পই। শ্রীশ মিত্র (হাবু মিত্র) ছোটো খাটো চেহারার মানুষ। তিনি আর.বি.রডা অ্যান্ড কোম্পানির একজন ট্যালি ক্লার্ক বা মিল কেরাণি। সাধারনতঃ মিল কেরাণিকে কোম্পানির নিয়মিত কর্মী হিসাবে বহাল করা হত না; একমাত্র আমদানিকৃত পণ্য খালাস করা হয়েছে কিনা এবং কোম্পানির দেওয়া তালিকা মিলিয়ে আমদানিকৃত মাল খালাসের হিসাব রাখা। এই ধরণের টুকিটাকি কাজে নিযুক্তদের স্থূলবুদ্ধি বা বোকা লোক বলেই তারা মনে করত এবং এ-কারণেই তাঁকে ‘হাবু’-নামে ডাকাও হতো। শ্রীশ মিত্রও এরই সুযোগ নিয়েছিলেন, এবং আত্মোন্নতির সমিতির অনুকূল মুখার্জির প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষিত এই বোকা আপাত বালকটিই ছিলেন অপারেশন রডার অন্যতম কাণ্ডারী। দিনের ব্যস্ততম সময়ে সরকারের দুটি দুর্গ রাইটার্স বিল্ডিং এবং গভর্মেন্ট হাউজ এবং একশ’ গজের মধ্যেই লালবাজার—কি দুঃসাহসিক জীবনের ঝুঁকি নিয়েই সেদিন এই অপারেশনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল তা সহজেই অনুমেয়।১৪

শ্রীশ মিত্রের (হাবু মিত্র) বুদ্ধিতে গাড়োয়ান হরিদাস দত্ত ‘রডা’ কোম্পানির মাল-সরকার হিসাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে কোম্পানির অনুমতিসহ লিস্ট অনুযায়ী প্রথমে ছয়’টি গাড়ি উপস্থিত হলেন; সপ্তম গাড়িটির তখনও না আসায় তিনি নিজেই হন্তদন্ত হয়ে সপ্তম শকটটিকে (গাড়োয়ান হরিদাস মিত্র চালিত গরুর গাড়ি) তাড়া দিয়ে আনতে ছুটলেন। পূর্ব-নির্দেশ মতই হরিদাস দত্ত একটু দুরত্বে তাঁর গাড়িটিকে রেখেই যাচ্ছিলেন – তখন শ্রীশ মিত্র (হাবু মিত্র) গাড়ির কাছে এসে রাগ দেখানো গলায় হেঁকে বললেন “ইয়ে উল্লুকা পাঠঠা, জলদি কেঁও আয়ে নেহি?” ভ্যাবাচাকা খাওয়া গাড়োয়ান উত্তর দেয় – “হুজুর মেহেরবানি!” বলে গাড়োয়ান হরিদাস দত্ত গাড়ি এগিয়ে দেয়। সাতখানি গাড়ি নিয়ে শ্রীশ মিত্র (হাবু মিত্র) যথারীতি মাল খালাস করলেন। প্ল্যান অনুযায়ী সর্বশেষ গাড়িটিতে মাউজার পিস্তল, পিস্তলের কার্তুজ, স্প্রিং, খাপসহ ইত্যাদি মাউজার পিস্তলের সমস্ত সরঞ্জামসহ বাক্সগুলি তোলা হল। কাস্টমস্-এর ছাড়পত্র পাওয়া মালবাহী সাতটি গাড়িই ‘রডা’ কোম্পানির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।১৫

প্ল্যান অনুযায়ী একেবারে শেষে থাকা সপ্তম গাড়িটি ছিল গাড়োয়ান বিপ্লবী হরিদাস দত্তের। ভ্যান্সিটার্ট রো-র সম্মুখে এসে পূর্বগামী ছ’খানা গাড়িই বাহুবাবুর সঙ্গে রডা কোম্পানির উদ্দেশ্যে গলির মধ্যে ঢুকে গেল; শ্রীশ মিত্রের (হাবু মিত্র) ইঙ্গিতে গাড়োয়ান বেশ বিপ্লবী হরিদাস দত্ত শকট গাড়িটি সোজা পূর্বদিকে চালিয়ে দিলেন। তাঁর গাড়ির দু’পাশে সশস্ত্র শ্রীশ পাল ও খগেন দাস রক্ষীর মতো চলতে লাগলেন। হরিদাস দত্তের শকট গাড়িটি ‘ম্যান্টং কোম্পানি’ ও বর্তমান ‘কারেন্সি অফিসের’ মধ্যবর্তী রাস্তা (বর্তমান মিশন রো’) ঢুকতেই শ্রীশ মিত্রও (হাবু মিত্র) এসে যোগ দিলেন তাঁদের সঙ্গে। মিশন রো হয়ে শকট গাড়িটি ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্ট্রীট, বেণ্টিং স্ট্রীট পেরিয়ে চাঁদনি চক্-এর পাশ দিয়ে মলাঙ্গা লেন্-এ অনুকূল মুখার্জীর আস্তানায় পৌঁছে যায়। মঙ্গলা লেনে অনুকূল মুখার্জীর আস্তানার কাছে একটি খোলা জায়গা ছিল। সেখানে স্তূপীকৃত লোহালক্কড় জনাকীর্ণ জায়গায় সেগুলি অতি দ্রুততায় কালিদাস বসু ও ভূজঙ্গ ধর প্রমূখের সাহায্যে দফায় দফায় ঘোড়ার গাড়িতে জেলে পাড়ার ভূজঙ্গ ধরের গৃহে নিয়ে যাওয়া হয়। অল্প সময়ের মধ্যে বড় বড় এগারটি বাক্স এনে রডা কোম্পানি মার্কা (R. B. Rodda Co.) বাক্স থেকে ২১,০০০ রাউন্ড বুলেট ঐ বাক্স গুলিতে ভরা হল। এই বুলেট ভর্তি বাক্সগুলি আপাতত ভূজঙ্গ লেনেই থাকল। বাকি ২৮,৮০০ রাউণ্ড কার্তুজ ও পঞ্চাশটি মাউজার পিস্তলই ইতিমধ্যেই নেতারা বাঙলার সবগুলি বিপ্লবী দলের মধ্যে বণ্টন করা হয়।১৬

