(পূর্বের সংখ্যার পর)
– ডঃ গৌতম মুখোপাধ্যায়
রাস্তার পর দিকে নদীর চড়াভূমিতে ছিল আমাদের কলমের আমবাগান। বোম্বাই, ল্যাংড়া, ফজলি, গোলাপখাস প্রভৃতি আম গাছ ছিল। কলমের গাছ বেশী উঁচু হয়না। লগা দিয়েই আমের নাগাল পাওয়া যেত। লগা হল একটা লাঠির মাথায় ছোট কঞ্চি বেঁধে 7 আকারের আঁকশী। বসত বাড়ির পাশ দিয়ে পেছন দিকে একটা সরু পায়ের চলার পথ আছে। সেই পথে একটু গেলেই চক্রবর্তীদের ভিটে। মাটির বাড়ি, টালির চাল। দু ভাই মদন ও মোহন স্ত্রী, পুত্র, কন্যা নিয়ে বাস করে। মদন বি এস এফ এ কনস্টবল। মোহন যজমানী ও অল্পবিস্তর চাষবাস করে।
পায়ে চলার পথ ধরে আরো অনেকটা এগিয়ে গেলে অনেক গুলো ছোট ছোট মাটির বাড়ি, কোনোটায় টালির চাল, কোনোটায় খড়ের চাল। ইতঃস্তত মোরগ মুরগী চড়ে বেড়াচ্ছে। এগুলো মুসলমান পাড়ার জানান দিচ্ছে। মুসলমানপাড়া ছাড়িয়ে গেলে ধান ক্ষেতের শুরু। এখান থেকে যতদূর চোখ যায় ধান ক্ষেত আর ধান ক্ষেত।
বর্ষার পর লক লক করে বেড়ে ওঠা সবুজ ধান। দিগন্তব্যাপী ধান ক্ষেত। মধ্যে মধ্যে আল, জমির মালিকানা পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী। বহুদূরে নজর করলে ইলেকট্রিকের পোস্ট দেখা যাবে। নীচেই শুয়ে আছে অদৃশ্যমান পাকা রাস্তা, দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছুটে চলেছে। সারাদিন হাওয়া অবাধে ছুটে ছুটে ধানের শীষ গুলোকে নাচ শেখায় ও নাচায়। কান পাতলে শীষের ঘর্ষণে ঘর্ষণে উদ্ভুত ঝিলমিল ঝিলমিল সুরেলা আওয়াজ শোনা যায়। ধান উত্পাদনে বায়ুর বিশিষ্ট ভূমিকা আছে। ধানের শীষের ডিম্বানুগুলোকে হাওয়া নিষিক্ত করে। তাতে পাই ধানের ভেতর দুধেলা চাল।
মুসলমান পাড়া জন বা জনমজুরের যোগান দেয়। জমিতে নীড়েন দেওয়া ( আগাছা উৎপাটন ) , লাঙ্গল দেওয়া, মই দেওয়া , ফসল কাটা বা অন্যান্য ফসলের উৎপাদন প্রক্রিয়ার জন্য জন মজুর প্রয়োজন। সকাল ৮-৯ টায় ৬-৭ জন আসত , কাকার কাছ থেকে বিড়ির বান্ডিল নিত। দালানে রাখা টোকা নিয়ে নিত। আর নিত নীড়েন এর জন্য হাসুয়া বা হেঁসো, ফসল কাটার সময় কাস্তে ইত্যাদি। সব যোগাড় যন্ত্র নিয়ে ক্ষেতের দিকে পা বাড়াত। কোন জমিতে কি করতে হবে বলা থাকত।
পরে বাড়ির থেকে কেউ গিয়ে তদারকি করত। ১টা নাগাদ ফিরে আসত। আবার দরকার মত ৩ টের সময় ক্ষেতে যেত।
বিকেলের শ্রম কে বলে বৈকালা। বৈকালার রেট অর্দ্ধেক ছিল।
