(পূর্বের অংশের পর)
– শ্রী অলোক ভট্টাচার্য
তালপাতায় লেখা সংস্কৃত পুঁথি, ইংরেজী ও বাংলায় বিভিন্ন বিষয়ের উপর বই, প্রবাসী ও ভারতবর্ষ পত্রিকাগুলি বছর অনুযায়ী বাঁধানো অনেকগুলি আলমারিতে সাজানো যা আমিও দেখেছি। পাঠকহীন ও ক্ষয়িষ্ণু এই লাইব্রেরীর অবস্থান, এইসব সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবহৃত হবে আশায় রাজবাড়ীর Woodhead Library কে আমিই উপহার দিয়েছিলাম ১৯৬৭ সালে। তাছাড়াও ছিল দুটি বড় খেলার মাঠ, পোস্টঅফিস, ইউনিয়ন বোর্ড, থিয়েটার হল (শৈশবে সেখানে অভিনয় হতে দেখেছি), দাতব্য চিকিৎসালয়, পাশ করা ডাক্তার, সমবায় ব্যাঙ্ক। আর ছিল শিক্ষিত ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে জ্ঞানী গুণী মানুষ।। তাদের কথাও আসবে।
(তৃতীয় অধ্যায়)
চলতে চলতে ভাবনা আসে কিছু ছেড়ে গেলাম কিনা। অনেক সময় একটু পিছিয়ে গিয়ে খুঁজতে হয়। তেমনি একটু পিছিয়ে খুঁজি।
রামচন্দ্রের পুত্রের কথা বলেছি। রামসেবক। তার ছিল দুই পুত্র। নামের সঙ্গে রাম জুড়ে রাখার ট্র্যাডিশন ছিল বোধহয়। দুই পুত্রই সেই ট্র্যাডিশানেই বোধহয় ছিলেন বিষয়াসক্তিহীন ও শাস্ত্রানুরাগী ও পন্ডিত। বড় রামজগন্নাথ ছিলেন আত্মভোলা। ছাত্র ও টোল ছিল তার জীবন। শান্ত-নির্বিকার, কম কথার মানুষ। ছোট রামধনও ছিলেন পন্ডিত। তার ছিল অনুসন্ধিৎসা, জ্ঞানের লড়াইয়ে রুচি। ছিল ছাত্র ও টোল। নবদ্বীপের মাধব তর্কসিদ্ধান্তের প্রিয় ছাত্র ছিলেন। তেমন কয়েকজন ছাত্র (পন্ডিত) তৈরিও করেছিলেন। তার মধ্যে তার এক পুত্র জানকীনাথ (রামজগন্নাথের পৌত্র) ও গ্রামেরই নকুলেশ্বর ন্যায়বাগীশ ও নবদ্বীপের আশুতোষ তর্কভূষণ পরে পন্ডিত সমাজে উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। রামধন নিজে বাংলাদেশের একজন অতিমন্য পন্ডিত বলে স্বীকৃত ছিলেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা-বিবাহ আইনসিদ্ধ করার সংগ্রাম শুরু করেছিলেন ১৮৪৫ নাগাদ। বাংলার পন্ডিতবর্গ তার তীব্র বিরোধিতা শুরু করেছিলেন। দু’এক জন ব্যতিক্রমীও ছিলেন। বিদ্যাসাগর পন্ডিতদের স্বমতে আনার জন্য বিভিন্ন পন্ডিতসভায় হাজির হয়ে বক্তব্য পেশ করতেন। তিনি এলেন কোড়কদীতে ১৮৫৩ সালে। কোটালিপাড়ার বৈদিক পন্ডিতরাও আমন্ত্রিত ছিলেন। বিতর্কসভায় রামধনের একটি পদ্ধতিগত আপত্তিতে বিদ্যাসাগর তখনকার মত পরাজিত হন। পন্ডিত সমাজের কাছে এবং কোড়কদীবাসীর কাছে তিনি বীরপুজো পেলেও এখনকার দিনে অধস্তনপুরুষ হিসেবে আমরা ভাবলে লজ্জা পাই। কিন্তু সমাজ তখন তেমনই ছিল। রামজগন্নাথ বিদ্যাসাগরের পক্ষে জবাব দিতে চাইলে টানলে বলতে দেননি বাকি পন্ডিতরা। কিন্তু সৌভাগ্যের কথা হল যে বিদ্যাসাগর পরাজিত হননি। ১৮৫৬ সালে বিধবা-বিবাহ আইনসিদ্ধ তিনি করেই ছাড়লেন। আর কোড়কদী ও কোটালিপাড়ার পন্ডিতদের মধ্যে স্টিরি-শিক্ষার বীজ তিনি বুনে দিয়ে গেলেন। এরই ফলশ্রুতিতে আমরা দেখতে পেলাম যে বিংশ শতাব্দীতে কোন অক্ষরজ্ঞানহীন কন্যা ছিল না কোড়কদীতে। অক্ষরজ্ঞানহীন কোন কন্যাকে বধূ করে কোড়কদীতে আনাও হত না।
(ক্রমশঃ)
Comment here