অস্ত্র বণ্টনে সে’দিন কোন দলাদলি করা হয়নি। নলিনীকিশোর গুহ তাঁর ‘বাংলায় বিপ্লববাদ’ গ্রন্থে লিখছেন “………এই হত্যাকাণ্ড (পুলিশ কর্তা বসন্ত চ্যাটার্জির হত্যা) ঢাকা (অনুশীলন) সমিতির লোকদের দ্বারা অনুষ্ঠিত হয়। ইহাতে ‘মসা’র পিস্তল ব্যবহৃত হইতে দেখা যাইতেছে। ‘মসা’র পিস্তল কলকাতায় একটি দল কর্তৃক (রডা আর্মস্ কেস)অপহৃত হয়। সুতরাং প্রমাণিত হইতেছে, –পিস্তলগুলি বিভিন্ন দলে বণ্টিত হইয়াছিল, অথবা অস্ত্রের লেনদেনের ব্যবস্থা হইয়াছিল।” ১৭ যদিও ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত রায় তাঁর ‘ভারতে সশস্ত্র বিপ্লব’ গ্রন্থে বলেন – “নলিনীবাবুর শেষের মন্তব্য ঠিক নয়। কারণ, বিশ্বস্তসূত্রেই জানা গিয়েছে যে, ‘মাউজার পিস্তল’ যতীন মুখার্জির নেতৃত্বে বাঙলার সকল দলই পান। এই বণ্টন-ব্যাপার ঘটে কর্মের তাগিদে, দলগুলোর ‘য়্যাক্শান্’ করার ক্ষমতাবৃদ্ধির সংকল্পে। এখানে ‘লেনদেনে’র প্রশ্ন কারো মনে আসেনি; কেউ তা ভাবেননি বলেই মনে হয়।”১৮ (ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত-রায়, ‘ভারতে সশস্ত্র-বিপ্লব’, রবীন্দ্র লাইব্রেরী, আষাঢ় ১৩৭৭, কলিকাতা; পৃষ্ঠা ১৩৯।)

রডা অস্ত্র লুঠের অ্যাকশান পরিকল্পনার অন্যতম কারিগর শ্রীশ পাল প্রমূখ প্রথম থেকেই জানতেন যে, “রডা কোম্পানির কর্তৃপক্ষ মাল ঠিক মত না-পৌঁছানর খবর পেতেই সর্বপ্রথম সন্দেহ করবেন শ্রীশ মিত্রকে (হাবু মিত্র)। তাই পূর্ব নির্ধারিত মতই সেদিনই বিকেলের দার্জিলিং মেলে হাবু মিত্রকে নিয়ে শ্রীশ পাল রংপুর রওনা হয়ে গেলেন। সঙ্গে নিলেন দুটি মাউজার পিস্তল ও বুলেট। রঙপুর ছিল হেমচন্দ্র ঘোষের মুক্তিসঙ্ঘের অন্যতম সাংগঠনিক ঘাঁটি। তাঁর নির্দেশেই এই অঞ্চলে সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডঃ সুরেন্দ্র বর্দ্ধনের কাছে নির্দেশ আসে শ্রীশ মিত্রের (হাবু মিত্র) জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করার। যার স্বীকৃতি মেলে ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত রায়কে লেখা একটি চিঠি থেকে – তিনি লিখছেন “ভাই ভূপেন, শ্রীশদা (শ্রীশ পাল) হাবুকে সণ্নগে করিয়া মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে সন্ধ্যার পরে কুলীর বেশে আমার ওখানে (নাগেশ্বরী, রঙপুর) আসেন এবং পরদিনই ভোরে (হাবুকে রাখিয়া ওরফে সুধীর মিত্র নামে তিনি থাকতে শুরু করেন) তিনি কলকাতায় ফিরিয়া যান। হাবু আমার কাছে মাস দুই ছিল। প্রথমে একটু সংগোপনেই থাকিত। কিন্তু স্বভাবত অত্যন্ত চঞ্চল বলিয়া শেষটায় সে আমার কথা শুনিত না, আমার ঘোড়া লইয়া ছুটাছুটি করিত। গ্রামের সকলের সাথে মেলামেশা করিল। ফলে সকলের নজরে পড়িয়া গেল, বিশেষত থানার লোকেদের। আমার উপর পুলিশের কিছু দৃষ্টি ছিল, তদুপরি নূতন লোক দেখিয়া এবং খাস কলকাতার ‘কথা’ উহার মুখে শুনিয়া পুলিশের সন্দেহ দানা বাঁধিয়া ওঠে। ………” ১৯

