আঙিনা

দেশ – ১৩

 

– ডঃ গৌতম মুখোপাধ্যায়

 

বোসেদের বাড়ী ছিল গ্রামের এক প্রান্তে। এক লপ্তে অনেকটা জমি নিয়ে ওদের বসতবাড়ী। গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে বর্ধিষ্ণু পরিবার। গ্রামের বা শহরের ধনী ব্যাক্তিরা একটু ভোলাটাইল হয়। কর্পূর এর মত। উবে যাওয়ার টেনডেনসী। টাকা হলে গ্রামের লোকেরা শহরে এবং শহরের লোকেরা বিদেশে পাড়ি দেয়। লোকে উন্নততর জীবন যাপন করতে চায়। সেটাই স্বাভাবিক।
বোসেরা সেইসময়ের তুলনায় আলোকপ্রাপ্ত। সাহেবদের সাথে ওঠাবসা ছিল।

আস্তে আস্তে জমি জমা সব বিক্রি করে তল্পিতল্পা গুছিয়ে শহরে চলে গেলেন। অত বড় বাড়ী বিক্রি হয়নি। সাথেও নিয়ে যেতে পারেননি। কাউকে দেখাশুনো করতে দিয়েছিলেন। ‌অত বড় বাড়ী মেন্টেন করা সোজা কথা নয়।

এক সময় কেউ আর বসবাস করত না। সাপ দখল নিয়ে নেয়। দু তিন দিকে বাঁশ ঝাড় ছিল। রাতে মর্মর ধ্বনি উঠত,বাঁশ পাতা সুরেলা আওয়াজ তুলত। প্রচলিত হল ভূতে রাতে গান ধরে। ভূতের বাড়ী হয়ে উঠল। দিনের বেলাতেও কেউ একা একা ছায়া মাড়াত না।

বর্ষায় জল জমলে, সাথে মিথেন গ্যাস থাকলে অনেকে দিব্যি কেটে বলতে পারত আমি নিজে আলেয়া বা লন্ঠন হাতে সাদা শাড়ি পরিহিতা পেত্নী, শাকচুন্নী দের ঘুরে বেড়াতে দেখেছি। কেউ বা বাঁশ ঝাড়ে ভূত দেখেছে বাঁশী বাজাচ্ছে। এই ভাবেই গ্রাম বাংলায় সরল মানুষদের মনে কুসংস্কার বাসা বাঁধে। হরাইজন্টালি বার্তা ছড়ায়। আবার ভার্টিক্যালি এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে প্রোথিত হয়।

গল্প ছড়াল রাতে সাহেব ভূতেদের সাথে নেটিভ ভূতেদের ক্রিকেট খেলা হয়।

যেটা লক্ষ্য করেছিলাম সেটা হল প্রকৃতি যদি মানুষের পরিত্যক্ত বাড়ি বা কিছু পায়, সেটা সে আত্মসাৎ করে নেয়। প্রথমে লতা, গুল্ম পদাতিক সৈন্যদের পাঠায় দখল নিতে। তারপর মায়াজাল বিস্তার করে ধীরে ধীরে। ধূলো, গাছপালায় ঢেকে দেয়। তারপর আস্তে আস্তে নিজের কোলে আশ্রয় দেয় পরম মমতায়। অনেক বছর পর সেখানে মাটির ঢিবি দেখা যাবে। ঢিবি অনেকটা জায়গা নিয়ে থাকলে, মানুষ খনন করে তুলে আনবে কোনো সভ্যতার নিদর্শন।

এখানে একটা প্রশ্ন রাখছি। লোহায় জং পড়ে কেন?

বৈজ্ঞানিক উত্তর হল লোহা জল ও বায়ুর( অক্সিজেন) সংস্পর্শে এলে জং পড়ে নস্ট হয়। আমাদের চোখে নস্ট হয়, হয়তো সামগ্রীক দৃষ্টিতে নষ্ট হয়না।

দার্শনিক উত্তর হল লোহা আমরা extract ( নিষ্কাশন ) করি লোহার বিভিন্ন অক্সাইড ( হিমাটাইট etc) আকরিক থেকে ব্লাস্ট ফার্নেসে। তাই লোহা বা স্টীল এর একটা টেনডেনসী থাকে আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবার অর্থাৎ অক্সাইড ফর্মে ফিরে যাওয়ার। জং লোহার অক্সাইড।

মানুষ ও মানুষের তৈরী সব কিছুর টেনডেনসী হল শেষ পর্যন্ত প্রকৃতি মায়ের কোলে ফিরে যাওয়ার।