১৯৭৭ সালে যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় এসে দুটো ভাল কাজ করেছিল। ক্ষেত মজুরদের শ্রমের রেট বেঁধে দিয়েছিল। সকালে ১৬/- টাকা আর বৈকালা ৮ টাকা। এতে সমস্ত ক্ষেতমজুর রা দুহাত তুলে আশীর্বাদ করেছিল। অপর কাজটি হল স্কুল টিচারদের বেতন ভদ্রস্থ করেছিল। তার আগে স্কুল টিচারদের সাথে মেয়ের বাবারা মেয়ের বিয়ে দিতে চাইতো না।
৩৪ বছরে এই দুটি কাজ উল্লেখযোগ্য। বাকি সব ধ্বংসের কাজ। শিক্ষা ক্ষেত্রে ইংলিশ তুলে দেওয়া, সহজপাঠ তুলে দেওয়া।
জঙ্গী পদ্ধতিতে কম্পুটারের বিরোধিতা। IIT খরগপুর, JU, শিবপুর, IIM , IACS, Bose Institute, Saha Institute of Nuclear Physics, Variable Energy Cyclotron, Satyen Bose Institute of Basic Science, Presidency College, St. Xavier’s College, Science college, Radio Physics etc বিশ্ববিখ্যাত ইন্সটিটুট পঃবঙ্গে ছিল। Skilled hands প্রচুর ছিল। শুধু কতগুলো অশিক্ষিত ধান্দাবাজ দের জন্য পঃবঙ্গ কম্পুটার থেকে বঞ্চিত রইল। ব্যাঙ্গালোর হয়ে গেল কম্পুটার হাব।
পুলিশ প্রশাসন পার্টি অফিস গুলো চালাত। রাস্তাঘাট পরিকাঠামো তলানী তে। পরে উদাহরণ দেব। প্রশাসনিক প্রধান রা শ্যালিকাপাশে বা নন্দন চত্বরে বিলাসিতায় মগ্ন। কে খোঁজ রাখবে পুরুলিয়া কোচবিহার জলপাইগুড়ির? সেন্ট্রাল ফোর্স দিয়ে ভোট করাতে 240 থেকে 40তে নেমে এল। সুভাষের রিগিং, অনিল বিশ্বাসের সায়েন্টিফিক রিগিং সব সেন্ট্রাল ফোর্সের বুটের তলায় গেল। সাম্প্রদায়িক ভাইজান ও পারল না বাঁচাতে।
ন্যানো ছিল মরণকালে হরিনাম। তাও পুরুলিয়ায় করলে হত। তা না তিন ফসলী জমি তে করতে গেল। দেশে আমাদের অনেক কাঁঠাল গাছ আর বাঁশের ঝাড় ছিল। কাঁঠালের আঁটি আখার আগুনে পুড়িয়ে নিতাম। দারুণ খেতে। তখনকার দিনে একটা বাঁশের দাম ছিল ৩ টাকা। বাঁশের ফুল হলে অমঙ্গল। ওই ফুল ইঁদুরের খুব প্রিয়। ওদের দ্রুত বংশবৃদ্ধি হয়। ফসল সব খেয়ে নেয়। ….ফলং দুর্ভিক্ষ।
ক্ষেতে ফসল থাকাকালীন অনেক সময় গরু বাছুর ঢুকে পড়ে ফসল খেতে থাকত। জমির মালিকের চোখে পড়লে অনেক সময় ধরে নিয়ে গিয়ে পন্ডে জমা দিত। পন্ড হল পশুর জেলখানা। পরে মালিক জরিমানা দিয়ে ছাড়িয়ে আনত।
ক্ষেতের আলে কালো রং য়ের বিষধর সাপ দেখা যেত। আলকেউটে। ধান চাষ নিয়ে পরের সংখ্যায় লিখব। ধানের রকম ভেদ আছে। আউশ, আমন আর বোরো।
এই সংখ্যায় ধান চাষ নিয়ে আলোচনা করব।