বেশ কয়েকদিন পেরিয়ে গেলে হাবু মিত্র (শ্রীশ মিত্র) আপিসে আসছেন না, কোন সংবাদ-ও পাঠাচ্ছেন না! রডা কোম্পানির খোঁজ নিয়ে জানতে পারে যে কাসটমস্ হাউসের কিছু মাল তাঁদের হেফাজতে আসে নি। কাসটম্স হাউসের সাথে যোগাযোগ করে রডা কোম্পানির সাহেবরা জানতে পারলেন যে তাঁদের সমস্ত মাল-ই শ্রীশ মিত্র (হাবু মিত্র) ২৬শে আগস্ট যথাসময়ে খালাস করে নিয়ে গেছেন। সাহেবদের টনক নড়ল এবং টেগার্টের কপালে চিন্তার ভাঁজ। তাঁরা জানতে পারলেন যে দিনসাতেক আগেই গাড়িবোঝাই অস্ত্র দিনে-দুপুরেই বিপ্লবীরা সরিয়েছেন! বিপ্লবীদের হাতে এই আধুনিক মারণাস্ত্র! কলকাতায় রীতিমতো ঢাক-ঢোল পিটিয়ে খবরটি ছড়ানো হল, এবং যাঁরা নিজের বাড়িতে নূতন ভাড়াটে দিয়েছেন তারা অতি শীঘ্রই যেন সেই ভাড়াটেদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য স্থানীয় থানায় অবগত করান।২০

ইতিমধ্যে শ্রীশ পাল হরিদাস দত্ত প্রমুখেরা চিন্তিত ছিলেন ২১,০০০ হাজার কার্তুজের নিরাপত্তা নিয়ে। কেননা ভূজঙ্গ লেন থেকে বড় বাজার অঞ্চলে বাঁশতলার এক মারোয়াড়ীর ব্যবসায়ীর গুদামে কয়েকবারের চেষ্টায় সরানো হলেও সেই স্থানটি নিয়ে বিপ্লবীরা চিন্তামুক্ত ছিলেন না। জোড়াবাগান থানা বাঁশতলার গুদামঘরটির ওপর নজর রাখতে শুরু করে কনস্টেবল আলী হোসেন মারফত। শ্রীশ পাল হরিদাস দত্তকে ডেকে পাঠান এবং বাঁশতলার গুদামের দারোয়ানকে জানিয়ে আসতে বলেন য়ে আগামীকাল দুপুরেই তারা গুদাম খালি করে দেবেন। পরের দিন সকাল ৯টার মধ্যেই হরিদাস দত্ত দারোয়ান শুকদেওকে সেই কথা জানালেন। কিন্তু শুকদেও আলি হোসেনের প্রলোভন জালে জড়িয়ে পড়তে পারেন, সেই আশঙ্কা করেই তিনি শুকদেও-এর কথায় অপেক্ষা না করেই দু-একপা করে সদর দরজার কাছে আসতেই কনস্টেবল আলি হোসেন উপস্থিত। শুকদেও আলী হোসেনকে দেখে বললেন ”ইয়ে বাবা আ গয়ে”। আলী হোসেন হরিদাস দত্ত-র দিকে এগিয়ে এসে বললেন “থানায় চলুন”।

আপত্তি করার কোন উপায় নেই দেখে তিনিও গলির পথে কয়েক পা এগুতেই বাড়ির সম্মুখে পড়ে থাকা বাড়ি মেরামতির বস্তু পরে আছে দেখে উপস্থিত বুদ্ধিবলে একটু থেমে জুতোয় বালি ঢুকেছে এই ভাব দেখিয়ে নীচু হাতের মুঠোয় বালি নিয়ে আলী হোসেনের চোখে সেই বালি ছুঁড়ে দিয়েই দৌড় দিলেন। অপ্রস্তুত আলী হোসেন চোখ রগরাতে রগরাতে প্রাণপণে চিৎকার করে “ডাকু ভাগতা হ্যায়।” ইতিমধ্যে হরিদাস দত্ত গুদামঘরের চাবিটি সবার অজ্ঞাতেই আধো-ঢাকা ম্যান্হোলের মধ্যে ফেলে দেন। বড়বাজার অঞ্চলে সকাল ৯-১০টার সময় ডাকু-ভাগতা হ্যায় ধ্বনি তুললে জনসমুদ্র বেষ্টনিতে আবদ্ধ হবেন—সেটাই স্বাভাবিক। অবশেষে হরিদাস দত্তকে সাধারণের বেশে নয় রীতিমতো ডাকুর বেশেই তাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হল। খবর পেয়েই টেগার্ট-লোম্যান-ম্যাক্লিয়োর প্রমূখ পুলিশের বড় কর্তারা উপস্থিত। থানায় এসেই হরিদাস দত্তকে দেখে টেগার্ট বলে উঠলেন “Hallow, Royal Bengal Tiger! Now you are bagged!” ২১