আগের লেখায় লিখেছিলাম, গ্রামের বা শহরের ধনী ব্যাক্তিরা একটু ভোলাটাইল হয়। কর্পূর এর মত। উবে যাওয়ার প্রবনতা। টাকা হলে গ্রামের লোকেরা শহরে এবং শহরের লোকেরা বিদেশে পাড়ি দেয়। লোকে উন্নততর জীবন যাপন করতে চায়। সেটাই স্বাভাবিক। বাঙালী এটা শুনে তেড়ে মারতে আসবে, যে সাথে উচ্চ শিক্ষা না থাকলে বিদেশ যাবে কি করে? কারন আবহমান ধরে বাংলা সিনেমায় দেখা গেছে নায়ক বিশাল রেজাল্ট করে বিদেশ যায়। ফার্স্ট এর নীচে নৈব নৈব চ।

এয়ারপোর্ট ও এযারোপ্লেন দেখানো হয়। উড়ে যায় প্লেন। বুঝতে হবে নায়ক বিদেশ চলল। গুজরাটের আমেদাবাদে ‌অনেক বছর কাটানোর সুবাদে দেখেছি, গুজরাটিরা বিদেশ যাওয়ার জন্য পড়াশুনার কোনো ধার ধারে না। কেউ টেলরিং এর দোকান খুলতে যাবে, কেউ চুল কাটার সেলুন খুলতে যাবে ইত্যাদি। কেউ গ্রসারীর দোকান দেয় ওখানে গিয়ে। ওদের মধ্যে খুব মিল। কম্যুনিটি ফিলিংস খুব স্ট্রং। যেটা বাঙালিদের মধ্যে নেই। দিল্লীর বাঙালি দের বেশ বদনাম আছে। যদি কেউ নতুন এসে সাহায্য চায়!! 

মুম্বাইয়ে পাশপোর্ট অফিসে দুটো লাইন। একটি শুধু গুজরাটিদের জন্য, অন্যটি বাকিদের জন্য। এতেই বোঝা যায় কারা ঝাঁকে ঝাঁকে বিদেশে যায়। আমোদাবাদ এর কাছে খেডা খুবই বর্ধিষ্ণু জেলা। বলা হয় এই জেলার প্রতি পরিবার থেকে অন্ততঃ একজন বিদেশে থাকে। আমেদাবাদের একটি বিখ্যাত নাচের গ্রুপ প্রতি বছর বিদেশে প্রোগ্রাম করতে যেত। পরে দেখা গেল যত লোক সাথে যায়, তত লোক ফেরেনা। এর নাম কবুতরবাজী। এক এক জনের কাছ থেকে মোটা টাকা নেওয়া হত। সত্যি কত কি জানে ওরা। আমাদের আমেদাবাদের সোসাইটির একটি ছেলে ও মেয়ে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে করে খাচ্ছে ভালোমতো। ছেলেটি উচ্চ মাধ্যমিকের দুবার ও মেয়েটি একবার ফেল করেছিল।

আমাদের এক সিনিয়র বাঙালী কলিগের মেয়ে সাধারন একটি কলেজ থেকে BE করে, ক্লাসমেট একটি গুজরাটি ছেলের সাথে অস্ট্রেলিয়া যায়। বিয়েও করে। মেয়েটি সুন্দর দেখতে। ওখানে ভালোই আয় করছিল দুজনে। ছেলেটি তলে তলে একটি ধনী অস্ট্রেলিয়ান মেয়ের সাথে ডেটিং শুরু করে। মেয়েটি ডিভোর্স নিয়ে ফিরে আসে। এক বছর পর আমেরিকা চলে যায়। ওর বাবা রিটায়ার করেছিলেন, মানসিক ভারসাম্য হারান। একমাত্র কন্যা। এখন কানাডা যাওয়া ট্রেন্ড হয়েছে। ১৫ লাখ টাকা লাগে সিটিজেনশিপ পেতে। ওখানে পৌঁছতে পারলে কাজ পাওয়া যায়। কানাডা অস্ট্রেলিয়ায় জন সংখ্যা খুব কম। ওদের সরকার ডাকে এস এখানে এস।

