Masculine Hinduism শব্দ দুটি আজকাল আর দেখতে পাওয়া যায় না বিশেষ। যদিও একসময় এ দুটির প্রচলন ছিল বৃহৎ আকারে। এক্ষেত্রে প্রথম প্রশ্ন যেটি উদ্ভুত হয় তা হলে সেটি কোন সময়। অবশ্যই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ; সমগ্র বঙ্গভূমির আকাশ হিন্দু মেলার নাদে কম্পিত। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের এক দশকের মধ্যেই তার সূত্রপাত। একমাত্র প্রসঙ্গ হিন্দু জাতির পুনরুত্থান; তাই জাতির এহেন উন্নতির জন্য যা সর্বাগ্রে প্রয়োজন অর্থাৎ কায়িক/দৈহিক বা শারীরিক সক্ষমতার অর্জন তার সুচনাকল্প হয়েছিল এই সময়েই; পরবর্তীকালে, বহু ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতানুযায়ী এটিই বঙ্গ তথা ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মহাসংগ্রামের সূতিকাগার। অবশ্য, প্রদীপ জ্বালানোর পূর্বে থাকে সলতে পাকানোর কাজ। সেই সলতে যে কবে থেকে পাকানোও শুরু হল সে বিষয়ে ইতিহাস কিঞ্চিৎ নীরব যদিও তার অন্যতম অনুপ্রেরণার স্থল যে রাজা রামমোহন রায়ের প্রায়-একক সংগ্রাম তা বলাই বাহুল্য। স্বীয় অকল্পনীয় প্রতিভা ও সংগ্রামের প্রতিস্পর্ধা নিয়ে রাজার আকস্মিক উত্থান বঙ্গের সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে যে প্রায় ঈশ্বরের আশীর্বাদ তুল্য তা বলার অপেক্ষা রাখে না। হিন্দু সমাজে প্রচলিত শত শত বছরের কু-রীতিকে, শাস্ত্রীয় নির্দেশকে অমান্য করে দেশাচারের ভিত্তিতে গঠিত নারীত্বের ভয়াবহ অবমাননাকারী সতীদাহ প্রথাকে যে প্রকার ধ্বংস করলেন অকাট্য যুক্তি ও স্পর্ধায় তা শুধুমাত্র শিক্ষিত বাঙ্গালীকে আপ্লুতই করেনি শুধু, শক্তির অন্য প্রকাশ রূপেই তা বন্দিত হয়েছে। রাজার লেখায় যে অমোঘ জাতীয়তাবাদ প্রকট হয়েছে তাও বাঙ্গালীকে বুঝিয়ে দিল – অনাচার, অত্যাচার রুখতে প্রয়োজন বলের, মানসিক ও শারীরিক।
বাঙ্গালী স্মরণ করল পুনরায় আর্য সনাতন হিন্দু শাস্ত্রে বর্ণিত – ঈদম শাস্ত্রম ঈদম শস্ত্রম শাপাদাপি শারাদাপি – জ্ঞানের শক্তির চর্চা ও শক্তির জ্ঞানের চর্চা তুল্যমূল্য নয় শুধু, একে অপরের পরিপূরকও। ………………৯০০ বছরের ঐসলামিক যথেচ্ছাচার যে বাঙ্গালীকে অবরুদ্ধ করেছিল প্রত্যেক স্তরেই, সেই লৌহ দরজা কিঞ্চিৎ প্রশস্ত হয়েছে ইংরেজের রাজ্ সিংহাসনে আরোহণের পরে। যদিও সে ক্রুর ও বন্য, নিজ স্বার্থ রক্ষার্থে।
হিন্দু মেলায় যা ঘোষিত হল – স্বদেশহিতৈষিণা/স্বদেশিকতাই শ্রেষ্ঠ ও তাই ধর্ম……জননী জনভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরিয়সী……এবং অস্তিত্ব রক্ষার্থে বাঙ্গালীকে সাধনা করতে হবে শক্তির, আধুনিক সমরবিজ্ঞানসম্পন্ন সমাজ গোড়ায় তার একমাত্র ব্রত। ………সমগ্র বঙ্গে বয়ে চলে হিন্দুর মধ্যে এক তীব্র তেজস্বীতা, শক্তির পথে রত থাকার নব মার্গের অন্বেষণের। দিকে দিকে গড়ে ওঠে আখড়া; জিমন্যাসিয়ামের মধ্যে দিয়েই জাতির স্ফুরণের নায়কের স্থানে আসীন তিন ব্যক্তি – নবগোপাল মিত্র, প্রিয়নাথ বসু ও হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথ স্বল্পায়ু হলেও শারীরিক বল, মল্লযুদ্ধ, যোগ ও নিনিজিৎসুতে তাঁর প্রতিভা অসামান্য, বঙ্গের তৎকালীন যুব সম্প্রদায়ের কাছে আদর্শ স্বরূপ। বাঙ্গালী পান করতে শুরু করল বীররসের।