বিশাল পুলিশ বাহিনী সহকারে হরিদাস দত্তসহ পুলিশকর্তারা বাঁশতলার গুদাম বাড়িতে পৌঁছলেন। কিন্তু পুলিশ কর্তাদের দুর্ভাগ্য তারা রডা কোম্পানির সমস্ত মাল উদ্ধার হল এই ভেবে একটু স্বস্তি বোধ করতে শুরু করতেই, অবশেষ তল্লাশিতে মিলল শুধুমাত্র পড়ে থাকা ২১.০০০ হাজার কার্তুজ। একটি মাউজার পিস্তলও তারা পেলেন না, উপরন্তু ২৮,৮০০ রাউণ্ড কার্তুজ উধাও। শ্রীশ মিত্র (হাবু মিত্র) উধাও হয়েছেন, এই কথাটি জানাজানি হতেই তাঁর সঙ্গে যাদের যাদের যোগাযোগ থাকে, খুঁজে খুঁজে তাদের নামের একটি তালিকা করে অনুকূল মুখার্জি, কালিদাস বসু, গিরীন ব্যানার্জি, নরেন ব্যানার্জি, ভূজঙ্গ ধর, বৈদ্যনাথ বিশ্বাস, সতীশ দে, উপেন সেন, প্রভুদয়াল হিম্মৎসিংকা ও আশুতোষ রায়কে গ্রেপ্তার করে পুলিশ কিছুটা স্বস্তি বোধ করল। যদিও শ্রীশ পাল, খগেন দাস গা-ঢাকা দিতে পেরেছিলেন। শ্রীশ পালের নরেন দত্ত নামেই গা ঢাকা দেন।২২

হরিদাস দত্তের গ্রেপ্তারের সাথে সাথেই পুলিশের পক্ষে মামলা সাজানোয় সুবিধে হল; তাদের হাতে আসা তথ্যের ভিত্তিতে এবং সিআইডি রিপোর্টে ভিত্তিতে টেগার্টগোষ্ঠী একটি সুন্দর রোমাঞ্চকর মামলা সাজালো। দীর্ঘ সাত মাস ধরে “রডা আর্মস কন্সপিরেসি’’ নামক মামলা চলল। কিন্তু আদালতে মামলার স্বপক্ষে প্রত্যক্ষ প্রমাণসহ যোগাযোগ তেমনভাবে উপস্থিত করতে না পারায় (শেষপর্যন্ত তিনি বুদ্ধিকরে চাবিসহ ধরা না পরায়) হরিদাস দত্ত ও কালিদাস দত্ত, ভূজঙ্গ ধর ও নরেন ব্যানার্জির দু’বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড হলো। এই চারজন ছাড়া বাকি সকলকেই উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে মুক্তি পান। হরিদাস দত্তকে Circumstantial evidence -এর জোরে এবং তাঁর হেফাজতে বুলেট পাওয়া গেছে এই অভিযোগে এনে সর্বমোট চারবছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। দীর্ঘ চার বছর তিনি প্রেসিডেন্সি জেলের চুয়াল্লিশ ডিগ্রি ও নরক্সম জাল্ডিগ্রীতে তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদীর জীবন কাটান। কয়েদকাল শেষ হতেই তাঁকে আবার জেলের গেটেই ‘তিন আইনে’ স্টেট-প্রিজনার করে হাজারিবাগ সেন্ট্রাল জেলে বন্দী অবস্থায় রাখা হয়।২৩

রডা-অভিযানের চিন্তা ও কর্ম নায়ক শ্রীশ পাল ১৯১৬ সালের প্রথম দিকে ধরা পরে ‘তিন আইনে বন্দী’ হন। State Prisoner রূপে নানা জেলে ঘুরিয়ে, শেষে হাজারিবাগ জেলে তাঁকে রাখা হয়, অপরাপর রাজবন্দীদের সাথে। ১৯১৯ সালের শেষের দিকে তিনি মুক্তি লাভ করলেও বহু অজ্ঞাতবাস ও কারাগারের নির্যাতনে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়েছিল। লোকসমাজে ফিরে এলেও তাঁর শরীরের কর্মশক্তি বহু চিকিৎসা, বহু চেষ্টাতেও ফেরানো যায়নি। এই দুর্জয় পুরুষ সবার অজ্ঞাতেই ‘বেঙ্গল ভলাণ্টিয়ারস’-এর পূর্বাপর প্রত্যেকটি কর্মপ্রচেষ্টায় সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছেন। ভগ্নস্বাস্থ্যে তিনি নানাভাবে বিপ্লবী কাজে পরামর্শ দিতেন। সবার একপ্রকার অজ্ঞাতেই এই নিষ্কাম কর্মযোগী মহান্ বিপ্লবী ১৯৩৯ সালে মৃত্যুঞ্জয়ীকুলের সঙ্গে মিলিত হতে দেহরক্ষা করেন। বিপ্লবী শ্রীশ পালের নাম আজকের প্রজন্মের বাঙ্গালী জানে না। তাঁর মতো নিষ্কাম সাধকের কথা যে জাতি ভুলে যায় সে জাতির অবক্ষয়ই স্বাভাবিক!২৪