১৯৮৫ তে ongcর চাকরী নিয়ে আমোদাবাদে যাই। প্রথমেই দেখলাম গুজরাট রাজ্যের area পশ্চিম বঙ্গের চার গুন বেশী। জন সংখ্যা এক চতুর্থাংশ। অর্থাৎ গুজরাটের লোকজন আমাদের তুলনায় ১৬ গুন সুবিধা পাচ্ছে। ONGC তে পেট্রোফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে কাজ পেয়েছিলাম। পেট্রলিয়ম exploration এর কাজ। সারা গুজরাট চষে বেড়াতে হত। গুজরাটের বিভিন্ন জায়গায় Well drill করা হত জিওলজিকাল ও জিওফিজিকাল ( সিসমিক) data analysis করে। আমরা এক একটা Logging Unitনিয়ে গিয়ে ওই। Well গুলোতে বিভিন্ন Tool , Cableএর সাহায্যে নামিয়ে বলে দিতাম well এ তেল বা গ্যাস আছে কিনা। আর থাকলে কোন Depthএ আছে এবং কতটা থাকতে পারে। Well গুলোর Depth হয় ২০০০ থেকে ৫০০০ মিটার।

গুজরাটের প্রত্যন্ত গ্রামেও চওড়া, পাকা রাস্তা। কোথাও সাইকেল রিক্সা নেই, ভিখারিও চোখে পড়েনি। গ্রামে গরুর গাড়ির বদলে দেখতাম উট গাড়ি। কিন্তু গাড়ি গুলোতে রাবারের টায়ার লাগানো। কাঠের ওপর লোহার বেড় দেওয়া নয় ( যেমন টা গরুর গাড়ি তে থাকে)। আমোদাবাদ বা অন্য কোথাও যুবকদের আড্ডা মারতে দেখিনি। আড্ডা দেওয়ার কালচার টা গুজরাটী দের নেই। লোকজন খুব helping.যেমন আমাদের শুরুতেই স্কুটার দিয়েছিল। শুরুতে স্পার্ক প্লাগের প্রবলেম হলে লোকে হাসত না বরং এসে সাইডের ঢাকামুখ খুলে, প্লাগ পরিস্কার করে দিত। লোকজন ব্যবসায় মনস্ক। পাশের বাড়ির ভদ্রলোক কোন একটা কাপড়ের মিলে কাজ করতেন। বিকেলে বাড়ি ফিরে মেশিনে উল দিয়ে সোয়েটার বানাতেন। স্ত্রী ও হাত লাগাতেন। অনেক রাত ‌অবধি কাজ করতেন।

আমেদাবাদে অনেক কাপড়ের মিল ছিল। পরে রিলায়েন্স এসেছিল। রিলায়েন্স এর কথা মনে থাকলে পরে লিখব। আমোদাবাদ কে বলা হত Manchester of East. যেমন হাওড়া কে বলা হত Sheffield is East. ( এখন বললে লোকে হাসবে)
ওখানে গ্রামের ভেতরেও পাকা রাস্তা, অটো চলছে। আমাদের দেশের রাস্তা অনেক অনেক পরে পাকা হয়েছে।

সে সময়ে জ্যোতি বাবুর রাস্তার একটা নমুনা দেই। ১৯৯৭ এ আমি কলকাতায় পোস্টেড ছিলাম। ফ্যমিলি নিয়ে ব্যান্ডেল যচ্ছিলাম। ওখানে এক মামা থাকতেন। দিল্লী রোড দিয়ে যেতে হত। দিল্লী রোডে ভীষন জ্যাম। গাড়ি নড়ছেইনা। উল্টোদিকেও একই অবস্থা। আর রাস্তা এত খারাপ যে উল্টো দিক থেকে চলা ট্রাকগুলো মোচার খোলার মত দুলছিল। মনে হচ্ছিল আমাদের গাড়ির ওপর এসে পড়বে। অফিসের গাড়ি। সেদিনই ফিরব। ড্রাইভার এখনো অর্ধেক পথ পার হয়নি। সাথে সাথে ডিসিসন। গাড়ি ঘোরাও। গিয়ে আর কাজ নেই। অতি কস্টে গাড়ি ঘোরানো গেল। এই ছিল জ্যোতিবাবুর আমলের দিল্লী রোড।

শিল্প গড়তে গেলে প্রয়োজনীয় Infrastuctureযে প্রথমে তৈরী করা দরকার সেই শিক্ষা জ্যোতি বাবুদের ছিলনা। শেখার ইচ্ছেও ছিলনা। 

 

(লেখক পরিচিতি – অবসরপ্রাপ্ত পেট্রফিসসিস্ট: ব্যাঙ্গালোরের প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ে পেট্রোলিয়াম বিভাগের প্রাক্তন ফ্যাকাল্টি)

(ক্রমশঃ) 

Comment here