……যা এতদিন সংরক্ষিত ছিল উপন্যাসের পৃষ্ঠায়, রাজপুত তথা মারাঠা, শিখ ও প্রতাপাদিত্য, সীতারামের বীরত্বের ধ্বজা ও শার্দুলসম আগ্রাসন তাতে দীক্ষিত হতে শুরু হল বাঙ্গালীর।…..ক্রমশ আবির্ভূত হবেন স্বামী বিবেকানন্দ, ভগিনী নিবেদিতা ও সরলা দেবী চোধুরাণী। Masculinity র সংজ্ঞা কি পরিবর্তিত হচ্ছে? পৌরুষ যে জন্মাবধি শুধুমাত্র পুরুষের অধিকারে তা সুনিশ্চিত করল কে? আক্ষরিক অর্থে পৌরুষ হল পুরুষোচিত আচরণ ও ধর্ম, সাহসিকতা, দৃঢ়তা, পরাক্রম, তেজ, পুরুষকার।….ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যের মহারাণী ভবশঙ্করী, ঝাঁসির রাণী লক্ষীবাঈ কি ব্যতিক্রম?
এহেন মহীয়সীরা যদি সার্থক পুরুষাকারের বৃত্তে না অঙ্গীভূত হন তাহলে কি রণশ্রেষ্ঠ সেই পুরুষকে অভিহিত করা হবে যিনি আপন স্বার্থে পুরনারী/গৃহলক্ষীদের মর্যাদা বিসর্জন দিতে সদা তৎপর!! ধর্মশাস্ত্র এক্ষেত্রে দ্বিধাহীন; devoid of any qualm….ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙ্গালীর শক্তি উপাসনায় বান ডাকলো স্বামী বিবেকানন্দের আবির্ভাব ও স্পর্শে। ১৮৯৭ সালে আমেরিকা হতে প্রত্যাবর্তনের পর শহর কলকাতায় তাঁর গণ সংবর্ধনায় স্বামীজী বলে উঠলেন, “….’আশিষ্ঠ দ্রঢ়িষ্ঠ বলিষ্ঠ মেধাবী’ যুবকদের দ্বারাই এই কাজ সম্পন্ন হবে।…এই রকম হাজার হাজার যুবক রয়েছে।…ওঠো,জাগো,জগত্ তোমাদের ডাকছে।..অন্যান্য জায়গায় বুদ্ধিবল আছে,ধনবল আছে, কিন্তু কেবল আমার মাতৃভুমিতেই উত্সাহাগ্নি বিদ্যমান।এই উত্সাহাগ্নি প্রজ্জ্বলিত করতে হবে;অতএব হে…যুবকগণ, হৃদয়ে এই উত্সাহের আগুন জ্বেলে জাগো॥”….এই সিংহনাদ যে স্তিমিত অগ্নিকে প্রজ্জ্বলিত করল তার শ্রেষ্ঠতম প্রমাণ হলেন দুই নারী, ভগিনী নিবেদিতা ও শ্রীমতী সরলা দেবী চৌধুরাণী। বিদ্রোহী আইরিশ রক্তের উত্তরাধিকারী নিবেদিতা যখন সশস্ত্র বিপ্লবের যজ্ঞবেদী প্রস্তুত করতে উদ্যত, রবীন্দ্রনাথের ভাগিনেয়ী সরলা উত্থিত হলেন বঙ্গের লুপ্ত বীররসের পুনরুদ্ধারে। তাঁর দ্বারা আরম্ভ ‘প্রতাপাদিত্য উৎসব’ ও ‘বীরাষ্টমী’ র প্রচলন শক্তি উপাসনার তরঙ্গে আনে এক নব হিল্লোল। শক্তি প্রদর্শনে অংশগ্রহণকারী যুবকদের হাতে লাঠি, তলোয়ার, বর্শা ও অন্যান্য তীক্ষ্ণ অস্ত্র দেখে, চমৎকৃত হয়ে তৎকালীন ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকা লিখলো: ‘মরিমরি কি দেখিলাম! এ কি সভা! বক্তিমে নয়, টেবিল চাপড়াচাপড়ি নয়, শুধু বঙ্গবীরের স্মৃতির প্রতি আহ্বান, বঙ্গ যুবকদের খতিন হস্তে অস্ত্র ধারণ ও তাদের নেত্রী এক বঙ্গ-ললনার হস্তে পুরস্কার বিতরণ। দেবী দশভূজা ই আজ সশরীরে অবতীর্ণ হইলেন!”….