ভারতের সশস্ত্র-বিপ্লবের ইতিহাসে ‘রডা অস্ত্র-হরণ’ ন্যায় দুঃসাহসিক কর্মের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই ঘটনার অন্যতম রূপকার বিপ্লবী হরিদাস দত্ত লিখছেন, — — ওব্রায়ন হত্যা ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেলে “আমি পলাতক হলাম এক সমুদ্রগামী জাহাজের স্টোর কীপার হয়ে। ……… তারপর প্রথম মহাযুদ্ধের সময় এসে গেল। ১৯১৪ সাল। মহানায়কদ্বয় যতীন মুখার্জী ও রাসবিহারী বসু সমগ্র বিপ্লবী দলগুলি নিয়ে সারা ভারতবর্ষে একটি সশস্ত্র বিপ্লবের পরিকল্পনা করবার আগে অস্ত্র-শস্ত্র সংগ্রহের জন্য তৎপর হলেন। ………… ষড়যন্ত্র পাকাপোক্ত হলে জাহাজ বোঝাই অস্ত্র আসতে পারে, প্রচুর অর্থও পাওয়া যেতে পারে—কিন্তু তার আগে তো কিছুটা অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে তৈরি থাকা চাই। স্মাগল্ করা রিভালবার-পিস্তলে প্রকৃত লড়াই চলে না। সুতরাং নেতারা অস্ত্র-সংগ্রহের নূতন পদ্ধতি আবিষ্কারে তৎপর। এমন সময় বিপিনবাবুদের তরুণ বন্ধু হাবু মিত্র একটি সংবাদ দিলেন যে রডা কোম্পানী ২৬শে আগস্ট (১৯১৪) তারিখে বহু অস্ত্র-শস্ত্র কাস্টম অফিস থেকে খালাস করে নিচ্ছে……”।২৫ তিনি লেখেন “কার্য সমাধা হবার পর ব্রিটিশ সরকার যেমন সন্ত্রস্ত্র হয়ে উঠেছিল।……… মহাযুদ্ধ সমাগত। সেই যুদ্ধের সৈনিক হবার পূর্বে অস্ত্রের প্রয়োজন। সেই অস্ত্র এসেছে।………১৯১৪ সাল হইতে অনুষ্ঠিত বিপ্লবীদের যুদ্ধকালীন যত ভয়াল অ্যাকশন, তার মূলে প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই রডার অস্ত্রাগার হইতে লুণ্ঠিত ‘মাউজার’-এর শক্তি। এবং এই কারণেই আমি বলব যে, ‘রডা অ্যাকশন্’ শুধু দুঃসাহসিক ও চমকপ্রদ নহে—ইহার পলিটিক্যাল গুরুত্ব প্রচুর।…”২৬

প্রখ্যাত অধ্যাপক শ্রী সুবোধ চন্দ্র সেনগুপ্ত তাঁর ‘India Wrests Freedom’ গ্রন্থে লিখেছেন “Few ‘actions’ in the entire history of the Indian revolutionary movement were more intricate, more daring and yet more neatly accomplished, and this achievement was due primarily to the ingenuity and courage of three men—Srishchandra (Habu) Mitra, Srishchandra Pal and Haridas Datta. ২৭

এদিকে হরিদাস দত্তের গ্রেপ্তারের খবরের সাথে সাথেই সুরেন্দ্র বর্দ্ধনকে সতর্ক করা হয়। সুরেন্দ্র বর্দ্ধনের লেখা পত্র থেকে জানতে পারি “আমার উপর পুলিশের কিছু দৃষ্টি ছিল, ……আমি পুলিশের গতিবিধি দেখিয়া এইরূপ অনুভব করি। থানার সহকারী দারোগা আমার অনুগত ছিল। একদিন সে আমাকে জানাইল যে, কলিকাতা হইতে আই-বি পুলিশ আসিতেছে, বোধহয় আমার বাড়ি সার্চ হইবে। আমি সেইদিনই সন্ধ্যায় হাবুকে হরিদাস দত্তের ছোট ভাই যামিনী দত্ত (বর্তমানে স্বর্গগত) ও আমার বিশেষ বন্ধু এবং একান্ত বিশ্বাসী নীলকমল দাসের (বৈরাগী) হেপাজতে আসামের সীমান্তে রাভাদের নিকট পাঠাইয়া দিই। পরের দিনই পুলিশ আমার বাড়িঘর ও ডিস্পেসারি তালাসি করিতে আসে এবং হাবু মিত্রকে না পাইয়া বড়ই হতাশ হয়। ………ইহার পর বহুদিন ধরিয়া নানা দিকে লোকজন পাঠাইয়া পুলিশ হাবু মিত্রকে খোঁজ করিয়াছিল। এবং আমাকেও কড়া নজরে রাখিয়াছিল। হাবু আসাম সীমান্তে ‘রাভা’ নামক পার্বত্যজাতিদের মধ্যে ছিল। আমাদের জানিত একটি রাভা-যুবক উহার সঙ্গী। হাবুকে ‘রাভা’রা মহিষ চড়াইবার কাজে লাগাইয়াছিল। ………দীর্ঘকাল কয়েদখানায় থাকার পর আমরা সকলে বাহিরে ফিরিয়া আসিয়া আসাম-সীমান্তবাসী রাভা’দের আস্তানায় খোঁজ লইয়া জানিতে পারি যে, হাবু এবং উক্ত রাভা-যুবক ওই আস্তানা হইতে বহুদিন ধরিয়া নিরুদ্দেশ হইয়াছে। সুতরাং হাবুর শেষ পরিণতি অজ্ঞাত ফ্রন্টিয়ার পাড়ি দিবার চেষ্টায় ঘটিয়াছে বলিয়া আমার-ও ধারণা। তাহার মত প্রাণবন্ত, সাহসী ও দুর্দান্ত যুবকের পক্ষে এবম্বিধ চেষ্টা করাই স্বাভাবিক। আমার দীর্ঘকাল জেলে থাকায় জন্যই হাবুর মত কর্মী নিখোঁজ হইয়া গেল। ইহা আমার কাছে কঠিন বেদনাদায়ক বস্তু হইয়া রহিয়াছে। তবে যেভাবেই হউক দুর্গম স্থানে তাহার যে ‘শহীদের মৃত্যু’ হইয়াছে এই বিষয়ে আমার সন্দেহ নাই।” ২৮

