বসুধা

যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় থেকে অশোকের শিলালিপি, মুদ্রায় হিমালয়ের ছোট্ট সেই রাজ্য

-শ্রী সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্য়ায়

 

হিমালয়ের কোলে ছোট্ট, প্রাচীন রাজ্য। একসময় বাণিজ্যে তার নামডাক ছিল সুদূর মধ্যএশিয়া পর্যন্ত। তবে এদেশের আর পাঁচটা প্রাচীন ছোট জনপদের মতো এদের নিয়েও তেমন লেখাজোকা নেই কোথাও, তাই এই রাজ্যের বিস্তারিত ইতিহাস পাওয়া কঠিন না বলে, অসম্ভব বলাই শ্রেয়। ভাগ্যিস মহাভারতে এর নাম উল্লেখ করা আছে। মহাভারত যদি ইতিহাস না হয় তাহলেই বা কী, এই জনপদের অনেক মুদ্রা তো পাওয়া গেছে।

মুদ্রাগুলি অতীব সুন্দর, অন্তত আমার চোখে। দুর্লভ না হলেও এই রাজ্যের মুদ্রা বর্তমানে খুব একটা সহজলভ্য নয়। মুদ্রায় ব্রাহ্মী হরফে লেখা রাজ্ঞাঃ কুনিন্দস্য অমোঘভুতিস্য মহারাজস্য। অর্থাৎ এই রাজ্যের নাম কুনিন্দ, আর রাজার নাম অমোঘভূতি। এই রাজ্যের অধিকাংশ মুদ্রাই রুপোর, তবে তামার মুদ্রাও পাওয়া গেছে। রুপোর মুদ্রার একদিকে রয়েছে হরিণ ও দেবীমূর্তি। আইকনোগ্রাফি বিশেষজ্ঞরা এই মানবীমূর্তিকে দেবী লক্ষ্মী বলে ব্যাখ্যা করেছেন। মুদ্রার অপরদিকে রয়েছে বৌদ্ধ স্তূপের ছবি। রয়েছে স্বস্তিক চিহ্ন ও সাপের ছবি। এসব নিয়ে গবেষণা করে পণ্ডিতরা একটি বিষয়ে একমত, এই রাজ্যে পরধর্মের প্রতি প্রত্যেকেরই শ্রদ্ধা ছিল। এই রাজ্যে শুধু যে হিন্দু ও বৌদ্ধ, এই দুই ধর্মেরই যথেষ্ট প্রভাব ছিল তা নয়, জৈন ধর্মাচরণেরও প্রমাণও মিলেছে। এটি যে সময়ের কথা তখন যিশু খ্রিস্টের জন্মই হয়নি।

মুদ্রায় বৌদ্ধধর্মের ত্রিরত্ন চিহ্ন রয়েছে, সাপ ও ত্রিশূলের চিহ্নও রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে নাগের চিহ্ন। ইতিহাসবিদদের ধারণা, স্থানীয় রাজারা নাগবংশীয় ছিলেন। মুদ্রায় যে নাগের ছবি রয়েছে, সেই নাগের সঙ্গে অবশ্য জৈন তীর্থঙ্করদের মূর্তিতে থাকা সাপের কোনও মিল নেই। এদের কোনও কোনও মুদ্রায় ত্রিশূল হাতে শিবের মূর্তিও দেখা যায়। তাতে লেখা, ছত্রেশ্বর মহাদেব। গাড়োয়ালে অবিষ্কৃত সম্রাট অশোকের লিপিতে উল্লেখ রয়েছে, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে কুনিন্দ রাজ্যে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ছিল।

রুপোর যেসব মুদ্রা পাওয়া গেছে সেগুলি খ্রিস্টপূর্ব প্রথম থেকে খ্রিস্টাব্দ তৃতীয় শতকের মধ্যবর্তী সময়ের। অর্থাৎ এই সময়ে তারা ইন্দো-গ্রিক, কুষাণ ও অন্যান্য় শক্তিশালী রাজ্যগুলির শাসনের বাইরে স্বতন্ত্র রাজ্য হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করেছে। পরে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে ও ষষ্ঠ শতকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনে চলে যায়।

হারিয়ে যাওয়া কুনিন্দ রাজ্যের অবস্থান সম্পর্কে একাধিক মত পাওয়া যায়, তা থেকে এই রাজ্যের অবস্থান সম্পর্কে আন্দাজ পাওয়া যায়। মহাভারতে এই রাজ্যের উল্লেখ রয়েছে। সেখানে বলা আছে, মেরু পর্বত ও মন্দার পর্বতের মধ্যবর্তী অংশে থাকা এই রাজ্য জয় করেছিলেন তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন। পরে সোনা উপঢৌকন নিয়ে পরাজিত রাজা সুবাহ যোগ দিয়েছিলেন যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে।

