বসুধাসংস্কৃতি

মুদ্রায় ইতিহাস: টাকা-পয়সা-পতাকায় একই সৌধ, ভারতীয়ের স্থাপত্য যে দেশের ঐতিহ্য

-শ্রী সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়

 

কয়েন, নোট ও জাতীয় পতাকায় একই সৌধের ছবি। বিশ্বে এমন দৃষ্টান্ত মাত্র দু’টি দেশে ছিল। এর মধ্যে একটি দেশ কিছুদিন আগে পতাকা বদল করায়, এখন এমন একটিমাত্র দেশ রয়েছে যাদের টাকা-পয়সা তো বটেই, জাতীয় পতাকাতেও রয়েছে সৌধের ছবি। সেই সৌধ গড়েছিলেন ভারতীয় রাজা দ্বিতীয় সূর্যবর্মণ, দ্বাদশ শতকে। আয়তনের নিরিখে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধর্মস্থান এটিই। আজকের পর্বে সেই হারানো ঐতিহাসের কথা, যার প্রতি পরতে জড়িয়ে ভারতের ঐতিহ্য।

কয়েক দশক আগেও বিশ্বের বহু তাবড় জাদুঘরে ভারতীয় বীথি বা ইন্ডিয়ান গ্যালারি বলতে শুধু ভারত নয়, বোঝানো হত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংস্কৃতি ধরা রয়েছে এমন গ্যালারিকে। বিশ্বায়নের যুগে ভারতের ক্ষেত্রে উল্টোটা ঘটেছে। ছোট হয়ে গেছে পরিসীমা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পেয়েছে আলাদা সংজ্ঞা।

দাক্ষিণাত্যের চোড় রাজাদের দাপট শুধু স্থলেই সীমাবদ্ধ ছিল না, চম্পা রাজ্যের সহায়তায় একাধিকবার তারা সমুদ্রে অভিযান করেছে। শেষে সাতশো নৌবহর নিয়ে আক্রমণ করে রাজ্য স্থাপনও করেছে বঙ্গোপসাগরের ওপারে। সেখানেই রাজা দ্বিতীয় সূর্যবর্মণ গড়ে তোলেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় মন্দির। ১১১১-১৩ থেকে শুরু হয়ে মন্দির নির্মাণ শেষ হয় ১১৫০ সালে। জায়গাটির নাম হয়ে যায় মন্দির-শহর, খমের ভাষায় আঙ্কোর ওয়াট। অধুনা কাম্বোডিয়া তো বটেই, গিনেস রেকর্ড বই অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধর্মস্থল এটিই। মন্দির নির্মাণ শেষ হওয়ার পাঁচ বছর আগেই প্রয়াত হন দ্বিতীয় সূর্যবর্মণ। আরও পঞ্চাশ বছরের মধ্যে এই মন্দির ধীরে ধীরে হয়ে যায় বৌদ্ধ ধর্মের উপাসনাস্থল।

কালের নিয়মে কার্যত ধ্বংস হতে বসে এই মন্দির। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে শুরু হয় নতুন করে সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ। তবে তার অনেক আগে, ১৮৫০-এর দশকে কাম্বোডিয়া নতুন জাতীয় পতাকা তৈরি করলে তার মাঝে চিহ্ন হিসাবে আঁকা হয় আঙ্কোর ওয়াটের ছবি। এর আগে বিশ্বে আর কোথাও এমনটি হয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই। কাম্বোডিয়ার ইতিহাসে নানা শক্তির উত্থান-পতন হয়েছে। উপনিবেশ, সাময়িক অধিগ্রহণ ও কমিউনিস্ট শাসনের সাক্ষী থেকেছে এই দেশ। অন্য কমিউনিস্ট দেশের সঙ্গে এই দেশের পার্থক্য হল, এখানের পতাকায় রয়ে গেছে আঙ্কোর ওয়াটের ছবি। এটি তাদের বহুত্ববাদ, সম্প্রীতি ও ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে এসেছে চিরকাল। তাই অল্প সময়ের একটি ব্যতিক্রম ছাড়া কাম্বোডিয়ার পতাকায় রয়ে গেছে এই সৌধের ছবি।

১৯৯৪ সালের ১০০ রিয়েল মুদ্রায় আঙ্কোর ওয়াটের ছবি রয়েছে। একাধিক নোটে রয়েছে আঙ্কোর ওয়াটের ছবি।

১৯৭২-৭৩ সালের ১০০০ রিয়েল নোটে যে পাথরের মুখ রয়েছে সেটি তা সোম মন্দিরের গম্বুজ থেকে নেওয়া। শিকড়ে ভরে যাওয়া ভগ্নপ্রায় তা সোম মন্দির সংরক্ষণ করেছে সে দেশের সরকার। ২০০২, ২০০৪ ও ২০১৪ সালে প্রকাশিত ৫০০ রিয়েল মুদ্রায় যেভাবে মন্দিরের ছবি ছাপা হয়েছে অনেকটা সেই রকমই রয়েছে পতাকায়। মুদ্রায় ব্যবহার হওয়া এই দু’টিই আঙ্কোর ওয়াট মন্দিরের।

চোড়দের যে ইতিহাস ছড়িয়ে রয়েছে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায়, ১০৮৮ সালে তার সূচনা করেছিলেন রাজেন্দ্র চোড়। তিনি চিনের রাজার কাছে নিজের দূত পাঠিয়েছিলেন। তাঁর উত্তরপুরুষরা সেই ধারা বজায় রেখেছিলেন। তিনি দক্ষিণপূর্ব এশিয়া আক্রমণ করেছিলেন। আরও পরে এই জায়গা আক্রমণ করেছেন দ্বিতীয় সূর্যবর্মণ। তবে কোনও ভারতীয় রাজাই সেভাবে এখানে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে পারেননি যেভাবে গ্রিকরা এশিয়ার বড় অংশে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল বা ইউরোপের নানা শক্তি এশিয়া-আফ্রিকা জুড়ে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। তাও সাগর পেরিয়ে এত অল্প সময়ের জন্য রাজত্ব করেও অনন্য কীর্তি স্থাপন করেছিলেন এক ভারতীয় রাজা। অনন্য, কারণ তা স্থান করে নিয়েছে পতাকায়। তাই এটি যেকোনও ভারতীয়র কাছে গর্বেরও বটে।

 

(লেখক পরিচিতি – প্রাক্তন সাংবাদিক, বর্তমানে ভাষাতত্ত্ববিদ; ইতিহাস চর্চা ও মুদ্রা সংগ্রহ তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান অঙ্গ)

Comment here