সশস্ত্র বৈপ্লবিক আন্দোলনে মত ও পথ নিয়ে বহু মতপার্থক্য রইলেও শাস্ত্র ও শস্ত্রচর্চার প্রতি এক প্রশ্নহীন আনুগত্য তাঁদের প্রত্যেককে একত্রিত করে জন্মভূমির শৃঙ্খলামোচনে। যে প্রতিস্পর্ধার জন্ম হয় প্রতি গৃহে, তা এক অসংশয়িত প্রত্যয় প্রতিষ্ঠা করে হিন্দু আত্মার অভ্যন্তরে ১৬ই আগস্টের মহাসমরে, মুসলিম লীগের নৃশংসতার বিরুদ্ধে রক্তাক্ত সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে। এবং সেই শেষ…..ক্রমশ ভ্রষ্ট হতে শুরু করে হিন্দু; স্বধর্মচ্যুতি হয়ে ওঠে তাঁর চরিত্রের মূল উপাদান। ধর্মপথ হতে বহু দূরে অবস্থানকারী বাঙ্গালী আজ শুধু শীর্ণকায়, ক্লান্ত ও আক্রান্ত নয়, অস্তিত্ব সঙ্কটের শেষ লগ্নে উপস্থিত প্রায়। কেন এমন হল? মাত্র কয়েক দশকে পরাক্রান্ত, বৃটিশের বিভীষিকা বাঙ্গালী আজ হতোদ্যম কি প্রকারে? এর বিস্তৃত ব্যাখ্যা প্রয়োজন; অতি সংক্ষেপে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তিম লগ্নে বাঙ্গালীর সর্বনাশের যে নীল নকশা আঁকা হয়েছিল, সেই সর্বনাশা চক্রান্তের মধ্যে ব্রিটিশ, মুসলিম লীগ ও অন্যান্য শক্তির উপস্থিতি ছিল সমানরূপে। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রোধের যে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল ১৯১১ সালে বাঙ্গালীদের প্রতাপে সেই অপমান কখনোই বিস্মৃত হয়নি ব্রিটিশ রাজশক্তি। পরবর্তী দশকগুলিতে এবং দেশভাগ পর্যন্ত তার সুচারু রূপায়ণই বাঙ্গালী হিন্দুর সমূহ বিনাশের পথ প্রশস্ত করে, যার জের চলছে এখনও এবং পরিত্রাণের কোন আশা সুদূর পরাহত। পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান বা বর্তমানের বাংলাদেশে যে প্রকারে চরমতম, পৈশাচিক নির্যাতন হয়ে চলেছে হিন্দুর উপরে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ দূরস্থান, প্রতিবাদ করার ক্ষমতাও হারিয়েছে হিন্দু। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও সমগ্র উত্তর বঙ্গেও তার অবস্থা তথৈবচ। ……যে রক্তাক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে হিন্দু হোমল্যান্ড রূপে প্রতিষ্ঠা হয় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের তাও আজ হিন্দুর হাত থেকে বেরিয়ে গেছে প্রায়।