অজ্ঞাতবাসের সময় মৎস্যদেশের রাজধানী উপপ্লব্যতে আশ্রয় নিয়েছিলেন পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদী। সেখানেই এক বিশেষ পরিস্থিতিতে মৎস্যরাজ বিরাটের শ্যালক কীচককে বধ করেন দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীম।

কীচক বধের খবর রটে যেতেই মৎস্যদেশ আক্রমণ করে ত্রিগর্ত। যমুনা ও ইরাবতী নদীর অববাহিকায় ত্রিগর্ত রাজ্যের অংশ ছিল কৌলিন্দ বা কুনিন্দ। তবে অনেকে মনে করেন তা নয়। কারণ কুনিন্দর রাজধানী হিসেবে অহিচ্ছত্র নামের উল্লেখ পাওয়া যায়, উত্তর পাঞ্চালের এই স্থান অশ্বত্থামার রাজধানী ছিল। তাহলে কুনিন্দ রাজ্য ঠিক কোথায়?

১৪০ খ্রিস্টাব্দে গ্রিক পণ্ডিত টলেমির জিওগ্রাফিকা অনুযায়ী বিপাশা, শতদ্রু, যমুনা ও গঙ্গার অববাহিকায় ছিল এই রাজ্য।গ্রিকরা এই রাজ্যকে কুলিন্দ্রিনী নামে উল্লেখ করেছে। সম্রাট অশোকের কালসি শিলালিপি অনুযায়ী, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে কুলুতা ও ত্রিগর্ত রাজ্যের কোনও অংশে কুনিন্দর অবস্থান ছিল। মানে অধুনা কুলু উপত্যকায় সাবেক কুনিন্দ রাজ্যের অবস্থান। খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে বরাহমিহির এই রাজ্যের অবস্থান শতদ্রুর তীরে বলে উল্লেখ করেছেন।

এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার তথ্য অনুযায়ী, যমুনা ও বিপাশা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে এই রাজ্যের অবস্থান ছিল। ত্রিগর্ত রাজ্যের অবস্থান ছিল ইরাবতী নদীর উচ্চপ্রবাহে। কুনিন্দ রাজ্য অধুনা জলন্ধর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলে সেখানে উল্লেখ রয়েছে। এদের সঙ্গে অধুনা রাজস্থানের যোগ ছিল বলেও জানা যায়।

কুনিন্দ রাজ্য সম্পর্কে অন্য কোনও নথি বিশেষ পাওয়া যায়নি, তাই তাদের সম্পর্কে জানার ব্যাপারে মুদ্রাই ভরসা। মুদ্রার ব্যাপ্তি থেকে জানা যায় এই জনপদ সমৃদ্ধ ছিল, এদের সঙ্গে আশপাশের রাজ্যের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল এই রাজ্যে বসবাসকারী ইন্দো-আর্য উপজাতির মানুষের। অনেকে মনে করেন, এই উপজাতির লোকজন মধ্যএশিয়া থেকে এখানে এসেছিলেন, তাঁদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্ম ছিল স্বতন্ত্র, যদিও তার সমর্থনে যুক্তি ও প্রমাণ পাওয়া যায় না। এঁদের মুদ্রায় ভারতে উদ্ভূত ধর্মের ছাপ স্পষ্ট, এমনকি ভাষাও সংস্কৃত, হরফ ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠী যা সেই সময়ে ইন্দো-গ্রিক মুদ্রায় ব্যবহার করা হত। মধ্যএশিয়ার সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্কের কথা জানা গেছে। মধ্যএশিয়ার সঙ্গে কুনিন্দ রাজ্যের সোনা, রুপো, মশলা ও বয়নের ব্যবসা ছিল, এমনকি ঘোড়ার ব্যবসাও চলত। এই রাজ্য শিল্প ও বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক ছিল।

মহাভারতের সময়কাল থেকে অন্তত খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতক পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে চলা কুনিন্দর মুদ্রা এই রাজ্যের শিল্প, ধাতুবিদ্যা ও চারুকলার বিস্তার ও চর্চা প্রমাণ করে। ভারতের যত সমসাময়িক যক মুদ্রা দেখেছি তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দৃষ্টিনন্দন এই রাজ্যের মুদ্রা, অন্তত আমার চোখে।

 

 

(লেখক পরিচিতি – প্রাক্তন সাংবাদিক, বর্তমানে ভাষাতত্ত্ববিদ; ইতিহাস চর্চা ও মুদ্রা সংগ্রহ তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান অঙ্গ)

Comment here