‘রডা অস্ত্র-লুণ্ঠন’-এর রাজনৈতিক গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত-রায় লিখেছেন-“রডা অস্ত্র-লুণ্ঠন’ একটি বিচ্ছিন্ন লুটতরাজের কাহিনী নয়। বাঙলার বিপ্লবীদের সর্বভারতীয় বিপ্লব-অভ্যূত্থান সংক্রান্ত কার্যক্রমের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে ওই বৈপ্লবিক-কার্য জড়িত।”২৯

পুলিশের রেকর্ডে এবং তৎকালীন আই-বি স্পেশাল সুপারিন্টেডেন্ট টেগার্ট লিখছেন “Our enquiries showed that the members of Hem Ghoshe’s Party had amalgamated in Calcutta with the remnants of the old Attonnati Samiti.” (Tegart’s printed note on the revolutionary movement in Rangpur, March 1, 1915; vide—Two Great Indian Revolutionaries’, p. 46-48)৩০ এর পরেই আই-বি স্পেশাল সুপারিন্টেণ্ডেন্ট টেগার্ট লেখেন “The gang responsible for this theft is connected with Hem Ghoshe’s party in Dacca.” (I.B Records, Govt. of West Bengal,–F. No. 1030,–1914)। এর পরের উদ্ধৃতিতে ভবিষ্যৎ কলকাতার পুলিশ কমিশনার টেগার্ট লেখেন –The conspiracy which culminated in this commenced in March, 1914, when we received information from a confidential source to the effect that two prominent members of Hem Ghose’s party, named Haridas Dutta and Khangen Das had been sent to Calcutta by Hem Ghose with object of arranging an assassination on behalf of revolutionary party.”৩১

যদিও টেগার্টের রিপোর্টে হেম ঘোষের দলের দ্বারা গুপ্ত হত্যা সংঘটিত হবার কথা বলা হলেও, রডার কোন উল্লেখ নেই। এবং ওব্রায়েন হত্যার পরিকল্পনা পুলিশের কাছে ফাঁস হয়ে যাওয়ার সেই কর্মসূচী বাতিল করতে হয়, এবং মনে রাখতে হবে শ্রীশ পাল, হরিদাস দত্ত এবং খগেন দাস সঙ্গে সঙ্গে পলাতক ছিলেন বেশ কিছুদিন। অর্থাৎ ‘রডা’র পরিকল্পনা পুলিশ আঁচ করতেই পারেনি। পরবর্তী কালে বলেছিলেন এই রডা’র অস্ত্রেই ১৯১৪-১৭ সালের মধ্যে বিপ্লবীরা ৪৪টি সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা করেছিল। যার মধ্যে ২৭জন ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়, ৪৪ জন আহত এবং প্রায় ৩,৬৭,৪৮০ টাকা লুঠ করতে সক্ষম হয়েছিল। রাওলাট কমিশন যে সিডিশন অ্যাক্টের সুপারিশ করেছিল তার পিছনে এই সময়ের বৈপ্লবিক কার্যকলাপের ভূমিকাই ছিল প্রধান। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে রাওলাট অ্যাক্টের বিরুদ্ধে যে অহিংস-সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ডাক শ্রী মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী দিয়েছিলেন তার পশ্চাতে এই ‘রডা অস্ত্র-লুঠ’-এর ঘটনার প্রত্যক্ষ ভূমিকাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। উড়িষ্যার বালেশ্বরে ৯ই সেপ্টেম্বর ১৯১৫ সালের বুড়িবালামের যুদ্ধেও যতীন মুখার্জী ও তাঁর চার সহযোগী এর রডা’র লুণ্ঠিত অস্ত্রে সজ্জিত হয়েই দেড় ঘণ্টা ব্যাপী বিশাল পুলিশের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রীতিমত ট্রেঞ্চে কেঁটে যুদ্ধ করেছিলেন।৩২

