বসুধাসাদাকালো রঙমাখা

মুদ্রায় হারানো ইতিহাস: সম্রাজ্ঞী জেনোবিয়া ও পালমাইরার কথা

– শ্রী সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়

 

দেশপ্রেমিক। এই শব্দটা বললে কোনও দেশ, কোনও কালে কখনও কি প্রথমেই কোনও নারীর কথা মনে পড়ে? বিশ্ববন্দিত নেতাদের তালিকায় চোখ বোলালে এমন নাম খুঁজে পাওয়া একটু মুশকিল। কিন্তু জানেন কি, সিরিয়ায় আজও দেশপ্রেমের প্রতীক এক নারী, তাঁর নাম জেনোবিয়া। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতক তিনি আজও তিনি সে দেশের দেশপ্রেমের প্রতীক।

ইসলাম ধর্ম বিস্তারের আগে সিরিয়া ছিল খ্রিস্টধর্মের পীঠস্থান। তারও আগে ইহুদীদের। অধুনা সিরিয়ার বিভিন্ন জনপদের নাম রয়েছে বাইবেলে। এই দেশে এখনও রয়েছে রোম সাম্রাজ্যের বহু নিদর্শন। সিরিয়া নিয়ে তৃতীয় তথা আপাতত শেষ পর্বের বিষয় পালমাইরা বা পালমেইরা। সঙ্গে পালমাইরান সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী জেনোবিয়ার কথা। ১৯৭৭, ১৯৭৮, ১৯৮২ ও ১৯৯০ সালে সিরিয়ার ১০০ পাউন্ড ব্যাঙ্কনোটে ছাপা হয়েছে সম্রাজ্ঞী জেনোবিয়ার ছবি। ভারতীয় হিসেবে তাঁর সঙ্গে সামান্য হলেও মিল খুঁজে পেতে পারেন মণিকর্ণিকার, যিনি ঝাঁসীর রানি লক্ষ্মীবাঈ নামে সমধিক পরিচিতা।

যতদূর জানা যায়, সাধারণ ঘরের মেয়ে ছিলেন জেনোবিয়া। বুদ্ধিমতী ও বিচক্ষণ এই নারীর সঙ্গে বিয়ে হয় ওডেনাথুস নমে স্থানীয় এক শাসকের। পরে তিনিই রাজা হন। সামরিক বল ও কৌশলে পূর্বে পারস্য ও পশ্চিমে রোমানদের আটকে দেন ওডেনাথুস। কিন্তু কোনও এক গুপ্তঘাতক তাঁকে হত্যা করে। তখন নিজের সম্রাজ্ঞী বলে ঘোষণা করে শাসনভার নেন সদ্যবিধবা জেনোবিয়া। তাঁর দরবার ছিল জ্ঞানীগুণীদের জন্য অবারিত। ধর্মীয়ভাবে তখন যাঁরা সংখ্যালঘু ছিলেন, তাঁদের নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করেছিলেন সেই যুগে। পরে তিনি নিজের ছেলেকে রাজা ঘোষণা করেন, তবে শাসনক্ষমতার অনেকটাই তাঁর হাতে ছিল।

রোমান আক্রমণ বারে বারে প্রতিহত করেছেন জেনোবিয়া। তবে স্ফূলিঙ্গের মতো সেনাবল নিয়ে বিশাল রোমান তরঙ্গ আটকে রাখা তাঁর পক্ষে এক সময় অসম্ভব হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত তিনি পরাজিত হন। তাঁর রাজধানী অবরুদ্ধ করে রোমানরা। রাজা তাঁর ছেলে, তবুও তাঁকেই বন্দিনী করে নিয়ে যাওয়া হয় রোমে। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।

ইতিহাস লেখেন বিজয়ীরা, তাই সেই সময় তাঁর নামেও নেতিবাচক কথা ছড়িয়ে পড়েছিল। এখন সেসব কথা অনেকেই পুরোপুরি বিশ্বাস করে উঠতে পারেন না। যেমন, ক্ষমতার লোভে তিনিই হত্যা করেছেন স্বামীকে।