যেসব অঞ্চলে বৃষ্টিপাত বেশি কিংবা নিচু জমি, সেসব অঞ্চলে ধান ভালো হয়। প্রচুর জল লাগে ধান চাষে। পাহাড় কিংবা পাহাড়ের ঢালেও এর চাষ হয়ে থাকে। ধান চাষ অত্যন্ত শ্রমনির্ভর। অনেক শ্রমিক প্রয়োজন হয়, এ কারণে যেসব এলাকায় শ্রমিক খরচ কম সেসকল অঞ্চলে ধান চাষ করা সহজ। আউশ, আমন, বোরো তিন প্রকার ধান হয়। জৈষ্ঠ্য আষাঢ় মাসে বীজ বপন করে অগ্রহায়ন পৌষ মাসে যে ধান কাটা হয় সেটা হল আউশ। আর এক দু মাস পরে বপন করে ফাল্গুন চৈত্রে কাটা হলে সেটা হয় আমন ধান। স্থান বিশেষের জলবায়ু ও বৃস্টিপাতের ওপর এই দু ধরনের ধান চাষ করা হয়। সর্ব ভারতীয় ক্ষেত্রে এদের একসাথে খরিফ শষ্য বলা হয়। বোরো ধান শীত কালে রোপন করে বর্ষায় কাটা হয়।
ধান চাষ করতে হলে প্রথমে বীজতলা তৈরী করতে হয়, সেখানে বীজ ছিটিয়ে রেখে কয়েকদিন সেচ দিতে হয় তারপর ছোট চারা তৈরী হলে সেগুলোকে তুলে প্রধান জমিতে রোপন করা হয়। তাছাড়া সরাসরি বীজ প্রধান জমিতে ছিটিয়েও চাষ করা হয়। সে ক্ষেত্রে জমিতে লাঙ্গল দিতে দিতে পেছনে ধামা হাতে নিয়ে বীজ ছড়ানো হয়। তারপর মই দেওয়া হত। এতে বীজগুলো মাটিচাপা পড়ে যেত। (পাকা ধানে মই দিতে নেই)
১৯৬০ সাল নাগাদ এক বিঘে জমিতে ৮ থেকে ১০ মণ ধান হলে ভাল ফলন বলা হত। এর কয়েক বছরের মধ্যে সবুজ বিপ্লব হয়। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গুলো থেকে উন্নতমানের বীজ পাওয়া গেল। দুটো বীজের নাম এখনো মনে আছে তাইচুঙ ও আই আর এইট। এই বীজগুলো এক বিঘেতে ২০ থেকে ২৪ মণ ধান দিত। তাইচুঙ , আই আর এইট ধানগাছ গুলো ছোট হাইটের হত। সবুজ বিপ্লবের আর সঙ্গী হল টিউবওয়েল শ্যালো বা ডীপ আর ট্রাক্টর, আর পেস্টিসাইড। পাঞ্জাব হরিয়ানায় রাস্ট্রায়াত্ত ব্যাঙ্ক গুলো কে বাধ্য করা হয় লোন মেলা করতে। ইউকো আর ইউবিআই তার মধ্যে প্রধান। ওই প্রদেশের ছোট বড় সব চাষীই লোন নেয়।
ভোটের আগে সব লোন মাপ করে দেওয়া হয়। এই সুযোগ পঃবঙ্গের চাষীরা পায়নি। লোন মাপের ফলে ইউকো ও ইউবিআই আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। hdfc ব্যাঙ্কের একটা শেয়ারের দাম আজ ২৬০০ টাকার বেশী। SBI er দাম ৪৯০ টাকা।
ইউকোর দাম ১২ টাকা। ইউবিআই ট্রেড হয়না। আমাদের একটা ডীপ টিউবওয়েল লোনে কেনা হয়েছিল।
(ক্রমশঃ)
(লেখক পরিচিতি – অবসরপ্রাপ্ত পেট্রফিসসিস্ট: ব্যাঙ্গালোরের প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেট্রোলিয়াম বিভাগের প্রাক্তন ফ্যাকাল্টি)
Comment here