তাই রডা অস্ত্রহরণের ঘটনা তাৎপর্য বহুমুখী। সুবোধ চন্দ্র সেনগুপ্ত লিখছেন –“I find in this episode an element of irony which has not occurred to the many people who have rightly praised the dauntless courage of the martyrs and the infinite resourcefulness of their leaders. No one has said a word about the unknown clerk who silently slipped out of the world so that others might fight and who their way to freedom. It is said that the world does not know its greatest men. How soon, I wonder, nations forget their nobelest heroes!”৩৩

ইতিহাসাচার্য ডঃ রমেশ্চন্দ্র মজুমদার লিখেছেন ভারতের মুক্তিসংগ্রামে বিপ্লববাদ যে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে সে সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই। স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরে, মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতির প্রভাবে ও কংগ্রেসদলের প্রাধান্য ও প্রচারের ফলে এ-সত্যটি অনকেই প্রকাশ্যে স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হতেন। কিন্তু যা সত্য তা; কেউ কোনদিন চেপে রাখতে পারে না। তাই আজ বিপ্লবীদের অবদান দেশে স্বীকৃতি পেতে আরম্ভ করেছে।………”।৩৪ কিন্তু আমার প্রশ্ন আজকের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস পাঠক্রমে এবং সহায়ক গ্রন্থপঞ্জীর তালিকায় সশস্ত্র বিপ্লব সম্পর্কে কোন গবেষণা গ্রন্থের যথেষ্ট অভাব এবং তা অস্বীকার করার উপায় নেই। স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবের ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা এবং বিপ্লবীদের আত্মোত্যাগের কথা আমাদের প্রজন্ম এমনকি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অজানাই থেকে গেছে। উপরন্তু একদল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় নূতন আঙ্গিকে সেই অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের সম্বোধিত করা হচ্ছে ‘Gentlemanly Terrorist’ অভিহিত করা হচ্ছে।৩৫

সশস্ত্র বিদ্রোহ এবং বিপ্লবের জন্য সর্বস্বত্যাগী বিপ্লবীদের একদল ইতিহাস ব্যাপারী সাম্রাজ্যবাদীদের ক্রীড়ানকে পরিণত হয়ে এখনও তাদের সন্ত্রাসবাদী তকমা দিয়ে চলেছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হল এঁরাই বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গদি আগলে, বসে রয়েছে; এবং দেশদ্রোহী এবং বিশ্বাসঘাতক এবং সাম্রাজ্যবাদীদের হয়ে ওকালতি করা তাদের তল্পিবাহকদের স্বাধীনতা সংগ্রামী আখ্যা দিয়ে অর্চনার বেদীতে বসানো হয়েছে। একজন ভারতীয় ও বাঙ্গালী হিসাবে আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ হল যে গত সাত দশকের বেশি সময় ধরে কংগ্রেস ও মার্কসবাদী ঐতিহাসিকগোষ্ঠীর লেখা মিথ্যা ও প্রবঞ্চনার ইতিহাস এখনও আমাদের পড়তে হচ্ছে এবং পড়াতে হচ্ছে। আর বিস্মৃতির অন্তরালেই থেকে যাচ্ছে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকৃত ইতিহাস।

 

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী:
১) Sen Gupta, Subodh Chandra, India Wrests Freedom’ chapter 3; 1982 Sahitya Samsad, p. 28-29.

২) রক্ষিত-রায়, ভূপেন্দ্রকিশোর, ‘সবার অলক্ষ্যে’, ১৯৬৬; কলিকাতা, পৃষ্ঠা ৩-৪।

৩) Sen Gupta, India Wrests Freedom’ chapter 3; p. 29.
৪) Sedition Committee Report, 15th April 1918, Mr. Justice Rowlatt of King’s Bench, Division of His Majesty’s High Court of Justice of President. Calcutta, Superintendent. Government Printing, P.66.
৫) রক্ষিত-রায়, ভূপেন্দ্রকিশোর ‘সবার অলক্ষ্যে’, পত্র সংগ্রহ (এক নং) শ্রীহরিদাস দত্ত (১০.৮.৬৫); ১৯৬৬, কলিকাতা, পৃষ্ঠা-২২১-২২২।
৬) রক্ষিত-রায়, ‘সবার অলক্ষ্যে’, পৃষ্ঠা ৩-৪।
৭) তদেব পৃষ্ঠা ৪।
৮) রক্ষিত-রায়, ভূপেন্দ্রকিশোর, ‘ভারতে সশস্ত্র-বিপ্লব’, রবীন্দ্র লাইব্রেরী, আষাঢ় ১৩৭৭, কলিকাতা; পৃষ্ঠা ১৩১-১৪৭।
৯) রক্ষিত-রায়, ‘সবার অলক্ষ্যে’, পৃষ্ঠা ৪-৫।
১০) রক্ষিত-রায়, ‘ভারতে সশস্ত্র-বিপ্লব’, পৃষ্ঠা ১৩১-১৪৭।
১১) রক্ষিত-রায়, পত্র সংগ্রহ, শ্রীহরিদাস দত্ত। পৃষ্ঠা-২২১-২২২।
১২) রক্ষিত-রায়, ‘সবার অলক্ষ্যে’, পৃষ্ঠা ৪-৫।
১৩) তদেব, পৃষ্ঠা ৫-৬।
১৪) রক্ষিত-রায়, ভূপেন্দ্রকিশোর, ‘ভারতে সশস্ত্র-বিপ্লব’, রবীন্দ্র লাইব্রেরী, আষাঢ় ১৩৭৭, কলিকাতা; পৃষ্ঠা ১৩১-১৪৭।
১৫) রক্ষিত-রায়, ‘সবার অলক্ষ্যে’, পৃষ্ঠা ৮-৯।
১৬) রক্ষিত-রায়, ‘সবার অলক্ষ্যে’, পৃষ্ঠা ৮-৯।