জেনোবিয়ার জন্ম ২৪০-৪১ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর মায়ের কোনও পরিচয় পাওয়া যায় না। তাঁর বংশ পরিচয় ও পিতৃ পরিচয় নিয়েও ইতিহাসবিদরা একমত হতে পারেননি। এমনকি কেউ কেউ ওডেনাথুসকে হত্যার জন্য তাঁকে দায়ী করেছেন। এর পক্ষে একটা যুক্তিও রয়েছে যা ফেলে দেওয়ার মতো নয়।

দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী হিসেবে ২৬০ সালে জেনোবিয়াকে গ্রহণ করেন ওডেনাথুস। তিন বছর পরে তাঁর প্রথমপক্ষের স্ত্রীর সন্তান প্রথম হাইরানকে সহ-শাসক নিযুক্ত করেন ২৬৩ খ্রিস্টাব্দে, যিনি বয়সে জেনোবিয়ার সমান বা সামান্য বড়। সদ্য মা হওয়া জেনোবিয়ার পক্ষে এটি মেনে নেওয়া সহজ নাও হতে পারে। স্বাভাবিক নিয়মে তো তাঁর ছেলে রাজা হতে পারতেন না, তাই স্বামী ও সতীনের ছেলেকে গুপ্তহত্যা করা ছাড়া অন্য কোনও সহজ পথও হয়তো ছিল না বিদূষী ও বিচক্ষণা জেনোবিয়ার সামনে। সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তিনি স্বামীকে হত্যা করেছেন এমন কথা হলফ করে বলা যায় না।

শাসনভার হাতে নিয়ে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে তিনি স্বাধীনতা রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন পারস্য ও রোমের মতো দুই শক্তিশালী শক্তিকে আটকে রেখে। অনেকে বলেন, পালমাইরা আদতে রোমের অংশ হলেও বিদ্রোহের পথে হেঁটে তাকে স্বাধীন ঘোষণা করা হয়, এজন্যই যুদ্ধ। ২৬৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পরে শাসনভার নিয়ে রাজা ঘোষণা করেন নিজের সন্তানকে, যাঁর নাম ভাবাল্লাথুস। শিশুপুত্রের হয়ে পাঁচ বছর তিনি রাজত্ব করেছেন। আমৃত্যু আপোষ করেননি রোমের সঙ্গে।

এবার আসা যাক পালমাইরার কথায়। আইসিসের আক্রমণে যার অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে (আগের একটি পর্বে বলা হয়েছে)। খ্রিস্ট জন্মের দু’হাজার বছর আগে এর অস্তিত্ব ছিল। এখান থেকে নব্যপ্রস্তর যুগের নিদর্শনও পেয়েছেন পুরাতত্ত্ববিদরা।

রোমানরা পাইমাইরা দখল করার পরেও এই শহরের বাণিজ্যিক গুরুত্ব কমেনি। সিল্ক রোডের উপরে থাকা এই নগর রোমের অধীনে থাকা সিরিয়া রাজ্যের প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। এখানে রোমান ও গ্রিক শৈলিতে তৈরি একের পর স্থাপত্য গড়ে উঠতে থাকে যা এখনও অবাক করে দেওয়ার মতো। ১০০ পাউন্ড নোটে জেনোবিয়ার পাশে যে ছবিটি রয়েছে সেটি পালমাইরার। তবে যে তোরণের মুখে জেনোবিয়ার মূর্তিটি ছিল সেটিও আইসিসের উন্মত্ত আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত। আইসিস বা ইসলামিক স্টেটের অনেক আগেও এই জায়গায় উন্মত্ত হামলা হয়েছে। তৈমুরের সময়ে, অর্থাৎ চতুর্দশ শতকে পালমাইরাতে ধ্বংসলীলা করে আক্রমণকারীরা। সমরখন্দের সেই শাসকের আক্রমণে নির্মাণ অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রাচীন নগর। তবুও এখনও পালমাইরা বয়ে চলেছে নিরবচ্ছিন্ন ইতিহাসের এক ধারা। যেখানে বদলেছে ধর্ম, ধ্বংস হয়েছে সভ্যতা। মুছে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে সভ্যতার নিদর্শন।

 

(লেখক পরিচিতি – প্রাক্তন সাংবাদিক, বর্তমানে ভাষাতত্ত্ববিদ; ইতিহাস চর্চা ও মুদ্রা সংগ্রহ তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান অঙ্গ)

Comment here