একটি ছোট উদাহরণ – পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলির পতন একটি শূন্য স্থান সৃষ্টি করে যা অতি দ্রুত পূরণ হয় বামপন্থীদের দ্বারা। স্বদেশী তথা হিন্দুদের কীর্তি করায়ত্ত হয় কম্যুনিস্টদের; স্বাধীনতা তথা লীগের গুন্ডামির বিরুদ্ধে সংগ্রামে যে যুবশক্তি তৈরী হতো আখড়াগুলোর অভ্যন্তরে তা দখল করে কংগ্রেস ও সিপিআই। পরবর্তীতে সিপিআইএম ও নকশালদের দখলে যায়। কালক্রমে, যা একসময় ছিল হিন্দুর পেশী তৈরীর সূতিকাগার তা পরিণত হয় armoury তে, রাজনৈতিক সংঘর্ষে ব্যৱহৃত হওয়ার জন্য। ৭০র দশকের রাজনৈতিক অমানিশায় পুলিশী হস্তক্ষেপে তা বন্ধ হয়; ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট প্রশাসনে অধিষ্টিত হলে সেই বন্ধ হওয়া আখড়া আর খোলা হয়নি কখনও। চির প্রণম্য বিপ্লবী শস্ত্রাচার্য শ্রী পুলিনবিহারী দাসের ঐতিহাসিক ‘বঙ্গীয় ব্যায়াম সমিতি’ কে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয় একইরূপে। শারীরিক বলই জন্ম দেয় অনাচার, অত্যাচারে বিরুদ্ধে প্রতিবাদরত সাহসের; তলিয়ে যায় বাঙ্গালী ক্রমশ। – হিন্দু বিস্মৃত হয়েছে তার ভূমি থেকে একদা উদ্ভূত পৌরুষ, machismo-এর। ভাগ্যলক্ষীকে সুপ্রসন্ন করতে হলে হিন্দুকে ফিরতে হবে তার মুলে, শক্তিমার্গের অনন্য সাধনায় অভীষ্ট রাষ্ট্রক্ষমতা অর্জনের জন্য। রাষ্ট্র বিনা ধর্মাচার অসম্ভব, ইহাই শাস্ত্রীয় প্রজ্ঞা। …..
“…. স্বামীজী অপ্রকট হবার আগে আমাকে একটা কথাই বার বার বলতেন: দেখ নিবেদিতা জীবনের অভিজ্ঞতা এবং উপনিষদের গভীরে প্রবেশ করে একটা সত্যই উপলব্ধি করছি, এই জগৎ এবং জীবনের শেষ কথা হচ্ছে শক্তি। যার কাছে শক্তি থাকবে সর্ব বিষয়ে শেষ কথা বলার অধিকারী সেই। অনিচ্ছার সঙ্গেও জগৎ তা মানতে বাধ্য, আমাদের দুৰ্ভাগ্য এদেশে যে ব্যক্তি যত বেশি ধাৰ্মিক সে তত বেশি নিরীহ গোবেচারা এবং দুর্বল। তাই তাদের লাঞ্ছনা নির্যাতনেরও শেষ নেই। যে যত ভদ্রলোক সে তত অসহায়। তার কারণ শক্তিহীনতা, উচ্চ আদর্শ, মহৎ চিন্তা বহনকারী হিন্দু সমাজের ইতিহাসটাই শুধু মার খাবার, আক্রান্ত হবার বিবরণে পূর্ণ। এতে কোন হিন্দুর ব্যথা বেদনা অপমান বোধ নেই। দুর্বলের এসব থাকে না। নায়মাত্মা বলহীনেন। লভ্যঃ হিন্দুকে শক্তিশালী হইতে হইবে”। – মিসেস মার্গারেট নোবেল ( ভগিনী নিবেদিতা )
(প্রবন্ধটি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মুখপত্র “বিশ্ব হিন্দু বার্তা’ – য় প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই)
শ্রী অনিমিত্র চক্রবর্তী হলেন একজন সাংবাদিক ও বিভাগীয় লেখক (columnist) এবং বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের এক সক্রিয় কর্মী।
Comment here