১৭) গুহ, নলিনীকিশোর, ‘বাংলায় বিপ্লববাদ’ এ মুখার্জী এণ্ড কোং লিমিটেড, কলিকাতা পরিবর্ধিত সংস্করণ, বৈশাখ, ১৩৬১; পৃষ্ঠা ১১৬-১১৭।
১৮) রক্ষিত-রায়, ‘ভারতে সশস্ত্র-বিপ্লব’, পৃষ্ঠা ১৩১-১৪৭।
১৯) রক্ষিত-রায়, ভূপেন্দ্রকিশোর ‘সবার অলক্ষ্যে’, পত্র-সংগ্রহ দুই ও তিন নং পত্রদ্বয়, সুরেন্দ্র বর্দ্ধন লিখিত; ১৯৬৬, কলিকাতা, পৃষ্ঠা-২২৯-২৩৩।
২০) তদেব, ‘সবার অলক্ষ্যে’, পত্র-সংগ্রহ দুই ও তিন, সুরেন্দ্র বর্দ্ধন পৃষ্ঠা-২২৯-২৩৩।
২১) রক্ষিত-রায়, ‘ভারতে সশস্ত্র-বিপ্লব’, পৃষ্ঠা ১৩১-১৪৭।
২২) রক্ষিত-রায়, ‘সবার অলক্ষ্যে’, পৃষ্ঠা ৯-১১।
২৩) রক্ষিত-রায়, ‘সবার অলক্ষ্যে’, পত্র সংগ্রহ (এক নং) শ্রীহরিদাস দত্ত (১০.৮.৬৫); ১৯৬৬, কলিকাতা, পৃষ্ঠা-২২১-২২৯।
২৪) রক্ষিত-রায়, ভূপেন্দ্রকিশোর ‘সবার অলক্ষ্যে’, পত্র সংগ্রহ (এক নং) শ্রীহরিদাস দত্ত (১০.৮.৬৫); ১৯৬৬, কলিকাতা, পৃষ্ঠা-২২১-২২৯।
২৫) রক্ষিত-রায়, ভূপেন্দ্রকিশোর ‘সবার অলক্ষ্যে’, পত্র সংগ্রহ (এক নং) শ্রীহরিদাস দত্ত (১০.৮.৬৫); ১৯৬৬, কলিকাতা, পৃষ্ঠা-২২১-২২২।
২৬) দত্ত, হরিদাস, ‘রডা কোম্পানির অস্ত্রহরণের তাৎপর্য প্রবন্ধ, পৃষ্ঠা ৪৩-৪৭; ‘অগ্নিযুগ’ – শৈলেশ দে সম্পাদিত; পূর্ণ প্রকাশন, ১৯৫৮।
২৭) Sen Gupta, Subodh Chandra, India Wrests Freedom’ chapter 3; 1982 Sahitya Samsad,
p. 38-39.
২৮) Tegart’s printed note on the revolutionary movement in Rangpur, March 1, 1915; vide—Two Great Indian Revolutionaries’, p. 46-48
২৯) দত্ত, হরিদাস, ‘রডা কোম্পানির অস্ত্রহরণের তাৎপর্য প্রবন্ধ, পৃষ্ঠা ৪৩-৪৭; ‘অগ্নিযুগ’ শৈলেশ দে সম্পাদিত; পূর্ণ প্রকাশন, ১৯৫৮।
৩০) Tegart’s printed note on the revolutionary movement in Rangpur, March 1, 1915; vide—‘Two Great Indian Revolutionaries’ Uma Mukherjee, p. 46-48.
৩১) I.B. Records, Govt. of West Bengal, — F. No. 1030,–1914.
৩২) রক্ষিত-রায়, ভূপেন্দ্রকিশোর, ‘সবার অলক্ষ্যে’, ১৯৬৬; কলিকাতা, পৃষ্ঠা ১৩-১৪।
৩৩) তদেব , Sen Gupta, p. 38-39. Sen Gupta, Subodh Chandra, India Wrests Freedom’ chapter 3; 1982 Sahitya Samsad, p. 38-39.
৩৪) ইতিহাসাচার্য রমেশচন্দ্র মজুমদার: রচনা ও সংগ্রহ ও প্রসঙ্গ, ‘রাখাল বেণু’, ১৪০৫; পৃষ্ঠা ৩০-৩২, পুনঃপ্রকাশ।
৩৫) Ghosh, Durba ‘Gentlemanly Terrorost : Political Violence and the Colonial State in India, 1919-17. Critical Perspectives on Empire; New York, Cambridge University Press, 2017.
https://www.livehistoryindia.com/cover-story/2019/09/08/a-great-robbery-that-shook-the-raj
https://amitabhagupta.wordpress.com/2019/02/09/anatomy-of-a-100-year-old-arms-heist/

Comments (1)

  1. তথ্যপূর্ন

Comment here